তুলির ছোঁয়ায় রাঙাবো জীবন
লিখেছেন লিখেছেন লুকোচুরি ১৪ মে, ২০১৪, ০৪:৩৯:৫৯ বিকাল
মুনিয়া এইচ.এস.সি. শেষ করে বড় বোন প্রীতির কাছে অস্ট্রেলিয়া এসেছে। বেচারি প্রীতি নিজের লেখাপড়া, বাচ্চা সামলানো, ঘরের কাজ এসব একা সামলে উঠতে হিমশিম খাচ্ছিল। তাই সে বোনের কাছে চলে এসেছে কিছুটা হলেও তো সাহায্য করতে পারবে এটা ভেবে। এখানের একটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। দুই বোনের ভালই সময় কেটে যাচ্ছে যদিও, তবে এখন প্রীতিকে দুইটা বাচ্চা সামলাতে হয় একটা তার নিজের ছেলে, তাশফিন আর একটা ছোট বোন মুনিয়া। এত্ত বড় ধাড়ী মেয়ে বাচ্চাদের মত আচরন করে। আর তাশফিন, মুনিয়া একসাথে হলে তো কথাই নাই। দুইটা মিলে সারা বাড়ি মাথায় তোলে। মুনিয়া প্রীতিকে "আপুমা" বলে ডাকে। আজতো বোনের নাম রেখেছে "মাম্মাসিস", মম থেকে মাম্মা আর সিস্টার থেকে সিস নিয়েছে।
মুনিয়া- মাম্মাসিস দেখো তোমার ছেলে বলে কি? প্রীতি- কি বলেছে? মুনিয়া- আমি তাশফিনকে শয়তানের ওয়াসওয়াসা নিয়ে বছিলাম আর ও শুনে বলে, "শয়তান খুব পচা। আমাদের সবকিছুতে ভাগ বসাতে চায়। শান্তি মত খেতে দেয় না। বিসমিল্লাহ না বললে অথবা কেউ বাম হাতে খেলে তার সাথে সেও খায়। আবার ঘুমানোর সময় আল্লাহ্র কাছে না দোয়া করে ঘুমালে আমাদের সাথে ঘুমায় আবার ফজরের সময়ে উঠতেও দেয় না। কত বড় খারাপ আমার পাশে ঘুমাতে চায়। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যখন আমরা টয়লেটে যাই সেখানেও প্রাইভেসি দেয় না। একটুও যদি লজ্জা থাকত এদের। আল্লাহ্ কত দয়ালু, আমাদের এত্ত এত্ত ভালবাসেন। তাইতো আমাদের সবসময় শয়তান থেকে রক্ষা করতে দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন।" প্রীতি একগাল হেসে বলল, মাশা আল্লাহ্ আমার আব্বাজান অনেক কিছু শিখেছে। অনেক খাঁটি কথা বলেছে। আল্লাহ্ তাশফিনের জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন, আমীন। মায়ের মুখে হাসি দেখে আর মায়ের করা দুয়ায় তাশফিন অনেক খুশি হল। মাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে চলে গেল খালামনির জন্য ছবি আঁকতে। খালামনি তাশফিনের ছবির খুব ভক্ত। আজ খালামনিকে ডায়নসরের ছবি এঁকে দিবে তাশফিন।
তাশফিনের স্কুলে এখন গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। দারুণ সময় কাটাচ্ছে তাশফিন আর মুনিয়া। নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়ে সারাদিন গেমস খেলা আর কার্টুন দেখা। বকেও কোন কাজ হচ্ছে না। প্রীতি এই দুটোকে ঠিক করার জন্য একটা বুদ্ধি বের করল। আজ থেকে ওদের দিয়ে কুরআনের সুরাহ মুখস্থ করাবে।
বিকেলে পার্কে যেতে যেতে প্রীতি ওদের একটা হাদিস শোনাল। - আবু সাইদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কুরআন সংরক্ষণকারী যখন জান্নাতে যাবে, তখন তাকে বলা হবে কুরআন থেকে পাঠ করতে থাকো। তখন সে প্রত্যেক আয়াত পাঠের মাধ্যমে একেক স্তর করে আরোহণ করবে। এমনকি তার মুকস্থকৃত সর্বশেষ আয়াত পাঠ করে নির্দিষ্ট স্থানে আরোহণ করবে এবং সেটাই তার ঠিকানা হবে। (ইবন মাজাহ) হাদিসটা শুনে তাশফিন আর মুনিয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে টম এন্ড জেরীর মত দুষ্ট হাসি দিল। কিন্তু কিছু বলল না।
প্রীতি বলল, আমি ঠিক করেছি তোমাদের দুইজনকে এখন থেকে সুরাহ মুখস্থ করতে দিব। কাল আমাকে তোমরা দুইজন সুরাহ নাবার প্রথম পাঁচ আয়াত মুখস্থ করে দিবে। তখন তাশফিন হঠাৎ করেই তাশফিন বলে উঠল আম্মুতা আমরাতো সুরাহ নাবা পারি। প্রীতি শুনে এত অবাক হল, হা করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। বলে কি এই ছেলে? কবে শিখল?
তাশফিন তখন মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, খালামনি সরি। আমি বলতে চাইনি। হঠাৎ করে মনের ভুলে বলে ফেলেছি। মুনিয়া বলল, হুম... অপরাধ করেছো বটে। ওয়াদা ভঙ্গ করেছো। মন খারাপ করো না। আমি কিছু মনে করিনি। তবে তোমাকে আল্লাহ্র কাছে তওবা করতে হবে। আর কখনো এমন করবে না এই প্রতিজ্ঞা করতে হবে। আল্লাহ্তো ক্ষমাশীল তিনি ক্ষমা করে দিবেন। আর একটা কথা মনে রাখবে, যে ওয়াদা ভঙ্গ করে সে মুনাফিক হয়ে যায়। এটা শুনে তাশফিন ঠিক করল আর এমন করবে না কখনো।
এতক্ষন ধরে প্রীতি সব চুপচাপ দেখছিল। এবারে প্রশ্নবান ছুঁড়ে দিল মুনিয়ার দিকে। বলল, কবে শিখেছিস? মুনিয়া বলল, রাতে যখন তুমি রোজ কুরআন থেকে সুরাহ, অর্থ এর তাফসীর এবং হাদিস শুনিয়ে ঘুমোতে চলে যাও তখন আমরা দুইজন মিলে শিখি। এই রামাদানে পুরো ত্রিশ নাম্বার পারা শিখে তোমাকে সারপ্রাইজ দিব ভেবেছিলাম তাই বলিনি। প্রীতি বলল, শিখবে ভাল কথা। কিন্তু রাত জেগে কেন? ঘুম আল্লাহ্র দেয়া অনেক বড় নেয়ামত। সুরাহ নাবার নয় নাম্বার আয়াতেই তো আছে, আল্লাহ্ বলেছেন, "তোমাদের নিদ্রাকে করেছি বিশ্রাম" তাই রাতে জেগে থাকা মোটেই ঠিক না। মুনিয়া বলল- না... না... শুধু রাতে আমি তাশফিনের তাজবীদ ঠিক করে দেই। আর আমরা ফজরের পর যখন তুমি সূর্যোদয় দেখা আর রান্না নিয়ে ব্যাস্ত থাকো তখন শিখি। প্রতিদিন সূর্যোদয় দেখা প্রীতির অভ্যাস, খুবই পছন্দের কাজ এটা তার কাছে। কুরআনের প্রতি ছেলে আর বোনের ভালবাসা দেখে প্রীতি মুগ্ধ হয়ে গেল।
পার্ক থেকে ফেরার পর বোন আর ছেলের না দেখে কুরআন থেকে তিলাওয়াত শুনে প্রীতি খুব খুশি হল, চোখ দুটো কেমন ছল ছল করে উঠল। প্রীতির হাজব্যান্ড শাহিদ সাহেব বাসায় ফিরে সব শুনে বেশ অবাক হলেন সাথে খুশিও হলেন। ফ্রেশ হয়েই আবার বাইরে চলে গেলেন। আর কিছুক্ষণ পর ফিরলেন এত্তগুলো চকলেট, আইসক্রিম আর তাশফিনের প্রিয় বার্গার নিয়ে। রাতে খাবার টেবিলে বসে সবাই একসাথে খাচ্ছিল। শাহিদ আর প্রীতি অবিশ্বাস্য রকমের খুশি। চোখে মুখে আনন্দের আভা প্রকাশ পাচ্ছিল। ইসলামের পর্দার বিধানের কারণে শাহিদ সাহেব আর মুনিয়ার খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। তবে আজ মুনিয়াকে ধন্যবাদ দিতে ভুললেন না, কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করলেন। প্রীতিও শাহিদ সাহেবের সাথে সাথে মুনিয়াকে ধন্যবাদ দিলেন।
রাতে খেয়ে যে যার যার রুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর প্রীতি এসে বোন আর ছেলেকে কুরআন থেকে সুরাহ, এর অর্থ, তাফসীর এবং হাদিস শুনিয়ে ঘুমোতে চলে গেল। তাশফিন আর মুনিয়ার বিছানা একই রুমে পাশাপাশি হওয়ায় ঘুমানোর আগে দুজন মিলে অনেক গল্প করে। হারিয়ে যায় কল্পনার জগতে। আজ তাশফিন কল্পনা করবে আর মুনিয়াকে সাথে করে নিয়ে যাবে তার কল্পনার দেশে। তাশফিন বলতে লাগল- "মেঘেদের মধ্যে অনেক সুন্দর ছোট্ট একটা দ্বীপ ছিল। সেখানে বাস করতো তাশফিন নামের অনেক গুডু গুডু একটা ছেলে। সে সবসময় বাবা ও আম্মুতার কথা শুনতো। কক্ষনো দুষ্টুমি করতো না। একদিন দ্বীপের বাগানে ঘুরতে গিয়ে তাশফিন অনেক বড় একটা বড় ডিম খুঁজে পেলো। সেটা ছিল একটা ডাইনোসরের ডিম। বাসায় এনে তাশফিন ডিমটাকে অনেক আদর করলো। তারপর একদিন সেই ডিম থেকে বের হলো একটা ছোট্ট একটা ডাইনোসর। তাশফিন ডাইনোসরটাকে আদর করতো, খাবার খেতে দিতো। যখন ডাইনোসরটা একটু বড় হলো তাশফিনের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।" গল্প শেষ হলে তাশফিন আর মুনিয়া ঘুমের দুয়া পড়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
[ এই গল্পটা আমার আদরের ছোট্ট সোনামনি, গুল্লু গুল্লু বাবু তাশফিনের (ভগ্নিপুত্র) জন্য। আর একদম শেষে যে ডায়নসরের গল্পটা আছে, এটা ওরই লেখা। ]
বিষয়: বিবিধ
১৯৪০ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লা খাইরান.. অনেক ভালো লাগলো পড়ে
ভালো লাগলো তারা বাসায় এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছেন- বাচ্চারা দ্বীনকে বোঝা নয়, ভালোবেসেই গ্রহণ করবে।
আর এই যে একটা ডায়নোসররের ডিমভাঙা বাচ্চা, তাশফিনের জন্য!
মন্তব্য করতে লগইন করুন