সারপ্রাইজ
লিখেছেন লিখেছেন লুকোচুরি ১৭ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৭:৪০:৫৭ সন্ধ্যা
১.
- তোকে বলেছি আমার দাবার গুটিগুলো দিতে। আর কতবার বলতে হবে?
- আগে বল ওগুলো দিলে আমাকে কি দিবি ?
- ঘোড়ারডিম দিব। আমার জিনিস দখল করে আছে, ফেরত চাইলে আবার বলে, কি দিবি ?
- আমিও দিব না।
- জলদি দিয়ে দে আজ স্কুলে দাবা খেলার প্রতিযোগিতা আছে। না হয় আমি বাবার কাছে বিচার দিব।
- দে না, কে নিষেধ করেছে? আমিও বলে দিব তুই টিফিনের টাকা দিয়ে না খেয়ে, মার্বেল কিনেছিস।
- আচ্ছা বিচার দিব না। বল কি চাস?
- এইতো লক্ষ্মী ছেলের মত কথা বলছিস। আজ বিকেলের ফুটবল ম্যাচে আমায় নিতে হবে।
- তোর মাথা ঠিক আছে? মা দেখতো তোমার মেয়ে কি বলছে । ও নাকি ফুটবল খেলবে।
- আমায় খেলতে না নিলে আমি দিব না।
- আচ্ছা যা নিব জলদি গুটিগুলো দে।
আমি আমার পুতুলের বক্স থেকে গুটি গুলো আনতে গেলাম। আমার পুতুলের বিয়ে ছিল। তাই ওগুলো নিয়েছিলাম। ওরা বিয়ের দাওাত খেতে এসেছিল। ভাইয়া এটা দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, আর মায়ের সেকি হাসি, আমার কাণ্ড দেখে। আমি গুটিগুলোকে কি সুন্দর করে পোশাক পরিয়েছিলাম। ধ্যাত, আমার কষ্টটাই বৃথা হয়ে গেল। তবুও ভাল আমি সেইদিন ফুটবল খেলতে পেরেছিলাম। ভাইয়ার দলের জার্সি পরে খেলেছিলাম ওইদিন, আর ২ টা গোল করেছি। আমার খেলা দেখে সবাই অবাক হয়েছিল। আমার জন্যই ওইদিন খেলায় জিতেছিল ভাইয়ার টিম।
আমি ছোটবেলায় দুষ্টের শিরোমণি ছিলাম, ছেলেদের ড্রেস পরতাম বেশিরভাগ সময়। আর ভাইয়ার সাথে ঘুরে বেড়াতাম। মার্বেল, লাটিম, ফুটবল, ক্রিকেট, এমন কোন খেলা নাই যা আমি খেলি নাই। অন্যের গাছে উঠে ফল চুরি করা, পাখির ডিম নামিয়ে নিয়ে আসতাম পাখির বাসা থেকে। আবার পাঞ্জাবি-পাজামা পরে বাবা, ভাইয়ার সাথে মসজিদেও যেতাম। আর মিলাদ যেদিন থাকতো সেইদিন সবার আগে গিয়ে বসে থাকতাম।
আর ঘুড়ি ওড়ানোতো ২ ভাইবোনের নেশা ছিল, দুপুরে যখন মা আমাদের ঘুম পাড়িয়ে পরে নিজে ঘুমাতেন, তখন আমরা মঞ্চ কাঁপানো সেই বিখ্যাত ঘুমের অভিনয়ের ইতি টেনে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে টম এন্ড জেরি টাইপ একটা হাসি দিয়ে খাটের নিচ থেকে নাটাই আর ঘুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরতাম পাড়ার মাঠে। এই ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে আমার ইতিহাসের পাতাটা অনেক সমৃদ্ধ। আমি আর ভাইয়া মিলে ঘুড়ি বানাতাম, সুতোয় মাঞ্জা দিতাম। কি কষ্টই না করেছি আমরা সুতোয় মাঞ্জা দিতে গিয়ে, সে এক করুন ইতিহাস... আমরা পুরানো ইলেকট্রিক বাল্ব সংগ্রহ করতাম, ওগুলোকে পাটায় পিষে পাউডার বানাতাম, এরপর সাগু, কাঁচের গুড়ো আর পানি একত্রে মিশিয়ে চুলোয় গরম করে বাড়ির ছাদে গিয়ে পুরো নাটাইয়ের সুতোয় ওগুলো দিয়ে ধার করতাম। এই ধারাল সুতা দিয়ে অন্যের ঘুড়ির সুতা কাটতে বেশ মজাই লাগত।
অনেক মজায় কেটেছে আমার ছোটবেলা। কি দিন ছিল ! যদি আবার ফিরে পেতাম ! মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হল তার শৈশব।
২.
- ওঠ, নামাজ পড়বি না? ফজরের আজান হচ্ছে তো, জলদি ওঠ লক্ষ্মী ভাই আমার।
- উমম... আরেকটু ঘুমাই, পরে পড়ব।
- ওঠ না, মা বকলে পরে বলবি আমি ডেকে দেইনি।
- যা ভাগ, কানের সামনে প্যান প্যান করবি না।
- তুই একটু অপেক্ষা কর আমি মজা দেখাচ্ছি।
এই বলে আমি পানি ঢেলে দিলাম ভাইয়ার উপর। আর ওমনি ও উঠে আমাকে ঝাড়ি দেয়া শুরু করল। বলল, আমাকে নাকি বিয়ে দিয়ে অন্যের বাড়ি পাঠিয়ে দিবে, তারপর ও শান্তিতে থাকবে। তখন আমিও বললাম ভাবিস না তুই, বিয়ে করলেও আমি ঘর জামাই বিয়ে করব, ভেবেছিস আমাকে বিয়ে দিয়ে তোর ঘাড়ের উপর থেকে বোঝা সরিয়ে দিবি? এত সোজা না বুঝলি? তুই তো আমার সাথে সবকিছুতে হিংসা করিস, মা আমাকে এখনও খাইয়ে দেয়, তোকে দেয় না। আমার বিয়ের পর মা আমার বরকেও খাইয়ে দিবে, তখন তুই কি করবি? যা খেলব না তোর সাথে। আমার একটা অভ্যাস আমি অভিমান করলে "খেলব না" এই ডায়লগ টা ছাড়ি। এরপর আমি গালফুলিয়ে চলে এলাম ওর ঘর থেকে।
মসজিদ থেকে ফিরে এসে ভাইয়া বলল, এই তোর গালে কি হয়েছে রে? আমি অভিমানের সুরে বললাম কিছু না। কিছুনা বললেই হল? আমি কি তোর সাথে মিথ্যা বলছি? আয়নার সামনে গিয়ে দেখ। আমি আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ভাইয়া বলল, দেখেছিস তোর গাল ফুলে আছে। এরপর ছড়া বলা শুরু করল,
"গাল ফুলানি মাইয়া
বকেছে তোকে ভাইয়া
গালফুলেছে বকা খাইয়া......
এটা শুনে আমি হেসে দিলাম, বললাম ছন্দ মেলানো ভাল হয়নি। ভাইয়া বলল ছন্দ অনেক ভাল হয়েছে, এতে কোন ডাউট আছে নাকি? আমি বলি, কচু হয়েছে। এরপর ও বলল, হয়েছে আর অভিমান করে থাকতে হবেনা, তোকে বিয়ে দিব না, আমিই বিয়ে করব, এবার খুশি? আমি বললাম, হুম খুশি। বিয়ের পর তোর বউকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যাবি, বাসায় এসে কলিং বেল বাজাবি, আমরা কেউ দরজা খুলব না, তুই মনের দুঃখে বলবি...
"বেল গাছে ঘুঘু পাখি
ঘরে আছে বউ
কলিং বেল বাজাই
তবু দরজা খোলে নাতো কেউ"
.........
এভাবে কেটে যেতে থাকল আমাদের দিনগুলো। কত দুরন্তপনা, কত মান-অভিমান। আর আমার ছেলেমানুষি স্বভাব তো আছেই। আমি গরম একদম সইতে পারি না, বিদ্যুৎ না থাকলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, এটা দেখে আমার ভাইয়া আমাকে শান্ত করার জন্য ছড়া শোনাত...
" কারেন্ট কারেন্ট (বিদ্যুৎ) ডাক পাড়ি
কারেন্ট মোদের নেতাদের বাড়ি
আয়রে কারেন্ট ঘরে আয়
গরমে মোদের জান যায়"
ওর ছড়া শুনে আমি হেসেই কুটিকুটি। লেখা পড়ার চাপ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের মাঠে মাঠে ছুটে বেড়ানো, বাঁদরামোগুলো আমাদের থেকে ১০০ হাত দূরে চলে গিয়েছিল অনেক আগেই। তবুও যেটুক সময় পেতাম দুজন সারাঘর মাতিয়ে রাখতাম। উচ্চশিক্ষার জন্য ভাইয়া ঢাকায় চলে গেল, আমি একা হয়ে গেলাম। কিছুই ভাল লাগতনা ওকে ছাড়া। যদিও মোবাইলএ কথা হত। কতরকম পাগলামি, ছেলেমানুষি কথাবার্তা বলি ভাইয়ার সাথে ও কিছুই মনে করে না, আমার সাথে ও তাল দিয়ে যায়। ফোনে ওকে বলি, ভাইয়া কি করছিস? ও বলে আজাইরা বসে আছি, আমি বলি, কি বললি আজাইরা কে নিয়ে বসে আছিস? আজাইরা কেরে? ও বলে তোর ভাবি, আমি বলি তাই নাকি? আগে বলিস নাই কেন? কবে বিয়ে করলি? ও বলে আজি করলাম। এরপর চলতে থাকে আমাদের আজাইরা কাহিনী। যখনি কথা হত আজাইরার প্রসঙ্গ উঠতই। কখনও আজাইরা ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করত, কখনও রান্না করত। একবার ভাইয়া রাস্তায় একা একা হাঁটছিল, ফোন করে জিজ্ঞেস করি ভাইয়া কি করিস? ও বলে হাঁটছি, আজাইরা ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে গেছে, তাই মন খারাপ। ওকে নিয়ে ছড়া লিখেছি শোন,
" আজাইরা রে আজাইরা
করলা মোরে বেজাইরা
আমি এখন তুমি হারা
ক্যামনে থাকি তোমায় ছাড়া
ওরে আমার আজাইরা,
জলদি তুই আয় ফিরা
একত্রে খাব মোরা দই চিড়া"
আমি এরপর ভাইয়াকে বলি ভাইয়া তুই কাঁদিস না, ওকে আমি গিয়ে নিয়ে আসব। এরপর দুজনই হেসে দিলাম। একটা জিনিস খুব খারাপ লাগতো, কি খেয়েছিস জিজ্ঞেস করলেই বলে বিষ। তখন মনে হয় আমার কাছে থাকলে নির্ঘাত বাবা অথবা মাকে দিয়ে বকুনি খাওয়াতাম। বিষ খাওয়ার জিনিস হল? আচ্ছা পাগল ও, নিষেধ করলেও শোনে না। যদি বলি ভাইয়া এসব কথা মুখে আনিস না, ও বলে আনব, আনলে কি হয়? ওরে কেমন করে বুঝাই এমন কথা শুনলে আমার মন খারাপ হয়। আবার যদি জিজ্ঞেস করি ভাইয়া কি করছিলিরে এতক্ষন? বলে কুতকুত খেলছিলাম। আমি বলি একা একা কেমন করে খেললি? ও বলে একা কোথায়? আজাইরা আছেনা? আমি বলি হুম, বেশি করে খেল।
ভাইয়ার পড়ালেখা শেষ, এখন সরকারি চাকরি করছে, গতবছর চাকরি পাওয়ার পর ওকে বলেছিলাম,
" ওরে আমার সরকারি কর্মকর্তা
তোরে বানাবো ভর্তা
তোর শ্বশুর বাড়ি হবে চর্তা"
চর্তা একটা জায়গার নাম। ও এই ছড়ার উত্তরে বলেছিল,
" ভর্তা বানাতে এলে
রাখবনা তোরে আস্তা
তোকে বানিয়ে দিব পাস্তা
তা দিয়ে করব নাস্তা"
৩.
১৩ ই অক্টোবর ভাইয়ার জন্মদিন। কি গিফট করা যায় ভাবছি। আমার মনে পড়ছে ছোটবেলায় টাকা জমিয়ে ওকে একটা ক্রিকেট ব্যাট জন্মদিনের উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম। ও এটা দেখে অনেক খুশি হয়েছিল। প্রতিবছরই কিছু না কিছু দেয়ার ট্রাই করি, এবার ভাবছি অন্যরকম কিছু একটা করতে, তাইতো এবার আমি বিশেষ মিশনে নেমেছি। ভাইয়াকে এবার মিথ্যা বলে বাসায় এনেছি, বলেছি আমি অনেক অসুস্থ তুই বাসায় চলে আয়, আমার মা-বাবাও আমার প্ল্যান এর কথা জানে, তারাও আমার সাথে আছে, আমি তো অসুস্থ সাজার ভান করে বসে আছি, ভাইয়ার জন্মদিনের কথা আমার মনেও নাই, এমন অভিনয় করছি। সারাদিন ভাইয়া আমার দেখাশোনা করছে, কি খাব, কি লাগবে এসব জিজ্ঞেস করছে বার বার।
আমার মিশনের কথাটা বলেই ফেলি, গত ঈদ এ ভাইয়া বাসায় এলে আমি ভাইয়ার ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে ড্রয়ার এ রাখছিলাম, তখনি ডাইরিটা পড়ে গেল, আমি আবার সেটা তুলে রাখতেই একটা পৃষ্ঠাটায় চোখ আঁটকে গেল, ওখানে লেখা, "আজ পাশের বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া এল। তাদের একটা মেয়ে আছে, নাম রাইসা। তাকে দেখেই কেন জানি ভাল লাগলো। এরপর খোঁজ নিয়ে দেখলাম ও পড়ালেখায়, গল্প লেখায়, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি, এমনকি কুরান তিলওাত এ ফার্স্ট। হিজাব পরে বাসার বাইরে বের হয়। একেবারে আমার মা যেমন টা চান, মেয়েটা সেরকমি। মা যদি তার ছেলের বউ নিজে না খুঁজতে চাইতেন তাহলে হয়ত আমি মেয়েটাকে নির্ঘাত প্রেমের অফার দিয়ে বসতাম। মা টা যে কিনা, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে শুধু।" ... আমার দোষ নাই, আমি ইচ্ছা করে পড়িনি ডাইরি। ও হ্যা রাইসা আমাদের প্রতিবেশী, কয়েকবছর আগে পাশের বাড়িতে ভাড়া এসেছিল, এখনও ওখানেই আছে। মা-বাবা হন্যে হয়ে তাদের ছেলের জন্য মেয়ে দেখছেন, অথচ মেয়ে ঘরের কাছেই আছে, তাদের আমি রাইসার কথা বলতেই তারা রাজি হয়ে গেলেন। এরপর রাইসার বাবা-মার কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেলে উনারাও দ্বিমত করলেন না। এরপর যেই ভাবা সেই কাজ। আমি প্ল্যান করে ভাইয়াকে ডেকে আনলাম, ভাইয়া আসার আগেই মা আর আমি মার্কেটে গিয়ে একটা সবুজ পাঞ্জাবি কিনে এনেছি, এটা ভাইয়ার জন্মদিনে আজ রাত ১২ টা ১ মিনিটে ভাইয়াকে গিফট করব। আর ওর জন্য একটা গল্প লিখলাম, এটা হবে ওর ২য় উপহার। আর ৩য় উপহার মানে, আসল ধামাকা তো এখনও বাকি আছে, কাল সন্ধ্যায় রাইসাদের বাড়ি যাব ওকে আংটি পরাতে, যখন রাইসা লাল শাড়িতে ভাইয়ার পাশে বসবে, ভাইয়া তখন কি অবাকই না হবে। আমি যে আর পারছি না অপেক্ষা করতে। সময় যাচ্ছে না কেন? কাল সন্ধ্যা আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন?? এবার আপনারাই বলুন আমার সারপ্রাইজ কেমন হল?
[এই গল্পটা গত ১৩ অক্টোবর ২০১২ তে আমার খুব প্রিয় একজন ভাইয়া, মাহমুদ হাসান এর জন্মদিনে তাকে সারপ্রাইজ হিসেবে দিয়েছিলাম।]
বিষয়: বিবিধ
২৮২০ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খুব সুন্দর লাগলো গল্পটি। আচ্ছা বাস্তবেই কি ভাইয়ার বিয়ে এভাবেই হয়েছিলো?
এমন যেন সব ভাই বোনেরা হয়৷ ধন্যবাদ৷
ভালো লাগলো খুব
তারপর কি হয়েছিল ? দিতে পেরেছিলেন সারপ্রাইজটা ?
মন্তব্য করতে লগইন করুন