শুরু হোক নতুন পথচলায়- ১৪২১বঙ্গাব্দ
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১৪ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:৫৭:১২ সকাল
সময় বড় বেরসিক । কারো জন্য অপেক্ষা করে না । যাদের সময়জ্ঞান কম তারা প্রায়ই সময়কে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেঈমান আখ্যায়িত করে । সময়ের ফ্রেমেই মানুষের সফলতা বিফলতা বাঁধা পরে । সময়ের কাজ সময়ে শেষ করতে পারলে তাদের জীবন থেকে দ্যুতি ছড়ায় । সে দ্যুতি ছড়ানো মানুষগুলো যেমনি নিজেদেরকে আলোকিত করে তেমনি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে আলোকিত করে । কথায় বলে সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না । এরা নিরন্তন বয়েই চলে । যারা সময়ের কাজ সময়ে করতে পারে না তারা পিছনের দিকে তাকালে যেমন অন্ধকার দেখে তেমনি ভবিষ্যতও অন্ধকার দেখে । যারা সময়ের কাজ সময়ে করতে পারে তারা পৃথিবীর সকল যশ-খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছে । সময় কেবল মানুষকে দিতেই জানে তবে মানুষের গ্রহন করার ক্ষমতা থাকা চাই । সময়ের মূল্য দিয়ে নিজের জীবনকে ধন্য করার মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে খুবই কম । এ প্রসঙ্গে এক মনীষী ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘মানুষ ঘটা করে, উৎসব করে জন্মদিন পালন করে, বন্ধুদের নিমন্ত্রন করে খাওয়ায়, হই-হুল্লোড়ে মেতে থাকে অথচ একবারও আফসোস করে না যে তার জীবন থেকে একটি বছর চলে গেলো, হারানো একটি বছরে সে কি অর্জন করতে পেরেছে’ ? এ মণীষীর মত গভীরভাবে জীবনের মূল্য, সময়ের তাৎপর্যকে অনেকেই মূল্যায়িত করতে না পারার কারনে পরিবারের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের এই করুন দশা ।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে দীর্ঘ ৪৪ বছর আগে অথচ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়ণশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে পরিচিত । অথচ বিশ্বের এমন অনেক দেশ আছে যারা প্রাকৃতিক এবং জনশক্তির দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছনে অথচ তারা বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি, দাতা দেশে পরিণত হয়েছে । সে সকল দেশের চেয়ে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল কিন্তু অনেকগুলো প্রতিকূলতার কারনে বাংলাদেশ তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে নি কিংবা পৌঁছতে দেয়া হয় নি । আবহাওয়া এবং জলবায়ুর দিক থেকে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জন্মলগ্ন থেকে ভালো । বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত দেশ বলা হলেও সে সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ বছরের নির্দিষ্ট মাসে হয় । বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বাংলাদেশের মত প্রয়োজনীয় বৃষ্টি, উষ্ণতা এবং শীতলতার ভারসাম্যতা পাওয়া যায় না । এ সকল দিক বিবেচনা করে বিশ্বের সকল দেশকে ছাপিয়ে বাংলাদেশকে বলা হয় সুজল-সূফলা, শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলাদেশ । বাংলাদেশের দক্ষিনে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে প্রাকৃতিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট ‘সুন্দরবন’ । সুন্দরবন বাংলাদেশকে সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা করে । বিশ্বের বৃহৎ মানচিত্রের মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের সামান্য একটু জায়গায় বাস করে প্রায় ষোল কোটি মানুষ । তবুও বাংলাদেশের জন্য বিপুল পরিমান জনসংখ্যা বোঝা নয় । বাংলাদেশের বিপুল পরিমান জনসংখ্যাকে যদি জনশক্তিতে রুপান্তরিত করা যায় তবে বিশ্বের বুকে অচিরেই অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাবে । বাংলাদেশের মত অন্য কোন দেশে শ্রমের মূল্য এত সস্তা না হলেও বাংলাদেশে বৃহৎ আকারে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে নি । যা দু’একটা গড়ে উঠেছে তাও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং দেশী পূঁজিবাদী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের অপকৌশলের কারনে ধ্বংসপ্রায় ।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে কখনই রাজনৈতিক স্থীতিশীলতা আসেনি । বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে যে দুই মহান ব্যক্তি নায়কের ভূমিকায় ছিলেন সেই দুই ব্যক্তিকে পৃথক সময়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে । দেশের শাসন ব্যবস্থা কখনো সামরিক শাসন আবারা কখনো অনিয়মিয়ত শাসকদের শাসনে চলেছে । স্বাধীনতা অর্জন পরবর্তী দীর্ঘ ৪৪ বছরের যে কিঞ্চিৎ সময়টাতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু ছিল সে সময়টাতে দেশের মধ্যে প্রকৃত গনতান্ত্রিক শান্তি প্রতিষ্ঠা পায়নি । বিরোধীদলের সরকার বিরোধী প্রচার, বিভিন্ন যৌক্তিক কিংবা ঠুনকো দাবীতে হরতাল অবরোধের মাধ্যমে দেশটাকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে । যে শাসকদের দেশে শান্তির পতাকা স্থাপন করার কথা ছিল তারাই অশান্তির দাবানল ছড়িয়েছে । হত্যা, গুমের মাধ্যমে সরকার বিরোধীদের গণতান্ত্রিক কণ্ঠরোধ করে দেয়া হয়েছে । কোন সরকারই তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার সমালোচনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে নি । যারাই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছে তাদের কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে । নিজেদের অবস্থানকে ধরে রাখার জন্য দেশের শাসকদের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর কাছে নালিশ করা হয়েছে । যেটা দেশের জন্য কোন অর্থেই কল্যান বহন করে নি বরং দেশটাকে ক্রমাগত ধ্বংসে মূখে ঠেলে দিয়েছে ।
হিন্দু ধর্মে একটি কথা আছে,‘বার মাসে তের পার্বণ’ । কিসের ১৩ পর্বন কিংবা ১৩০ পর্বন । এক বছরে ৩৬৫ দিন । বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে ৮৫ দিন সরকারী ছুটির ব্যবস্থা করা হয়েছে । সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির মাধ্যমে ১০৪ দিন পেশাগত দায়িত্ব থেকে দূরে রাখা হচ্ছে । প্রতি মাসে নিয়মগত ২ দিন ছুটির বিধান রাখা হয়েছে যাতে বছরে ২৪ দিন কাজ থেকে দূরে থাকা যাচ্ছে । অসুস্থতা কিংবা প্রাকৃতিক কারনে ছুটি-ছাটা তো আছেই তার উপর যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয় তাহলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ অবকাশ যাপন রোধ করে কে ? একটি দেশের শীর্ষস্থানীয় আমলারা যদি বছরের যদি ২০০ দিন বা তারও বেশি সময় অবকাশে কাটায় তাহলে সে দেশে শনির দশা লাগবে নাতো কি আমেরিকা কিংবা বৃটেনে লাগবে ? এ দেশে কত দিবস ! কেউ জন্মানোর দিবস আবার কারো মৃত্যু দিবস অথচ যারা বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদেরও দিবস আছে ঠিকই কিন্তু অফিস বন্ধ দিয়ে নয় । এ দেশে ক্রিকেট খেলা হলে হাজার হাজার মানুষ স্টেডিয়ামে কিংবা বাসায় টিভির সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয় অথচ বাংলাদেশ ছাড়া বর্হিবিশ্বের যে সকল খেলোয়ারের আত্মীয় স্বজনরা ক্রিকেট খেলে তারাও তাদের কাজ বাদ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা টিভির সামনে বসে থাকে না । আশ্চার্য হয়েছিলাম, যে দিন ভারতের বিশ্ব বিখ্যাত ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার দক্ষিন আফ্রিকার বিরুদ্ধে ওয়ানডে ম্যাচে তৎকালীন বিশ্বসেরা অপরাজিত দুইশত রান করেছিল সে ম্যাচটাও শচীনের স্ত্রী কিংবা সন্তানরা দেখে নি কারন শচীন তনয় অর্জুনের ম্যাচের পরেরদিন স্কুলে পরীক্ষা ছিল । অথচ আমাদের দেশের অবস্থা !
কয়েক হাজার কোটি টাকা যে দেশের ব্যাংকে আছে সেই দেশটি টানা পাঁচ বার দুর্নীতিতে বিশ্বের নেতৃত্ব দেয় অথচ মিলিয়ন বিলিয়ন কোটি ডলার যাদের ব্যাংকে আছে সে সকল দেশ দুর্নীতির কোন সিরিয়ালে নেই এমনকি তাদের কোথাও দুর্নীতির ছিঁটেফোটাও নেই । বাংলাদেশে কোটি টাকা ব্যয়ে কোন উন্নয়ণমূলক কাজ করতে গেলে বিশ্বের দাতা দেশ কিংবা বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়, সেই দেশটি পদ্মা সেতু নির্মান করবে বলে বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ এনে কোন প্রকার কাজ আরম্ভ করার আগেই প্রায় আটশ কোটি টাকা লাপাত্তা করে দেয় । একজন ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করার জন্য ১২০০ কোটি টাকা ব্যয় করে, ১০০ কোটি টাকা খরচ করে গ্রীনেস বুকে নাম লেখাবে বলে গণ কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় অথচ সেই দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষ অভূক্ত, দুই তৃতীয়াংশ মানুষ ঠিকমত দুই বেলা খেতে পারে না । দেশকে ডিজিটাল করার ঘোষণা করা হলেও দেশের সিংহভাগ এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটি, তার পৌঁছে নি অথচ দেশটা ডিজিটাল করা হচ্ছে ! ঘুষ ছাড়া অফিস আদালতের কোন কাজ চলে না । শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার মানসে প্রশ্নপত্র পরীক্ষার পূর্বেই শিক্ষার্থীদরে কাছে যাতে পৌঁছে সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে । সকল পরীক্ষায় নকলের সয়লাব । তবুও কর্তৃপক্ষ নির্বিকার । সকল নেতার মূখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার কথা অথচ এই চিত্র কি মুক্তি যুদ্ধের চেতনায় ছিল ? স্বজনপ্রীতি ছাড়া, দলীয় লেভেল ছাড়া চাকরি হচ্ছে না । দিনের পর দিন বেকার বেড়েই চলছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেসনজট বাড়তে বাড়তে চার বছরের কোর্স আট বছরের শেষ হচ্ছে না । কোটা পদ্ধতির বিষাক্ত ছোবলে চাকরির ক্ষেত্র সংকীর্ণ করে ফেলা হয়েছে । বিদেশী প্রভূদের খুশি করার জন্য দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতেও কেউ কার্পন্য করছে না । দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলি বিভিন্ন রাষ্ট্রের তাঁবেদারী করতে গিয়ে বাংলাদেশকে সে সকল দেশের অঙ্গরাজ্য বানানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে । এ রকম যদি চলতে থাকে তবে বাংলাদেশের অবস্থা দিন দিন অবনতির শীর্ষে পৌঁছবে ।
দেশের গরীবদের ঠাট্টা করতে বড়লোকেরা পহেলা বৈশাখে মেতে ছিল পান্তা ইলিশ নিয়ে । এটা নাকি নতুন বৎসর বরণের সংস্কৃতি । বাজারের সেরা চাল রেঁধে তাতে পানি দিয়ে, সরষে ইলিশ বেজে মাটির বাসনে একটি কাঁচা মরিচ নিয়ে রমনার বটমূলে কিংবা তিন তারা, পাঁচ তারা হোটেলে বছরের একটি দিন উৎসবের নামে বেহায়াপানা করা বৈশাখ বরণ করা নয় বরং গরীবের গরীবত্ব নিয়ে মজাক করা, তাদেরকে অপমান করা । গরমভাতে পানি দিলে পান্তা ভাত হয় না, গরীব যে পান্তা ভাত খায় তা দুই তিন দিনের পঁচা, কোন গরীব পান্তাভাতে ইলিশ খাওয়ার সামর্থ রাখে না । এ রকম করে পান্তা খেয়ে গরীবকে সহমর্মিতা জানানোর পরিবর্তে গরীবকে তাচ্ছিল্য করা হয়, তাদের অসহায়ত্বকে খোঁটা দেয়া হয় । গরীবরা ইলিশমাছ ধরলেও দুই হাজার টাকা মূল্যের একটি ইলিশ খাওয়ার সামর্থ তাদের নেই । কাজেই যারা বলেন, পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খেয়ে আপনারাও গরীবের কাতারে দাঁড়ান তারা আপন সত্ত্বার সাথে ধোঁকাবাজি করেন । আর কারও কাছে না হোক অন্তত বিবেকের কাছে জবাবদিহী করতে হবে ? সে দিন বেশি দূরে নয় ।
সকল কষ্টের পরও আমরা বাঙালী । খৃষ্টাব্দ, হিজরীরর সাথে বঙ্গাব্দে আমাদের অহংকার । বঙ্গাব্দ বাঙালীত্বের নিদর্শন । কাঠ ফাটা চৈত্রকে বিদায় দিয়ে বৈশাখকে সম্ভাষণ জানানো আমাদের কর্তব্য । সে কর্তব্যকে শুধু একটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বছরের বাকি দিনগুলো হিন্দি, ইংরেজী আর উর্দুতে জড়িয়ে রাখা ত্যাগ করতে হবে । ফোক গানের পরিবর্তে বাংলা গান যেন হৃদয়ের তুষ্টি দিতে পারে । শুধু একদিনেই যেন ‘এসো হে বৈশাখ....এসো এসো’ এর তাৎপর্য বিলীন হয়ে না যায় । একটি সূখি সমৃদ্ধি দেশ গড়তে যে সকল প্রতিকূলতা আছে তা মূল থেকে উপড়ে ফেলে যেন বাংলা ১৪২১ সালে নতুনভাবে নতুন পথে যাত্রা শুরু করতে পারি । যে পথে থাকবে না রাজনৈতিক অস্থিরতা, হানাহানি, খুন-গুম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কিংবা মিথ্যা আশ্বাস । নেতা যেন জনদরদী হয়ে দেশের মঙ্গল করতে পারে তার অনুপ্রেরণা যেন আমরা দিতে পারি । অবহেলায় দীর্ঘ ৪৩টি বৈশাখ কাটালোও দেশের আগামী বৈশাখগুলো যেন মঙ্গলময় হয় । বিশ্বের একটি উন্নতশীল দেশ হিসেবে যেন বাংলাদেশ অচিরেই প্রতিষ্ঠা পায় তার উপলক্ষ্য যেন এদেশে ৩২ কোটি সক্ষম হাত তৈরি করতে পারে সে কামনায় । শুভ হোক আগামীর পথচলা ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
বিষয়: বিবিধ
৯৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন