এবি সিদ্দিকী ফিরলেন, বাকিরা ফিরবে কবে ?
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ২২ এপ্রিল, ২০১৪, ১২:০৩:৪৯ দুপুর
গ্রাম অঞ্চলে কয়েকবছর আগেও লুকোচুরি খেলার প্রচলন ছিল । কয়েকজন শিশু একত্রিত হলেই তারা আনন্দ করার জন্য এ খেলা খেলত । শিশুদের মধ্য থেকে একজনকে চোর বানিয়ে বাকিরা সবাই বিভিন্ন গোপন আস্তানায় লুকাতো এবং খেলার ভাষায় চোর শিশুটিকে সকলকে খুঁজে খুজে বের করতে হত । চোর শিশুটি একজন করে শিশু দেখত এবং খিলখিল করে হেসে উঠত । গ্রামাঞ্চলের এ ঐতিহ্যবাহী খেলাটি একেবারে বিলীন হয়ে না গেলেও খুব একটা প্রচলিত নেই । তখনকার প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন । বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে কয়েকজন শিশু একত্রিত হলেই বিভিন্ন ভিডিও গেম কিংবা মোবাইলে কার্টুন দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । আমাদের সময়কার আনন্দঘন মূহুর্ত তৈরির লুকোচুরি খেলায় হাল জমানার ছেলেমেয়ে মজা পায় না বরং ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়েরা এরকমভাবে সময় কাটানোকে বৃথা মনে করে । জাতিসত্ত্বায় গভীরভাবে বাঙালীত্ব মিশ্রিত থাকার কারনে বাঙালীরা তাদের কোন প্রথাকে সহজে হারিয়ে যেতে দিতে নারাজ । যে খেলাটি শিশুদের মনোরঞ্জন করার কথা ছিল সেই খেলাটি খেলছে দেশের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ । খেলার ধরনটা বদলেছে । পূর্বে যেখানে সবাই লুকাতো এবং একজন তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাত সেখানে এখন একজনকে বা একাধিক জনকে অন্যকোন পক্ষ জোর করে আড়াল করে ফেলছে এবং যেখানে লুকানো হয়েছে সেখানে না গিয়ে তার আশপাশে একপক্ষ খুঁজছে । অতীতের লুকোচুরি খেলায় লুকানো শিশুকে পেলে বিশ্বজয় করার মত আনন্দের বন্যা বয়ে যেত সেখানে এখন অনিচ্ছাকৃত লুকিয়ে ফেলা ব্যক্তিকে যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তখন সে লাশ কিংবা মোটা অঙ্কের মুক্তিপণের দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে । এসব লুকিয়ে ফেলা ব্যক্তির মধ্য থেকে এ পর্যন্ত সামান্য সংখ্যককে ফিরে পেলেও সহস্রাধিক লোক এখনো নিখোঁজ রয়েছে । এমনকি তাদেরকে কে বা কাহারা লুকিয়ে রেখেছে সে সম্মন্ধে কোন তথ্য বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলাবাহিনীর কাছেও নেই । কোনদিন তাদের ফিরে পাওয়া যাবে কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই । পরিবারের সদস্য বা শুভাকাঙ্খীরা এ সকল নিঁখোজ হওয়া ব্যক্তিদের ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধলেও বাস্তবাদীদের মতে তাদেরকে ফিরে পাওয়ার আশা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে গুম করা হয়েছে ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল । তিনি হলেন বিএনপির সাবেক সাংসদ সিলেটের ইলিয়াস আলী । তার গুমকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগঠন টানা পাঁচদিন হরতালসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মসূচী পালন করেছে । সরকারী বিভিন্ন বাহিনীর সাড়াশী অভিযানের পরেও তার কোন হদিস পাওয়া যায় নি । ইলিয়াস আলীর স্ত্রী এবং সন্তানেরা বাংলাদেশের তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে নিখোঁজ ইলিয়াস আলীকে আইন শৃঙ্খলা-বাহিনী মারফত খুঁজে বের করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে করজোরে অনুরোধ করেছেন । শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যদের হারানোর ব্যথা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করার কারনে ইলিয়াস পত্নী তাহসিনা রুশদী লুনা এবং তার সন্তানদেরকে যত দ্রুত সম্ভব ইলিয়াস আলীকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন । প্রধানমন্ত্রীর সে আশ্বাসের বয়স প্রায় দু’বছর পার হতে চলল অথচ ইলিয়াস আলীর কোন হদিসই শনাক্ত করা গেল না । কয়েকমাস আগে ইলিয়াস আলীর ছোট ভাইয়ের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ইলিয়াস আলী ভারতের কারাগারে বন্দী আছেন মর্মে যে খবর বেরিয়েছিল তাতে সত্যের কোন স্পর্শ ছিল বলে মনে হয় না । শুধু ইলিয়াস আলীই নন রাজনৈতিক, ব্যবসায়ীকসহ বিভিন্ন শত্রুতার কারনে হাজার হাজার মানুষ গুম হয়ে আছেন । ইলিয়াস আলীকে বনানী থেকে গুম করার পর যখন তার নিখোঁজ অবস্থায় দু’ই বছর পূর্তী হবে ঠিক তার আগ মূহুর্তেই গুম হলেন পরিবেশ বিষয়ক আইনী সংঘঠন ‘বেলা’র নির্বাহী পরিচালক রেজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়িক আবু বকর সিদ্দিক । বিভিন্ন ঘটনা এবং নাটকীয়তার পর দীর্ঘ ৩৫ ঘন্টা পর এবি সিদ্দিকের পকেটে ৩০০ টাকা যাতায়াত খরচ দিয়ে তাকে অপহরণ কারীরা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় । এবি সিদ্দিককে ফিরে পেতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম । অনেকে ধারণা করছেন এবি সিদ্দিক রাজনৈতিক কারনে গুম হননি তবে তার স্ত্রী রেজাওয়ানা হাসানের পরিবেশ রক্ষায় আন্দোলন করতে গিয়ে দেশের কয়েকটি বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে আইনি লড়াই লাগে । এ কারনে এবি সিদ্দিক অপহৃত হতে পারেন বলে অনেকে ধারণা পোষেণ । তাছাড়া এবি সিদ্দিকের সাথে কারে ব্যক্তিগত শত্রুতার কোন প্রমান পাওয়া যায় নি । এবি সিদ্দিকে অপহরণ এবং ইলিয়াস আলীর গুম একই সূত্রে বাঁধা না হলেও দু’জনের পরিবার এবং সারা দেশবাসী গুমাতঙ্কে ভূগছে । এবি সিদ্দিক উদ্ধার হওয়ার পর সরকারী দল থেকে ঘটা করে ঘোষণা করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী তৎপর হওয়ার কারনে অপহরণ কারীরা এবি সিদ্দিককে ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছে । আওয়ামীলীগের এ ঘোষণার পর সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. তুহিন মালিক প্রশ্ন তুলেছেন, এবি সিদ্দিক যদি জননেত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক উদ্যোগের কারনে দ্রুত উদ্ধার হয়ে থাকে তবে ইলিয়াস আলী এবং অন্যান্য গুম হওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে মানবদরদী প্রধানমন্ত্রী আন্তিরিকতা দেখাচ্ছেন না কেন ? ড. তুহিন মালিকের প্রশ্নের উত্তর সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে জাতি দ্রুত আশা করে ।
গত কয়েকবছরে সবচেয়ে বেশি গুমের ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জের ধরে বলে দাবি করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া । বেগম খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, গত কয়েকমাসে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে বিএনপির ১৬৭ জন নেতা কর্মীকে গুম করা হয়েছে । এর মধ্য থেকে কয়েকজনকে এনকাউন্টারে মেরে ফেলা হলেও অনেকের কোন খোঁজই পাওয়া যায়নি । ভবিষ্যতে তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়েও অনেকে সন্দিহান । শুধু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নয়, দেশের সর্বস্তরের মানুষ গুমাতাঙ্কে ভূগছে । ব্যবসায়ী, শ্রমিক নেতা থেকে শুরু করে ২ বছরের মাছুম বাচ্চারাও গুম বা অপহরণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না । গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে সাভারের শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম গুম হন এবং গুম হওয়ার কয়েকদিন পর তার লাশ পাওয়া যায় । ক্লাসের ভাল ছাত্রটি গুম হয়ে যাচ্ছে । কোন ব্যক্তি ব্যবসায় উন্নতি করার কারনে কোন এক পক্ষ তাকেও গুম করছে । ছাত্রীদের অপহরণ করে গুম করা হচ্ছে । মোট কথা দেশময় গুমের রাজত্ব কায়েম হয়েছে । কে কোন বেলায় গুম হয়ে যায় তা বলা দুষ্কর । অর্থ হাসিলের লোভে যারা অপহরণ করে তারা কিছু অর্থ পেলেই অপহরণকৃতকে ছেড়ে দেয় কিন্তু রাজনৈতিক কারনে যারা গুম হচ্ছে তাদের জীবনের সম্ভাবনা দিনে দিনে ক্ষীন হয়ে আসছে । ছাত্রনেতাদের মধ্যে যাদেরকে গুম করা হচ্ছে কিংবা ক্লাসে ভালো লেখাপড়া পারার অপরাধে যাদেরকে গুম করা হচ্ছে তাদের অনেকগুলো লাশ বিভিন্ন ড্রেন, নদী, জঙ্গল, পানির ট্যাঙ্ক কিংবা রাস্তার পাশে পাওয়া গেছে । রাজনৈতিক কারনে যারা গুম হচ্ছেন তাদেরকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে গুম করা হলেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুমের ব্যাপারে কিছুই জানে না বলে জানাচ্ছে । তাতে গুম হওয়া ব্যক্তিটির জীবন্ত ফিরে আসার সম্ভাবনা নিম্ন দিকেই যাচ্ছে । বিভিন্ন গণমাধ্যমের জরিপ মতে দেশে সহস্রাধিক ব্যক্তি গুম হয়েছেন, যাদের গুম হওয়ার পর থেকে কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি । বেঁচে আছে নাকি চিরদিনের মত হারিয়ে গেছে তাও জানা যাচ্ছে না । ফলে গুম হওয়া বক্তিদের অত্মীয়-স্বজনের চোখের পানি জড়তে জড়তে দাগ হয়ে যাচ্ছে তবুও স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আবেগঘন মূহুর্ত হাজির হচ্ছে না বরং দিনে দিনে গুমের বহর বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
এবি সিদ্দিক যেভাবে মৃত্যুকূপ থেকে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক উদ্যোগের ফলে তার পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পেরেছেন তেমনি দেশের যে সংখ্যক মানুষ গুম হয়ে নিখোঁজ অবস্থায় আছেন তাদের সবাইকে যেন ফিরে পাওয়া যায় । কোন মানুষ মৃত্যু বরণ করলে কয়েকদিন কেঁদে, শোক প্রকাশ করে তাকে হৃদয়ের আড়াল করতে না পারলেও সাময়িক ভূলে থাকা যায় কিন্তু যারা গুম হয়ে আছেন তাদের জন্য তাদের পরিবারকে সর্ব সময়ে শোকের সায়রে ভাসতে হচ্ছে । মানসিক দো’টানায় তারাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে । গুম হওয়া মানুষগুলোর মধ্য থেকে যাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে তারা পিতার আগমনের প্রহর ঘুনছে । গুম হওয়া ব্যক্তিদের মাতা-পিতা সর্বক্ষন মহান স্রষ্টার কাছে তাদের আদরের ধন, বুকের মানিকের জীবন ভিক্ষা চেয়ে তাদের কোলে ফিরে চাচ্ছে । সন্তানের জন্য পিতা-মাতার কামনা বৃথা হয় না । যদি পিতা-মাতার দোয়া ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য অশুভ কোন শক্তি তৎপরতা চালায় তবে তাদের ধ্বংস অনিবার্য । এবি সিদ্দিকের মত সকল গুম হওয়া ব্যক্তিরা যেন আমাদের মধ্যে ফিরে আসে শুধু সেই কামনায় এবং ভবিষ্যতে যেন আর কোন গুমের ঘটনা না ঘটে সেই প্রর্থনায় ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
বিষয়: বিবিধ
৯৮৯ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন