গনতন্ত্র, সংবিধান, রাজনীতি এবং নির্বাচনী সংকট নিরসনে কিছু প্রস্তাবনা
লিখেছেন লিখেছেন সত্য এবং সুন্দর ০৮ জানুয়ারি, ২০১৪, ০১:১৭:৩২ দুপুর
“Govt. of the people, for the people and by the people” বলেছিলেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যাব্রাহাম লিংকন। অর্থ্যাৎ গণতন্ত্রের একমাত্র উৎসই হলো জনগণ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও বিরোধীদের মত প্রকাশের ব্যবস্থা করবো। চিরস্থায়ী ক্ষমতা কুক্ষিগত করা গণতন্ত্রের আচরণ হতে পারেনা। বিরোধীদের মত প্রকাশ, নাগরিকের অধিকারের নিশ্চয়তা, সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখাই হলো গণতন্ত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হবার পর আজ অবধি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিপূর্ণ পরিবেশ আমরা পাইনি। গণতন্ত্রের এই অগ্রযাত্রা বারবার ব্যহত হয়েছে এক নায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, স্বশস্ত্রবাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং ক্ষমতা লোভের কারণে।
একটি শক্তিশালী সংবিধান আজও বাংলাদেশের জনগণ পায়নি। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে সকল নির্বাচিত সরকারই নিজের ইচ্ছেমত সংবিধানকে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন করেছে। যেখানে জনগণের মতের প্রতিপলন ঘটেনি। সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিজেদের খেয়াল খুশিমত অবৈধ সকল কাজই বিগত সরকার গুলো করেছে। যার শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে জনগণকেই।
একটি সুন্দর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, শক্তিশালী সংবিধান, স্বাধীন বিচার বিভাগ, নিরপেক্ষ প্রশাসন সকল জনগণের আত্মিক চাওয়া হলেও সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল ও নেতারা নিজেদের ক্ষমতার লোভে এসব চাওয়াকে পাশ মনগড়া সংবিধান রচনা করেছেন। বির্তকিত করা হয়েছে বিচারালয়কে, দলীয়করণ করা হয়েছে প্রশাসনকে। ফলে তৈরী হয়েছে একটি জুলুমতান্ত্রিক সমাজ, কন্ঠস্তব্দ করা হয়েছে বিরোধী মতের, নির্যাতিত হচ্ছেন জনগণ। কলংকিত করা হয়েছে গণতন্ত্রকে।
সময়ের কালক্রমায় আজ দাবী উঠেছে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু পরিবেশের, দাবী উঠেছে শক্তিশালী কার্যকর সংবিধানের, মুক্তি চাচ্ছে পরিবারতান্ত্রিকতা থেকে, সোচ্চার হচ্ছে নব প্রজন্ম, বন্ধ হোক ক্ষমতার দ্বন্ধ, প্রতিষ্ঠিত হোক জনগণের অধিকার।
সমাধানের প্রথম উপায় হচ্ছে একটি শক্তিশালী সংবিধান। এ বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা পেশ করা হলো।
০১. প্রধানমন্ত্রী পদটি বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান ক্ষমতা সম্পন্ন পদ। বাংলাদেশের ইতিহাসে বারবার একই মুখ গুলো এই পদে সমাসীন। যার ফলে ক্ষমতার লোক এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও একক কর্তৃত্ব এখানে প্রকট। এই পদটাকে কার্যকর এবং যোগ্য নেতৃত্ব দ্বারা অলংকিত করার জন্য প্রয়োজন কিছু সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতা। একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র দুইবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে পারবে। দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকার পর এই পদের জন্য উক্ত ব্যক্তি অযোগ্য বিবেচিত হবেন। ফলে দেখা যাবে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা পাবে, গণতন্ত্র আরো উৎকর্ষিত হবে। যোগ্য এবং নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে। পরিবার তান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত হবে দেশ।
০২. রাষ্ট্রপতি পদটাকে আরো কার্যকর ক্ষমতা সম্পন্ন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি কোন দলের রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে ইতিপূর্বে জড়িত ছিলেননা দেশের এমন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করবেন সাংসদরা।
০৩. মন্ত্রী, এমপিদের নির্বাচন করার সর্বোচ্চ বয়ষসীমা হবে ৭০ বছর। ৭০ উর্ধ্বো কোন ব্যক্তি রাজনীতিতে সরাসরি অংশ গ্রহন করতে পারবেনা।
০৪. মন্ত্রী ও মন্ত্রী পদমর্যাদার পদে সর্বোনিন্ম শিক্ষাগত যোগ্যতা হতে হবে মার্ষ্টাস। তেমনি ভাবে এমপি ও এ মর্যাদার পদের সর্বোনিন্ম শিক্ষাগত যোগ্যতা হতে হবে ডিগ্রী। ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের যোগ্যতা হতে হবে কমপক্ষে এইচএসসি। এবং নুন্যতম এসএসসি পাশ ছাড়া কোন প্রকার নির্বাচনে অংশ গ্রহন করা যাবে না।
০৫. দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কিত না করার জন্য অবসর নেয়ার পরও কোন প্রকার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহন করতে পারবেনা। অনুরূপ সরকারী আমলারাও অবসর নেয়ার পর রাজনীতিতে আসতে পারবেনা। এতে প্রশাসনে দরীয়করণ এবং গোলামী অনেকাংশে কমে যাবে।
০৬. সরকারী কোন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দল গুলোর ব্যানারে বা সমর্থিত ব্যানারে বা অঙ্গ সংগঠন হিসেবে কোন দল বা ইউনিয়ন থাকতে পারবেনা। রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন বা লেজুড় ভিত্তিক কোন সংগঠন সরকারী কোন প্রকার সংস্থায় থাকতে পারবেনা।
০৭. গণতন্ত্রের পরিপূর্ন পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সকল রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সাধারণ সম্পাদক পদে এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৩ বার নির্বাচিত হতে পারবেন। প্রতি নির্বাচনের মেয়াদ হবে ৪ বছর। এতে পরিবার তান্ত্রিকতা বিলোপ হবে, যোগ্য নেতৃত্ব তেরী হবে, গণতন্ত্রের আভ্যন্তরীন চর্চা বাড়বে, নেতৃত্বের গতিশীলতা সৃষ্টি হবে এবং অযোগ্য ব্যক্তি পদ আকঁড়ে থাকতে পারবেনা। নির্বাচন কমিশনের আয়োজনে সকল দলের দলীয় কাউন্সিল অনু্ষ্ঠিত হবে।
০৮. জাতীয় নির্বাচনে একজন প্রার্থী একাধিক আসনে নির্বাচন করতে পারবেনা। ফলে স্থানীয় নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে।
০৯. নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে জোট গঠন করা যাবেনা। নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠনে সমস্যা হলে শুধুমাত্র সরকার গঠনকল্পে ২ দলীয় জোট সরকার গঠন করা যাবে। এতেকরে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল গুলো প্রভাব ফেলতে পারবেনা। এবং অন্য দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা যাবেনা।
১০. একক ভাবে সরকার গঠন করতে হলে ৫০% ভোট বা আসন পেতে হবে। কোন দল যদি সরকার গঠন করার মত একক সংখ্যাগরিষ্ঠ্যতা না পায় কিন্তু ৩০% ভোট পায়, তাহলে % এর আলোকে উক্ত দলকে সরকারে অংশিদার করতে হবে। এক্ষেত্রে মন্ত্রনালয় বন্টনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত দলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। ফলে সরকার ক্ষমতার একক অপব্যবহার করতে পারবেনা। যার ফলশ্রুতিতে একটি সূষ্ঠূ গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে উঠবে।
১১. যুগপোযুগি একটি সংবিধানের অভাব বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। প্রয়োজন একটি শক্তিশালী কার্কর, বাস্তবভিত্তিক, আধুনিক এবং গ্রহনযোগ্য সংবিধান। এর জন্য বাংলাদেশের বিগত নির্াচনে প্রতিনিধিত্বকারী সকল দল সমূহ থেকে প্রতিনিধি নিয়ে এবং বিচারপতি, বুদ্ধিজিবী, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ দিয়ে সমন্বিত একটি কমিটি উন্নত বিশ্বের সংবিধান বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, রাশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মান, চীন, সেীদি আরব, তুরস্ক, ইরান ইত্যাদি দেশের সংবিধান অনুসরণ করে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও সকল ধর্মের উপযোগী একটি সংবিধান প্রনয়ণ করে এর সকল ধারা সমূহ ধাপে ধাপে সকল জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ করে মতামত, সংশোধনী নিতে হবে এবং জনমত গঠন করার ব্যবস্থা করতে হবে। চুড়ান্ত খসড়া প্রনয়ণের পর গণভোটের মাধ্যমে উক্ত সংবিধানকে বৈধ করতে হবে। সংবিধানের কোন ধারা পরিবর্তন করতে হলে গণভোটের মাধ্যমে করতে হবে। ফলে সংবিধান নিয়ে কেউ রাজনীতি এবং যাচ্ছেতাই কাটছাট করতে পারবে না। রাজনৈতিক দল গুলো সংবিধান মানতে বাধ্য হবে। সংবিধানের মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকবে।
১২. রাজনৈতিক দল সমূহের কোন ছাত্র সংগঠন থাকতে পারবেনা। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবেও নিয়ন্ত্রিত হতে পারবেনা। ফলে ছাত্র সংগঠনে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। দলীয় লেজুড় ভিত্তি বন্ধ, রাজনৈতিক হানাহানি থেকে ক্যাম্পাস মুক্ত হবে। দেশের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে। মেধাই হবে নেতৃত্বের কোয়ালিটি।
১৩. বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ মুজিবর রহমান ও শহীদ জিয়াউর রহমান হচ্ছেন স্বরণীয়, বরণীয়, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু কুলষিত রাজনীতির কারণে এই মহান নেতাদের নিয়ে কটুক্তি করার সাহস দেখায় রাজনৈতিক দল গুলো। এই মহান ব্যক্তিদ্বয় হচ্ছেন রাষ্ট্রের সম্মানের সাথে জড়িত। উনাদের সম্মান রক্ষার্থে কোন রাজনৈতিক দল উনাদের নাম বা ছবি ব্যবহার করতে পারবেনা। উনাদের নিয়ে কোন প্রকার দলীয় শ্লোগান দেয়া যাবেনা। সরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহে উভয় ব্যক্তির ছবি টানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এত করে উনাদের যর্থাথ সম্মানের রক্ষা করা সম্ভব হবে।
১৪. দেশের সর্বোচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন একটি নির্বাহী পরিষদ গঠন করতে হবে। এই পরিষদের সদস্য হবেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, সর্বোচ্চ আমলা, মন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক গর্ভনর, স্বশস্ত্র বাহিনীর প্রধানগণ। সংসদ কর্তৃক প্রনয়ণকৃত সকল আইন, নীতিমালা, পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতিমালা, প্রতিরক্ষা বিষয়ক সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ উক্ত পরিষদের অনুমোদন ব্যতীত পাশ করা বা সিদ্ধান্ত নেয়া যাবেনা। যার ফলে সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারবেনা। সরকার পরিবর্তন হলেও দেশের আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র বিষয়ক সিদ্ধান্ত সমূহ সব সময় একই থাকবে।এই পরিষদের বয়ষ সীমা হবে ৭৫-৮০ পর্যন্ত।
উপরে মৌলিক কিছু প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। মুক্তিকামী সকলেই সম্ভবত এর সাথে একমত পোষন করবেন। কিন্তু কে নেবে এ উদ্যোগ? যেখানে প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের মুখ্য বিষয় হচ্ছে ক্ষমতা, সেটা যেভাবেই হোকনা কেন! আমরা সাধারণ জনগণ একটি স্বাধীন বাংলাদেশ দেখতে চাই, স্বাধীনতা চাই, অধিকার চাই, শান্তি চাই, শৃঙ্খলা চাই, ন্যায্য বিচার চাই, সুস্থ্য জীবনের নিশ্চয়তা চাই, আইন মানতে চাই, দেশেপ্রেমিক নেতা চাই, নিরপেক্ষ সেবক প্রশাসন চাই, চাই সত্যিকারের গনতন্ত্র, চাই বিশ্বের দরবার মাথা উচুঁ করে দাড়াঁতে চাই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, “রাজনীতি একটি নৈতিক বিজয়” এটাই হোক আমাদের রাজনৈতিক দল গুলোর আদর্শ।
লেখক : প্রভাষক, ফেনী ভিক্টোরিয়া কলেজ।
বিষয়: রাজনীতি
১৫৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন