‘‘ওমা ! এ কোন আজব দেশে মোদের জন্ম দিলে’’
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ২০ মার্চ, ২০১৪, ০৭:০০:৫২ সকাল
‘‘শিক্ষক-মোরা শিক্ষক, মানুষের মোরা পরমাত্মীয়,ধরনীর মোরা দিক্ষক’’- কবি গোলাম মোস্তফার এ উক্তিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসয়ান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল আজিজের সাথে ওৎপ্রতো ভাবে মিশে গেছে । তবে সেটা ইতিবাচকভাবে নাকি নেতি-বাচকভাবে সে বিচার আরও পরে করব । গত ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৩ তম জন্মদিন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগ আয়োজিত ‘জাতীয় শিশু দিবসের’ আলোচনায় তিনি সরকারের কাছে একটি মহৎ ! দাবী উত্থাপণ করেছেন । তিনি সরকারের কাছে বিনীত আরজি জানিয়েছেন, সকল ছাত্রলীগ নেতাদেরকে চাকরি দিতে হবে । তিনি তার আলোচনায় বলেন, ছাত্রলীগ নেতাদের ‘রেজাল্টের প্রয়োজন নেই, তাদের গায়ে থাকা ক্ষত চিহ্নই তাদের বড় যোগ্যতা । তাদের আর কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নাই’ । তার এ উক্তি নিয়ে আলোচনা স্থলে হাসি ঠাট্টার উদ্রেক হয় । সরকারের মাননীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর অধ্যাপক আব্দুল আজিজের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন,‘ছাত্রলীগ অবশ্যই চাকরি পাবে তবে তা তা হতে হবে মেধার জোরে । অনুকম্পা বা করুনার জোড়ে নয়’ । মাননীয় সংস্কৃতি মন্ত্রীর এ নৈতিক প্রতিবাদের জন্য তাকে দেশের সকল ছাত্রদের পক্ষথেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যিনি জাতির বিবেকখ্যাত একজন শিক্ষকের এ বক্তব্য কোন উদ্দেশ্যে ছিল তা আমার কাছে স্পষ্ট নয় । যদি শিক্ষকের মন্তব্যটি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগের নেতাদের ব্যাপারে হয় তবে কিছুই বলার নেই, কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ছাত্র হওয়ার সুযোগ পায় তারা দেশের সর্বোচ্চ ভাল ছাত্রের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত । ছোট হোক বড় হোক তারা চাকরি পাবেই । দল করার কারনে তাদের পড়াশুনায় একটু ব্যাঘাত হওয়া অস্বাভাবিক নয় । তাই দেখা যায়, যারা ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত তাদের রেজাল্ট অন্যান্য ছাত্রদের তুলনায় বেশ শোচনীয় । কিন্তু অধ্যাপক আব্দুল আজিজের এ মন্তব্যটি সারা বাংলাদেশের ছাত্রলীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে হয় তবে রাজনীতি বিমূখ শিক্ষার্থীদের আবারও মাঠে নামতে হবে। বাংলাদেশে প্রতিবছর যতগুলো চাকরির পদশূন্য হয় তার চেয়ে প্রতিবছর কয়েকগুন বেশি ছাত্রলীগের নেতা পাশ করে বের হয়। যদি এদের সবাইকে চাকরি দিতে হয় তবে অধ্যাপক ড. আব্দুল আজিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীলদলের আহ্বায়ক হলেও তাকে অচিরেই তার পদ ছেড়ে ছাত্রলীগ নেতাদের সেখানে সুযোগ দেয়া বুদ্ধি মানের কাজ হবে । তিনি তার আলোচনায় আরও বলেছেন, তিনি একজন ছাত্রলীগ নেতার জন্য চাকরির সুপারিশ করতে একজন মন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন কিন্তু যখন প্রত্যেক ক্লাশে থার্ড ক্লাস দেখে মন্ত্রী মহোদয় তাকে চাকরির প্রদানে অস্বীকৃতি জানায় তখন অধ্যাপক মহোদয় ছাত্রকে নির্দেশ দেন তার শার্ট খুলে পিছের দাগগুলো মন্ত্রী মহোদয়কে দেখাতে । অধ্যাপক আব্দুল আজিজের এহেন কথার পিঠে জাতি যদি তাকে প্রশ্ন করে, আপনাদের কাজ শিক্ষা দেয়া । একজন ছাত্রকে প্রকৃতি শিক্ষা দিয়ে আপনারা ছেড়ে দিলে ছাত্রটি তার যোগ্যতায় চাকরি পাবেই । কিন্তু তিনি ছাত্রটিকে সে শিক্ষা না দিয়ে কোন স্বার্থে, কোন মানসিকতায় ছাত্রের চাকরির জন্য সুপারিশ করতে গেলেন ? কিংবা ছাত্ররাজনীতি করলে পিঠে দাগ পড়বে কেন ? ক্ষত হবে কেন ? রাজনীতি যদি ক্ষত এবং দাগের সৃষ্টি করে সে রাজনীতির ভবিষ্যত কি ? তাহলে যে সকল ছাত্ররা রাজনীতি বিমূখ আছে তারাই কি তবে ভাল আছে ? তাদের একদিকে অর্জন করছে প্রকৃত শিক্ষা অপরদিকে পিঠে কোন দাগ বা ক্ষতের কারনে বাব-মাকেও টেনশনে থাকতে হচ্ছে না ।
বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে আনুমানিক পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী আছে । এদের মধ্যে এক পঞ্চমাংশও রাজনীতির সাথে জড়িত নয় । বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমান শিক্ষার্থীরা পাশ করে চাকরির খোঁজে বের হয় তার তুলনায় চাকরির কোঠা খালি হয় মাত্র কয়েকটি । সরকারী-বেসরকারি খাতে চাকরির শুন্য কোঠা পূর্ণ হওয়ার পরেও লাখ লাখ ছাত্র বেকার থেকে যায় । এরপরে একজন আদর্শবান শিক্ষক যদি মেধার মূল্যায়ণ না করে ঢালাওভাবে সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠনের নেতাদের চাকরি দিতে বলে তবে জাতি সেটার সমালোচনা করবে নাকি ঠাট্টা করবে তার দিশা হারিয়ে ফেলে । তবে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষগুলো বুদ্ধিমান হওয়ার কারনে জাতির শিক্ষিত সন্তানদের এমন উক্তিকে কৌতুক হিসেবে গ্রহন করে একটু মজা করে । একজন শিক্ষকের এ হেন দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি উদাসীন শিক্ষার্থীদেরকে যেমন রাজনীতির দিকে টেনে রাজনীতির ময়দানকে উত্তপ্ত করে তুলবে তেমনি পড়–য়া শিক্ষার্থীদেরকে হতাশায় নিমজ্জিত করবে ।
বাংলাদেশে ক্ষমতার মসনদকে ঘুরে ফিরে দু’টো দলই দখল করে । এর একটি আওয়ামীলীগ যারা এখন সরকারে আছে অন্যটি বিএনপি যারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রনহন না করায় অনেকটা ঘরকুনো স্বভাবে আছে । এছাড়া জাতীয় পার্টি সংসদে বর্তমানে বিরোধীদলের দায়িত্ব পালন করলেও জাতীর কাছে তাদের তেমন কোন অস্তিত্ব নাই যা চলমান উপজেল নির্বাচনের ফলাফলে জাতি বেশ ভালোভাবেই দেখিয়ে দিচ্ছে । আওয়ামীলীগের সাথে জোট বদ্ধ আছে দেশের সম্ভাবনাময়ী কয়েকটি ছোট দল তেমনি ভাবে বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ আছে দেশের ১৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল যাতে রয়েছে জামা’আতে ইসলামীর মত শক্তিশালী দল । আওয়ামীপন্থি শিক্ষকের মত গ্রহন করে যদি আওয়ামীলীগ সরকার শুধু তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাদেরকে চাকরি দেয় তাহলে তাদের সংগঠেেনর কর্মীরা বিদ্রোহী হবে এবং আওয়ামীলীগের অন্যান্য শরীকদলগুলো তাদের সংঘ ছেড়ে পালাবে । আর যদি সেটা হয় তবে আওয়ামীলীগ অনেকটা অসহায় হয়ে পরবে । অন্যদিকে বিএনপি যদি তাদের জোট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারে আর যদি বিএনপিপন্থি কোন শিক্ষক অধ্যাপক আব্দূল আজীজের মত ছাত্রদলের নেতাদের পক্ষে সুপারিশ করে বসে এবং বিএনপির নেতারা সেপথে হাঁটেন তাহলে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের কর্মীরা, জামা’আতে ইসলামীর ছাত্র সংঘঠন ইসলামী ছাত্র শিবির এবং জোটবদ্ধ অন্যান্য দলের ছাত্র সংগঠনগুলোও বিএনপির সংঘ ছেড়ে পালাবে । সুতরাং আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির নেতারা এখনও আব্দুল আজিজের মত মানসিক ভারসাম্যহীন হয়নি, যাতে কেউ কিছু বললেই সেটা ঝটপট করতে হবে ।
ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে বাংলাদেশের অনেকেই দিয়েছেন । তবে ছাত্ররাজনীতিকে একেবারে নিষিদ্ধ করার উপায় নেই । তাহলে বাংলাদেশেকে আগামী দিনে নেতৃত্ব দেয়ার মত কোন দক্ষ নেতা জন্মাবে না । বর্তমান সময়ে যারা আওয়ামীীলীগের উচ্চ পর্যায়ে অথবা বিএনপির উচ্চ পর্যায়ে নেতৃত্বদানকারী হিসেবে আছেন তাদের অনেকেই ছাত্র জীবনে তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন । ছাত্রজীবনে রাজনীতি করার কারনে তারা যে দক্ষতা অর্জন করেছেন সে দক্ষতার আলোকেই তারা আজকে দেশকে সুষ্ঠুভাবে নেতৃত্ব দিতে পারছেন । তবে দেশের সব ছাত্রকে যে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত থাকতে হবে এটা ভাবা উচিত নয় । কোন ছাত্র রাজনীতি করুক কিংবা রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকুক তাকে অবশ্যই প্রকৃত শিক্ষাটুকু ছাত্রজীবনেই অর্জন করতে হবে । একজন ছাত্রের মূখ্য গুন হল শিক্ষা অর্জন । ছাত্রজীবনে শিক্ষা অর্জনের পরে যে যতগুলো গুন অর্জন করতে পারবে সেটা তার জন্য গৌণ । সুতরাং মূখ্য গুন বিচ্যুত হলে যেমন প্রতি পদে পদে লাঞ্ছিত হতে হয় তেমনি নিজের অতীতেকৃত ভূলের জন্য হয় আফসোস । একজন শিক্ষার্থী যখন ছাত্রজীবন সমাপ্তির পর তার কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয় তখন সে জীবিকার তাগিদে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে । তার এ ভিন্ন পথই সমাজকে উত্তপ্ত করে তোলে এবং ধ্বংসের মুখোমূখি দাঁড় করায় ।
কবি গোলাম মোস্তফার কবিতার পংক্তিদ্বয় যদি অধ্যাপক আব্দুল আজিজ সাহেব ইতিবাচকভাবে নিয়ে সরকারের কাছে ছাত্রলীগের পক্ষে ওকালতি করেন তবে দেশকে উদ্দেশ্য করে বলতে হবে, ‘মা ! ওমা ! তুমি মোরে এ কোন আজব দেশে জন্ম দিলে’ । যে দেশের মানুষ গড়ার হাতিয়ার মানুষকে অমানুষ বানাতে চায় । আর যদি নেতি-বাচকভাবে অন্যমনস্কভ হয়ে তার আদর্শ হারিয়ে আনন্দের আতিশয্যে বলে ফেলেন, তবে রাজনীতি বিমূখ ছাত্রদের পক্ষ হয়ে তাকে ছাত্রদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলার মত বেয়াদবি করব না তবে ভবিষ্যতে যাতে তিনি এরকম উক্তি করে দেশবাসীর কাছে হাসি ঠাট্টার পাত্র না হন সেজন্য বিনীত অনুরোধ করব । আমাদের একজন শিক্ষককে কেউ খোঁটা দিলে সেটা আমাদের আত্ম সম্মানে লাগে । সুতরাং নিজের জন্য না হোক দেশের ৫ কোটি শিক্ষার্থীর অভিভাবক হিসেবে যথেষ্ট দায়িত্বশীল হতে হবে । যাতে গোলাম মোস্তফার মতই ছাত্রদের উপর অভিভাকত্বের দাবী করে এদেশের প্রতিটি শিক্ষক বলতে পারেন,‘পিতা গড়ে শুধু শরীর, মোরা গড়ি তার মন, পিতা বড় কিবা শিক্ষক বড়-বলিবে সে কোন জন’ ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক
বিষয়: রাজনীতি
১০৬৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন