মুসলমানদের দুর্ভাগ্য ও একটি দৃষ্টিভঙ্গি
লিখেছেন লিখেছেন সত্য এবং সুন্দর ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৪:১৩:৩৯ বিকাল
অবসর সময়ে যে আলোচনাগুলো মুখরোচক হয়ে ওঠে তারমধ্যে একটি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অনগ্রসরতা। প্রায়শ কথাটা এভাবে বলা হয় যে,
‘জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনগ্রসর বলেই মুসলমানদের এই দুর্গতি।’
এটা ঠিক যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের তুলনায় প্রাচ্য পিছিয়ে রয়েছে। তবে এটাও ঠিক যে, সেই অনগ্রসরতাই এ জাতির দুর্গতি ও পরাধীনতার কারণ নয়। প্রকৃতপক্ষে সমস্যা অন্য জায়গায়। মুসলিম উম্মাহর মাঝে কিছু বৈশিষ্ট্যের জাগরণ সম্ভব হলে বিদ্যমান জ্ঞান ও প্রযুক্তিই তাদের জাতীয় প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। তাই মুসলমানদের পরাধীনতার প্রসঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনগ্রসরতার প্রশ্ন অবান্তর; বরং তা মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টিকে সরিয়ে দেয়, উপরন্তু' কিছু আত্মঘাতী বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
এ প্রসঙ্গে দু’টি বিষয়ে চিন্তা করা যায়। এক. আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ দুই. আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের পারদর্শিতা। আমাদের দেশের কথাই ধরুন। এটি একটি মুসলিম দেশ এবং এদেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ মুসলিম। তবে আধুনিক শিক্ষা-ব্যবস্থাই এদেশের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত শিক্ষার মূলধারা। অতএব দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থী আধুনিক শিক্ষা-ব্যবস্থায় শিক্ষাগ্রহণ করছে। এটি শুধু বাংলাদেশের কথা নয়, সকল মুসলিম দেশে আধুনিক শিক্ষা-ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত। তদ্রূপ যেসব দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু সেখানকার পরিসংখ্যান গ্রহণ করলেও একই চিত্র পাওয়া যাবে। সেসব দেশের অভিবাসী মুসলিম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় শিক্ষা ধারার সঙ্গেই জড়িত এবং বলা বাহুল্য তা আধুনিক শিক্ষা। তাহলে কীভাবে বলা যায় যে, মুসলিম-সমাজে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা নেই? কোন শিক্ষিত মুসলমান যখন এমন কথা উচ্চারণ করেন তখন একটি মারাত্মক আশঙ্কা উঁকি দেয় যে, তাহলে কি মুসলমান অবচেতন মনে নিজের পরিচয়ও ভুলতে বসেছে? তারা কি শুধু মসজিদ-মাদরাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরই মুসলমান বলে ভাবতে শুরু করেছেন?
যাই হোক, দ্বিতীয় প্রসঙ্গ অর্থাৎ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিমদের পারদর্শিতার বিষয়টিও এখান থেকে প্রমাণিত হয়। যেহেতু সিংহভাগ মুসলিম আধুনিক শিক্ষা-ব্যবস্থায় জ্ঞান অর্জন করছে তাই মুসলিম-সমাজে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোন বিষয় আছে কি, যা নিয়ে মুসলিমরা পড়াশোনা করছেন না? বিশেষজ্ঞতা ও পারদর্শিতারও অভাব আছে বলে তো মনে হয় না। এমনকি বৈশ্বিক পর্যায়ের প্রতিভাও মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি বা হচ্ছে না এমন বলা হলে তা হবে সত্যের অপলাপ। কোন উদ্যমী ব্যক্তি যদি এ ধরনের মুসলিম প্রতিভার একটি তালিকা তৈরি করেন তাহলে, হলফ করে বলা যায়, তা বেশ দীর্ঘই হবে।
অতএব এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন যে, মুসলিম সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা নেই। কেউ হয়তো বলতে পারেন, ‘পাশ্চাত্যের সমপরিমাণ তো নেই।’ তাহলে বলব, আপনি ঠিক বলেছেন, কিন্তু এর তো প্রয়োজনও নেই। এখানে তুলনা নয়, পর্যাপ্ততাই মূল। অর্থাৎ ওদের তুলনায় আমাদের কম আছে না বেশি-এটি মূল প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের যা আছে তা কি আমাদের প্রয়োজন পূরণে পর্যাপ্ত ছিল না? অবশ্যই ছিল। সিংহভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় সংশ্লিষ্ট থাকার পরও তা পর্যাপ্ত নয়-এটা হাস্যকর।
তাহলে কেন আমাদের প্রয়োজন পূরণ হচ্ছে না? কেন মুসলমান পরাধীন? মূল সমস্যাটা কি? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরকে সাহসিকতার সঙ্গে ভাবতে হবে। সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কি হতে পারে তা পরবর্তী প্রশ্ন। প্রথমে সমস্যা নির্ণয়ে সাহসী ও ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া অপরিহার্য। আমাদের মূল সমস্যা মাত্র একটি। আমি অত্যন্ত- স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই যে, তা হচ্ছে মুসলিম হয়েও আমরা জীবনের সকল অঙ্গনে ইসলামকে ত্যাগ করেছি।
মুসলিম জাহানের বিভিন্ন ভূখণ্ড দীর্ঘ সময় অমুসলিম উপনিবেশ দ্বারা আক্রান্ত- ছিল। সেই পরাধীনতার যুগে অমুসলিমরা আমাদের সমাজ-ব্যবস্থা, অর্থ-ব্যবস্থা ও বিচার-ব্যবস্থার যে নীতি ও কাঠামো করে দিয়েছে স্বাধীনতার পরও তা আমরা ত্যাগ করতে পারিনি। এর অনিবার্য প্রভাব পড়েছে আমাদের জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থায়।
শুধু তাই নয়, পরাধীনতার যুগে তারা আমাদের যে মানস-কাঠামো তৈরি করেছে আমরা এখনও তা বহন করছি। চিন্তা ও মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণ কোন কিছুতেই আমরা স্বকীয়তায় প্রত্যাবর্তন করতে পারিনি। তাই জাতি হিসেবে মুসলিম হয়েও আমাদের সমাজ-ব্যবস্থা, অর্থ-ব্যবস্থা ও বিচার-ব্যবস্থায় এর কোন প্রভাব নেই। অতএব শিক্ষা-ব্যবস্থাতেও তা অপরিহার্যভাবেই অনুপস্থিত। আমরা পারিনি আমাদের জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ঢেলে সাজাতে, এমনকি সফলভাবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্ত করতেও আমরা সক্ষম হইনি। ফলে লক্ষ লক্ষ মুসলিম শিক্ষার্থী জ্ঞান-বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করলেও চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত স্বাতন্ত্র অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। একজন অমুসলিম যেমন স্রষ্টা সম্পর্কে নিষ্পৃহ হয়ে সৃষ্টিজগতকে পর্যবেক্ষণ করে আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ও কি তা-ই করেন না? ফলে সৃষ্টির অপার রহস্য উন্মোচিত হওয়ার পরও এই জ্ঞান তাদেরকে স্রষ্টা পর্যন্ত পৌঁছুতে সাহায্য করে না।
জীবন-দর্শন ও আচরিত জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। একটি সাহসী জাতির যে স্বাধীন নির্বাচন-শক্তি থাকা অপরিহার্য আমরা তার পরিচয় দিতে পারিনি। তাই পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে তাদের অকল্যাণকর জীবন-দর্শনও আমরা গ্রহণ করে ফেলেছি। অথচ এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। পাশ্চাত্যের ভোগবাদী ও নাস্তিক্যবাদ কি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপরিহার্য অনুষঙ্গ? এটা কি কোনোভাবেই সম্ভব নয় যে, আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গ্রহণ করব, কিন্তু তা প্রয়োগ করব আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও জীবন-দর্শনের আলোকে? অর্জিত জ্ঞানকে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিন্যাস- করে নিতে পারলে, সন্দেহ নেই, আমরাই হয়ে উঠতাম পৃথিবীর সেরা শক্তি। এটি নিছক একটি তত্ত্ব নয়, মুসলিম উম্মাহর অতীত ইতিহাস এরই জ্বলন- প্রমাণ।
আমাদের মাঝে সর্বোচ্চ সম্ভাবনা ছিল পৃথিবীর নেতৃত্ব গ্রহণের এবং বিশ্ব মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার, কিন্তু চিন্তাগত পরাধীনতা ও নির্বিচার পরানুকরণ সেই অমিত সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তিক্ত হলেও সত্য এই যে, সভ্যতা, আধুনিকতা, অগ্রসরতা ইত্যাদি বিভিন্ন অসার শব্দ ও অলিক কল্পনার দ্বারা দাসত্ব ও পরানুকরণকেই শিক্ষা ও শিক্ষা-ব্যবস্থার মৌলিক দর্শনরূপে গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে মুসলমানদের মানস-কাঠামো এমনভাবে গড়ে উঠছে যে, নিজ সম্ভাবনাকে অনুধাবন করাও তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি যখন রোগ সম্পর্কেই উদাসীন হয়ে যায়; তখন আরোগ্য লাভ অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।
তবুও শেষ কথা এই যে, হতাশার ঘন আঁধারেও আশার আলোকবিন্দু দেখা যাচ্ছে। অব্যাহত জুলুম-অত্যাচার এবং শোষণ ও বঞ্চনার কারণে মুসলিম জাহানে প্রাণের স্পন্দন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে দীর্ঘ ভোগবাদী ও নিপীড়নমূলক জীবন-ব্যবস্থায় অতিষ্ঠ হয়ে অমুসলিম সমাজেও ইসলামী জীবনাদর্শের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। ওই সময়টা বোধ হয় খুব বেশি দূরে নয় যখন ইসলামই হয়ে উঠবে বিশ্ব মানবতার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। আর ইসলাম যেহেতু সর্বজনীন আদর্শ তাই তা গ্রহণ করে অন্যান্য জাতি যদি আদর্শিক প্রতিযোগিতায় অগ্রগামীও হয়ে যায় তবে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। তখন মুসলিম-সমাজে, মুসলিম পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে অতি সহজে ইসলামী পরিচয় পেয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যারা এর মূল্য অনুধাবনে সক্ষম হয়নি তারা ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
‘তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে আমি তোমাদের পরিবর্তে নিয়ে আসব অন্য এক সম্প্রদায়। অতঃপর তারা তোমাদের মতো হবে না।’
আমাদের যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম-পরিচয় দান করেছেন তারা নিশ্চয়ই এই দুর্ভাগ্য বরণ করতে প্রসঙ্গত নই। সেক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শের দিকেই আমাদের ফিরে আসতে হবে। সম্ভবত এখনো তার সুযোগ রয়েছে।
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ
বিষয়: বিবিধ
১২৪০ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কোন স্লেইভ শ্রেনী কখনো তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনা - যতক্ষন না সে কোন আদর্শকে আষ্ট্রে পৃষ্ঠে আকড়ে না ধরে - আমাদের জন্য সুখবর হল - আমাদের মধ্যস্থিত অল্প কিছু মানুষের কাছে সেই ডিভাইন আদর্শ আছে - শুধু দরকার তা নিজের মধ্যে ধারন করা ও অন্যকে করতে উৎসাহিত এবং ক্ষেত্র বিশেষে বাধ্য করা।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন