‘ধুমপান কেবল ধুমপায়ীদের ক্ষতিগ্রস্থ করে না’
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ২৬ মে, ২০১৪, ০৮:০৮:১২ সকাল
‘বিড়ি খাবি খা, মারা যাবি যা’ কথাটি শুনে অনেকেই হাসেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন । বিড়ি খেলেই মানুষ মারা যাবে ? ধুমপান করলে মানুষ মারা যাবে কিনা সেটা জ্ঞানীরা যেমন জানেন তেমনি মূর্খরাও কম জানেন না । বিড়ি কিংবা সিগারেট প্রস্তুতকারীরা এসকল পণ্যের প্যাকেটের গায়ে লিখতে বাধ্য হয়, ‘ধুমপান মৃত্যু ঘটায়’ ‘ধুমপান ক্যান্সার ঘটায়’ ধুমপান বিষপান’ । তবুও মানুষ “আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান’ গানটির মত তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যের অপকারীতা জেনেও ভয়াবহ মাত্রায় এসব দ্রব্য ব্যবহার করে । সরকারের কঠোরতার কারনে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যের প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও এ সকল পণ্য উপদানের সাথে জড়িতরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করে এ সকল পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে । বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা কিংবা সরকারের তরফ থেকে তামাকজাত দ্রব্যের যতই অপকারীতা এবং এটা গ্রহনে শরীরের জন্য ক্ষতিকর দিকগুলো প্রচারণা চালানো হচ্ছে ততই মানুষ এ সকল দ্রব্যের মোহে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ছে । এ যেন নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের গভীর টান । বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশেও প্রতিবছর ধুমপায়ীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে । ধুমপান কেবল শারীরীক ক্ষতি করে না বরং মানুষকে আর্থিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করায় । যে ক্ষতি থেকে মানুষ কখনো উত্তরন পায় না বরং দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয় নতুবা পঙ্গুত্ব বরন করে ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ মতে, বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে ৩০ বছরের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতি বছর ৫৭ হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করে এবং প্রায় ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে । আবার নিজে ধুমপান না করেও অন্যের ধুমপানের ফলে কর্মক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন ১ কোটি ১৫ লাখ মানুষ । পাবলিক প্লেস বা লোকালয় অর্থ্যাৎ হাট বাজার, হাসপাতাল, বাস, লঞ্চ, বাস টার্মিনাল, অফিস পাড়া, কালেক্টর চত্বর, আদালত এলাকা বা চত্বর, বিপনী বিতান, শপিং মল, জনবহুল মোড়, বাসা বাড়ীর হিসাব যোগ করলে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুন বেড়ে যাবে । বলা বহুল্য পরোক্ষ ধুমপানের কারনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় মহিলা এবং শিশুরা । ধুমপায়ীদের স্পর্শে ধুমপানের ধোঁয়ায় অধুমপায়ীরা চরমভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে অর্থ্যাৎ একজন ধুমপায়ীর কল্যানে তার আশে পাশে যতদুর পর্যন্ত ধোয়ার ঝাঝ যায় ততটুকু এলাকায় অবস্থানরত অধুমপায়ীরা ধুমপায়ীদের শারীরীক ক্ষতির মতই ক্ষতিগ্রস্থ হয় । একজন ধুমপায়ী ধুমপানের কারনে যে পরিমান নিকোটিন গ্রহন করছে তার তুলনায় তার আশেপাশের লোকজন কম নিকোটিনের অংশীদার হচ্ছে না। অথচ নিকোটিনকে মৃত্যুর ওষুধ বলা হয় ।
বাংলাদেশে জ্যামিতিক হারে ধুমপায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে । ‘ক্যাম্পেইন ফর ক্লিন এয়ার’ নামের একটি জরিপ প্রতিষ্ঠান ২০০৭ সালে দেশের ধুমপায়ীদের সংখ্যা নির্নয় করার জন্য দেশব্যাপী একটি জরিপ পরিচলান করে । সে জরিপে দেখা যায়, দেশের শতকরা ৪৮% মানুষ কোন না কোন ভাবে ধুমপায়ী । অথচ ২০০৬ সালে এর পরিমান ছিল ৪১ শতাংশ । সংস্থাটির চালানো জরিপের পর দীর্ঘ ৭ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে । নিংসন্দেহে ধুমপায়ীর সংখ্যা আরও বেড়েছে । প্রকাশিত জরিপটির সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হল, ২০০৬ সালের তুলনায় ২০০৭ সালে কিশোর ও তরুন ধুমপায়ীর সংখ্যা ১১শতাংশ বেড়ে ৬৯% দাঁড়িয়েছে । জরিপে আরও দেখা গেছে তরুন ও কিশোর ধুমপায়ীদের মধ্যে ৯৮%সিগারেট পান করে এবং মাত্র ২% বিড়ি পান করে । বাংলাদেশের ধুমপায়ীদের পরিণতির কথা বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালে কঠোর সতর্কবানী উচ্চারণ করেছে । শুধু যে মানুষ ধুমপানের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তা কিন্তু নয় । ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য যেমন জর্দা, গুল, সাদা পাতা/ আলাপাতা, নস্যি ও খৈনিসহ ধোঁয়াবিহীন তামাকের কারনে ২৬.৬% পুরুষ এবং ২৭.৯% নারী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অথচ তারা জানতেও পারছেন না যে এ সমস্ত তামাকজাত দ্রব্য গ্রহন করে নিজেদের কতবড় সর্বনাশ করছেন । তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে নানা রকম রোগের সংক্রমন ঘটে । এসকল রোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হৃদরোগ, মস্তিষ্ক স্ট্রোক, পক্ষাগাত, ফসফুসের ক্যান্সার, ফুসফুসের যক্ষ্মা, স্বরযন্ত্রের ও শ্বাস নালীর ক্যান্সার, ক্ষতিগ্রস্থ মাড়ি এবং বিশেষ করে নারীদের নানা ধরনের প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা হচ্ছে । গর্ভবতী নারী সুস্থ শিশু জন্ম দিতে পারছে না । বাংলাপিডিয়ার তথ্য থেকে জানা যায়, ফুসফুসের ক্যান্সারের ৮৫% কারন ধুমপান এবং পুরুষদের ক্যান্সার সংক্রান্ত মৃত্যুর ২১% ঘটে ধুমপানের কারনে । অন্যদিকে নানা ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে ১৩% হয় তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারনে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তামাকজাত দ্রব্য বর্জনের মাধ্যমে দেশের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব । বাংলাদেশের বিড়ি কারখানায় যারা কাজ করে সেই ৬৫০০০ নারী পুরুষ ও শিশু শ্রমিকেরা যেন নিজেদেরকে মৃত্যু কুপে সঁপে দিয়েছে । তামাক জাত দ্রব্যের কুফলে যে রোগগুলো হয় তার মধ্যে মাত্র ৮টি রোগের চিকিৎসাবাবদ রাষ্ট্রকে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয় ।
ধর্মে ধুমপানকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে । ধর্ম যেহেতু মানবতার মঙ্গলের জন্য কাজেই যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তাই ধর্মে নিষেধ । শুধু ধর্মীয় দিক নয় অন্য অনেকগুলো দিক বিবেচনা করলেও কোন সচেতন এবং শিক্ষিত মানুষ ধুমপান করে নিজেকে ধ্বংস করতে পারেন না । কেউ আত্মগাতী হয়ে নিজেকে ধ্বংস করার চিন্তা করলেও তার আশেপাশে বসবাসরত পুরুষ, মহিলা বিশেষ করে শিশুদের ধ্বংস করা বা তাদের জীবনকে হুমকির মূখে ফেলার কোন অধিকার নৈতিকভাবে কারো নেই । এছাড়াও আরো কতগুলো দিক বিবেচনায় মানুষকে অবশ্যই ধুমপান ত্যাগ করা উচিত । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার রিপোর্ট মতে, একজন অধুমপায়ী ব্যক্তির চেয়ে একজন ধুমপায়ী ব্যক্তি ২০ বছর কম বাঁচে । এছাড়া ধুমপানের কারনে প্রতিবছর বিশ্বে যতগুলো অপমৃত্যু হয় তার সমপরিমান অপমৃত্যু অন্য কোন কারনে হয় না । ধুমপান মানুষের স্মরনশক্তি কমিয়ে দেয় এবং মনোবল দূর্বল করে দেয় । অতিরিক্ত ধুমপানের কারনে দৃষ্টি ক্ষমতা লোপ পায় এবং ঘ্রানেন্দ্রিয় ও স্বাদ গ্রহনের ক্ষমতাকে হৃাস করে দেয় । যৌনশক্তি হ্রাসেও ধুমপান মারাত্মকভাবে দায়ী । পেশাব বিষাক্ত এবং হজম শক্তি কমানোর পিছনেও ধুমপানের ভূমিকা রয়েছে । ধুমপানের এতগুলো ক্ষতিকর দিক থাকার পরেও একজন জ্ঞানী মানুষ ধুমপান করবে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় ।
প্রতি বছর ৩১শে মে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’ ঢাকঢোল পিটিয়ে পালন করা হলেও ধূমপান বিরোধী আইনের সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে বাংলাদেশে ধুমপায়ীদের সংখ্যা প্রতিবছর আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে । আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন না থাকার কারনে মূলত ধুমপায়ীরা যত্রতত্র ধুমপান করার সাহস পাচ্ছে । ধুমপান বিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের দীর্ঘ দিনের দাবী ও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সরকার আরও জনমূখী করে পূর্বের ‘তামাক জাত দ্রব্য ব্যবহার আইনের’ সংশোধনী আনেন । যে আইনে উল্লেখ আছে কোন ব্যক্তি যদি প্রকাশ্যে ধুমপান করে তবে তাকে ৩০০ টাকা জরিমানা করা যাবে । এছাড়াও তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটের অর্ধেক জুড়ে ছবিযুক্ত স্বাস্থ্য সতর্কবানী মুদ্রণের বিধান রাখাসহ তামাকজাত দ্রব্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে । এমনকি তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় স্থলে যে কোন উপায়ে বিজ্ঞাপন প্রচারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে । আইনে আরও উল্লেখ করা হয়, এ বিধান লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব তিন মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদন্ডের শাস্তি রাখা হয়েছে । নতুন এ আইনে কোন ব্যক্তি ১৮ বছর বয়সের নিচের কোন তরুনের কাছে তামাক বা তামাকজাত কোন দ্রব্য বিক্রি করতে পারবে না এবং তাদেরকে বিক্রি অথবা বিতরন কাজেও ব্যবহার করা যাবে না । এ বিধান লঙ্গনকারীর বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হলেও দিন দিন ১৮ বছরের কম বয়সের তরুন-কিশোর ধুমপায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে । এর জন্য আইনের প্রয়োগহীনতাই দায়ী ।
তামাক বিরোধী এমন জনকল্যানমূখী আইন থাকার পরেও তা কার্যকর হচ্ছে না কেন ? এর উত্তরে প্রথমেই বলতে হবে যারা আইনের বাস্তব প্রয়োগ করবেন তাদের একাংশ ধুমপানে আসক্ত । দ্বিতীয়তঃ তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন, বিক্রয় ও বিপননের সাথে ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক কিছু নেতার সম্পৃক্ততা রয়েছে । যার কারনে দৈব কোন নির্দেশে আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে না । নবম জাতীয় সংসদের আইন মন্ত্রী জনাব ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ একটি সেমিনারে বলেছিলেন, দেশে বিড়ি তৈরি নিষিদ্ধ করা হবে এবং সিগারেটের দাম ন্যূনতম ২৫ টাকা করা হবে । শফিক আহমেদের এ আশার বানীতে ধুমপান বিরোধীরা মনে মনে একটি বিষাক্ত ধোঁয়া মুক্ত দেশের ছবি কল্পনা করতে এবং অপমৃত্যুতে স্বজন হারানোর আহাজারি থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছিল । বাস্তবে শফিক আহমেদের সে আশার বানী বাস্তবায়িত হয় নি । কোন দৈব শক্তি তার আশাকে দমিয়ে রেখেছে তা জাতির কাছে স্পষ্টভাবে প্রকাশ না করলেও তাদেরকে অনুমান থেকে বিরত রাখতে পারে নি । শুধু সরকারের একক প্রচেষ্টায় ধুমপানমুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব নয় একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট তবে জনগনের চাইতে এ ব্যাপারে সরকারকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে । সরকার এবং জনগনের যৌথ উদ্যোগে অন্তত প্রকাশ্য স্থানে ধুমপান বন্ধ করা সম্ভব । একজন ধুমপায়ী তার গণতান্ত্রিক অধিকারের কারনে তার ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে পারে কিন্তু তার আশে পাশের মানুষের জীবনকে হুমকির সম্মূখীন করে অবিবেচকের মত আচরনকে অন্তত স্বাধীনতা ভোগ বলা যায় না । কাজেই যাদের বিবেক জাগ্রত নয় শাস্তির মাধ্যমে হলেও তাদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে । দেশের মানুষকে বিশেষ করে শিশুদের সুস্থ বিকাশের জন্য প্রকাশ্যে ধুমপানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা এবং আইনের বাস্তবমূখী প্রনয়ন করতে হবে । দেশের পরিচালক বৃন্দ এবং সচেতন মহল যত তাড়াতাড়ি এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে তত দ্রুত একটি সুস্থ স্বাভাবিক প্রজন্মের আশা করা যাবে । কাজেই আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যতের জন্য এখনই সচেতন হওয়ার উত্তম সময় । আসন্ন বাজেটে তামাকজাত দ্রব্যের উপর উচ্চ মাত্রার করারোপের মাধ্যমেও দেশের মানুষকে ধুমপানেরর ক্ষতি থেকে রক্ষা করা সম্ভব । অর্থমন্ত্রী মহোদয় অবশ্যই এ ব্যাপারের একটু ভেবে দেখবেন বলে আশা রাখি ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
বিষয়: বিবিধ
১১৬২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন