প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পরীক্ষায় নকল জাতীর মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিচ্ছে

লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১৮ এপ্রিল, ২০১৪, ১০:৩৭:৪৬ সকাল

শিক্ষাকে জাতির মেরুদন্ড বলা হয় । একটি জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত । একটি জাতি যত বেশি শিক্ষিত হবে সে জাতির মেরুদন্ড তত বেশি শক্তিশালী হবে । একজন মানুষের মেরুদন্ডের হাড় যত বেশি মজবুত হয় এবং এর গাঁথুণী যত বেশি টিকসই সে ব্যক্তি তত বেশি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে তেমনি যে জাতির লোকেরা জ্ঞানের রাজ্যে যত বেশি বিচরণ করবে সে জাতি তত বেশি গৌরব এবং মর্যাদার অধিকারী হবে । প্রাচীন যুগের গ্রীকরা এর প্রকৃত উদাহরণ । কেবল সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল কিংবা মহাবীর আলেকজান্ডার গ্রিকদের মধ্য থেকে ব্যক্তি কেন্দ্রিক শিক্ষিত ছিল না বরং তাদের সকলেই কম বেশি জ্ঞানের চর্চা করত । তাইতো কয়েক হাজার বছর পূর্বের সে মানুষগুলোর রচনাবলীর মধ্যে আজও মানুষ কল্যান রাষ্ট্রের, আদর্শ রাষ্ট্রের, নীতি তত্ত্বের আলোচনা খোঁজে সে অনুযায়ী রাষ্ট্র এবং জীবন গঠন করতে চায় । বিশ্বের দরবারের যতগুলো জাতি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব পেয়েছে তার সবগুলো জাতিই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে বিশ্ববাসীর কাছে তাদের জাত চিনিয়েছে । সকল যুগেই কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছিল, আছে. থাকবে । তিক্ত হলেও সত্য যে, সে ব্যতিক্রমীদের মধ্যে বাঙালীরা অর্থ্যাৎ আমরাও শামিল হয়েছি । যে কোন জাতি দু’ইভাবে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পেতে পারে । হয় সাধু হও নয় চোর হও । বাঙালীরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়েছে । সাধু সন্যাসী হয়ে বিশ্বের বুকে পরিচিতি পাওয়া যত কঠিন তার চেয়ে হাজারগুন সহজ চোর তথা অনৈতিক পন্থায় বিচরণ করে পরিচিতি পাওয়া । ভৌগলিক এবং জাতিগত উৎপত্তির কারনেই বাঙালীরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিচ্ছে ।

সকল বাঙালীকে দোষ দেয়ার মত সৎসাহস আমার নেই । যদি এরকমটি করতে হয় তাহলে আমাকে আধুনিক দর্শনের জনক ফরাসি দার্শনিক রেঁনে ডেকার্ডের পথে হাটতে হবে । রেঁনে ডেকার্ড যেমনি স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান পাওয়ার জন্য ঈশ্বর, বাইবেল এবং সৃষ্টি জগৎকে অস্বীকার করতে পেরেছিলেন তেমনটা আমার পারার উপায় নেই । এটা করতে গেলে আমাকে সংসার, সমাজ ছাড়া করা হবে । কাজেই সমাজ ব্যবস্থা যেমনি চলছে তার উপর থেকেই এর বিচার করা মঙ্গলের হবে । স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ৪৩তম বার্ষিকি পালন করেছি । স্বল্প শিক্ষিত একটি জাতি দিনে দিনে পূর্ন শিক্ষার পানে ছুটছে । স্বাধীনতা পরবর্তী যে বাংলাদেশের শিক্ষার হার ছিল মাত্র ১০-১৫% সেই দেশটির শিক্ষার হার এখন ৮০% ছুঁই ছুঁই । অল্প সময়ের মধ্যে কি চমক ! শহরের মানুষ সচেতন হওয়ার জন্য তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে আনতে সরকারকে তেমন কোন বেগ পেতে হয় নি কিন্তু গ্রামের অসচেতন অভিভাবকের ছোট ছোট কোমল মতি বাচ্চাদেরকে স্কুলে আনতে সরকারকে ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে হয়েছে । অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে যখন বাঙালী জাতি শতভাগ শিক্ষার হার নিশ্চিত করার দ্বারপ্রান্তে তখন শিক্ষা ব্যবস্থার উপর কালো মেঘের ঘনঘটা হিসেবে দেখা দিয়েছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং পরীক্ষায় নকলের সয়লাব । মাত্র দশ বছর বা তারও কম বয়সী কোমলমতি শিক্ষার্থীর জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা তথা সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে লেখাপড়া জীবনের সকল পরীক্ষা এমনকি চাকরির জন্য সবচেয়ে প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষা হিসেবে খ্যাত বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং সে পরীক্ষায়ও নকল আজ-কালকার নিত্যনৈমিত্তিক খবর । এ অবৈধ প্রথা যেন ধীরে ধীরে বৈধতা পাচ্ছে । সামাজিক অন্যান্য রীতিনীতির মত নকলপ্রথা কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁসও যেন আমাদের আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে ! এ অবৈধ প্রথার বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রনালয় ঘোষিত আইন শুধু কালো কালির ছাপায় সাদা কাগজের ফ্রেমে আবদ্ধ আছে । বাস্তবে তার কোন প্রয়োগ না থাকার কারনে সাধারণ মানুষের সমাজবিরোধী ভাবনাকে অযৌক্তিক বলার কোন উপায় আপাতত নেই ।

সারা বছর জুড়েই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন না কোন পরীক্ষা থাকে । বিশেষত ফেব্রুয়ারী থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স, ডিগ্রি, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী কিংবা জেএসসি পরীক্ষা থাকেই । অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ভঙ্গুর দশা চলছে এ কথা কারও অস্বীকার করার উপায় নেই । এতদিন বাংলাদেশের সফল শিক্ষামন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব দেশের জনতার সাথে দ্বিমত পোষন করলেও সর্বশেষ গত ৯ই এপ্রিল ঢাকা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজী দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর ১০ই এপ্রিলের পরীক্ষা স্থগিত করার পর তিনিও জনতার কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং নকল প্রথার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন । মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের এ আশ্বাসে জনতা হালে পানি পেয়েছে , নতুন আশায় বুক বাঁধার সাহস পাচ্ছে । প্রশ্ন জেগেছে, শিক্ষামন্ত্রী একা মানুষ কতটা পারবেন ? যেখানে গোটা নৈতিক ব্যবস্থা ভিন্নপথে বহমান । গত ২২ বছরে বিভিন্ন পরীক্ষা মিলিয়ে মাত্র! ৬৫ বার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেছে । কোথা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় ? নিশ্চয় যে প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ছাপানো হয় সেখান থেকে কিংবা যারা প্রশ্নপত্র বহনের সাথে জড়িত তাদের মাধ্যমে । কোন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রশ্ন পত্র ফাঁস হওয়ার ন্যূনতম সুযোগ নেই । কেননা যে কোন শিক্ষা বোর্ড নির্বাচিত শিক্ষকদের কাছ থেকে চার সেট প্রশ্ন নিয়ে লটারির মাধ্যমে তা থেকে দু’ই সেট প্রশ্ন ছাপায় । প্রশ্নপত্র জমা দেয়া এ শিক্ষকদের জানার কথা নয় কার দেয়া প্রশ্নপত্রের সেট ছাপানো হয়েছে এবং কোন সেট থেকে পরীক্ষা হবে । শিক্ষক যদি প্রশ্নপত্র প্রকাশও করেন তবে চার শিক্ষকের প্রশ্ন মিলালে গোটা সিলেবাসের খুব বেশি বাকী থাকে না । শিক্ষামন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থার কোন জায়গায় ঘুঁণে ধরেছে । অতীতে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি তা কিন্তু নয় । বর্তমান সময়ের মত অতীতেও মাঝে মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হত । তবে বিজ্ঞানের গতিশীলতা অতীতের তুলনায় বর্তমান সময়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রকে মূহূর্তের মধ্যে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে । সবচেয়ে লজ্জার কথা, যে প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে একজন ছাত্র তার কৃতিত্ব প্রকাশ করবে, ভবিষ্যত জীবন গড়বে, জীবনের সেই ‘প্রেসক্রিপশন’ বিক্রি হচ্ছে মাত্র দুই-পাঁচ টাকায় !

বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রের মত পরীক্ষায় নকল রোধে ড্রোন ব্যবহার কিংবা প্রত্যেক পরীক্ষার হলে সিসি ক্যামেরা বসানোর মত আর্থিক সঙ্গতি দেশের নেই । এমনটা ভাবলেও সেটা অযৌক্তিক হবে । আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের মত ততোটা নীতিবানও আমারা হতে পারি নি । শত বছর পূর্বের যে মানুষটি তার সন্তানের কল্যানার্থে শিক্ষকের কাছে চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, ‘‘আমার সন্তানকে শিখাবেন নকল করে পাশ করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানের’’ । দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার হু-হু করে উন্নতি হচ্ছে ! দেশে যে অবস্থা চলছে এরকম চলতে থাকলে দেশের শিক্ষিতের হার শতভাগ ছাড়িযে গেলেও! অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না । দেশে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর অভাব নাই । জ্ঞান অন্বেষণের মানসিকতা এ জাতীয় শিক্ষার্থীদের মনে ব্যাপক স্থান জুড়ে আছে । তবে অনৈতিকতার রাজ্যে নৈতিকতা কয়দিন টেকে ? প্রকৃত শিক্ষার্থীরা যখন নৈতিক ভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে সারা বছর ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে কাটানো, হাজিরা খাতার সবশেষ অবস্থানের ছেলেটির চেয়ে ফলাফলে পিছিয়ে পরবে তখন নৈতিকতা নামক বিরল বস্তুটি পালানোর রাস্তা পাবে কি ? কাজেই শিক্ষার হার বাড়াতে গিয়ে নকল প্রথা এবং প্রশ্নপত্রের ফাঁসের মাধ্যমে জাতিকে মেরুদন্ডহীন করে দেওয়া হচ্ছে নাতো ? তা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে । ভঙ্গুর মেরুদন্ড নিয়ে যে জাতি বেঁচে থাকে সে জাতি সমাজের কোন উপকারে তো আসেই না বরং সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায় ।

সময় এসেছে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসকারী এ কু-প্রথা থেকে জাতিকে রক্ষা করার । ওয়াজ, উপদেশ কিংবা অনুরোধ করে নৈতিকতা জাগ্রত করা যায় না । প্রত্যেকের বিবেকের জবাবদীহিতা জাগ্রত হওয়া চাই । একমাত্র সঠিক জ্ঞানানুশীলনের মাধ্যমে বিবেককে জাগ্রত করা সম্ভব । নীতি কথা দিয়ে যাদের সৎপথে আনা সম্ভব নয় তাদের জন্য বেতের লাঠি এবং শ্রীঘরই শ্রেয় । মাত্র হাতে গোন কয়েকজন ব্যক্তি প্রশ্নপত্র ফাঁস করার ক্ষমতা রাখে । তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমূখি দাঁড় করাতে পাড়লেই মেরুদন্ডহীন একটি জাতিকে মেরুদন্ডদান করে সোজা হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানো সম্ভব হবে । বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনাকে তদন্ত করার জন্য শিক্ষামন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তাদেরকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে রিপোর্ট নেয়া হয়েছে । অতীতের সে সকল রিপোর্টের বিশ্লেষন এবং বর্তমান কারনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোকে ফাইল বন্দী না রেখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা আশু আবশ্যক । শিক্ষা সংক্রান্ত এ অপতৎপড়াতাকে মাথাচাড়া দিয়ে জাগতে দিলে পরবর্তী প্রজন্ম অথর্ব কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করবে । একেকজন অনেকগুলো শিক্ষা সনদপত্রের অধিকারী হবে ঠিকই তবে চিরকাল লাঞ্ছনা, গঞ্জনা নিয়ে বাঁচতে হবে । কাজেই পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (আপরাধ ) আইন ১৯৮০ এবং এর সংশোধনী ১৯৯২ সালের আইনে যে শাস্তির বিধান রয়েছে (প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সাথে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে ১০ বছরের কারাদন্ডসহ অর্থদন্ড) তাকে আরও বাস্তমূখী করে প্রয়োগ করতে হবে । আগামীতে দেশকে একটি দক্ষ জাতি উপহার দিতে হলে শিক্ষা সংক্রান্ত সকল আপরাধের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ হাতে নেয়া জরুরী । তা না হলে সভ্য একটি জাতি আবারও অসভ্য এবং প্রকৃত মূর্খ জাতিতে পরিনত হবে । সরকার, শিক্ষামন্ত্রী এবং শিক্ষা সংক্রান্ত সকল কর্মকর্তা, কর্মচারীরা নিশ্চয়ই এটা চাইবেন না ।

রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।



বিষয়: বিবিধ

১০২৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File