`পত্রিকায় আর ছাপবে না এবিএম মূসার কলাম কিংবা টিভিতেও দেখা যাবে না তার গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে আলোচনা’

লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১০ এপ্রিল, ২০১৪, ০৭:৩৬:১২ সকাল

‘‘যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে, কেঁদেছিলে তুমি একা, হেসে ছিল সবে....এমন জীবন তুমি করিও গঠন, মরনে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন”- হ্যা পাঠক বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ কিংবদন্তী এবিএম মূসার কথাই বলছি । কবিতার চরণের মত বর্ণীল জীবন তিনি গঠন করতে পেরেছিলেন । বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অঙ্গনে যিনি নতুন ধারা সৃষ্টির জন্য আমরণ সংগ্রাম চালিয়েছেন সেই স্পষ্টভাষী, সজ্জন এবিএম মূসা আর আমাদের মাঝে নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) । স্রষ্টার ডাকে সারা দিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে এমন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন যেখান থেকে পূনরায় ফিরে আসার সাধ্যি কারো নেই । আজ থেকে এবিএম মূসার লেখা পড়ার জন্য কেউ অপেক্ষা করলেও পত্রিকার পাতায় আর প্রকাশ পাবে না তার কোন কলাম কিংবা টিভির সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকলেও তার কন্ঠ আর শুনতে পাওয়া যাবে না । আপদমস্তক গুনী এ মানুষটি বিশ্বব্যাপী তার ভক্তকূল এমনকি সমালোচকদেরকেও চোখের জলে ভাসিয়ে ৯ই এপ্রিল রোজ বুধবার বেলা সোয়া একটায় রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন । মূলত বার্ধক্যজনিত কারনে তার মৃত্যু হলেও ডাক্তারদের মতে মাইলোডিসপ্লাষ্টি সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে তার অস্থিমজ্জা অকোজো হয়ে গিয়েছিল । এ রোগটি প্রায় ক্যানসারের কাছাকাছি । এ রোগে চরমভাবে আক্রান্ত হওয়ার পর সর্বশেষ মার্চ মাসের ২৯ তারিখ তিনি গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পরেন । অসুস্থ হওয়ার সাথে সাথেই তাকে ২৯শে মার্চ ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । হাসপাতালের ৫০২ নং কক্ষে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এবিএম মূসার অবস্থা সংকটাপর্ণ হওয়ার পর ৭ই এপ্রিল রাত আড়াইটা থেকে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয় । তাতেও তার অবস্থার কোন উন্নতি না হয়ে অবনতির দিকে যেতে থাকে । বুধবার বেলা সোয়া একটায় তার চিকৎসকরা মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তার কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থা খুলে ফেলেন । সাঙ্গ হয় দীর্ঘ ৮৪ বছরের একটি বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প ।

এবিএম মূসার সারা জীবন নানা বৈচিত্র্যে ভরপূর । ১৯৩১ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী ফেনীর জেলার ফুলগাজী থানার ধর্মপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে সাংবাদিক এবিএম মূসা জন্মগ্রহন করেন । তার শিক্ষাজীবন কেটেছে চট্টগ্রামের সরকারি মোসলেম হাইস্কুল, নোয়াখালী জিলা স্কুল, ফেনী কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ-এ । বিএ প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়েছেন চৌমুহনী কলেজ থেকে । ছাত্রজীবনেই সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয় চৌমুহনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘কৈফিয়ত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে । এ সময়েই তিনি বাম-রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন । ছাত্রজীবনে নিয়মিত লিখতেন সাপ্তাহিক সংগ্রাম ও পাকিস্তান অবজারভারে ।

প্রবীন সাংবাদিক এবিএম মূসার পেশা জীবন অনেক লম্বা এবং সফলতায় ভরপূর । ১৯৫০ সালে তার পেশা জীবনের সূচনা হয় যা মৃত্যুর আগে অসূস্থ হওয়ার পর্যন্ত চলমান ছিল । দীর্ঘ ছয় দশক তথা ৬৩ বছরের পেশা জীবনে তিনি তার সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন নামজাদা প্রতিষ্ঠানে । যেখানেই যে কাজ করেছেন সে কাজের সাথে হৃদয়ের মাধুরী মিশিয়েছেন । তার এ অকৃত্রিমতাই তাকে সফলতার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে । বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তাকে শ্রদ্ধার চোখে সম্মান করে । ১৯৫০ সালে ‘দৈনিক ইনসাফ’ থেকে তার পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা জীবনে সূচনা হয় । একই বছরে তিনি ইংরেজী দৈনিক ‘পাকিস্তান অবজারভারে’ যোগ দেন । ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান অবজারভারে রিপোর্টার, স্পোর্টস রির্পোটার, বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পাকিস্তান অবজারভার বন্ধ করে দিলে তিনি ‘সংবাদে’ যোগ দেন । ১৯৫৪ সালে পূনরায় পাকিস্তান অবজারভার চালু হলে তিনি তার পূর্বের কর্মস্থলে ফিরে যান । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসি, সানডে টাইমস প্রভৃতি পত্রিকায় সংবাদদাতা হিসেবে এবিএম মূসা রণাঙ্গন থেকে সংবাদ পেরণ করতেন । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বিটিভির মহাব্যবস্থাপক, মর্নিং নিউজের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন । শুধু বাংলাদেশের গন্ডীর মধ্যেই এ অকুতোভয়ী সাংবাদিকের পেশা জীবন সংকীর্ণ ছিল না । ১৯৭৮ সালে এ মহান সাংবাদিক থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অবস্থিত জাতিসংঘের পরিবেশ কার্যক্রমের (এসকাপ) এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক পদে যোগ দেন । তিন বছর সেখানে সফলতার স্বাক্ষর রেখে ১৯৮০ সালের শেষ দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন । দেশে ফিরে তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন । ২০০৪ সালে তিনি কিছুদিন বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়াও নির্ভীক সাংবাদিক এবিএম মূসা জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং আজীবন সদস্য ছিলেন । তিনি চারবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও তিনবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ।

এবিএম মূসা ছন্দের জাদুতে লিখতে এবং যৌক্তিভাবে কথা বলায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন । মৃত্যুর পূর্ববর্তী বছরগুলোতে তিনি টেলিভিশন টক-শোতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল মানুষের গনতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কথা বলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন । সরকার এবং সরকারী দলের কর্মকান্ডের সমালোচনা করায় তাকে অনেক গঞ্জনার শিকার হতে হয় । কালজয়ী এ লেখক, সম্পাদক ‘মুজিব ভাই’ নামের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় বই রচনা করেন । এবিএম মূসার পছন্দের সাংবাদিকদের মধ্যে অতীতে হ্যারি ইভান্স এবং বর্তমানে গার্ডিয়ানের রবার্ট ফিস্ক ছিলেন শীর্ষে । সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় এবিএম মূসা শতাধিক পুরস্কার অর্জন করেছেন । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হয়েছে একুশে পদক (১৯৯৯), জেফারসন ফেলোশিপ (১৯৭০), কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়ন ফেলোশিপ (১৯৬১) প্রভৃতি । পারিবারিক জীবনে এবিএম মূসা তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক । স্ত্রী সেতারা মূসা এদেশের নারী সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ । এবিএম মূসা তার বৈপ্লবিক কর্মকান্ড এবং নির্ভীক সত্যের সৈনিক হিসেবে বাংলাদেশের তরুনদের মনের গভীর স্থান করে নিয়েছিলেন । তার এ স্থান তার অনুপস্থিতিতেও তার জীবদ্দশায় সম্পাদিত মহৎ কর্মের কারনে তার অনুসারীরা সারা জীবন ধারণ করবে ।

পেশার জগতে সাংবাদিকতা মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃত । সেই সাংবাদিকরা বিভিন্ন দলের অন্ধ সমর্থন করুক সেটা এবিএম মূসা কখানো চাইতেন না । কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে সাংবাদিকরা সত্যের প্রকাশ থেকে বিচ্যুত হবে এটা তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেনে নিতে পারেন নি । বাংলাদেশের জাতীয় প্রেস ক্লাব দু’টি ভাগে বিভক্ত । তার একটি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন অন্যটি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন । এ দুটি দলের একটি আওয়ামীলীগ এবং অন্যটি বিএনপি সমর্থিত সাংবাদিক সংগঠন । আজ থেকে ৭৯১ দিনে আগে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার পর প্রবীন সাংবাদিক এবিএম মূসা বারবার সাংবাদিকদেরকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন । তিনি মনে প্রাণে কামনা করতে একটি অভিন্ন সাংবাদিক সংস্থা । যেখানে কোন দলীয় ব্যানার থাকবে না । একজন সাংবাদিকের বিপদে সকল সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়বে । সত্যকে প্রকাশ করাই হবে সাংবাদিকদের ব্রত । কতিপয় সাংবাদিকদের হীনমন্নতা এবং স্বার্থহানীতার আশঙ্কায় এবিএম মূসার এ উদ্যোগ সফলতার মূখ দেখে নি । বিভিন্ন টকশোতে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা এবিএম মূসার জীবনের একটি অন্যতম লক্ষ ছিল তিনি একটি ব্যতিক্রমী স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল খুলবেন । নবম জাতীয় সংসদের বর্তমান সরকারের কাছে এ দাবী উত্থাপন করেও তিনি সরকারের মর্জি লাভ করতে সামর্থ হন নি ।

এবিএম মূসা তার জীবদ্দশায় সাংবাদিকতা পেশাকে একটি পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন । তিনি যেমনি এ পেশাকে অনেক কিছু দিয়েছেন তেমনি এ পেশাও তাকে অনেক উঁচু স্থানে আসীন করেছে । তার জীবনের অন্তিম ইচ্ছা দুটির দ্বীতয়টি পূরণ করার সুযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যদি আন্তরিক হয় এবং প্রকৃতপক্ষেই হৃদয় দিয়ে তাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে তবে প্রথম স্বপ্নটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব । যদি এটা করা যায় তাহলে এবিএম মূসার বিদেহী আত্মা যেমনি শান্তি পাবে তেমনি দেশব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতনও বন্ধ হবে । জাতি প্রকৃত সত্যকে জানতে পারবে । দেশ থেকে অন্যায় অপরাধ চিরতরে বিদায় হবে । আমরা তার প্রাপ্য সম্মান যথাযথ ভাবে শোধ করতে পারি নি তবে সাংবাদিকদের নমনীয়তায় যদি তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় তবে তার ঋণ কিছুটা হালকা হবে । অন্তিম শয়ানে এবিএম মূসা তার উত্তরাধিকারীদের কাছে আকুতি জানিয়েছেন, ‘মৃত্যুর পর যেন তার লাশ নিয়ে ব্যবসা না হয়’ । তার মত দেশের সর্বস্তরের মানুষও চায় তার লাশ নিয়ে যেন কোন প্রকার ব্যবসা না হয় । মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে অবশ্যই তার কর্মফল অনুযায়ী সর্বোচ্চ পুরুস্কারে ভূষিত করবেন এবং প্রাপ্য স্থানে আসীন করবেন । আমরা সকলেই মহান স্রষ্টার কাছে তার পরকালীন শান্তির জন্য দোয়া প্রার্থণা করি ।

রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।



বিষয়: বিবিধ

১০৬১ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

205520
১০ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ০৮:২২
মোহাম্মদ ওমর ফারুক ডেফোডিলস লিখেছেন :

হে প্রভু তাকে সকল গুনাহ ক্ষমা করে বেহেস্তে প্রবেশ করার তৌফিক দিন
১০ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০১:৩৪
154541
রাজু আহমেদ লিখেছেন : আমীন । খাস করে তার জন্য একটু দোয়া করবেন । আমার খুব প্রিয় লেখক ছিলেন ।
205604
১০ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১১:৪১
১০ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০১:৩৫
154543
রাজু আহমেদ লিখেছেন : আল্লাহ তায়ালা আপনার দোয়া কবুল করুন ।
205634
১০ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ১২:৩৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : এবিএম মুসা আজিবন অন্ধ ভাবেই আওয়ামি লিগ সমর্থক ছিলেন। কিন্তু সৎ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন প্রকৃত সাংবাদিক এবং ব্যাক্তিগত ভাবে পুর্নাঙ্গ সৎ।
১০ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০১:৩৬
154545
রাজু আহমেদ লিখেছেন : সে কোন দলের ছিল সেটা বড় কথা নয় । তিনি সত্য বলতে পেরেছেন কিনা সেটাই বড় । আমার কাছে তাকে সৎ ও নির্ভীক মনে হয়েছে ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File