এখনই এসো, কাল যদি ভালো না থাকি
লিখেছেন লিখেছেন টুটুল বিশ্বাস ১৯ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৪:১৩:৩৯ বিকাল
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
ফোনটা এলো বিকেলে। রোববার, ৫ জানুয়ারি। বাইরের কোনো কাজ রাখিনি সেদিন। বাড়িতে বসে আমার আগামী বইয়ের জন্য লিখছিলাম। হঠাৎ বেলভিউ থেকে ফোনে মুনমুন। বলল, 'একটু কথা বলো।' তার পরেই এক বিমুগ্ধ বিস্ময় আমার জন্য ফোনের ও পারে তিনি, সুচিত্রা সেন! গলাটা হয়তো একটু ভারী, তবে কথার মিষ্টতা আগের মতোই। আমাকে বললেন, 'চলে এসো, তোমাকে দেখতে চাই।' জানতে চাইলাম, 'কবে? আজই, না কাল?' জবাব এলো, 'এখনই এসো। আজ ভালো আছি। কাল যদি ভালো না থাকি।'
ভাইপো অভিষেককে ডেকে নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছিল। এর আগে কোনো দিন তাকে সামনে থেকে দেখিনি। পরিচয় যা, সেটা পর্দায় দেখে। এবং যে কোনো বাঙালির মতোই উত্তম-সুচিত্রা জুটি সম্পর্কে চিরাচরিত আবেগের আমিও শরিক। সেই সুচিত্রার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি! সুচিত্রা সেন, আমাদের বিশ্বজয়ী দেবকন্যা!
ঠিক দু'দিন আগেই জানতে পারি, মহানায়িকা বেলভিউতে সুব্রত মৈত্রের চিকিৎসাধীন। সে দিনই নার্সিং হোমে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। তবে তিনি যেহেতু দীর্ঘদিন স্বেচ্ছায় নিজেকে আড়ালে সরিয়ে রেখেছিলেন, তাই তার সেই ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে দেখা করার চেষ্টা করিনি। বাইরে থেকে মুনমুন, রাইমা, রিয়ার সঙ্গে কথা বলে ডাক্তার মৈত্র, ডাক্তার সমরজিৎ নস্কর, বেলভিউর সিইও প্রদীপ টন্ডনের কাছে সব খবরাখবর নিয়ে ফিরে আসি। শুধু প্রার্থনা ছিল, ঈশ্বর ওনাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলুন। এবার দেখা করার ডাক পাঠালেন 'স্বপনচারিণী' নিজেই।
মুনমুন, রাইমা, ডাক্তার মৈত্র আমাকে নিয়ে গেলেন। মনে হলো, যেন আমারই জন্য অপেক্ষা করছিলেন। প্রথম দেখা! সেই অনুভবটা ঠিক বলে বোঝানোর নয়। তার কেবিনে ঢুকতেই কাছে ডাকলেন। আমার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কত আদর করলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, 'খুব ভালো থেকো।' সেদিন আমারও সুযোগ হয়েছিল তার হাতে-পায়ে-গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়ার। অনেকক্ষণ কথাও হয়েছিল। খানিকটা সময় তো একেবারে একান্তে আমরা দু'জন। বেশ হাসিখুশি সুচিত্রা সেনকে দেখে ফিরে এলাম। আসার আগে বললেন, 'আবার এসো কিন্তু।'
এর পরে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত তার নার্সিংহোমে থাকাকালীন আমি রোজ গিয়েছি, শুধু এক দিন কলকাতায় ছিলাম না বলে যেতে পারিনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও দেখা করে এসেছিলাম। শুক্রবার সকালে গিয়ে দাঁড়ালাম তার নিথর দেহের সামনে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
তাকে দেখতে গিয়ে কোনো দিন ঘণ্টা দু'-তিন থাকতাম আমি।
সেই থেকে যতবার গিয়েছি, উনি কথা বলতে না পারলেও ইশারায় কাছে ডেকেছেন। হাত ধরে থেকেছেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। চা-কফি খেতে বলেছেন। গত পরশুও যখন গেলাম মুনমুনের সামনেই উনি হাত বাড়ালেন। হাতে সুচ ফুটিয়ে নানা রকম ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা, টিউব-পাইপ ইত্যাদি লাগানোর জন্য তার হাতের বহু জায়গায় কালশিটের মতো হয়ে গিয়েছিল। আমি সেখানে হাত বুলিয়ে দিতাম। উনি ভালোবাসতেন সেটা। নার্সকে বলেছিলাম ভালো করে তিনবার মলম লাগিয়ে দিতে। জানতে চেয়েছিলাম, 'খুব ব্যথা?' উনি বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, খুব।' কিন্তু নিজের রোগযন্ত্রণা নিয়ে কখনও কাউকে বেশি বিরক্ত করতে চাননি। অথচ মুনমুন-রাইমা-রিয়া এবং চিকিৎসকরা যে কী আন্তরিক পরিশ্রম করেছেন ওনাকে সুস্থ করে বাড়ি ফেরানোর জন্য, তা আমি কাছ থেকে দেখেছি।
এই তো কয়েক দিন আগেই আমরা নিজেরা বলাবলি করলাম, উনি নিজেই যখন আর হাসপাতালে থাকতে চাইছেন না, তখন রোববার বাড়ি নিয়ে যাওয়াই ভালো। দরকারে বাড়িতে হাসপাতালের মতো সব বন্দোবস্ত করে দেওয়া যাবে। তার আগে এক দিন খিচুড়ি খাওয়ার কথাও হলো। উনি খিচুড়ি খেতে ভালোবাসতেন। বললাম, এই শীতেই এক দিন খিচুড়ি রান্না করে আপনার বাড়ি নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে মজা করে খাব। উনি শুনে হেসেছিলেন। দুর্ভাগ্য, কোনোটাই হলো না।
তার আরও একটি ভালো লাগার কথা জেনেছি। 'হসপিটাল' ছবিতে তার লিপে গীতা দত্তের গাওয়া 'এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু ...' গানটি খুব প্রিয় ছিল তার। বলেছিলাম, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে এক দিন আপনার বাড়ি গিয়ে ওই গানটি শুনিয়ে আসব। সব কথাই এখন স্মৃতি! আমাদের সুন্দর বন্ধনে জড়িয়ে রেখে তিনি আকাশ মায়ের কোলে অন্য শান্তির নীড় খুঁজে নিলেন।
কয়েক দিন ধরেই তার শারীরিক অবস্থা খুব স্থিতিশীল ছিল না। সেটা চিকিৎসকরা তো বটেই, আমরাও বুঝতে পারছিলাম। তবু চেষ্টার ত্রুটি হয়নি। শেষের ক'দিন কথা বিশেষ বলছিলেন না। তারই মধ্যে তার মন ভালো করার জন্য মজা করতে চাইতাম, খিচুড়ি খাওয়ানোর মতো হাল্কা প্রসঙ্গ তুলতাম। কিন্তু মনের কোনায় একটা দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছিল।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নবান্ন থেকে বেরিয়ে বেলভিউ যাওয়ার পথেই ফোনে জানতে পারলাম, তার অবস্থা বেশ খারাপ। ডাক্তার মৈত্র, ডাক্তার নস্কর সবাই ভেঙে পড়েছেন। তবু গিয়ে তাদের সবার সঙ্গে কথা বলে আমার মতো করে জোর দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তার পরে ঢুকলাম মহানায়িকার কেবিনে। তিনি চোখ খোলার চেষ্টা করছিলেন। হাত ধরলেন। চোখের কোল বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে এলো। চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র তাকে বললেন, 'চিকিৎসার কারণে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। ক্ষমা চাইছি। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।' আসলে মহানায়িকা নিজেও আর চাইছিলেন না কষ্ট পেতে। বরং স্বমর্যাদায় শান্তিতে তার অভীষ্টলোকে চলে যেতে চেয়েছিলেন দ্রুত। তাই রক্ত পরীক্ষার জন্য সুচ ফোটালে বিরক্ত হতেন। নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন বা বাই-প্যাপ লাগাতে গেলে হাত সরিয়ে দিতেন। ভেন্টিলেশনে না দেওয়ার কথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন আগেই।
এই অবস্থায় আমরাও জেনে গিয়েছিলাম, আর বেশি সময় নেই। তিনি আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে যাবেন যে কোনো সময়। দু'দিন আগে থেকেই তাই পুলিশ কমিশনার, চিকিৎসক সবার সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করে রাখতে উদ্যোগী হই। সবই গোপনে। কারণ কাজটি বড় নির্মম। তবু কর্তব্য তো করতেই হবে। আমরা চাইনি তার শেষ ইচ্ছার কোনোরকম অমর্যাদা করতে। তার পরিবার যেমন বলবেন, সেভাবে সব করাটাই লক্ষ্য ছিল। মহানায়িকা নিজেকে জনবিরলে রেখেছিলেন। তাই শেষযাত্রা ও অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্থা আগে থেকেই এমনভাবে তৈরি ছিল যাতে তার মুখ প্রকাশ্যে না আসে।
সুচিত্রা মানে কি শুধুই রোম্যান্টিক নায়িকা? গত কয়েক দিন তাকে কাছ থেকে দেখার পর আমি কিন্তু এক অন্য সুচিত্রা সেনকেও আবিষ্কার করেছি। আমাকে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, 'অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জায়গা থেকে সুচিত্রা সেন কি আপনাকে বিশেষ নজরে দেখেছেন'? সে উত্তর তো আমার কাছে থাকার কথা নয়। যিনি জানেন, তিনি আজ অন্য লোকের যাত্রী। তবে এটা বলব, আমাকে ডেকে পাঠানোর আগে তিনি নিশ্চয় আমার কাজের ধারা সম্পর্কে একটু-আধটু জেনেছিলেন। আমার মাথায় তার আশীর্বাদের হাত তো আমি পেয়েছি! সর্বোপরি তার মনের দৃঢ়তা ছিল বলে মৃত্যু সম্পর্কেও এত উদাসীন হতে পেরেছেন তিনি।
আর ছিল ধর্মের প্রতি অগাধ আস্থা। তিনি রামকৃষ্ণ মঠের দীক্ষিত ছিলেন, সবাই জানি। কিন্তু তার প্রতিদিনের কত সময় তিনি ধর্মাচরণে কাটাতেন, নিজের ঠাকুরঘরে একান্তে পুজো-অর্চনায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন সেটা বলার মতো। এই অসুস্থতার মধ্যেও নার্সিংহোমে মঠ থেকে ফুল ও চরণামৃত এসেছে তার জন্য। তার শেষযাত্রার আগে এসেছেন মঠের সাধুরা।
তবে 'মুডি' ছিলেন খুব। মেজাজ খুশি থাকলে একেবারে হাসির ধারা। আবার কোনো কারণে মুড ভালো না থাকলে বা বিরক্ত হলে মুখের রেখায় চরম অভিমানের প্রকাশ। আমি নিজেই এটা দেখেছি। যদিও সৌজন্যের মাত্রা কখনও ছাড়াতেন না। মৃত্যুর দু'দিন আগেও আমাকে হাত তুলে নমস্কার জানাতে ভোলেননি। আর ফিটফাট ছিলেন এতটাই যে, ঠোঁটের ক্রিমটাও ঠিকঠাক মাখিয়ে দিতে হতো।
সব শেষে সেই অনিবার্য প্রশ্ন। কেমন দেখতে ছিলেন এখনকার সুচিত্রা সেন? কেমন চেহারা ছিল তার? এই লেখার সেই গোড়ার প্রসঙ্গে ফিরি। আমাদের সবার স্বপ্নের নায়িকাকে প্রথম দেখতে যাওয়ার দিনে আমার মনেও এই কৌতূহল যে ছিল না, বলি কী করে! আর গিয়ে কী দেখলাম? শুনলে আশ্চর্য হবেন, ওনার চেহারা একেবারে আগের মতোই আঁটোসাঁটো। বয়স ছাড়া ভাঙনের ছাপ নেই। কারণ যাঁরা মাথা উঁচু করে চলেন, তারা তো ভাঙতে জানেন না। তার মরদেহের সামনে দাঁড়িয়েও সেই কথাটি বারবার মনে হচ্ছিল। একেবারে শান্ত, সুন্দর মুখ, যেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছেন। নিজস্বতায় অনড় থেকে এই চলে যাওয়া তাকে চিরজয়ী করে রাখল। আমরা শুধু সেই জয়ের সাক্ষী থাকলাম।
বিষয়: বিবিধ
১৩২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন