প্রিয়জন
লিখেছেন লিখেছেন রবিউল করিম বাবু ২২ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৯:০৩:৫৭ রাত
স্মৃতিকথা (২০০২-২০০৩)
শক্ত পুরনো ইটের বিশাল দালান। চারদিকে ফুল ও ফলের বাগান। ভেতরে বিস্তৃত উঠোন, বাইরে সবুজ মাঠ এবং ঘাটবাধা পুকুর। এসব মিলে বাড়িটার নাম বড়বাড়ি। পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে পূর্ব-উত্তরে যতদুর চোখ যায়, সমস্ত কিছুর মালিক ওই বড়বাড়ির লোকজনেরা। ফলে গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বারদের চেয়েও ওই বাড়ির মুরব্বিদেরই ইজ্জত সম্মান বেশি। সেই বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ পুত্রটির নাম মাহমুদ হাসান অনু। বনেদি এবং উচ্চবংশের ছেলে হওয়ায় তার চেহারা সুরতেও একটা রাজপুত্র রাজপুত্র ভাব আছে। এই ভাবের কারণে সমবয়সী হওয়া সত্তেও অনুর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় একটু দেরিতেই। প্রাইমারী পেরিয়ে হাইস্কুলে যাওয়ারও অনেক পরে। আমি আবার খেলাধুলায় খুব ভালো ছিলাম। এজন্য এলাকায় সবাই আমাকে চিনতো এবং সম্মান করতো। আমার এই সাফল্যের ঈর্ষাতেই হয়তো ক্লাসের ফার্স্ট বয় মাহমুদ হাসান অনুর রাজকীয় ভাবটা একটু একটু করে গলতে শুরু করলো। একদিন দেখি আমি সাইকেল নিয়ে মাঠে যাওয়ার পথে অনু একটা ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে রাস্তায়। আমাকে থামিয়ে বলল- বাবু কেমন আছো?
=ভালো আছি, কী খবর তোমার?
**খবর আর কি, চলো তোমার সঙ্গে মাঠে যাবো। তুমি তো প্রতিদিন এই দিক দিয়েও যাও। যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে গেলেই পারো।
আমি হাসলাম, বললাম ওঠো পেছনে। অনু সাইকেলের পেছনে উঠে বসলো। ব্যস, শুরু হয়ে গেলো আমাদের বন্ধুত্ব। ওর সঙ্গে কয়েকদিন মেলামেশা করে বুঝলাম ওর চেহারায় যতটা অহমিকা, মন ততটা অহংকারী নয়। বেশ বন্ধুত্বপুর্ন সহজ মানসিকতা আছে তার মধ্যে। শুধু বংশ বা পারিবারিক ব্যবধানের কারণেই অনেকে তাকে বুঝতে পারেনা। আমি পারলাম। খুব ভালোভাবেই বুঝলাম অনু খুব চমৎকার একটা ছেলে। অনুও বেশ ভক্ত হয়ে গেলো আমার। আমরা দুজন গ্রীস্মের প্রখর দাবদাহে ঘন্টার পর ঘন্টা পুকুরে গোসল করে চোখ লাল না করে বাসায় ফিরতাম না। বিকেলে ফুটবল খেলা শেষে সন্ধ্যা লাগালাগি সময়ে ক্ষুদার্ত পেটে দুজনে চলে যেতাম স্টেশন বাজারে মালাই চা আর বনরুটি খাওয়ার জন্য। তারপর সাইকেলটা হাতে নিয়ে গল্প করতে করতে ক্লান্ত পায়ে দুজনে বাসায় ফিরতাম সন্ধ্যার পর। বাসায় ফিরে পড়াশোনা আর হয়না বললেই চলে। পাশে হারিকেন, সামনে বই, ঢুলুঢুলু চোখে অ্যা য়ু অ্যা য়ু করতে করতে কোনরকম রাত দশটা বাজলেই হয়, খেয়েদেয়েই ঘুম। তারপর সকাল, আবার বিকেলের প্রতিক্ষায় সারা দিন ছটপট করা। কখন বিকেল হবে কখন মাঠে যাবো আর দেখা হবে প্রাণপ্রিয় বন্ধুটির সঙ্গে, যার গলা জড়িয়ে ভরসন্ধ্যায় গ্রামের জোছনাময় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বলবো মন প্রাণ খুলে। আমি বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলাম অনু নামের এই ছেলেটার উপর পূর্ণ আস্থা এবং নির্ভর করা যায়। ঠিক করলাম এই বন্ধুটাকে আমি সারাজীবন ভালোবাসবো, বিশ্বাস করবো, শ্রদ্ধা করবো। কিন্তু সময় এবং জীবন যেহেতু বহমান, তাই আমরা হাইস্কুল শেষ করে দুজন দুইদিকে চলে গেলাম। আমি আসলাম ঢাকায়, অনু ভর্তি হলো শহরের একটা কলেজে। বিদায় বেলায় কথা দিলাম কথা নিলাম চিঠি লিখবো দেখা না হয় যতদিন। ঢাকায় এসে নতুন মানুষ নতুন পরিবেশে আমার মন বসেনা। শত মানুষের ভিড়েও নিজেকে একা মনে হয়। প্রিয় বন্ধু অনুর মুখটা ভেসে থাকে চোখের সামনে। নতুন ঠিকানা দিয়ে চিঠি লিখলাম ওকে। ওর চিঠি পেলাম ১২ দিন পর। চমৎকার হাতের লেখা সংকলিত ভাষাসমৃদ্ধ পরম যত্নে লেখা সেই চিঠি পড়ে কী যে আনন্দ হতো আমার! চিঠির খামগুলো খুলতাম সতর্কভাবে, যাতে চিঠির কোন অংশ একটুও না ছিঁড়ে। পড়া শেষে গভীর মমতায় চিঠিগুলো আবার রেখে দিতাম ট্রাংকের ভেতর। একদিন কি এক সামান্য কারণে একটু রাগ করলাম ওর উপর। লিখলাম, তুই আর চিঠি লিখিসনা আমাকে, তোর মতো বন্ধু আমার দরকার নাই। ওমা, ও দেখি সত্যি সত্যি চিঠি লেখা বন্ধ করে দিল! আমি যথারীতি আগের মতই চিঠি পাঠাই, খবর নেই ক্ষমা চাই, কিন্তু দিন যায় মাস যায় অনুর চিঠি আর আসে না। আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। কী আশ্চর্য, এতো সামান্য কারণে বন্ধুর উপরে এতোদিন অভিমান করে থাকে কেউ? অভিমান এতো তীব্র হয় মানুষের!
আমার পরীক্ষা ঘনিয়ে আসলো, পরীক্ষা দিলাম। এবার বাড়ি যাওয়ার পালা। অনুরও পরীক্ষা শেষ, সেও নিশ্চই বাড়ি এসেছে। আবার কিছুদিন একসাথে.. .। শালা রাজপুত্রের বাচ্চা, বাড়ি আসি দাড়া। কানের নিচে দুই থাপ্পড় মারলে রাগ অভিমান সব পানি হয়ে যাবে আগের মতো।
ও আবার ভি-নেক টি শার্ট খুব পছন্দ করে। গেলাম নিউমার্কেট। চাররঙা চারটা টি শার্ট কিনলাম রাজপুত্রের জন্য। ব্যাগের একেবারে তলানীতে ফেলে রাখলাম শার্টের প্যাকেটটা, না হলে মা আবার দেখে ফেললে কিচকিচ শুরু করবে***বন্ধু বান্ধবের লেইগা ট্যাকা নষ্ট কইরা এইসব কিননের কি দরকার হ্যাঁ? তুই কি কামাই করস.. .।
বাড়ি পৌছলাম প্রায় সন্ধ্যার দিকে। রাতে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে খেতে বসে দেখি মা তরকারির বাটি দিয়ে পাটি ভর্তি করে ফেলেছেন। গস্তো ভুনা, কইমাছ ভাজি, আলু ভাজি, ডাল.. .। সবই আমার প্রিয় তরকারি কিন্তু আমার চোখে মুখে বাস ভ্রমনের রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে দুইমুঠ ভাতও খেতে পারবোনা হয়তো আর এতোসব রান্নাবারার কি দরকার ছিল কে জানে। মাকে এসব কে বুঝায়, মাতো মাইই। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে অথচ মা একটা হাতপাখা নিয়ে বসে আছেন সামনে। পুরোন অভ্যাস, আমি বললাম.. .
=মা তুমিও খাও।
**আমি পরে খামু বাজান, তর আব্বায় আহুক।
=আব্বায় আইতে দেরি আছে, তুমি আমার লগে খাও। তোমার খাওয়া দেখি আর খাই। নাইলে আমি খাইতেয়ারুম না।
মা একটা প্লেটে একমুঠ ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলো। আমি বললাম..
=রিফাতের কি খবর, স্কুলে যায় ঠিকমতো না দৌড়াদৌড়ি করে সারাদিন?
**ইস্কুলেতো যায়রে, পড়ালেহাতেও ভালো, তয় কথা হুনেনা। পুকুরে নামলে আর উডেনা। তর বাপেরে কইলে কয় বড়ডার মতো হইছে। তুই কাইল সকালে অরে এটটু ধমক টমক দিয়া দিছ।
=আচ্ছা দিমুনে, তুমি খাও।
**হ খাইতাছি, তুই ভাত ল চাইড্ডা। দক্ষিণ পাড়ার বড়বাড়ির খবর কিছু হুনছস?
=কি খবর মা?
**ওই যে চুল বড় বড় পোলাডা। তর লগে যে ঘুরতো। মনু না কি জানি নাম?
=মনু না মা, অনু। কি হইছে কও।
**হায়রে বাজান, আল্লায় কার কুনসুম মরন দিবো কেউই কইতেয়ারেনা। অতো সোন্দর জোয়ান মরদ পোলাডা। বাপের মটরসাইকেল লইয়া কইজানি ফুটবল খেলতে যাইতাছিল। যাওনের সুম রুপগঞ্জ বিরিজের উপ্রে এক টেরাকের লগে এমুন জোরে ধাক্কা... .. .!x
আমি বেশ পরিস্কার বুঝতে পারলাম একটা হীম শীতল সাঁপ আমার ঠান্ডা শরীর বেয়ে নিচে নেমে গেল। একটা নীল কষ্টের ভারী থাবা প্রচন্ড শক্তি দিয়ে আঘাত করলো আমার বুকে। আমার চোখ ভিজে দৃষ্টি ঘোলা হয়ে গেল মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই। আমি বোবা হয়ে গেলাম। তবুও খুব জোরে জোরে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করলো- অনু, ভাই আমার, আমি তোকে কেন খেলতে শিখিয়েছিলামরে। কেন তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম মাঠে। আমার এতো বিশ্বাস এতো ভালোবাসা উপেক্ষা করে তুই চলে গেলি! আমি আর কাকে চিঠি লিখবো? কোথায় পাবো তোর মতো আরেকটা প্রাণের বন্ধু? আরেকটা প্রিয়জন?
বিষয়: বিবিধ
১৪৮২ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন