রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা মানবতা বিবর্জিত কাজ
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০২ জুন, ২০১৪, ০৮:১০:৫১ সকাল
মুসলামনদের নিকটে সবচেয়ে প্রিয় মাস পবিত্র মাহে রমজান একেবারেই সন্নিকটে । আর মাত্র কয়েক দিবা-রজনী পার হলেই রমজান শুরু। এ মাসটি মূলত মুসলমানদের ইবাদতের মাস হিসেবে প্রসিদ্ধ । মুসলমানদের আত্মশুদ্ধিও হয় এই মাসে । মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর উপর মহান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক অবতীর্ন মানবতার মুক্তির গ্রন্থ পবিত্র আল কুরআন নাযিলের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এই মাসে । আল্লাহর আদেশে সামর্থবান মুসলমান নর-নারী এ মাসে দিনে পানাহার থেকে বিরত থাকে এবং আল্লাহর রাসূলের নির্দেশে রাতে নামাজ আদায় করে । ইবাদাত, আত্মশুদ্ধিসহ বিভিন্ন কারনে এ মাসটি মুসলিম উম্মাহের জন্য ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে । মুসলমান নর-নারীরা এ মাসকে সওয়াব হাসিলের উত্তম সময়ভেবে দুনিয়ার সকল মোহ-টান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ মাসকে কেবল আল্লাহর জন্য ওয়াক্ফ করে দেয় । মানুষের এ ত্যাগের জন্য আল্লাহ রোযা পালনকারীকে বিশেষ পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন । অন্য সকল ইবাদতের মর্যাদাকে ছাড়িয়ে হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, “রোযা আমার জন্য এবং এর পুরস্কার আমি নিজ হাতে দিব’’ । রোযার মাস যেমনি ইবাদতের তেমনি ভেজালমুক্ত খাদ্য গ্রহনের । আল্লাহ তায়ালা তার বিশেস মহিমায় এ মাসে পৃথিবীর সকল উত্তম খাদ্য দ্রব্যের যোগান বাড়িয়ে দেন । আমার নিজ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সারা বছর বাজারে মাছ ওঠে না বলে কথা চললেও কেবল রোজার মাসে বাজারে এত অধিক পরিমান মাছের যোগান হয় যা ক্রয় করার ক্রেতা পাওয়া যায় না । মওসুমি ফল, শাক-সবজির কোন অভাব থাকে না । তাই তো ইসলামী স্কলাররা মত দিয়েছেন, ‘রোজার মাসে আল্লাহর অবারিত নেয়ামত পৃথিবীতে নাযিল হয়’ । যে নেয়ামত বরকত কেবল মুসলিম নর-নারীই গ্রহন করে না বরং দুনিয়ার সকল ধর্মের মানুষসহ আল্লাহর সকল সৃষ্টিকূল রহমতের এ ফল্গুধারা লাভ করে । কেউ পরকালীন মুক্তির পয়গাম হিসেবে আবার কেউবা জীবাকা নির্বাহকল্পে ।
দেশের সব মানুষের মানবতবোধ এক রকম নয় । মানবতার যেমন বন্ধুর অভাব নেই তেমনি শত্রুও কম নেই । রোজার মাস এলেই দেখা যায়, ইফতার সমাগ্রীসহ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজীয় দ্রব্যের দাম আচমকা বেড়ে যায় । অথচ রমজান মাস ছাড়া বছরের অন্যান্য মাসগুলোতে এ সকল খাদ্য দ্রব্যের দাম থাকে সহনীয় পর্যায় কিংবা মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে । ব্যতিক্রম ঘটে কেবল রমজান মাসে । অধিক মুনফাখোররা তাদের গুদামে রমজান মাসের নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু খাদ্য দ্রব্য অবৈধ, অনৈতিকভাবে মওজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রমাজানের একমাস কিংবা ১৫দিন পূর্বে বাজারের চাহিদা অনুপাতে অনেক কম পরিমানে দ্রব্য বাজারে ছাড়ে এবং মূল্য বৃদ্ধি করে দেয় । যদিও এদের সংখ্যা কম কিন্তু বাজার ব্যবস্থাকে এই কম সংখ্যক লোকই নিয়ন্ত্রন করে । তাই রমজান শুরু হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে দেখা যায় চিনি, ছোলা বুট, পিয়াজ, সয়াবিন তেল, সকল প্রকার মসলা, ডালসহ এ জাতীয় পণ্যগুলোর মূল্য পূর্বের তুলনায় কেজিতে ১০টাকা থেকে শুরু করে শতাধিক টাকা পর্যন্তও বেড়ে যায় । এ সময় প্রশাসন লোক দেখানো কিছু অভিযান চালালেও গোটা বাজার ব্যবস্থাকে তারাই যেন লাগামহীন করে রাখে । এরপর রমজান ঈদ পূর্ববর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আরেকদফা বাড়িয়ে দেয়া হয় । অবশ্য রমজানের শেষ দশক নাজাতের হলেও স্থানীয় ভ্রাম্যমান অভিযান চালানো প্রশাসন বিভিন্ন নামকরা বাজারে জোড় দাপটে অভিযান চালিয়ে ভেজাল, মেয়াদয়োত্তীর্ন খাদ্যদ্রব্য চিহ্নিত করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জরিমানা হিসেবে মোটা অংকের টাকা আদায় করে এবং কিছু সংখ্যককে শারীরীক শাস্তিও প্রদান করে । টিভি মিডিয়ায় বেশ ফলাও করে এ সংবাদ প্রচার করা হয় । সারা বছরব্যাপী নিরব প্রশাসন হঠাৎ সরব হওয়ার নেপথ্যের কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে একজন সচেতন ক্রেতা বলেছিল, ‘সরকার তাদের আমলাদের ঈদ বোনাস দেয়ার টাকা উসুল করার জন্যই সীমিত সময়ের এ ভ্রাম্যমান অভিযান চালাচ্ছে’ । কথাটির সত্যতা যতটাই গভীর হোক কিংবা যুক্তিহীন হোক প্রশাসনের চলার ভঙ্গিমা দেখে অনেকটাই তাই মনে হয় ।
রমজান মাস এলে মানুষ নির্বিগ্নে রোজা রাখবে না দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির কথা শুনে ঘাম জড়াবে ? এমনিতেই বাংলাদেশে বছরের পুরোটা সময় দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির কারনে মানুষের প্রচুর ক্ষোভের কথা, আন্দোলনের কথা শোনা যায় । এরপরেও যদি রমজান উপলক্ষে আরও কয়েকদফা অমানবিক ভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হয় তবে সেটা শুধু অমানবিক নয় বরং মানবতার সাথে শত্রুতা বটে । রমজান শুরু হতে এখনও প্রায় একমাস বাকী অথচ চিনির দাম কেজিতে দুই টাকা বাড়ানো হয়েছে কেননা চিনি ছাড়া ইফতারীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সরবত তৈরি করা যাবে না । ছোলা-বুটের দাম প্রতি কেজিতে ৭-৮ টাকা বাড়ানো হয়েছে কেননা ইফতারীতে ছোলা-বুটের আইটেম মানুষ অবশ্যই রাখবে । এটাই যদি মূল্য বৃদ্ধির শেষ ধাপ হত তাহলেও কথা ছিল । এটা তো কেবল মূল্য বৃদ্ধির আগাম সংকেত । অসাধু ব্যবসায়ীদের কৌশল । অপরাধ করার পূর্ব সতর্কতা । পয়েলা রোজায় দাম বাড়ালে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মানুষ কথা বলবে তাই মানুষকে তারা সে সুযোগ দিতে নারাজ । এক মাস আগ থেকেই দেখাতে হবে যে, আসলে এ সকল দ্রব্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারেই বৃদ্ধি তাই দেশের অভ্যন্তরীন বাজারেও দাম বাড়িয়ে দেয়া হল ! আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই তবে সে মূল্য বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে দেশের অভ্যন্তরে মূল্য বৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে না । আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্য মূল্যের দাম যদি ১% বৃদ্ধি পায় তবে দেশীয় বাজারে দ্রব্যের মূল্য ১৫-২০% বাড়িয়ে দেয়া হয় । এটাই কি নৈতিক ব্যবসায়ীর নীতি ?
ব্যবসার ব্যপারে সকল ধর্ম কিছু বিধি নিষেধ দিয়েছে । ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, ‘ব্যবসাকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে আর সুদকে হারাম’ । ইসলামে ব্যবসায়ের সকল দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে । অথচ মুসলমানরা তাদের আদর্শ বিচ্যুত হয়ে অনৈতিকতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে । নয়ত কোন মুসলমান ব্যবসায়ী রমজান মাসে দ্রব্য মূল্যের বৃদ্ধি ঘটিয়ে অন্য মুসলামনদেরকে আল্লাহর স¥রনের পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে ? শুধু যে মুসলমানরা এ কাজ করে তা নয় বরং অন্য ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যবসায়ীরাও অনৈতিকভাবে পণ্য দ্রব্য মওজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা পালন করছে । মুসলমান কিংবা অন্যধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ী বলে কথা নয় বরং সকল ব্যবসায়ীকে মনে রাখতে হবে রমজান, ঈদ বা পুজার সাথে সংশ্লিষ্ট যে সকল দ্রব্যাদি আছে সে সকল দ্রব্যাদির অযথা, অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি করে হয়ত অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব তবে সেটা মানবীয় আচরণ নয় বরং পশুত্বের আচরণ । যারা রমজানকে সামনে রেখে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছে বা করার কথা ভাবছে তারা সকলেই মানবতার চরম শত্রু । অচিরেই তারা সমাজ বিবর্জিত হবে । তা দেখার জন্য কেবল সময়ের অপেক্ষা ।
২০১৪-১৫ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণার মাত্র ২৫ দিন পর রোজা শুরু হবে । সরকারের বাজেট ঘোষণার পর স্বাভাবিক ভাবেই কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং কিছু পণ্যের মূল্য হৃাস পাবে । তবুও সরকাররের উচিত হবে অন্তত রমজানকে সামনে রেখে যে সকল খাদ্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাবে তা ঈদের পর থেকে কার্যকরী করার সিদ্ধান্ত নেয়া । বাজেট ঘোষণার পর থেকে যদি সেটা বাস্তবায়ন করা হয় তবে দেশব্যাপী চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে । সরকার যাতে এ ব্যপারে সদয় বিবেচনা করে তার আকুতি রইল । যে সকল ব্যবসায়ীরা রমজান উপলক্ষে অধিক মুনাফা লাভের কারনে অনৈতিকভাবে পণ্য মওজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে তাদের রমজানের আগেই চিহ্নিত করে তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিলসহ দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির নিশ্চয়তা সরকারকে করতে হবে এবং সরকারকে বিশেষ টিম গঠনের মাধ্যমে দেশের সকল বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে । বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় কোন কারনে রমজানে দ্রব্যাদির দাম আচমকা বেড়ে যায় তার সঠিক কারন বের করে তার সমাধান করা সরকারের দায়িত্ব । শুধু সরকার নয় ব্যবসায়ী-ভোক্তা সকলকেই এ ব্যাপারে পারস্পরিক সহোযোগিতার মনোভাব পোষন করতে হবে । অন্তত রমজান মাসকে যেন মানুষ ইবাদাতের উপলক্ষ বানাতে পারে তার নিশ্চয়তা সরকার এবং জনগণকে যৌথভাবে দিতে হবে ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
বিষয়: বিবিধ
১১৯৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমাদের দেশে রমজান মাসকে কিছু লোক তাদের অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে ধরে নিয়েছে। দেশে খাদ্য শস্য ও ভোজ্য তেল আমদানিকারক এবং সরবরাহকারির সংখ্যা সিমাবদ্ধ। সাধারনত এরাই বিভিন্ন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রমজান মাসে দামবাড়িয়ে দেয় গত বছরের চিনি সংকট ও তাদের তৈরি কৃত্রিম সংকট। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই মুনফাখোররা অনেকে আবার নিজেদেরকে ইসলামের বড় সেবক বলে দাবি করেন এবং মসজিদ মাদ্রাসার পৃস্টপোষক হন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন