‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস : বাঙালী ও মুসলমানদের সংস্কৃতি নয়’

লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৭:২৭:১৮ সকাল

বিশ্ব ভালবাসা দিবস একেবারেই অত্যাসন্ন । বিশ্বব্যাপী চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি, কিভাবে বরণ করা যায় ২০১৪ সালের ১৪ই ফ্রেব্রুয়ারীর বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে । সেক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই । তরুন-তরুনীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের সমারোহ । কতসব বিচিত্র আয়োজন হবে এইদিনে । দিন-রাতভর চলবে আয়োজনের জলকানী । বিশ্বায়ণের সূত্রে পাওয়া এ পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের জন্য কতটা মানানসই একবারও কি তা ভেবে দেখেছি ? বাঙালী জাতি হিসেবে আমাদের আছে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি । অথচ আমরা আমাদের সংস্কৃতির খোঁজ-খবর তেমনভাবে রাখি না । বাঙালীদের ৩৬৫ দিন ভালবাসার । অথচ একটি বিশেষ দিনকে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে বাকীদিনগুলোক ভালবাসাহীন করে চালাতে চাইছি । সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে যে ভালবাসা চিরন্তনভাবে চলে আসছে মাঝপথে এসে সে ভালবাসায় বাধার সৃষ্টি করে ভালবাসাকেও করে ফেলছি সংকীর্ণ । ভালবাসা দিবসের সময় আসলে আমরা হিতাহীত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকি উম্মাদের মত । অথচ একবারও গভীরভাবে খোঁজ নিয়ে জানতে চাই না ভালবাসা দিবস উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস । মনে প্রশ্ন জাগে না, কোন কারনে আমরা বিশেষ একটি দিনের খাঁচায় বন্দি করে ফেলছি মুক্ত ভালাবাসাকে । শুধুমাত্র নিষিদ্ধ যৌবন কামনার তাড়নায় আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে আমাদের বিবেককে । ভালবাসা দিবস বলতেই তরুন-তরুনীরা হুঁশ হারিয়ে উম্মাদনায় মাতছে । যে সকল দেশ থেকে ভালবাসা একেবারেই পরবাসী হয়েছে সে সকল দেশের মানুষ ভালবাসা দিবস পালন করে কিছুটা লাভবান হলেও বাংলাদেশের মত একটি আদর্শিক ইসলামিক দেশে ভালবাসা দিবস পালনের নামে যা হয় তা আদৌ কাম্য নয়, নয় গ্রহনযোগ্যও । যে দেশের মানুষের জীবনের সকল পরতে-পরতে ভালবাসায় ভরপুর তারা নির্দিশ্ট একটি দিন কেন্দ্রিক ভালবাসাকে পুঁঞ্জিভূত করে ফেলবে, এটা কখনো হবার নয়, মানার নয় । বিশেষত আমরা যে ইতিহাসগুলোকে স্মরণ করার মানসে ভালবাসা দিবসকে পালন করি সেসকল ঘটনাগুলোতে প্রকৃত ভালবাসার ছিটেফোঁটাও ছিল কিনা তা নিয়ে আছে গুরুতর প্রশ্ন ।

ভালবাসা দিবস কী ?

পশ্চিমা দেশগুলোতে ১৪ই ফ্রেব্রুয়ারীকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বলা হয় । বছরের ৩৬৫ থেকে মাত্র একটি দিন ও রাত প্রেম সরোবরে ডুব দেয়া, সাঁতার কাটা, চরিত্রের নৈতিক ভূষণ খুলে প্রেম সরোবরের সলিলে হারিয়ে যাওয়ার দিবস হচ্ছে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বা ‘ভালবাসা দিবস’ । এ দিনটিকে ‘লাভ ডে’ অথবা ‘লাভার্স ফেস্টিভ্যাল’ বলা হয় না । অথচ আমাদের দেশে ‘সেন্ট ভালেন্টাইন্স ডে’ এর অনুবাদ করে বলা হচ্ছে ‘ভালবাসা দিবস’ । এরুপ অনুবাদের কারনে এদেশের সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে । ভালবাসা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শব্দ ।মূল শব্দের অনুবাদ বিকৃত করে ‘ভালবাস দিবস’ বলায় এটা যে ভিন্ন দেশ ও ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এসেছে সেটা সহজে বুঝা যাচ্ছে না । বাংলাদেশেরর মত অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ তার নিজ নামের পরিবর্তে অনুবাদের ছদ্মবরণে প্রবেশ করছে । ফলে এ দিবসের প্রকৃত অর্থ, উৎপত্তির কারণ ও ইতিহাস অনেকের কাছেই অজানা থেকে যাচ্ছে । অনেকটা হুজুগের বশবর্তী হয়ে বিজাতীয় ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতি-নীতিতে লালিত ও পরিপুষ্ট একটি ধর্মীয় উৎসবের দিনকে এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী বিশেষকরে তরুন-তরুনীরা নিজেদের একটি অন্যতম উৎসবের দিন হিসেবে গ্রহন করছে ।

‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর আসল পরিচয় :

‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’(Saint Valentine’s Day)এর প্রথম শব্দটিই এ দিনটির আসল পরিচয়ের জানান দেয় ।

Advanced Oxford Learners’ Dictionary তে Saint শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে : A person declared to be holy by the Christian Church because of her/his qualities or good works.

অর্থ্যাৎ, এমন ব্যক্তি, খৃষ্টান গীর্জা কর্তৃক যাকে তার গুনাবলী বা ভাল কাজের জন্য পবিত্র সত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয । আর Valentine শব্দের অর্থ ভালবাসা নয় । Valentine মূলত একজন ব্যক্তির নাম । খ্রীষ্ট ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করার কারনে যাকে গীর্জা কর্তৃক Saint (পবিত্র সত্তা) ঘোষণা দেয়া হয়েছিল । সুতরাং সহজেই বুঝা যায়, গীর্জা কর্তৃক ‘পবিত্র সত্তা’ হিসেবে ঘোষিত একজন ধর্মযাযকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এ দিনটি উদযাপনের মূল কারণ ।

ইতিহাসে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ :

‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর ইতিহাস অতি প্রাচীন । এর উৎস হচ্ছে আজ থেকে প্রায় ১৭শ’ বছর আগের পৌত্তলিক রোমকদের মাঝে প্রচলিত ‘আধ্যাত্মিক ভালবাসা’র উৎসব । এ পৌত্তলিক উৎসবের সাথে কিছু কল্পকাহিনী জড়িত ছিল, যা পরবর্তীতে রোমীয় খৃষ্টানদের মাঝে প্রচলিত হয । এ সমস্ত কল্প-কাহিনীর অন্যতম হচ্ছে, এ্ দিনে পৌত্তলিক (অগ্নি উপাসক) রোমের পৌরণিক কাহিনীতে বর্ণিত রোমিউলাস নামক জনৈক ব্যক্তি একদা নেকড়ের দুধ পান করায় অসীম শক্তি ও জ্ঞানের অধিকারী হয়ে প্রাচীন রোমরে প্রাচীন রোমের প্রতিষ্ঠা করেন । পৌরাণিক এক কাহিনীকে কেন্দ্র করে ১৫ই ফ্রেবুয়ারী একটি জমকালো উৎসব পালন করত রোমানরা । এ দিনে যে সকল বিচিত্র অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করা হত তার মধ্যে অন্যতম ছিল, দু’জন শক্তিশালী পেশীবহুল যুবক গায়ে কুকুর ও ভেড়ার রক্ত মাখত । অত:পর দুখ দিয়ে সেসকল রক্ত ধুয়ে ফেলার পর এ দু’জন লোককে সামনে বের করা হত দীর্ঘ পদযাত্রা । এ দু’যুবকের হাতে চাবুক থাকত, যা দিয়ে তারা পদযাত্রার সামনে দিয়ে অতিক্রমকারীকে আঘাত করত । রোমান মহিলাদের মাঝে কুসংস্কার ছিল যে, তারা যদি চাবুকের আঘাত গ্রহন করে, তবে তারা বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি পাবে । এ উদ্দেশ্যে মহিলারা পদযাত্রার সামনে দিয়ে যাতায়াত করত ।

রোমকরা খৃষ্টধর্ম গ্রহনের পরও এ উৎসব উদযাপনকে অব্যাহত রাখে । তবে পৌত্তলিকতার খোলস পাল্টে তার এ উৎসবকে ভিন্ন এক ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট করে । সেটা হচ্ছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক জনৈক খৃষ্টান সন্ন্যাসির জীবনোৎসর্গ করার ঘটনা । ইতিহাসে এরকম দু’জন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনেরর কাহীনির সন্ধান পাওয়া যায় । এদের একজন সম্পর্কে দাবী করা হয়, তিনি শান্তি ও প্রেমের বানী প্রচারের ব্রত নিয়ে জীবন দিয়েছিলেন । তাদের স্মরনে খৃষ্টনরা তাদের উৎসবকে অব্যাহত রাখে । সময়ের আবর্তে ‘আধ্যাত্মিক ভালবাসার’ উৎসব রুপান্তরিত হয় জৈবিক কামনা ও যৌনতার উৎসবে । তবে এ উৎসব খৃষ্টধর্মের প্রাণকেন্দ্র ইতালীতে নিষিদ্ধ করা হয় । কিন্তু আঠারো ও উনিশ শতকে তা পুনরায় চালু হয ।

ক্যাথলিক বিশ্বকোষে ভ্যালেন্টাইন ডে সম্পর্কে তিনটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় । তবে বিভিন্ন বইয়ে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা উদ্ধৃত হয়েছে । সেগুলো থেকে প্রসিদ্ধ কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হল :

প্রথম বর্ণনা : রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস এর আমলে ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন শিশু-প্রেমিক, সামাজিক ও সদালাপী এবং খৃষ্ট ধর্ম প্রচারক । অপরদিকে রোম সম্রাট ছিলেন দেব দেবীর পূজায় বিশ্বাসী । সাম্রাটের তরফ থেকে দেব-দেবীর পূজা করতে বলা হলে ভ্যালেন্টাইন তা প্রত্যাখান করে । ফলে ভ্যালেন্টাইনকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং ২৭০ খৃষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রীয় আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগে সম্রাট ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে ।

দ্বিতীয় বর্ণনা : সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কারারুদ্ধ হওয়ার পর প্রেমাসক্ত যুবক-যুবতীরা অনেকেই প্রতিদিন তাকে কারাগারে দেখতে আসত এবং ফূল উপহার দিত । আগন্তুকরা বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক কথা বলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে উদ্দীপ্ত রাখত । জনৈক কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনের সাথে প্রত্যহ সাক্ষাৎ করতে আসত । অনেক্ষণ ধরে তারা দু’জন প্রাণ খুলে কথা বলত । এক সময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যায় । সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকৎসায় অন্ধ মেয়েটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায় । ভ্যালেন্টাইনের সাথে সম্রাটের মেয়ের সম্পর্ক এবং ভ্যালেন্টাইনের প্রতি দেশের যুবক-যুবতীদের ভালবাসার কথা সম্রাটের কানে যায় । এতে সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন । তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল ২৬৯ খৃষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারী ।

তৃতীয় বর্ণনা : সমস্ত ইউরোপে যখন খৃষ্টান ধর্মের জয়-জয়কার তখনও বড় আয়োজন করে পালিত হত রোমীয় একটি রীতি । মধ্য ফেব্রুয়ারীতে গ্রামের সকল যুবকেরা সমস্ত্ মেয়েদের নাম চিরকুট তুলত, যার হাত যে মেয়ের নাম উঠত, সে পূর্ণবৎসর ঐ মেয়ের প্রেমে মগ্ন থাকত । আর তাকে চিঠি লিখতে এ বলে যে, ‘প্রতিমা মাতার নামে তোমায় প্রেরণ করছি’। বৎসর সমাপান্তে এ সম্পর্ক নবায়ন বা পরিবর্তন করা হত । এ রীতিটি কতক পাদ্রীর গোচরীভূত হলে তারা একে সমূলে উৎপাটন করা অসম্ভব ভেবে শুধু নাম পাল্টে দিয়ে একে খৃষ্টান ধর্মায়ণ করে দেয় এবং ঘোষণা করে এখন থেকে এ পত্রগুলো ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’ এর নামে প্রেরণ করতে হবে । কারন এটা খৃষ্টান নির্দশন, যাতে কালক্রমে এটা খৃষ্টান ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায় ।

চতুর্থ বর্ণনা : প্রাচীন রোমে দেবতাদের রাণী জুনো (Junno)’র সম্মানে ১৪ই ফেব্রুয়ারী ছুটি পালন করা হত । রোমানরা বিশ্বাস করত যে, জুনোর ইশার-ইঙ্গিত ছাড়া কোন বিয়ে সফল হয় না । ছুটির পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারী লুপারকালিয়া ভোজ উৎসবে হাজারো তরুনের মেলায় র‌্যাফেল ড্র্র’র মাধ্যমে সঙ্গী বাছাই পক্রিয়া চলত । এ উৎসবে উপস্থিত তরুনীরা তাদের নামাঙ্কিত কাগজের সিপ জনসম্মুখে রাখা একটি বড় পাত্রে ফেলত । সেখান থেকে যুবকের তোলা সিপের তরুণীকে কাছে ডেকে নিত । কথনও এ জুটি সারা বছরের জন্য স্থায়ী হত এবং ভালবাসার সিঁড়ি বেয়ে বিয়েতে পরিনতি ঘটত ।

পঞ্চম বর্ণনা : রোমানদের বিশ্বাসে ব্যবসা, সাহিত্য, পরিকল্পনা ও দস্যুদের প্রভু ‘আতারিত এবং রোমানদের সবচেয়ে বড় প্রভূ ‘জুয়াইবেতার’ সম্পর্কে ভ্যালেনটাইনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল । সে উত্তরে বলে, এগুলো সব মানব রচিত প্রভু, প্রকৃত প্রভু হচ্ছে ‘ঈসা মসীহ’ । এ কারণে তাকে ১৪ই ফ্রেব্রুয়ারীতে হত্যা করা হয় ।

ষষ্ঠ বর্ণনা : কথিত আছে, খৃষ্টধর্মের প্রথম দিকে রোমের কোন এক গীর্জার ভ্যালেন্টাইন নামক দু’জন সেন্ট (পাদ্রী) এর মস্তক কর্তন করা হয় নৈতিক চরিত্র বিনষ্টের অপরাধে । তাদের মস্তক কর্তনের তারিখ ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারী । ভক্তেরা তাদের ‘শহীদ’(!) আখ্যা দেয় । রোমান ইতিহাসে শহীদের তালিকায় এ দু’জন সেন্টের নাম রয়েছে । একজনকে রোমে এবং অন্যজনকে রোম থেকে ৬০ মাইল (প্রায় ৯৭ কি.মি) দুরবর্তী ইন্টরামনায় (বর্তমান নাম Terni) ‘শহীদ’ করা হয় । ইতিহাসবিদ কর্তৃক এ ঘটানা স্বীকৃত না হলেও দাবী করা হয যে ২৬৯ খৃষ্টাব্দে ‘ক্লাইডিয়াস দ্যা গথ’ এর আমলে নির‌্যাতনে তাদের মৃত্যু ঘটে । ৩৫০ খৃষ্টাব্দে রোমে তাদের সম্মানে এক রাজপ্রসাদদ (Basillica) নির্মাণ করা হয় । ভূর্গভস্থ সমাধিতে একজনের মৃতদেহ আছে বলে অনেকের ধারণা ।

সপ্তম বর্ণনা : ৮২৭ খৃ্ষ্টাব্দে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের এক ব্যক্তি রোমের পোপ নির্বাচিত হয়েছিল । তিনি তার চারিত্রিক মাধুর‌্য এবং সুন্দর ব্যবহার দিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই রোমবাসীর মন জয় করে নিয়েছিল । কিন্তু মাত্র ৪০ দিন দায়িত্ব পালনের পরই তার জীবনাবসান ঘটে । প্রিয় পোপের মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারী রোমবাসী এক অসুষ্ঠাসের আয়োজন করেছিল । অনেকের মতে এভাবেই ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র সূচনা হয় ।

এ দিবসে যা করা হয় :

পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে এ দিনে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন. এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও উপহার বিনিময় হয় । উপহার সামগ্রীর মধ্যে আছে পত্র বিনিময়, খাদ্যদ্রব্য, ফুল, বই, ছবি, `Be my Valentine’(আমার ভ্যালেন্টাইন হও), প্রেমের কবিতা, গান কার্ড প্রভৃতি । গ্রীটিং কার্ডে, উৎসব স্থলে অথবা অন্য স্থানে প্রেমদেব (Cupid) এর ছবি বা মূর্তি স্থাপিত হয় । সেটা হল একটি ডানাওয়ালা শিশু, তার হাতে ধনুক এবং সে প্রেমিকার হৃদয়ের প্রতি তীর নিশান লাগিয়ে আছে । এ দিন স্কুলের ছাত্ররা তাদের ক্লাসরুম সাজায় এবং অনুষ্ঠান করে ।১৮শ’ শতাব্দী থেকেই শুরু হয়েছে ছাপানো কার্ড প্রেরণ । এ সব কার্ডে ভাল-মন্দ কথা, ভয়-ভীতি আর হতাশার কথাও থাকত । ১৮শ’ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যে সব কার্ড ভ্যালেন্টাইন ডে’তে বিনিময় হত তাতে অপমানজনক কবিতাও থাকত ।

তবে সবচেয়ে যে জঘন্য কাজ এ দিনে করা হয়, তা হল ১৪ই ফেব্রুয়ারীতে মিলনাকাঙ্খী অসংখ্য যুগল সবচেয়ে বেশী সময় চুম্বনাবদ্ধ হয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া । আবার কোথাও কোথাও চুম্বনাবদ্ধ হয়ে ৫ মিনিটি বা তার বেশি সময় অতিবাহিত করে ঐ দিনের অন্যান্য প্রোগ্রামে অংশগ্রহন করে ।

বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে :

বাংলাদেশের পত্রিকা ‘যায়যায় দিনের’ সাবেক সম্পাদক ও বিটিভির এককালের জনপ্রিয় টক’শো “লাল গোলাপ শুভেচ্ছ” এর্ পরিচালক ও উপস্থাপক জনাব শফিক রেহমন বাংলাদেশের ভালবাসা দিবসের জনক । এ দিবসে ভালবাসায় মাতোয়ারা থাকে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো । পার্ক, রোস্তোরাঁ, ভার্সিটির করিডোর, টিএসসি, ওয়াটার ফ্রন্ট, ঢাবির চারুকলার বকুলতলা, আশুলিয়া, কুয়াকাটা এবং কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসহ-সর্বত্র থাকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের তুমুল ভিড় । ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে অনেক দম্পতিও উপস্থিত হয় প্রেমকুঞ্জগুলোতে । আমাদের দেশের এক শ্রেণীর তরুন-তরুনী, যুবক-যুবতী এমনকি বুড়া-বুড়ীরা পর‌্যন্ত নাচতে শুরু করে ! তারা পাঁচতারা হোটেলে, পার্কে, উদ্যানে, লেকপাড়ে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসে ভালবাসা বিলোতে, অথচ তাদের নিজেদের ঘর-সংসারে ভালবাসা নেই ! আমাদের বাংলাদেশী ভ্যালেন্টাইনরা যাদের অনুরণে এ দিবস পালন করে, তাদের ভালবাসা জীবন-জ্বালা আর জীবন জটিলতার নাম; মা-বাবা, ভাই-বোন হারাবার নাম, নৈতিকতার বন্ধন মুক্ত হওয়ার নাম । তাদের ভালবাসার ‘ধর ছাড়’ আর ‘ছাড় ধর’ নতুন নতুন সঙ্গী । তাদের ধরা-ছড়ার বেলেল্লাপনা চলতে থাকে জীবনব্যাপী ।

কোরআন ও হাদীসের আলোকে ভালবাসা দিবস :

ইসলাম কোন গতানুগতিক ধর্মব্যবস্থার নাম নয় বরং এটা পূর্নাঙ্গ একটি জীবন ব্যবস্থার নাম । মানুষের সৃষ্টি হতে ধ্বংস (মৃত্যু) পর‌্যন্ত যত পালনীয় এবং বর্জনীয় কার‌্যাবলী আছে তার সবগুলোই ইসলামে পরিপূর্ন ভাবে বর্ণিত আছে । ইসলাম কোন নির্দিশ্ট দিবস পালনের অনুমোদন করেনা । অথচ পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতি ঢালাওভাবে গ্রহন করতে গিয়ে আমরা আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য সংস্কৃতি এবং সভ্যতা ভূলে বসে আছি । হাদীস শরীফে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিধর্মীদের অনুসারী হবে তার হাশর বিধর্মীদের সাথে হবে’ । (আবু দাউদ) উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমানিত হয় ভালবাসা দিবস মুসলিমদের রীতি নয় । ইহা খৃষ্টানদের রীতি । যে রীতি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস এবং তার প্রেমিকার আত্মহত্যা দ্বারা সূচিত হয়েছিল । সুতরাং যদি কোন মুসলিম এই দিবস পালন করে তার হাশর তথা শেষ বিচার ঐ বিধর্মীদের সাথে হবে । ভালবাসা দিবসের নাম করে বর্তমানে একশ্রেণীর ছেলে মেয়েরা লোক চক্ষুর আড়ালে নির্জনে সাক্ষাত করে । তারা নানা প্রকার অশ্লীল কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকে । বিয়ের আগে যে প্রেম ভালবাসা করা হয় তা অবৈধ । আর ইসলামে অবৈধ প্রেম ভালবাসার কোন স্থান নাই । বিয়ের পূর্বে একটা ছেলে একটা মেয়ের সাথে সাক্ষাতও করতে পারবে না । হাদীস শরীফে আছে, ‘হযরত ইবনে আব্বাস (রাHappy থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাHappy বলেছেন, তোমদের কেউ কোন মেয়ের সাথে নির্জনে মিশবে না । তবে তার সাথে কোন পুরুষ থাকলে ভিন্ন কথা”। (বুখারী ও মুসলিম)

উপরোক্ত হাদীস হতে বুঝা যায়, কোন পুরুষ ও নারী একাকী নির্জনে দেখা সাক্ষাত করতে পারবে না । সুতরাং বিয়ের আগে ইসলামে প্রেম ভালবাসার কোন বৈধতা নেই । আর নারী-পুরুষ যদি নির্জনে একাকী থাকে তবে তাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি থাকে আর ঐ তৃতীয় ব্যক্তি হল শয়তান । শয়তানের কাজ হল যিনা-ব্যভিচার করান । কোন নারী বা পুরুষ যিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত শয়তান বেশি খুশি হয় । পবিত্র কোরআন মাজীদে এসেছে, ‘তোমরা যিনা-ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়োনা । নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পথ”। (সূরা বনী ইসরাঈল : ৩২)

১৪ই ফ্রেব্রুয়ারী ভালবাসা দিবস নামে যা উদযাপিত হয় তা হল অশ্লীল ও যিনা-ব্যভিচার । ছেলে-মেয়েরা ঐ দিন প্রকাশ্যে যিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হয় । আর এই যিন-ব্যভিচারের ইন্ধন যোগায় সমস্ত মিডিয়াগুলো । এই দিনটি কেউ প্রকাশ্যে যিনা-ব্যভিচার করে আবার কেউ গোপনে যিনা-ব্যভিচার করে । তাদের ভিতর আল্লাহর ভয় কাজ করে না । হাদিস শরীফে এসেছে, ‘হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন । হযরত রাসুলে কারীম (সাঃ) বলেন, কোন ব্যভিচারী ব্যভিচারে লিপ্ত অবস্থায় মু’মিন থাকে না । কোন চোর চুরি করা অবস্থায় মু’মিন থাকে না । কোন শরাব খোর শরাব পান করা অবস্থায় মু’মিন থাকে না । মানুষের চোখের সামনে কোন নিরীহ লোকের উপর আক্রমনকারী মু’মিন থাকে না’ ।(বোখারী, মুসলিম, নাসায়ী)। পাশ্চাত্যের প্রভাবে মুসলিম বিশ্ব বর্তমানে এতোটাই প্রভাবিত হয়েছে যে তারা কি জায়েজ ও কি না জায়েজ তা ভূলে যাচ্ছে । তারা ভূলে যাচ্ছে মুসলিমদের ঐতিহ্য । বর্তমানে আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা এই ভালবাসা দিবসের নামে লিপ্ত হচ্ছে অশ্লীল কর্মে । তারা লিপ্ত হচ্ছে যিনা-ব্যভিচারের মত জঘন্যতম কাজে । আর কিছু মেয়েরা এমনও রয়েছে যারা এই ভালবাসা দিবসের দিন কলেজের নাম করে বের হয়ে তারা তাদের প্রেমিকের সাথে সাক্ষাত করছে এবং সংগোপনে তারা তাদের মূল্যবান সম্পদ জলাঞ্জলি দিচ্ছে । এই দিনটিতে হাজার হাজার মেয়ে তাদের সতীত্ব হারিয়ে অসতীর খাতায় নাম লিখায় । নারীদের সবচেয়ে বড় সম্পদ সতীত্ব । নারীর অমূল্য সম্পদ সে সতীত্বই যদি হারিয়ে ফেলে তবে তাদের কিইবা মূল্য থাকে ? সতীত্বহীন নারীদেরকে দাউস বলা হয় । নিশ্চয়ই দাউসের স্থান জাহান্নাম ।

ইসলাম ধ্বংসের পথে এই দিনটির সূচনা :

ভালবাসা দিবসের নামকরে খৃষ্টানরা চায় মুসলিম সমাজকে বিভ্রান্ত করে ইসলাম ধ্বংস করতে । তাই তারা অশ্লীলতায় ভরপূর অবৈধ দিনটি পালন করে, যাতে কোন ভাবে ইসলামী ঐক্যে ফাটল ধরানো যায় । আর এতে খৃষ্টনরা সফলও হচ্ছে । বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলোতে ভালবাসা দিবস পালন করছে । যার ফলে মুসলিম যুবক-যুবতী, তরুন-তরুনী ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে । যাতে করে তারা অতিমাত্রায় বিধর্মীদের অনুসারী হয়ে পরছে । যে কারনে বিশ্বব্যাপী অশান্তির দাবানল আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে । মুসলমানরা তার নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতা থেকে দূরে সরে যাওয়ায় জীবনের প্রতি পদে পদে ব্যাপকভাবে লাঞ্চিত, অপমানিত ও অপদস্ত হচ্ছে ।

ভালবাসা দিবসের অপকারীতা :

ভালবাসা দিবসটি ভালবাসার নামে সূচনা হলেও এই দিবসটি সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে । এই দিবসটি সমাজের শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতা ধ্বংস করে সমাজকে বিশৃঙ্খল এবং অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত করে । এ দিনটি পালনের অনেকগুলো অপকারীতা লক্ষ করা যায় । তার মধ্য থেকে কয়েকটি হল-

ভালবাসা দিবস পালনের ফলে মুসলিম সমাজের যুবক-যুবতীরা বিপথগামী হচ্ছে ।

এই দিনটি পালনের ফলে সমাজের যুবক-যুবতীরা ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ।

এই দিনটি পালনের ফলে মুসলিম সমাজের যুবক-যুবতীরা নিজ ধর্মের মর্মবাণী ভূলে বিধর্মীদের অনুসারী হচ্ছে ।

এই দিনটির দরুন খৃষ্টান-নাসারারা তাদের উদ্দেশ্যকে সফল করতে পারছে । তারা ইসলামী চেতনায় আঘাত হানছে ।

এই দিনটির ফলে নারীরা তাদের সতীত্ব হারাচ্ছে ।

এই দিনটি পালনের ফলে অনেক নারী-পুরুষ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে ।

এই দিনটি পালনের ফলে নারী-পুরুষের অবাধ যৌন মিলনের দরুন এইডসের মত সমাজে নানা ধরনের জটিল রোগব্যাধি ছড়াচ্ছে ।

এই দিনটি পালনের ফলে সমাজে জন্ম নেয় অসংখ্য জারজ সন্তান ।

সবচেয়ে বড় কথা শয়তান এই ভালবাসা দিবসে যিনা-ব্যভিচার করে গর্ভবোধ করে ।

ভ্যালেন্টইন্স ডে’ সম্পর্কিত এসব জানা-অজানা তথ্য জানার পরেও ইসলাম ধর্মের অনুসারী বাংলাদেশী ঐতিহ্যে লালিত কোন নারী কিংবা পুরুষ কি এইদিনে তার প্রিয়জন থেকে কোন চিরকুট, প্রেমপত্র, লাল গোলাপ, ভ্যালেন্টাইন্স ডে কার্ড বা কোন উপহার পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবে ? কিংবা এ দিনে তথাকথিত ভালবাসা বিনিময়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে ? তবে তা জেনে শুনে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক মূল্যবোধ ও নিজ দেশের মাটি ও মানুষের সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে আত্ম-বিস্মৃতির চরম দেউলিয়াপনা ছাড়া আর কি হতে পারে ? প্রিয় তরুন-তরুনী, যুবক-যুবতী আপনারাই বলুন, এতোসব আলোচনার পরেও কি আপনারা বলবেন, ভ্যালেন্টাইনের সাথে ভালবাসার কোন সম্পর্ক আছে ? আমরা কি আমাদের ঐতিহ্য গুলো ধরে রাখবো নাকি বিজাতীর কালচার গুলো আমদানী করবো । আল্লাহ তায়ালা আমদেরকে সঠিক ইসলাম বুঝার মত বুদ্ধিদান করুন । আবেগের চেয়ে বিবেককে বেশি প্রধান্য দিতে শিখি ।আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থ-সংস্কৃতি চর্চার মানসিকতায় গড়ে তুলি ।

রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।



বিষয়: আন্তর্জাতিক

২৯৩০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

175779
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১০:৪০
আমি মুসাফির লিখেছেন :

এইটা ভালবাসা দিবসের ফসল।

১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:২১
129249
রাজু আহমেদ লিখেছেন : এ ফসল সমাজে নষ্ট করে ।
175796
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:৩৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভ্যালেনটাইন ডে এর অপসংস্কৃতি পাশ্চাত্যেও চালু হয়েছে ২৫-৩০ বছর আগে মাত্র। ফাদার্সডে, মাদারস ডে, টিচারস ডে ইত্যাদির মত এটিও একটি বানিজ্যিক দিবস। কিন্তু এর কুফল আরো বেশি।
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:২২
129250
রাজু আহমেদ লিখেছেন : ধন্যবাদ সবুজ ভাই । আসুন মানুষকে সচেতন হতে ‍উৎসাহ প্রদান করি ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File