স্বাধীনতা অর্জন করা সহজ কিন্তু রক্ষা করা কঠিন

লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ২৪ মার্চ, ২০১৪, ০৭:১৪:৩৪ সকাল

চলছে উত্তাল মার্চ । ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রত্যেকটি দিন ছিল বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রারম্ভের চরম উত্তেজনাকর দিন। পহেলা মার্চ থেকে ২৬ শে মার্চ পর্যন্ত প্রতিটি রাতে মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্ন দেখে ঘুমোতে যেত এবং ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে সে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকত । দেশের নেতার মুখ থেকে কখন ধ্বনিত হবে স্বাধীনতার অমোঘ বাণী । মূলত বাঙালীর হৃদয়ে স্বাধীনতার বীজ ১৯৭১ সলেই প্রথম রোপিত হয়নি । বাঙালীরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল ১৯৪৭ সালের আগষ্টে পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই । বৃটিশদের শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালীর তৎকালীন পরিচয় পূর্ব পাকিস্তানী হিসেবে যখন খোলা বাতাসে বুক ফুলিয়ে চলতে শুরু করবে তখনই পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে একের পর এক আঘাত পেতে শুরু করে । দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে যখন ক্লান্তি দূর করতে বিশ্রাম নেয়ার কথা ছিল সেই সময়ে আবারও নতুন করে পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরিকল্পনা করতে হয়েছিল । আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালীরা বুঝতে পেরেছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের পশু সূলভ আচরণকারী মানুষগুলোর সাথে বেশিদিন স্থায়ী হওয়া যাবে না । বৃটিশদের হিং¯্র থাবা থেকে পূর্ব পাকিস্তানীরা মুক্তি পেয়ে যখন ঘর গোছাতে ব্যস্ত তখনি আবার সে নড়বড়ে ঘরে হানা দেয় পশ্চিম পাকিস্তানীরা । একের পর এক অনৈতিক যুক্তি খাড়া করে পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাতে থাকে । ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই একটির পর একটি আঘাত হানতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানিদের অস্তিত্বের উপর । ধ্বংস করতে চায় পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালীদের । বাঙালীরা তাদের দেয়া একটির পর একটি আাঘাত সহ্য করতে থাকে । এভাবে আর কতকাল সহ্য করা যায় । অবশেষে পূর্ব পাকিস্তান জন্মের মাত্র ২৩ বছরের মাথায় ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ শুরু হয় বাঙালীর স্বাধীনাত সংগ্রামের মূল পালা এবং ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় ।

আজ আমাদের পরিচয় আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক । আমাদের এ স্বাধীনাত ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র নয় মাসে অর্জিত হলেও এ নয় মাসকে পেতে সহ্য করতে হয়েছে দীর্ঘ ২৩ বছরের বিভৎস হিং¯্রতার ইতিহাস । স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যে ৩০ লক্ষ শহীদ এবং ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জ্বত উৎসর্গ করতে হয়েছিল, তার চেয়ে কোন অংশে কম উৎসর্গ করতে হয়নি ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত । জেল, জরিমানা, নির্যাতন, ভোগান্তির কথা না হয় বাদ দিলাম । দীর্ঘ ২৩ বছরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলনের ফল ছিল আমাদের স্বাধীনতা । স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে স্বাধীনতা যোদ্ধাদের যত অবদান আছে তার চেয়ে কোন অংশে কম অবদান ছিল না এ দেশের নারী-বৃদ্ধদের । সাত কোটি মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে আমরা বিশ্ব মানচিত্রে পেয়েছে স্থায়ী আসন এবং বিশ্ব দরবারে পেয়েছি বাঙালী জাতীয়তার স্বীকৃতি ।

আগেই বলেছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমির খুবই মর্মান্তিক এবং দীর্ঘ । ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয় এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহের দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয় । হিন্দু অধ্যুষিত এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে দুই হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানীদের ইসলাম ধর্মীয় সংখ্যা গরিষ্ঠতার কারনে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে যোগ করে দেওয়া হয় । তৎকালীন সময়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আলাদা দু’ভূখন্ডের রাষ্ট্রকে প্রকৃত রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও ভারত এবং পাকিস্তানের নেতাদের পরামর্শে বৃটিশরা এভাবেই ভাগ করে দিয়ে যায় । ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে অবস্থিত এ দু’টি অংশের মানুষের কেবল মিল ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে । ১৯৪৭ সালের মধ্য আগষ্টের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের মানুষেরা পূর্ব পাকিস্তানী মানুষদের নানা ভাবে বঞ্চিত করে । এ ধারা অব্যহাত ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত । পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানীদের অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মত । পাকিস্তানের জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্ধ থাকত । দুই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের । এ সকল শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানীদের সাথে বিমাতা সূলভ আচরণ করতে থাকে । এ কারনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তান সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে । দু’ই পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ মানুষের মূখের ভাষা ছিল বাংলা অপরদিকে মাত্র ৬.০৭ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল উর্দু । কিন্তু পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা-ভাষী মানুষের অধিকারকে হরণ করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে । পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বিশেষ করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অন্যায় সিদ্ধান্তকে মেনে না নিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় । পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদের জোয়ার দেখে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা এবং এর আশ পাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে । পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পাকিস্তানের পুলিশ মিছিলরত ছাত্রদের উপর গুলি ও লাটি চালায় । এতে সালাম, বরকত, রফিকসহ কয়েকজ ছাত্র ঘটনা স্থলেই মারা যায় । দেশব্যাপী এ খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে । পরে অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবী মেনে নেয় এবং ১৯৫৬ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার পূর্ণ স্বীকৃতি দেয় । পাকিস্তানীদের দেয়া স্বীকৃতিও পূর্ব পাকিস্তানীদের মনের ক্ষত মোছাতে সক্ষম হয় না । পরবর্তীতে দেখা যায় বাংলাদেশের স্বাধীতা অর্জনের পিছনে ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে ।

চাকরির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানীদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় । বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে এ পার্থক্য ছিল অত্যন্ত মর্মস্পর্শী । পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে বাঙালীরা একেবারে অবহেলিত ছিল । সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন অংশে সমগ্র বাহিনীর মাত্র ৫ শতাংশ বাঙালী অফিসার ছিল যাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রযুক্তিগত বা ব্যবস্থাপনার পদে ছিলেন । খুব অল্প সংখ্যক বাঙালী অফিসার আদেশদানকারী পদ লাভের সুযোগ পেতেন । পশ্চিম পাকিস্তনীরা বিশ্বাস করত বাঙ্গালীরা পশতুন বা পাঞ্জাবীদের মত ‘সাহসী’ নয় । পাকিস্তানের বাজেটের একটি বড় অংশ সামরিক খাতে বরাদ্দ থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাররা এর সূফল সামন্যই পেত । জনসংখ্যার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গোটা পাকিস্তানের বৃহত্তর অংশ হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানীরা কুক্ষীগত করে রাখত । পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী শাসনের নামে ষড়যন্ত্র শুরু করে । যখনই পূর্ব পাকিস্তানের কোন নেতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুড়া, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) নির্বাচিত হত, তখনই কোন না কোন অজুহাতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাদেরকে পদচ্যুত করত । পূর্ব পাকস্তানীদের দাবিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সাল থেকে পরবর্তী ১১ বছর পাকিস্তানে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালায় । পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের এই অনৈতিক ক্ষমতা দখল পূর্ব পাকিস্তানের দূরত্ব বাড়িয়েই চলে । ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ভোলায় সৃষ্ট সাইক্লোন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে, সেই জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারায় । কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরেও জরুরি ত্রানকার্য পরিচালনায় গড়িমসি করে । তাদের উদাসীনতায় যারা ঘূর্নিঝড়ের পরেও বেঁচে ছিল তারাও মৃত্যু বরণ করে । এমনকি জেনারেল আইয়ুব খান হেলিকাপ্টারে বিপর্যস্ত এলাকা পরিদর্শণে আসলেও আসল ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা না দেখেই পাকিস্তান চলে যায় । ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর প্রতি পাকিস্তান সরকারের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে । পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চূড়ান্ত নাটকীয়তার মুখোমূখি হয় যখন ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দল পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে । দলটি পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসন বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, যা আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের অধিকার প্রদান করে । কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি এ নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত দল হলেও তিনি শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করার বিরোধীতা করে । জুলফিকার আলী পাকিস্তানের দুই প্রদেশে দুইজন প্রধানমন্ত্রী রাখার প্রস্তাব করেন । ‘এক ইউনিট কাঠামো’ নিয়ে ক্ষুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে এরকম অভিনব প্রস্তাব নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার করে । এমনকি শেখ মুজিবরের ছয় দফা দাবী মেনে নিতেও ভূট্টো অস্বীকৃতি জানায় । ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ দু’ই দলের নেতা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে নিয়ে দেশের ভাগ্য নির্ধারনে ঢাকায় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয় । এ বৈঠকে কোন ফলপ্রসু সিদ্ধান্ত না হওয়ায় শেখ মুজিবর রহমান সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দেন । দেশের পরবর্তী ভাগ্য নির্ধারন এবং দেশবাসীকে দিকনের্দশনা প্রদানপূর্বক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ১৯ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন । এই ভাষনে তিনি বাঙালী জাতীকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন এবং ২৫ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই তার দাবী মেনে নেয়ার জন্য পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকদের হুঁশিয়ার করে আল্টিমেটাম দেন । ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন,‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার এ ভাষণের মাধ্যমেই মূলতঃ বাঙালীর স্বাধীনতার জন্য রোপিত বীজের অঙ্কুরোধগম হয় ।

সারা দেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল, তখন ইয়াহিয়া খাঁন ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সাথে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করে । কিন্তু একই সাথে সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহন করতে থাকে । বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়, কিন্তু বাঙালী বিচারপতিরা তাকে শপথ বাক্য পাঠ করাতে রাজি হয় না । পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র আনা হতে থাকে । ১০ থেকে ১৩ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান এয়ারলাইন্স তাদের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তানে জরুরী ভিত্তিতে ‘সরকারী যাত্রী’ পরিবহণ করতে শুরু করে । এই ‘সরকারী যাত্রীর’ প্রায় সবাই ছিল সাদা পোশাকে পাকিস্তানের সামারিক বাহিনীর সদস্য । ‘এমভি সোয়াত’ নামে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে । এতসব আয়োজনের মধ্যে মুজিব-ইয়াহিয়ার আনুষ্ঠানিক বৈঠক চললেও তা সফল হয় না । পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষ থেকে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা । ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞের সবুজ সংকেত দিয়ে গোপনে সন্ধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে যাত্রা শুরু করেন । ২৫ শে মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে পরিকল্পনা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তা এশিয়া টাইমসে প্রকাশ করা হয় । সেখানে বলা হয়, ‘সামারিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করে “তিরিশ লক্ষ বাঙ্গালিকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে” । সে পরিকল্পনা মতোই ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানী আর্মি অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করে, যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গালির প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়া । এরই অংশ হিসেবে সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজ নিধন করা হয় এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়’ । এ হত্যাাকান্ডের খবর যাতে বর্হিবিশ্বে না পৌঁছতে পারে সেজন্য ২৫ মার্চের আগেই বিদেশী সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগে বাধ্য করা হয় । তবে সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে এবং ‘ওয়াশিংটন পোষ্টের’ মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে এই গণহত্যার খবর জানিয়ে দেয় । ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্য রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় । কথিত আছে, শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার কিছু পূর্বে রাত বারোটার পর অর্থ্যাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে স্বাক্ষর করেন ।

এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । ঘোষণাটি ছিল ইংরেজীতে, যার অনুবাদ হল, ‘‘আমি, মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমান্ডার-ইন চিফ, শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করছি । আমি আরও ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর.........” । ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে যা নয় মাস স্থায়ী হয় । ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহাকুমা (বর্তমান জেলার) বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগর) গ্রামে । এ অস্থায়ী সরকার ব্যবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠন করা হয় । তবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমেদ এর উপর । এ সরকারে অধীনেই বংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করে যুদ্ধ চলতে থাকে । আক্রমন পাল্টা আক্রমনের মধ্যে ধীরে ধীরে পাকিস্তানী বাহিনী দূর্বল হয়ে পড়ে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর চুড়ান্ত পরাজয়ের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয় ।

স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস শোকের ইতিহাস , হারানোর ইতিহাস এবং অর্জনের ইতিহাস । ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং ৭ কোটি মানুষের উপর চলা অমানুষিক নির্যাতনের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশ পেলাম সে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ হুমকির মূখে । রাজনৈতিক অস্থিরতা, আভ্যন্তরীণ চক্রান্ত এবং বিদেশী কিছু রাষ্ট্রের সূদুঢ় প্রসারী চক্রান্তের ফলে আজ আমাদের স্বাধীনতা, বাঙালী জাতীয়তা বিলীন হতে বসেছে । বর্হিবিশ্বের দেশগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে যতটুকু হুমকি হয়েছে তার চেয়ে দেশের আভ্যন্তরীণ চক্রান্তকারীরা দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার জন্য ওঠে পড়ে লেগেছে । দেশী বিদেশী জঙ্গি-গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত চোখ রাঙাচ্ছে আমাদের সবুজ শ্যামল প্রাকৃতির পাণে চেয়ে । রাজনৈতিক দলগুলোর তাদের দলীয় সার্থের ওপর এমনভাবে আসনাবদ্ধ হয়েছে যার কারনে দেশ গোল্লায় যেতে বসেছে অথচ তাদের সে হুঁশ নাই । এখন সময় এসেছে, স্বাধীনতার ৪৩ তম বর্ষের পূর্বক্ষণে দাঁড়িয়ে সকলেই শপথ করি. যে কোন মূল্যে দেশের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করব । কবি যেমন বলেছিলেন,

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি,

মোরা একটি মূখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি

যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা................।

কবি মনের এ আকুতি যেন সকলে জীবনের আকুতি হয় এবং এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই যেন আমরা আমাদের ভবিষ্যত জীবন গড়তে পারি ।

রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।



বিষয়: বিবিধ

১০৮৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

196926
২৪ মার্চ ২০১৪ সকাল ০৯:০০
হতভাগা লিখেছেন : একমত ।

তবে , বাংলাদেশ তো সেটা করছে না । বাংলাদেশ নিজেদেরকে পরনির্ভরশীল করে রাখছে ।

পরনির্ভরশীল স্বাধীনতা পরাধীনতার চেয়েও ভয়ংকর

কারণ, কোন দেশের অধীন হলে সে দেশ অন্তত তার দখলকৃত দেশের উন্নতির জন্য কিছু না কিছু করবে । বৃটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ দখল করলেও তারা কিছু কিছু ভাল কাজও করে গেছে ।

কিন্তু পরনির্ভরশীল স্বাধীনতাতে দেশটি যার উপর নির্ভরশীল থাকে সবসময়ই সেই দেশটির পানে চেয়ে থাকতে হয় নিজেদেরই ব্যাপারে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও ।বড় দেশটি সবসময়ই আগে নিজের স্বার্থ হাসিল করে নির্ভরশীল দেশটিকে দিয়ে , বিনিময়ে সামান্য কিছু দিতেও দুঃখপ্রকাশ করে ।

৩য় অন্য কোনদেশের ব্যাপারেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সেই প্রভুদেশের কাছে ক্লিয়ারেন্স নিতে হয় । ফলে বন্ধুহারা হয়ে যায় পরনির্ভরশীল দেশটি ।

ফলে পরনির্ভরশীল দেশটি তার প্রভূ দেশটির খামখেয়ালীর শিকার হয় সবসময়ই ।

তার নিজের সবকিছুই সে প্রভূ দেশটির জন্য বিলিয়ে দেয় । বিনিময়ে কিছুই পায় না , বরং দিনের পর দিন প্রভু দেশটি তাকে বিভিন্নভাবে শোষন করতে থাকে ।

পরাধীন থাকলে যে দেশটি কিছু না কিছু পেত দখলকারী দেশের কাছ থেকে , পরনির্ভরশীল থাকলে সেটাও পায় না ।


''মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি,........''

এই গানটি সম্ভবত আপেল মাহমুদেরই লিখা , সুর করা ও গাওয়া ।

এই গানটিকেই আমার স্বাধীনতার জন্য আসল গান মনে হয় । গানটি মনোযোগ দিয়ে শুনলে চোখে পানি চলে আসে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File