লাশ যেন শুধু সংখ্যা না হয়
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৪ মে, ২০১৪, ০৬:১১:৪২ সন্ধ্যা
চলছে বৈশাখ । কালবৈশাখী ঝড়ের কারনে এ মাসকে সবাই কম বেশি ভয় পায় । তবুও বছর জুড়ে সবাই এ মাসটির আগমনের প্রতীক্ষায় থাকে । বাংলাদেশে আরবী, ইংরেজী বছরের শুরু কিংবা অন্য কোন মাসকে স্বাগতম জানানোর জন্য দেশব্যাপী এত আয়োজন করা হয় না যত বেশি আয়োজন করা হয় বাংলা বর্ষবরণ কিংবা বৈশাখ বরণ উপলক্ষে । বৈশাখের কালবৈশাখী আমাদের দেশের কত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে তার কোন সঠিক সংখ্যা আমাদের কাছে নেই । কালবৈশাখের তীব্র ঝড় কিংবা সাইক্লোন বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলসহ উপকূলীয় অঞ্চলকে বারবার ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে । সর্বশেষ সিডর কিংবা আইলা বাংলাদেশের একাংশের মানুষকে কত কষ্ট দিয়েছে তা এ ধ্বংসের ভূক্তভোগী ছাড়া অন্য কেহ সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারার কথা নয় । এ বছরও শীলাবৃষ্টি, বজ্রপাত কিংবা বৈশাখী ঝড়ে দেশের শতাধিক মানুষ মারা গেছে । প্রাকৃতিক দূর্যোগকে মোকাবেলা করার কথা যতই বলা হোক না কেন প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতির তান্ডব থেকে রক্ষা পাওয়া আদৌ সম্ভব নয় । শুধু যে বাংলাদেশের মত একটি গরীব দেশ প্রাকৃতির বিপক্ষে য্দ্ধু করে জয়ী হতে পারে না তা কিন্তু নয় বরং আমেরিকার মত একটি শক্তিশালী দেশকেও প্রাকৃতি তার বীভৎস দর্শন যে কতবার দিয়েছে তার সীমা-পরিসীমা নাই । প্রাকৃতির সাথে যুদ্ধ করে অতীতের মানুষ যেমন টিকতে পারে নি ঠিক তেমনিভাবে বর্তমান যুগের কৌশলী মানুষ গুলোও টিকতে পারছে না । প্রাকৃতিক দূর্যোগকে মোকাবেলা করে নয় বরং আমাদের সাবধানতা এর ভয়াবহতা থেকে আমাদেরকে বহুলাংশে রক্ষা করতে পারে । প্রাকৃতিক তান্ডবের কারনে প্রতিবছর বাংলাদেশে যারা মৃত্যুবরণ করে তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য সাবধানী পদক্ষেপ অনেক কার্যকারী । বজ্রপাতে, শীলে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কিংবা তীব্র গতির বাতাসের কারনে ঘর-বাড়ি চাপা পড়ে যারা মৃত্যুবরণ করে তাদের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা না গেলেও অন্তত অনেক কমানো যায় । যার দৃষ্টান্ত বিশ্বের অনেক দেশ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে । কিন্তু শুধু বাংলাদেশে কালবৈশাখীর সময়টাতে কয়েকটি কারনে প্রতিবছর শতাধিক-সহস্রাধিক মানুষ মারা যায় যা বিশ্বের অন্য কোন গরীব কিংবা ধনী রাষ্ট্রে দেখা যায় না ।
সম্প্রতি ঝড়ের কবলে পড়ে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলায় এমভি শাখিল-১ নামের একটি লঞ্চ ডুবে গেছে । শতাধিক যাত্রী বোঝাই লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার পর রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১৩টি লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে । এখনো অর্ধশতাধিক যাত্রী নিঁখোজ আছে বলে স্থানীয় কর্তপক্ষ জানিয়েছে । ধারনা করা হচ্ছে যারা এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি তাদের কারও জীবিত উদ্ধার হওয়ার সম্ভবনা নাই । শুধু এমভি শাখিল-১ নয় বরং প্রতিবছর ডজন ডজন লঞ্চ দেশের বিভিন্ন নৌ-রুটে ডুবে যায় । অন্য খুঁটিনাটি কতগুলো কারন থাকলেও বৈশাখী ঝড়েই বেশিরভাগ লঞ্চ ডুবে যায় বলে বিভিন্ন গবেষণার সূত্র প্রকাশ করেছে । এমভি শাখিল-১ চলতি বছরের জানুয়ারী মাসেও একবার দূর্ঘটনায় পড়েছিল । গত বছর একই সময়ে পদ্মা ও মেঘনাসহ বেশ কয়েক স্থানে কয়েকটি লঞ্চ ডুবির ঘটনা ঘটেছে । যাতে কয়েক শত মানুষ মারা গেছে । যাদের লাশ উত্তোলন করা হয়েছে তাদের ছাড়া যাদের লাশ পাওয়া যায়নি তাদেরকে কোন হিসাবে উঠানো হয় নি । একটি লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পরে তাতে কতজন যাত্রী ছিল তার সঠিক হিসাব কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করতে নারাজ । সে কারনে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন তথ্য সূত্র মতে কোন লঞ্চেই সহস্রের নিচে যাত্রী থাকে না । সুতরাং লঞ্চ ডুবে যারা মারা যায় তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম প্রকাশ করা হয় ।
বিভিন্ন সময় লঞ্চ ডুবির কারনে গঠিত কমিটির রিপোর্টে দেখা গেছে, সামান্য কয়েকটি কারনে লঞ্চ ডুবে । বৈশাখের তীব্র ঝড় এবং নদীর উত্তলতা থেকে সাবধান থাকলে লঞ্চ যাত্রাকে নিরাপদ রাখা যায় । বাংলাদেশের আবহওয়া অধিদফতর এর বিরুদ্ধে কিছু দুর্নাম থাকলেও এ সংগঠনটি বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দূর্যোগের আগাম বার্তা দিয়ে আমাদেরকে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির কবল থেকে রক্ষা করেছে । যদিও কয়েকটি ঘটনায় ভিন্নতা ছিল । নদী বেষ্টিত বাংলাদেশের নৌযাত্রা সহজলভ্য হওয়ায় দেশের মানুষ বিশেষ করে দক্ষিনাঞ্চলের মানুষ নৌপথেই বেশি যাতায়াত করে । এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার নিয়ন্ত্রিত স্টীমার এবং মালিকানাধীন লঞ্চ সার্ভিসই প্রধান ভরসা । যদিও স্টীমারের সার্ভিস লাইফের কখনই স্টীমার ডুবির খবর শোনা যায় নি কিন্তু প্রতি বছর লঞ্চ ডুবির খবর বাংলাদেশের জন্য নিত্য নৈমিত্তিক হযে দাঁড়িয়েছে । লঞ্চের সঠিক আকার, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতায় নিয়মান্ত্রিকতার অভাব, লঞ্চ তৈরির মেটারিয়ালে ভেজাল, দক্ষ চালকের অভাব, আবহাওয়া সতর্কতা অমান্য, ধারন ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী কিংবা মালামাল বোঝাই এর কারনেই লঞ্চ দূর্ঘটনা গুলো ঘটে থাকে । এ সকল ত্রুটির সাথে ধমকা বাতাস কিংবা ঝড়ো হাওয়া হলেই সহ¯্রাধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চ নদী গর্ভে তলিয়ে যায় । কিছু মানুষ লঞ্চ থেকে বের হতে পারলেও বিশাল কূল-কিনারাহীন নদী থেকে সাতরিয়ে তীরে আসতে পারে না যে কারনে তাদেরও মৃত্যু হয় । লঞ্চ দূর্ঘটনায় সাধারনত পুরুষের চেয়ে নারী এবং শিশুদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি থাকে । আবহাওয়া সতর্কতা মেনে, সুষ্ঠু কাঠামোয় লঞ্চ নির্মান করে, দক্ষ নাবিক দ্বারা, সঠিক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে লঞ্চ যাত্রা করলে সে যাত্রায় যেমন ভয় থাকে না তেমনি দীর্ঘ পথের যাত্রা হয় আরামদায়ক এবং উপভোগ্য । কাজেই কর্তপক্ষ বছরের দূর্ঘটনা বেশি সংঘঠিত হওয়ার এই সময়টাতে অবশ্যই লঞ্চ যাত্রার প্রতি তীব্র দৃষ্টি রাখবেন এবং যাত্রী সাধারনকেও মনে রাখতে হবে সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি । অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে কোন অবস্থাতেই লঞ্চে বা অন্য কোন বাহনে যাত্রা করা আদৌ উচিত নহে ।
বাংলাদেশে লাশের মিছিল চলছে । সময় যতই গড়াচ্ছে লাশের সাঁড়ি ততই দীর্ঘ হচ্ছে । রাজনৈতিক, মানব সৃষ্ট কারন থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক কারনে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ লাশের সাঁড়িতে যোগ হচ্ছে । কিছু মৃত্যু আছে যা রোধ করা মানুষের অসাধ্য । তবে এমন কিছু মৃত্যু আছে যা অবশ্যই রোধ করা যায় । লঞ্চ দূর্ঘনার মৃত্যুও ঠিক এমন, যাকে রোধ করা যায়। এ মৃত্যুকে সচেতনার মাধ্যমে শুণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব । বর্তমান সময়ে অপহরণ কিংবা গুম করে যাদেরকে মেরে ফেলা হচ্ছে তাদেরকে নিয়ে দেশব্যাপী তুমুল আলোচনা চলছে । অবরোধ থেকে শুরু করে অনশন । মানববন্ধন থেকে শুরু করে গভীর রাত্রের টকশোর সবখানেই এ লাশের খবর । হয়ত তাদের অনেকে রাজনৈতিক নেতা কিংবা দেশের শীর্ষস্থানীয় নতুব ব্যবসায়ী । তাদের হারিয়ে দেশ দিশেহারা । লঞ্চে যারা চলাচল করে তারা অতি সাধারণ লোক ! তারা দেশের জন্য বোঝা ছিল ! নয়ত তাদের মৃত্যু নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই কেন ? আমাদের মনে রাখা উচিত প্রতিটি লাশ কোথাও না কোথাও ব্যথার সৃষ্টি করে । কাউকে না কাউকে নিভৃতে কাঁদায় । কোথাও না কোথাও শূন্যতার সৃষ্টি করে । কাউকে না কাউকে শোকের সাগরে ভাসায় । সুতরাং প্রতিটি লাশ যেন জাতির পরিচালকদের মাথা ব্যথার কারণ হয় । তাদেরকে একটু ভাবায় । লাশের মধ্যে যেন শ্রেণীভেদ সৃষ্টি করা না হয় । কোন কোন লাশ শুধু সংখ্যায় প্রকাশ আবার কোন কোন লাশ নিয়ে রাজনীতি না হয় । মনে রাখতে হবে প্রতিটি লাশ তার জীবদ্দশায় নিজ নিজ আঙ্গিকে অনেক মূল্যবান ছিল ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
বিষয়: বিবিধ
১১৮০ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যারা বৈশাখকে স্বাগত জানানোর কারণে আজ বৈশাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। যারা ইলিশ পান্তা খেয়েছিল সবাইকে যুদ্ধাপরাধীর লিস্টে দেয়া হোক। তারপর ক্রস ফায়ারে। অর্থাৎ হাত পা বেঁধে ঠাণ্ডা মাথায় এদেরকে ক্রস ফায়ার করা হোক।
জন্য বাংলাদেশ, সরি জয় বাংলা। বাংলাদেশ বললে আবার হেতি রাগ করবে। তাই জয় বাংলা।
সত্যি বলেছেন। একটি লাশ অনেকের কষ্টের কারণ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন