ডাক্তাররা যখন কর্মবিরতিতে কিংবা ধর্মঘটে
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:১০:২১ সকাল
প্রখ্যাত মনীষী ডিভিরেট বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে ভালো ডাক্তার সে যাকে চেষ্টা করেও পাওয়া যায় না’ । মনীষীর ভাষ্যমতের ভালো ডাক্তার আমাদের দেশে খুব কমই আছে । চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিভিন্ন উন্নত দেশের তুলনায় তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ণশীল দেশ বাংলাদেশ যথেষ্ট এগিয়েছে । বাংলাদেশের চিকিৎসা অন্যান্য দেশের তুলনায় যেমন সস্তা তেমনি নির্ভরযোগ্য । অর্থনৈতিক পরাশক্তি সম্পন্ন দেশগুলো হতে অনেক রোগী বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা নিতে আসে । দেশের ডাক্তাররা রোগীর প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক । রোগীদের শেষ ভরসা ডাক্তারদের আস্তানা । ঈশ্বরের পরেই রোগীরা ডাক্তারদের স্থান দিয়ে রেখেছে । পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নাই যিনি কখনো রোগী হন নি । অতীতে ডাক্তার এবং রোগীদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল । কেননা ডাক্তাররা তাদের সর্বস্ব উজাড় করে রোগীর সেবা করে থাকেন । অতীতে দেখা যেত ডাক্তাররা তাদের পারিবারিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে রোগীদের বাড়িতে বাড়িতে ছুটত । বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ কিংবা সাহিত্যের অনেক গল্পে ডাক্তারদের উজ্জ্বল কৃতিত্বের কথা পাওয়া যায় । বর্তমান সময়ে ডাক্তাররা তাদের পেশাকে অর্থ লাভের মাধ্যম হিসেবেই বেশি ব্যবহার করছে । সেখানো রোগীর সুস্থতা-অসুস্থতা গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে । বিভিন্ন রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থেকে অলিখিতভাবে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ অর্থ লাভ কিংবা বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধি থেকে দামী দামী উপঢৌকন ডাক্তারদের দিন দিন লোভী বানাচ্ছে । ডাক্তার পৃথিবীর উপরে মানুষের ঈশ্বরের স্বীকৃতি নিয়ে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসকে পুঁজি করে ধণের পাহাড় গড়ে যাচ্ছে অথচ রোগী মানসম্মত চিকিৎসা পাচ্ছে না ।
একজন ভালো ডাক্তার দীর্ঘ দিনের গবেষণা শেষে রোগীর রোগ নির্ণয় এবং সে রোগ থেকে অব্যহতি পাওয়ার জন্য যে ঔষধ প্রয়োজন সে সম্মন্ধে পরিপূর্ণ জানেন-এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই । অর্থের লোভে কিংবা অন্য কোন পারিপার্শ্বিক কারনে মানুষের ভগবান ডাক্তার সাহেব রোগীর রোগ নির্ণয় করতে পারলেও সে রোগকে উপশমকারী ঔষধ দিচ্ছেন না । বিভিন্ন নিম্নমান সম্পন্ন ঔষধ কোম্পানীর ভেজাল ঔষধ লিখে রোগীকে আরও বিপদে ফেলছেন । অথচ ডাক্তারের ভাবা উচিত ছিল প্রত্যক্ষভাবে তার হাতেই একজন রোগীর জীবন মৃত্যু নির্ভর করছে । অধিকাংশ ডাক্তারেরাই সে দিকে খেয়াল না করে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় মানহীন ঔষধ কিংবা চুক্তিকৃত রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে রোগীকে পাঠিয়ে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেন । অপরেদিক চিকিৎসা গ্রহনের করে রোগীর একটি রোগ সারলেও ভেজাল ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কারনে আরও পাঁচটি রোগের জন্ম হয় । ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ডাক্তারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, ‘তিনি সবচেয়ে ভালো ডাক্তার যিনি প্রায় সব ঔষধগুলির অকার্যকারিতা সম্বন্ধে ভালো করে জানেন’ । আমাদের দেশের সিংহভাগ ডাক্তাররা ভালো এবং মানসম্মত হওয়ার কারনে তার সকল ঔষধের গুনাগুন এবং অপকারিতা সম্পর্কে জানলেও অর্থলোভে কিংবা চক্ষুলজ্জায় রোগীর পাণে না চেয়ে ঔষধ কোম্পানীর দিকে চেয়ে থাকেন ।
অতি সম্প্রতি ডাক্তারদের প্রায়ই কর্মবিরতি কিংবা ধর্মঘট করতে দেখা যায় । এর পিছনে বিভিন্ন ধরনের কারনও পাওয়া যায় । কোনটি ঠুনকো আবার কোনটি যুক্তিযুক্ত । সম্প্রতি রাজশাহী, রংপুর,চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী হাসপাতালে ডাক্তারদের কর্মবিরতি পালন করতে দেখা গেছে । অতি সম্প্রতি ঢাকার শাহবাগস্থ বারডেম হাসপাতালের ডাক্তাররা অনির্দিষ্ট কালের জন্য কর্ম বিরতি ঘোষণা করেছে । কখনো রাজনৈতিক কারন কখনওবা রোগীদের স্বজনকর্তৃক ডাক্তারদের লাঞ্ছিত কিংবা মারধরের ঘটনায় ডাক্তাররা কর্মবিরতি পালন করছে । রাজনৈতিক ঘটনাগুলোকে ডাক্তারদের এড়িয়ে যাওয়া উচিত । দল বা মতের সমর্থন করা দোষের নয় তবে তাতে যদি চিকিৎসাধীন রোগীদের জীবনহানীর আশঙ্কা সৃষ্টি হয় কিংবা রোগীদের নিয়ে স্বজনরা চরম দূর্ভোগের মধ্যে পড়ে তবে ডাক্তারদের প্রতি রোগীর আত্মীয় স্বজনরা আস্থা হারিয়ে তাদের প্রতি ভিন্ন ধারনার সৃষ্টি হবে । যা ডাক্তারদের জন্যও যেমনি কল্যানকর হবে না তেমনি রোগীদের জন্য তো কল্যানকর নয়ই । ডাক্তাররা ভূলের উর্ধ্বে নয় । অন্যান্য পেশাজীবি মানুষের মত তাদেরও ভূল হওয়া স্বাভাবিক । সেজন্যই চিকিৎসা পেশাকে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে । ডাক্তারের অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃত ভূল যেভাবেই হোক যদি কোন রোগীর প্রাণহানী কিংবা অঙ্গহানী হয় তবে স্বাভাবিকভাবেই রোগীর আত্মীয় স্বজনরা সেটা মানতে নারাজ । ডাক্তাররাও অপারেশনে এমন কিছু ভূল করে যা একজন পেশাদার হিসেবে ডাক্তারদের থেকে কখনো আশা করা যায় না । ২০১২ সালে চমেক হাসপাতালে একজন চিকিৎসক এক রোগীর মলদ্বারে একটি অপারেশন করে শরীর অভ্যন্তরে সুঁই রেখে আসেন । পরবর্তীতে রোগীটি মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার পর আরও দুইবার ডাক্তারের শরনাপন্ন হন । ডাক্তার রোগীটির সমস্যার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আরও দুইবার অপারেশানের নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন । পরে রোগীটি ভারতে গিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে সে সুঁইটি বের করান । পরবর্তীতে মামলা মকদ্দমা হয় । ডাক্তারের জেল হয় । তাতেও তার সহকর্মী ডাক্তাররা কর্মবিরতি ঘোষণা করে । এছাড়াও সিজারের সময় সিজার পেটে রেখে সেলাই দেয়া কিংবা অন্যান্য অনেক ভূল চিকিৎসার কারনে রোগীর মৃত্যুর কথা নিত্য-নৈমিত্যিক খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
ডাক্তারদের বিরুদ্ধে রোগীদের স্বজনদের লেলিয়ে দেয়ার পিছনে ডাক্তারদের ভূমিকা অপরিসীম । একজন ডাক্তার আরেকজন ডাক্তারকে চিরশত্রু মনে করে । একই বিভাগের একজন চিকিৎসক থেকে চিকিৎসা গ্রহন করে অন্য একজন ডাক্তারের কাছে গেলে পূর্বের চিকিৎসক সম্পর্কে রোগীর কাছে গালি গালাজ করে । মাঝে মাঝে এমন শব্দ উচ্চারণ করে যা শিক্ষিত কোন মানুষ ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না । জন্তু জানোয়ার সম্বোধন তো আছেই । সাধারণ মানুষ চিকিৎসা বা রোগ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ । চিকিৎসকরা যা বলে তাকে অবতারের কথার মত বিশ্বাস করে সে অনুযায়ী ঔষধ গ্রহন করে । এত ভক্তি শ্রদ্ধা নিয়ে যে ডাক্তারের দীর্ঘদিন চিকিৎসা গ্রহন করল সেই ডাক্তার সম্বন্ধ্যে অন্য ডাক্তারের কাছে যখন এমন কথা শুনল তখন সব ডাক্তারদের উপর থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে আস্থা হারাতে শুরু করে । তখন চিকিৎসাধীন কোন রোগী অপচিকিৎসায় মারা না গিয়ে স্বাভাবিক কারনে মারা গেলেও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের ভূল চিকিৎসায় রোগী মারা গেছে বলে রোগীর আত্মীয় স্বজনরা বদ্ধমূল বিশ্বাষ পোষণ করে । এ কারনেই রোগীর আত্মীয় স্বজন কর্তৃক ডাক্তাররা প্রহৃত কিংবা লাঞ্ছিত হয়ে থাকেন । যার কারনে ডাক্তাররা অনশন কিংবা কর্মবিরতিতে বাধ্য হন অথচ এ কারন সৃষ্টির জন্য ডাক্তাররাই বহুলাংশে দায়ী ।
সরকারকে বিশেষ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে যথেষ্ট আন্তরিক হতে হবে যাতে ডাক্তারদেরকে কর্মবিরতি করতে না হয় । প্রয়োজনে যে সকল কারনে ডাক্তাররা কর্মবিরতি কিংবা ধর্মঘট করেন সে সকল কারন চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে । প্রয়োজনে কঠোর আইন করতে হবে । সরকারকে মনে রাখতে হবে, তার প্রজাসাধারনের মৌলিক চাহিদা পূরনের জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিতে হবে কেননা সাংবিধানিকভাবে মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম । ডাক্তারদের ধর্মঘটের জন্য যদি কোন রোগীর প্রাণহানী হয় তবে তার দায়ভার যেমন ডাক্তারদেরকে নিতে হবে তেমনি সরকারকেও জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে । রাষ্ট্রের সাধ্যানুযায়ী যতটুকু সম্ভব ততটুকু সুযোগ-সুবিধা ডাক্তারদেরকে প্রদান করতে হবে যাতে ডাক্তাররা তাদের ধর্ম ছেড়ে অনৈতিক পথে ধাবিত না হয় । রোগীর রোগের অসহ্য যন্ত্রনা পূর্ণভাবে রোগী ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারে না । মৃত্যুকালীন সময়ে রোগী যেন আরামে শেষ চিকিৎসা গ্রহন কিংবা রোগী যেন সুস্থ হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে তার নিশ্চয়তা সরকার এবং ডাক্তারদের যৌথভাবে দিতে হবে ।
ডাক্তার, রোগী এবং জনগণ পরস্পর বন্ধু হওয়া উচিত ছিল । ডাক্তাররা যেমন তাদের সকল স্বার্থ ত্যাগ করে দিন রাত রোগীর সেবা করে চলেন তেমনিভাবে রোগীরা ডাক্তারদের ততোটা বন্ধু এখনও হতে পারেনি । তাইতো পল্লীকবি জসিম উদ্দিন বলেছিলেন, ‘‘বিপদ কালেতে মোরা হাত জোড় করি, বিপদ কাটিলে পুনঃ নিজ মূর্তি ধরি । অসময়ে চিকিৎসককে বন্ধু বটে কই, সুসময়ে দেখা হলে মূখ ফিরে লই” । কবির এ ধারণা অচিরেই যেন দেশের মানুষ পাল্টে দিতে পারে সে জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে । ডাক্তারের দায়িত্ব শুধু রোগীর সেবা করা এটাই যেন ভেবে বসে না থাকি । ডাক্তারকে বন্ধু ভেবে তার দিকটাও দেখার চেষ্টা করলে ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে ব্যবধান কমে এসে যেমন সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে তেমনি উভযের মধ্যে হৃদ্রতাও বাড়বে ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
বিষয়: বিবিধ
৯৩৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সহমত
মন্তব্য করতে লগইন করুন