ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ও আমাদের শিক্ষা
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০২ মার্চ, ২০১৪, ১১:১৭:২৫ সকাল
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকাস্থ রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) মাত্র ১৯ মিনিট স্থায়ী একটি ভাষণে ৭কোটি বাঙালির স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহা চাঙ্গা করে দিয়েছিল । দুনিয়া কাঁপানো ভাষণগুলির মধ্যে অন্যতম এ ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিদেরে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন । বাঙালী জাতির স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ’৭১ সালের ২৬শে মার্চ দেয়া হলেও মূলত ৭ই মার্চের ভাষণই ছিল স্বাধীনতার বীজ বপনের দিন । ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তান জন্মের পর থেকে পূর্ব-পাকিস্তানীরা ক্ষণে ক্ষণে যে স্বাধীনতার স্বপ্নের জাল বুনেছিল সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন যে অবশ্যম্ভাবী সেটা স্পষ্ট হয়েছিল ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কথার গাঁথুনিতে । বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত সে বক্তৃতার হাত ধরেই এ বঙ্গের ৭কোটি মানুষ ছিনিয়ে এনেছিল কাঙ্খিত বিজয় । বঙ্গবন্ধুর সে বক্তৃতাটির গুরুত্ব স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়েই বিলীন হয়ে যায়নি বরং তাতে বর্তমান বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালীর চলার পথের দিক-নির্দেশনা, অনুপ্রেরণা আজও চির অমলীন হয়ে আছে ।
৭ই মার্চের ভাষণের পেক্ষাপট ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ় প্রসারী । মূলত পশ্চিম পাকিস্তানীদের পাষন্ড আচরনের প্রতিবাদ এবং বাঙালির মুক্তির পথ দেখানো ছিল এ ভাষণের মূল উপজীব্য । ’৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও সামরিক শাসক ইয়াহইয়া খান নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মুসলিমলীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে টালবাহানা শুরু করে । শুধু ক্ষমতা হস্তান্তারই নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানীদের এ রকম অনেকগুলো অন্যায় কাজের প্রতিবাদের কঠোর প্রকাশই ফূটে উঠেছিল ৭ই মার্চের ভাষণে । এ ভাষনে-বাংলাদেশ কোন আদর্শে জন্মাবে, যুদ্ধ কোন পরিকল্পনায় হবে, বাঙালীরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের কোন উপায়ে প্রতিহত করবে, প্রতিরোধের ধরণ এবং শিক্ষা কেমন হবে তার পূর্ণাঙ্গ ছক চিত্রিত হয় । বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও পূর্ব-পাকিস্তানের ভবিষ্যত নির্ধারন করতে কোন অংশ বাদ রাখেননি । বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের শুরুতেই উপস্থিত কোটি জনসমুদ্রকে ‘প্রিয় ভাইয়েরা’ সম্বোধন করে আপন করে নেন । মাত্র ১৯ মিনিট স্থায়ী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন । একই সাথে মুসলিমলীগের প্রধান হিসেবে তার নিজের ভূমিকা ও অবস্থান স্পষ্ট করেন । ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন ও তার ফলাফল এবং পাকিস্তানী রাজনীতিকদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের উপর একটি নতিদীর্ঘ আলোচনা করেন । সামরিক শাসক ইয়াহইয়া খানের কাছে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং পূর্ব-পাকিস্তানীদের উপর চালানো অত্যাচার এবং সামরিক আগ্রাসন বন্ধের আহ্বান জানান । বঙ্গবন্ধু হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, যদি এ দাবী মেনে নেওয়া না হয় তবে সামগ্রিকভাবে অন্যায়ের মোকাবেলা করা হবে এবং দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল চালিয়ে যাওয়া হবে ।
বঙ্গবন্ধু-এই সর্বজন স্বীকৃত নামটা শুনলেই সবার হৃদয়ের মনি কোঠায় জেগে ওঠে বিনয়াবনত শ্রদ্ধা । যেন সবাই অন্তর চক্ষু দ্বারা দেখতে পাচ্ছে, তর্জনী উঁচু করে আজও বজ্র কন্ঠে ঘোষণা করছেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” । বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ আজও শ্রবন করলে রক্তের অনুরণন ঘটে । যতবার শুনি ততবার ঘটে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে আমাদের শিখিয়েছিলেন সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা । দিয়েছিলেন ন্যায়ের পক্ষে জান বাজি রাখার প্রেরণা । তিনি বলেছিলেন, “যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব” । বিশ্বের সকল বাঙালীকে তার অমোঘ ঘোষণার মাধ্যমে শিখিয়েছিলেন কিভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং সেটাকে প্রতিহত করতে হবে । বঙ্গবন্ধু তার বজ্রকেন্ঠে স্বর তুলে বলেছিল, “আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে, তা দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করত হবে” ।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে জাতির জন্য শিক্ষা ছিল কিভাবে শত্রুদের মোকাবেলা করতে হবে । তিনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন শুধু মরনাস্ত্র দিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করা যায় না । শত্রুকে পরাজিত করার জন্য চাই অনেক কলা-কৌশল । তাইতো স্বাধীনতার স্থপতি বলেছিলেন, “আমরা তাদেরকে ভাতে মারবো, পানিতে মারব” । বঙ্গবন্ধুর বাতলে দেয়া সে কৌশল পালন করেই আমরা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছিলাম । ’৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাঙালী স্বাধীনতা যোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে বঙ্গবন্ধুর শেখানো অনেক কৌশল প্রয়োগ করেছিল । তাইতো ৯মাস দীর্ঘকালব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে আমরা পাকিস্তানী বাহিনীকে খাদ্য কষ্ট দিয়েছি । এদেশের বিভিন্ন খাল, বিল ও নদীতে চুবিয়ে চুবিয়ে মেরেছি । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণের একেবারে শেষদিকে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন, যেন বন্ধুর বেশে শত্রু আমাদের অন্দরে প্রবেশ করে আমাদের ক্ষতি করতে না পারে । সেজন্যই স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, “শোনেন, মনে রাখবেন, শত্রুবাহীনি ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে” ।
বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে জঘন্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে সংখ্যালগুদের উপর নির্যাতন । দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতীর খড়া চলছে অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রক্ষার উপর খুব গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী-নন বাঙালী যারা আছে- তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনার উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়” । ৪৩ বছর আগে অর্জিত স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে বঙ্গবন্ধুর যে দর্শন মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল তার সে দর্শন আজও আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল পরিমন্ডলে অবশ্যপালনীয় । বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সব-ডিভিশনে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক ! মনে রাখবা ! রক্ত যখন দিয়েছি আরও দেব, এদেশের মানুষকে মক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ ! এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ! জয় বাংলা !!” ।
যে বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে স্বাধীনতার লাভের স্বপ্ন বুনতে সাহায্য করেছিল, অর্জন করে দিয়েছিল অমূল্য স্বাধীনতা, সেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শুরু হয়েছে চরম দলীয়করণ অথচ বঙ্গবন্ধু কোন দলের, ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তি নন । তিনি সবার । প্রকৃত বিচারে ৭ই মার্চের ভাষণের হত ধরেই আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতা, একটি স্বাধীন ভূখন্ড-বাংলাদেশ । আমরা বঙ্গবন্ধুকে তার যথার্থ সম্মানের স্থানে আসীন করতে পারিনি কারন এর পিছনে ষড়যন্ত্র করছে রাজনীতির জঘন্য মানসিকতা । সেকারনে আমরা প্রায় সময়েই বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রাখি অথচ বিশ্ববাসী তাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করতে একটুও ভুল করেনি । তার ৭ই মার্চের ভাষনটি স্থান পেয়েছে দুনিয়া কাঁপানো ভাষনগুলোর শীর্ষের দিকে । এমনকি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আজও পৃথীবির কোন মহান নেতা সংক্ষিপ্ত সময়ে এত তাৎপর্যমন্ডিত ভাষণ দিতে পারেন নি । রাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা ইউএসবি (USB) বঙ্গবন্ধুকে `World political poet’ বা বিশ্ব রাজনীতির কবি উপাধীতে ভূষিত করেছে । সুতরাং ৭ই মার্চের ভাষণের প্রেরণায় উজ্জীবীত হোক গোটা দেশ, সমগ্র বাঙালী সমাজ । স্বাধীনতা অর্জনের মানসে উৎসর্গিত তিরিশ লাখ শহীদের বুকের তাজা খুন এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম যেন বৃথা না যায় । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মানে স্বাধীনদেশের ১৬কোটি মানুষ যেন হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারি, এই হোক ২০১৪ সালের ৭ই মার্চের প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের শিক্ষা এবং আমাদের শপথ ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
বিষয়: রাজনীতি
১১৪৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন