শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কেন ছাত্রলীগের হামলা

লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৪:৫৮:৫২ বিকাল

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় । আয়তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরের অবস্থানটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের । ১৯৫৩ সালের ৬ই জুলাই পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি তার যাত্রা শুরু করে । অনেক চড়াই-উৎড়াই এবং কঠোর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা পায় । ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, ১৯৫৩ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী ভূবন মোহন পার্কে আয়োজিত একটি জনাকীর্ণ জনসভায় পূর্ববঙ্গীয় আইন সভার সদস্য, প্রখ্যাত আইনজীবী মাদারবখশ তদানীন্তন সরকারকে হুশিয়ার করে বলেন, যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা না হয়, তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবী করতে আমরা বাধ্য হব । মাদারবখশের কঠোর হুঁশিয়ারীতে সরকারের টনক নড়ে । অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১শে মার্চ প্রাদেশিক আইন সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ হয় । এত আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, সে প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন সংগ্রাম চলবে সেটাই স্বাভাবিক । হোক সে শিক্ষকদের আন্দোলন নতুবা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের রয়েছে দীর্ঘ-সূত্রিতার ইতিহাস । তবে অতীতের সকল আন্দোলনের ইতিহাসকে পেছনে ফেলেছে সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর অবৈধ অস্ত্রধারীদের অতর্কিত হামলা । আন্দোলনের কারন এবং এর যৌক্তিকতার প্রশ্নে দেশের অধিকাংশ বিশিষ্টজন মনে করেন, শিক্ষার্থীরা কখনো সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের পক্ষে লড়াই করে না । শিক্ষার্থীরা যে সকল আন্দোলন করে, তা হয় শিক্ষার কল্যানে নতুবা দেশের আগামীর কর্ণধারদের মঙ্গলের নিরেখে । ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৯০ এ এইচ এম এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ২০০৭ সালে আরেক স্বৈরশাসক মঈনু্দ্দীন-ফখরুদ্দীনদের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ ছাত্রদের অংশগ্রহনে অনেক আন্দোলনই এমনটা ইঙ্গিত দেয় । আজ পর‌্যন্ত দেশে এমন কোন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়নি, যেখানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে শিক্ষার বিরুদ্ধে, সত্যের বিরুদ্ধে । তারা স্লোগান তুলেছে, পরীক্ষায় অংশগ্রহন করবে না অথচ সার্টিফিকেট পাওয়ার পক্ষে । এরকম কোন দৃষ্টান্ত অতীতের কোন যুগে ছিল না আজও নাই ভবিষ্যতেও থাকবে কিনা সন্দেহ । সুতরাং এককথায় বলা যায়, শিক্ষার্থীদের সকল সময়ের আন্দোলন শিক্ষার্থীদের কল্যানের জন্য, দেশ এবং জাতির মঙ্গলের জন্য ।

গত চারদিন আগ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকহাজার শিক্ষার্থীরা টানা আন্দোলন করে আসছিল । শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারন ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ফি বৃদ্ধি করেছে এবং প্রকৃত শিক্ষা দান থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করে বিভিন্ন অনুষদে সান্ধ্যকালীন মাষ্টার্স কোর্স চালূ করেছে । সকল শিক্ষার্থীদের এক দাবী, পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বর্ধিত ফি প্রত্যাহার এবং বিভিন্ন বিভাগে চালু করা সান্ধ্যকালীন মাষ্টার্স কোর্স বন্ধ করতে হবে । বরিবার বেলা এগারোটায় আন্দোলনের মূখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বর্ধিত ফি বাস্তবায়ণ স্থগিত করলেও সান্ধ্যকালীন মাষ্টার্স কোর্সের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত দেয় নি । আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হয়ে, তাদের সকল দাবী মেনে না নেওয়া পর‌্যন্ত তাদের আন্দোলন থেকে পিছু হটবেনা বলে ঘোষণা দেয় । রবিবারের (০২-০২-১৪) মধ্য দুপুরে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয় । আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আরও কয়েকহাজার শিক্ষার্থী । আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অংশ হিসেবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে সমাবেশ করে এবং বিভিন্ন অনুষদের মূল ফটকের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয় ।

অবশেষে বাধে আসল বিপত্তি । উম্মোচিত হয় ছাত্রবেশী সরকারীদল সমর্থক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের আসল চেহারা । ছাত্রলীগের কর্মীরা আনন্দমিছিলের নামে অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর । সংঘর্ষস্পটে অবস্থানরত বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পুলিশ সদস্যরা ছাত্রলীগ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বিবাদ মীমাংসায় কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, সেটা অনেকের কাছেই অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ (?)

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলারপর অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে । পাঠকের কাছে তার মধ্য থেকে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর আশা করতেই পারি ? ১-শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবী-ধাওয়া আদায়ের আন্দোলনে ছাত্রলীগকর্মীরা কেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা পোষণ না করে উল্টো আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালালো ? ২-তাহলে কি ধরে নিতে হবে, আওয়ামীলীগের অংগসংঘঠন ছাত্রলীগ, ছাত্রদের ব্যানারে গঠিত হলেও এরা প্রকৃত ছাত্র নয় বরং অন্যকিছু ? রবিবারে ছাত্রলীগের আক্রমনের সময় একটা বিষয় স্পষ্ট ছিল, তারা যখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালিয়েছে তখন তাদের মূখে স্লোগান ছিল, “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” । দেশের সাধরণ নাগরিক হিসেবে এ স্লোগানটিকে জাতীয় স্লোগানের মর‌্যাদায় স্থান দিয়েছি । এখন দেখছি এ স্লোগান তুলে মানুষ হত্যার, মানুষের উপর গুলি করার বৈধতা দেয়া হয় । প্রশ্ন জাগতেই পারে, এ স্লোগানের উদ্দেশ্য কি তাহলে বর্তমানে যেটা দেখছি সেটাই ?

যতকথাই হোক না কেন, যত প্রশ্ন উত্থাপন করি না কেন, ছাত্রশব্দটি যুক্ত থাকার পরে ছাত্রলীগ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে কোনদিন আলাদা করে দেখার, ভাবার সুযোগ নাই । তবে ছাত্রলীগের কর্মীরা কোন স্বার্থে একই বেঞ্চে বসে ক্লাস করা, একই শিক্ষকের লেকচার গ্রহন করা, সর্বোপরি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দেয়ার পরেও কেন এই শত্রুতা ? বাংলাদেশের প্রতিটি প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত ঘটনাকে ফলাও করে প্রচার করেছে । বিবিসিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতার সম্পূর্ণ খবর প্রকাশ করার চেষ্টা করেছে । তাদের মতে, এ সহিংসতায় প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীসহ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছে । যার মধ্যে গুলিবিদ্ধ প্রায় ৩০ জন । সাংবাদিকদের ভাষ্যমতে সহিংসতার মধ্যে একশ্রেণীকে দেখা গেছে সামনের দিকে রিভালভার তাক করে গুলি করতে অথচ তারা পুলিশ নন । পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও তারা টিয়ারসেল এবং রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে । তাহলে হাতবোমা এবং মারনাস্ত্র ব্যবহার করল কারা ? নিশ্চয়ই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রিভালবার অথবা হাতবোমা নিয়ে আন্দোলনে নামে নি ? সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে এ বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত এবং দোষীদের আইনের আশ্রয় এনে তাদের ছাত্রত্ব বাতিল করে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা উচিত ।

আবারও অনির্দিশ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে । এ সময়ে কোন পক্ষ উপকৃত হবে সেটা বোধগম্য নয় । ছাত্ররা পিছিয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নাই । শিক্ষকরাও কি ভাল থাকবেন এসময়ে ? যাদের অধিকাংশ সময় কাটত জ্ঞান বিতরণ করে সেই তারা আরাম আয়েশের জীবন জাপনে কতটা সূখ উপভোগ করতে পারবেন সেটা সত্যিই ভেবে দেখা উচিত । শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয় বাংলাদেশের অনেকগুলো পাবলিক এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একই মানের সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হচ্ছে । কারোটা প্রকাশ পাচ্ছে আবার কারোটা রয়ে যাচ্ছে নিরবে নিভৃতে । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ শিক্ষামন্ত্রনালয়ের সকল কর্মকতাদের সচেতন হওয়া জরুরী । সমস্যার আকার বৃহৎ হওয়ার আগেই সেটা সমাধান করতে পারলে রাজশাহীর মত কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হবেনা দেশবাসীকে । অতীতে দেখেছি যারা প্রকৃত অপরাধী তারা কোন এক দৈবশক্তিবলে মু্ক্তি পেয়ে যাচ্ছে । ভবিষ্যতে যেন এমনটা আর না হয় । শিক্ষার্থীদেরকে যেমন শিক্ষার পরিবেশ দিতে হবে ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দিতে হবে নিশ্চিত আগামী । আশা নয় বিশ্বাস, কর্তৃপক্ষ এবার হয়তবা সচেতন হবেন ? সংঘাতমুক্ত আগামীর অপেক্ষায়-

রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।



বিষয়: রাজনীতি

১১৯৬ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

172496
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : সান্ধ্যকালিন মাষ্টার্স কোর্স চালু করার বিরুদ্ধে কেন আন্দোলন তা বুঝতে পারছিনা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও সান্ধ্যকালিন গ্র্যাজুয়েশন কোর্সও আছে। আমাদের মত দেশে তা আরো বেশি প্রয়োজনিয়। কারন অনেক দরিদ্র সন্তান কে চাকুরির জন্য পড়াশুনায় ইতি টানতে হয়।
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৫০
126619
রাজু আহমেদ লিখেছেন : আপনার সাথে আমিও কিছুটা একমত । তবে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে ছাত্রদের চেয়ে শিক্ষদের গবেষণা করতে হয় বেশি । সুতরাং গবেষণার সময়টা যদি পন্ডিত মহাশয় ব্যবসায় ব্যয় করেন তবে ছাত্রদের দিবেনটা কি?
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৯:০৫
126650
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : গবেষনার সময়টা সন্ধা হবে কেন?
একজন শিক্ষককে কি ২৪ ঘন্টাই কাজে ব্যাস্ত থকতে হবে। তার পারিবারিক বা ব্যক্তিগত জীবন বলে কি কিছু থাকবেনা। নিয়মিত কাজের সময়এর মধ্যেই তা করা সম্ভব এবং উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তাই করা হয়। অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম এর মত ব্যাক্তিকে দেখেছি। নিজের গবেষনা এবং ছাত্রদের শিক্ষা দিয়েও অসংখ্য সামাজিক সাংিস্কিতিক কর্মকান্ডে অংশ নিতে একই সঙ্গে সুন্দর পারিবারিক জীবনযাপন করতে।
172562
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৩৩
আবু আশফাক লিখেছেন :
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৪৮
126618
রাজু আহমেদ লিখেছেন : ধন্যবাদ ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File