••প্রথম অথবা শেষ চিঠি••

লিখেছেন লিখেছেন আবরার আদিব ১৮ জানুয়ারি, ২০১৪, ১০:৪২:৩৯ রাত



মাহী চিঠি লিখতে বসেছে। তবে সে জানে না চিঠি লিখে শেষ করতে পারবে কি না। এসব লেখালেখি কখনো তাকে দিয়ে হয়নি। এর আগে সে খুব সম্ভব কাউকে চিঠি লিখেনি। অবশ্য পরীক্ষার খাতায় অনেক চিঠি লিখেছে। 'বাবার কাছে টাকা চাহিয়া পত্র টাইপ!' সেখানেও দু' লাইন লেখার পরেই তার মনে হত আর কিছু লেখার নেই। টাকা তো চাওয়া শেষ, এবার কি লেখা যায়? আজকের পরিস্থিতি কিন্তু ভিন্ন। তার ভিতরে কথার স্রোত, কিন্তু লেখাগুলো কাগজে গড়াচ্ছে না। মাথায় আঁটকে গেছে। ছাড়াবার ব্যবস্থাও মাহীর জানা। তার মস্তিষ্ক এখন সিগারেটের ধোয়ার জন্য ব্যকুল। সিগারেট কাছে নেই। নিজের পয়সায় সিগারেট সে কঠিন বিপদে পড়লে খায়। আজ মনে হচ্ছে তেমনি বিপদ।

জীবনে সবচেয়ে বেশী সিগারেট কিনে নিয়েছে দীপান্বিতার কাছে থেকে। দীপান্বিতা টাকা দিয়েই বলত, 'এখন দূরে গিয়ে টানবি। খবরদার কাছে আসবি না।'

মাহী কিন্তু দূরে সরে যেত না। তার মুখের সামনেই ধোঁয়া ছাড়ত। সাথে সাথেই দীপান্বিতার চড়-থাপ্পড়। সিগারেট কেনার টাকা জন্যই হোক অথবা কোমল হাতের চড়-থাপ্পড়ের জন্যই হোক মাহী কিন্তু দীপান্বিতার প্রেমে পড়ে গেল। প্রেমের ব্যপারে সবচেয়ে উদাসীন ছেলেটি প্রেমে পড়ল ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারেই। প্রেমের প্রস্তাবে চট করেই কিন্তু দীপান্বিতা সাড়া দিল না। খানিকটা দূরেই সরে গেল। মাহীও পিছু ছাড়ল না। রাত-বিরাতে রোকেয়া হলের সামনে গিয়েই এসএমএস করে দিত 'অনেকক্ষণ তোর হলের সামনে দাঁড়িয়ে। একটা সিগারেট কিনে দেবার জন্য হলেও বাহিরে আয় না।' দীপান্বিতা প্রথম কয়েকদিন পাত্তা দিত না। কিন্তু যখন মনে ভালোবাসার জন্ম নেয় সেটাকে ছুঁড়ে ফেলা কি এতই সোজা?

তাদের প্রেম চলতে থাকে উদ্দাম গতিতে। কখনো বা টিএসসির বারান্দায় কাঁধে মাথা রেখে শুধুই নিরবে চেয়ে থাকা, আবার কখনো কার্জনের সবুজ ঘাসে ছুটোছুটি। দিন শেষে নির্জন ফুটপাতে একসাথে পথচলা। তারা শুধুই যেন নিশ্চুপে অনুভব কত একে অন্যকে। চিরকুটের মত মাহী এসএমএস পাঠাতো দীপান্বিতাকে রুদ্রের কবিতা-

'গোপনে ছিলাম নিজের মধ্যে একা

তুমি এসে কেন হঠাৎ ডাকলে করাঘাতে!

আত্মমগ্ন কুয়াশার মোহ ছিঁড়ে

দূরে তাকাতেই দেখলাম ঘন বনভুমি

তুমি ডাকলেই মনে হল আমি একাকি ছিলাম ।'

এভাবেই কেটে গেল অনেকটা দিন। দুটো বছর। অনেককিছুই তাতে বদলালো না। তুই তখনো তুমি হয়নি। অথবা হুটহাট করে বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়া কোনো অজানা পথে, এসব চলত আগের মতই। দীপান্বিতা কিন্তু বদলে গেছে সময়ের সাথে কিছুটা। মাহীকে মাঝে মাঝে বলত, 'তুই কি কখনোই বদলাবি না।' মাহী ভুল্ভাল কবিতা আওড়ে এসব উড়িয়ে দিত। তারপরেই সিগারেটের টাকার দাবি জানিয়ে বলত, 'আহ! সিগারেট ছাড়া কি আর কবিতা বের হয়! দে তো কিছু টাকা!' দীপান্বিতা এবার ক্ষেপে উঠতো। 'সিগারেটের টাকাটা অন্তত রোজগার করতে পারিস!' মাহী ছিল মধ্যবর্তী ফ্যামিলির ছেলে। যতটা না দরকার তার চেয়ে অনেক বেশীই টাকা বাসা থেকে পেত। খরচের হাতও ছিল বেশ চওড়া। দীপান্বিতা কিন্তু এসব একদম সহ্য করত না। শাসিয়ে বলত, 'এভাবে বাবা-মায়ের উপড় আর কত পেইন দেয়াটা কিন্তু ঠিক না। আমাদের বিয়ের পরও কি তুই এমন করবি?' দীপান্বিতার মুখে বিয়ের কথা শুনলেই মাহী একদম বিরক্ত হত।

'তোরা মেয়েরা আসলে বিয়ে ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতে পারিস না। এত ফিউচার প্ল্যান কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবা-মা যার হাতে তুলে দিবে তার হাত ধরেই সবাইকে লাথি মারবি।'

দীপান্বিতা এই কথায় রেগে যেত। তার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য মাহীকেই আবার ছুটতে হত।

সিগারেট সমস্যার সমধান হয়েছে। প্যান্টের পকেটেই ছিল। তবে ন্যাতান্যাতা অবস্থা। কি আর করা! সিগারেট জ্বালিয়েই মাহী লিখতে শুরু করল।

'প্রিয় নি্তা...'

দীপান্বিতার মত এত বড় নাম বন্ধু মহলে চলে না। সবাই ওকে দীপা বলেই ডাকত। শুধু মাহীই বলত নিতা। আদুরে নাম ঠিক না। এই নামের পিছনে তার ব্যাখ্যাও আছে। দীপান্বিতাকে সে প্রায়

ই বলত, 'দেখ নিতা, সবাই তোকে দীপা ডেকে অসম্পূর্ণ রাখে। আমি নিতা ডেকে তোকে সম্পূর্ণতা দেই। তোর জীবনের আমি কিন্তু পূর্ণতা দেবার জন্যই এসেছি!'

'তাই? হিন্দি সিনেমা দেখছিস মনে হয় খুব'

'ধুর! তোর সাথে রোমান্টিক কথা বলেও শান্তি নেই!'

মাহী জানত এসব কথা দিপা খুব ভালোবাসত। দীপাকে খুশি করার জন্যই মাঝে মাঝে মাহী দুএকটা ভালোবাসার পক্তি আওরাতো। আসলে প্রেমের সংজ্ঞা নিয়ে সবসময়ই সন্ধিহান ছিল মাহী। আসলেই খুব সাধারণ মেয়ে ছিল দীপা। অল্পতেই সে খুব খুশি। হালকা প্রেমের কথায় চোখের জল টলমল!

হটাৎ করেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। মাহীর ক্ষেত্রেও ঠিক

তেমনই হলো। ফেসবুকে জেরিনের সাথে প্রথম পরিচয়। ফার্স্ট ইয়ারে তাদের ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছে। প্রথম দেখাতেই মাহী যেন মোহগ্রস্থ হল জেরিনের প্রতি। প্রবল সেই মোহ। টিএসসিতেই মাঝে মাঝে দেখত ওকে। হয়তো বন্ধুদের সাথে তুমুল আড্ডার মধ্যমণি সে অথবা গিটার হাতে যোগ দিচ্ছে কোরাসে। মাহী জেরিনের দিকে তাকিয়ে থাকত নির্লজ্জের মত। পাশে দীপা থাকলেও সে দিকে তার নজর নেই। জেরিন ছিল যেন জলের মত, তাকে ছোঁয়া যায় কিন্তু চেপে ধরা যায় না। ফোনে কথা হত কোনো কারণ ছাড়াই। জেরিন সব সময়ই অনেক বেশী উচ্ছলিত, অনেক বেশী প্রাণবন্ত। জেরিনকে দেখার পর থেকেই দীপাকে যেন আরো বেশী নিরাসক্ত মনে হয় মাহীর। বারবার শুধু জেরিনের জন্য ভালোবাসা উঁকি দেয় তার মনের দুয়ারে। তার মনে হয়তো এটাই সত্য প্রেম।

জেরিনের একটু সঙ্গ পাবার জন্য কতই না ব্যাকুল থাকত মাহী। লুকিয়ে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসে চলে যেত শুধুই জেরিনের দেখা পাবার জন্য। ফারজানা ম্যামের ক্লাসে একদিন তো ধরা পড়েই গেল!

ম্যাম অবাক হয়ে বলল, 'মাহী তুমি এখানে!'

'ইয়ে ম্যাডাম, আপনার ক্লাসগুলো অনেক মিস করি। আজ হটাৎ নস্টালজিক হয়ে...।' ফারজানা ম্যামও বুঝে ফেলেছিল কাহিনী ভিন্ন। ফার্স্ট ইয়ারে তার খুব কম ক্লাসেই মাহীকে পাওয়া গেছে। জেরিনের কাছে থেকে যত অবহেলা সে পেত ততই আরো দুরুন্ত হয়ে উঠতো সে। দীপা অবাক হয়ে সব দেখত কিছু বলত না। সে নিজেই সরিয়ে নিল। কি অদ্ভূত, মাহী তার দিকে যেন ফিরেই তাকালো না! কবে শেষ মোবাইলে কল দিয়েছে বা এসএমএস সে মনেই করতে পারতো না। দীপা মাহীর কাছে থেকে সরিয়ে নিলেও কষ্টগুলো লুকিয়ে রাখে। আঝোড়ে কেদেছে বন্ধুদের কাছে। একবার তো রঞ্জুর সাথে মাহীর এ নিয়ে হাতাহাতিই হয়ে গেল।

রঞ্জু কথাইয় কথায় বলেছিল, 'তুই যে এভাবে বেহায়ার মত ওই মেয়ের পিছনে ঘুরছিস তাতে তো আমাদের জুনিয়রদের সামনে কোনো প্রেস্টিজ থাকল না। দীপার সাথেও বা তুই এমন করছিস কেন?'

মাহী তেলে বেগুণে জ্বলে উঠে বলেছিল, 'তোর এত দরদ থাকলে যা না ওর সাথে লেগে পর। ছেড়ে দিলাম তোর জন্য...'

এতেই হাতাহাতি লেগে গেল। মাহীর মনে হত দীপার এসব আচরণ শুধুই তাকে তেজ দেখানোর জন্য।

জেরিনের সাথে প্রেম যেমন আচমকা হয়ে গেল ঠিক তেমনি একদিন হুট করে বিয়ে করে ফেলল। সবকিছুই খুব দ্রুত হয়ে গেল। ফ্যামিলি থেকেও মেনে নিল সব। মাহীর মাস্টার্সের রেজাল্ট তখন বের হয়নি, সেই সময় ফ্যামিলি থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিয়ের কার্ড দিতে মাহী দীপান্বিতার কাছেও গিয়েছিল। কার্ড দিয়েই বলেছিল, 'আসবি কিন্তু নীতা।' দীপান্বিতা শূন্য চোখে কার্ডের দিকে তাকিয়ে ছিল।দীপার এমন শূণ্য দৃষ্টি মাহী কখনো দেখে নি। দীপা এসেছিল। যাবার আগে মাহীকে বলেছিল, 'ভালো থেক!...'

মাহী হো হো করে হেসে বলেছিল, 'মুখস্থ করে এসেছ নাকি?' কি অসম্ভব অপমান। আশেপাশে কত মানুষ। চেনা-অচেনা। কতটা ক্ষুদ্র মনে হতে দীপার নিজেকে সেটা মাহী বোঝার চেষ্টাও করেনি। দীপার চোখ থেকে জল গড়িয়েছিল, মহীকে কিন্তু সে দেখতে দেয়নি সে। এই কয়েক বছরে কষ্ট গোপন করায় সে অনেক বেশী পারদর্শী।

এসব ভাবতে গেলে মাহীর খুব অবাক লাগে। মনে হয়তো এইতো কয়েকদিন আগেও ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়িয়েছে কিন্তু এরই মাঝে এতগুলো বছর! মাস্টার্স শেষ করে দীপা ডিপার্টমেন্টে লেকচারার হিসাবে জয়েন করল। কিছুদিন পরই পিএইডির জন্য চলে গেল নিউ অর্লিন্সে। মাহী জানে দীপা এখনো বিয়ে করেনি। বিয়ের চেষ্টা নাকি ওর পরিবার থেকে একবার করেও ছিল, দীপাও নাকি রাজি ছিল। শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। মাহীর ভাবতে খুব ভালো লাগে দীপা হয়তো তার জন্যই এখনো দীপা একা। পরক্ষণেই নিজেকে ধিক্কার জানায়। মাহীর সাথে জেরিনের বিয়েটা টেকেনি। যতটা দ্রুত তারা কাছে এসেছে ঠিক ততটাই দ্রুত তাদের ভিতরে দূরত্বের সৃষ্টি। দীপার মত নিরবে জেরিন চলে যায়নি। কি অসহ্য দু'জনের মাঝে ঝগড়া! শেষের দিকে ঝগড়ার সময়টা মাহী শুধুই নিরবে সিগারেট টেনেছে। তার সব কথা ফুরিয়ে গিয়েছিল।

দীপাকে বোঝার চেষ্টা করে এখন মাহী। কিসের দম্ভ ছিল তার তখন? ভালোবাসাকে বোঝার না চেষ্টা করে সে শুধু মোহের পিছনেই ছুটেছে। অসম্ভব যন্ত্রণা হয় তার এখন। এসব কষ্টকে সে কিন্তু দূরে সরিয়ে রাখে না। পরম যত্নে কাছে রাখে। এই যন্ত্রণার মাঝে সে তার নীতাকে খুঁজে পায়। জমা হওয়া দুঃখগুলোকে সে কবিতা বানানোর চেষ্টা করে। ভার সহ্য না করতে পেরে কবিতারা ভেঙ্গে পড়ে কাঁচের মত।

মাহীর মনে হল একবার হয়তো ক্ষমা চাওয়া উচিৎ দীপার কাছে। অন্তত একিটুকু তার প্রাপ্য। এজন্যি চিঠি লিখতে বসা। দীপার ইমেল এড্রেসও ছিল তার কাছে। রঞ্জুর কাছে থেকেই ইমেল, ঠিকানা সব নিয়েছে। রঞ্জু আছে টেক্সাসে। মাঝে মাঝেই ফোন দেয়। সবকিছুতেই এখন তার উৎসাহ প্রবল।

'তুই চলে আয় না একবার আমেরিকায়। আমাদের অনেকেই তো আছে এখানে। সেই ভার্সিটির দিনগুলোর মত আবার একসাথে হারিয়ে যাবো!'

দীর্ঘক্ষণের ফোনলাপে মাহী শুধু হু হু করেই কাটিয়ে দেয়। তার ভীতরে যে এখন শুধুই শূণ্যের বাস।

চিঠি লিখতে বসাটাই আসলে ঠিক হয়নি। এতক্ষণেও কিচ্ছু লেখা হল না। 'প্রিয় নিতা' এই সম্বোধনটাও কি ঠিক হচ্ছে? প্রিয় নিতার প্রতি তার কত অপ্রিয় আচরণ! কলম হাতে নিয়ে কতটা সময় চলে গেল! মাহী এবার নির্লজ্জের মত লিখলো, 'ফিরে এসো নিতা... ফিরে এসো!'

বিষয়: বিবিধ

১৬৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File