বিগত ৫ বছরে ভয়াবহ নারী নির্যাতন বাদ যায়নি ছাত্রী-শিক্ষিকা অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ মানবাধিকার নেত্রীও সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার পর্দানশিনরা
লিখেছেন লিখেছেন ডাক্তার রিফাত ৩০ জানুয়ারি, ২০১৪, ১০:৩০:২৮ রাত
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বিগত পাঁচ বছরে দেশে নারী নির্যাতনের চিত্র ছিলো ভয়াবহ। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষিকা, অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ, চাকরিজীবী ও নারী মানবাধিকার নেত্রী কেউই বাদ যায়নি এ সরকারের জুলুম-নির্যাতনের হাত থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার এবং দলীয় ক্যাডারদের মাধ্যমে নিত্যনতুন পৈশাচিক কায়দায় চালানো নির্যাতনের চিত্রগুলো অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বিশেষ করে জঙ্গি কর্মকা-ের অপপ্রচার চালিয়ে ধর্মপ্রাণ নামাযী, বোরকাধারী ও ভিন্ন রাজনৈতিক মত ও আদর্শের কর্মী সমর্থকদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা ছিলো বেশি। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই নিরীহ নারীদেরকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বহু ঘটনায় দেশ-বিদেশের বিবেকবান মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তবে এক্ষেত্রে সরকার ও তাদের মদদপুষ্ট মানবাধিকার এবং নারী সংগঠনগুলো ছিলো একেবারে নির্বিকার। ধর্মীয় কিছু সংগঠন এসব কর্মকা-ের প্রতিবাদ করতে গেলেও তারা সরকারের প্রতিরোধের শিকার হয়।
এদিকে ধর্মপ্রাণ নারীদের নির্যাতনের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতে কাউকে বোরকা বা ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না মর্মে আদেশ দেয় উচ্চ আদালত। একই ধরনের নির্দেশনা দিয়ে পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বোরকা বিরোধী এসব আইন ও পরিপত্র জারির প্রেক্ষিতে দেশে অনৈতিক কর্মকা- আরও বেড়ে যায় বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়। সরকারিভাবে ধর্মীয় পোশাকবিরোধী এসব তৎপরতায় দেশে নারী ধর্ষণ, ইভটিজিং, ছাত্রী-শিক্ষিকা লাঞ্ছনাসহ নানা অনৈতিক কর্মকা- বেড়ে যায় বহুগুণে। বিশেষ করে সরকারদলীয় ক্যাডারদের দ্বারা যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনায় সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনৈতিক কর্মকা-ের প্রতিবাদ করায় শিক্ষক খুনসহ সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন অনেকে। আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয় অনেক তরুণী। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই যে বোরকাধারীসহ ধর্মপ্রাণ মানুষের হয়রানি বেড়ে যায় তার প্রমাণ আবারও পাওয়া গেছে গত ৫ বছরের শাসনামলে।
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আওয়ামী মহাজোটের প্রথম চার বছরে সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৬৭ হাজার ২২৯টি। ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ১২ হাজার ৯৭১ জন। যৌতুক ও নানা কারণে স্বামীর ঘরে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দুই হাজার পাঁচজন নারী। অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৪৪২ জন। নির্যাতনের কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে দেড় হাজারের বেশি নারীকে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে নারী নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটেছে, ২০১২ সালে ঘটেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ২০০৮ সালে নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ৮৮টি। ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে নবেম্বর মাস পর্যন্ত এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ৯৭টি। অর্থাৎ এসিড নিক্ষেপের হার বেড়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০৮ সালে যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২৬৯টি। ২০১২ সালে ঘটেছে ৭৭১টি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে নির্যাতনের হার বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ধর্ষণের হার বেড়েছে ১৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল বরিশালের নিউ সার্কুলার রোডের এক বাড়িতে র্যাব হানা দিয়ে বোরকা পরে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য জড়ো হওয়ার অপরাধে (?) ২১ নারীকে গ্রেফতার করে। র্যাব সাংবাদিকদের কাছে তাদের অভিযানের সংবাদ জানালে তা ফলাও করে ছাপা হয়। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য না পেয়ে ২১ পরহেজগার নারীকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়। ঘটনার দীর্ঘ ২ মাস পর ২৩ জুন আদালত তাদের বেকসুর খালাস দেন। একইভাবে বোরকা পরার কারণে ২০০৯ সালের ৩ জুলাই পিরোজপুর জেলার জিয়ানগরে ছাত্রলীগের বখাটে কর্মীদের প্ররোচনায় পুলিশ জঙ্গি সন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া দুই ছাত্রী ও এক স্কুল শিক্ষিকাকে গ্রেফতার করে। এসব তরুণীর কাছে ইসলামী বইপত্র এবং ইসলামী ছাত্রীসংস্থার পরিচিতি পাওয়ায় তাদেরকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে ৭ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে তাদেরকে ঢাকায় টিএফআই সেলে নিয়ে আসা হয়। এ মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন পুলিশ কর্র্মকর্তা অমর সিংহ। রিমান্ডে পর্দানশীন নারীদের বোরকা খুলতে বাধ্য করা হয় বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। ২০ দিন কারাগারে বন্দী থেকে অবশেষে তিন অসহায়, নিরপরাধ তরুণী ২৩ জুলাই মুক্তি পান। খারিজ করে দেয়া হয় মামলাটি।
২০০৯ সালের ১৯ জুন রাজশাহীতে জঙ্গি সন্দেহে নিরীহ ১৫ নারী ও শিশুকে গ্রেফতার করা হয়। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ওইদিন বিকালেই মুচলেকা দিয়ে তাদের মুক্ত ঘোষণার পর আবার ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পুলিশ গ্রেফতারকৃতদের সম্পর্কে ব্যাপক তদন্ত করেও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য পায়নি। শেষ পর্যন্ত আদালত তাদের বেকসুর খালাস দিলে জুলাই মাসের ১ তারিখে ১১ দিন কারাবাস শেষে ১৫ জন নিরপরাধ নাগরিক মুক্তি পান।
২০১০ সালের ৩ এপ্রিল সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. একেএম শফিউল ইসলাম তার ক্লাসে ছাত্রীদের বোরকা পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তিনি ক্লাসে ‘মধ্যযুগীয় পোশাক বোরকা’ পরা যাবে না এবং এটি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের কোনো পোশাক হতে পারে না বলে ফতোয়া জারি করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটি বিভাগীয় কোনো সিদ্ধান্ত নয়, তবে আমার ক্লাসে কোনো ছাত্রীকে আমি বোরকা পরতে দেব না।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর ইডেন ও বদরুন্নেছা কলেজে বোরকাধারী ছাত্রীদের হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ নেতাদের মাধ্যমে ছাত্রীদের দিয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করার খবরে সর্বমহলে ঘৃণার সৃষ্টি হয়। এই কলেজে ছাত্রী সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বোরকা পরা ও নামাযী ছাত্রীদের ধরে বোরকা খুলে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। এদিকে এ বছর পয়লা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে লাঞ্ছিত হয় অর্ধশতাধিক ছাত্রী। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানেও তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয় বেশ কয়েকজন ছাত্রী ও অভিভাবক। এছাড়া অনৈতিক কাজে রাজি না হওয়ায় রাজশাহী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। এসব ঘটনার মাধ্যমেই সারা দেশে ইভটিজিং ও অসামাজিক কার্যকলাপ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।
একই বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে তল্লাশির নামে পর্দানশীন ও নামাযী ছাত্রীদের হয়রানির ঘটনা ঘটে। এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের রুম থেকে ইসলামী বই-পুস্তককে জেহাদী বই বলে তা জব্দ করে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রশাসনের সহায়তায় এ ধরনের কর্মকা-ে সারাদেশে বোরকাধারী ছাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ বছরের শেষ দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শাইখুল ইসলাম জিয়াদ নামের এক শিক্ষক বোরকা পরা তিন ছাত্রীকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়।
২০১০ সালের ২১ জুন সাংগঠনিক কাজে ঢাকায় আসার পথে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছাত্রী সংস্থার নরসিংদী জেলা শাখার ৯ নেতা-কর্মীকে জঙ্গি সন্দেহে আটক করে রমনা থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে জিজ্ঞাসাবাদের পর কোনো অভিযোগ না পেয়ে রাত ৩টার দিকে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
সারাদেশে নারী নির্যাতনের চিত্র যখন ভয়াবহ রূপ নেয় ঠিক সেই মুহূর্তে ২০১০ সালের আগস্টে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউকে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না-মর্মে হাইকোর্টের নির্দেশনা ও শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পরিপত্র জারি করা হয়। এ সিদ্ধান্তকে কুরআনের বিধান পরিপন্থী এবং নারীদের বেপর্দা করার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১১ সালের ৯ জুলাই উত্তরা উইমেন্স কলেজে ছাত্রী সংস্থার প্রচারপত্র দেখে ৩ ছাত্রীকে আটক করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত একজন শিক্ষিকা। পরে বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাংচুরের মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়। বিনা অপরাধে ৮দিন কারাভোগের পর তারা জামিনে মুক্তি পায়। ২০১৩ সালের জুনে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।
১ মে ২০১২ তারিখে রাজধানীর উত্তরখান এলাকার একটি কলোনিতে তাফসির বৈঠক করার অপরাধে স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মীরা ছাত্রীসংস্থার এক নেত্রীকে আটক রেখে পুলিশে খবর দেয়। পরে পুলিশ এসে তাকে জঙ্গি সন্দেহে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে দুই দিন রিমান্ডে নেয়। দীর্ঘ এক মাস কারাভোগের একপর্যায়ে আদালত থেকে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পান তিনি।
এ বছর ১২ অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুদের সহযোগিতা করার সময় ছাত্রী সংস্থার দুই কর্মীকে একটি রুমে আটক রেখে পুলিশকে খবর দেয় ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। পরে তাদেরকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে পুলিশ। ৬ দিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান তারা। ১৬ অক্টোবর রাজধানীর ওয়ারলেস রেলগেট থেকে কিছু ইসলামী বই কিনে ফেরার পথে গাজীপুরের দুই ছাত্রীকে আটক করে পুলিশ। গভীর রাতে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়।
৪ ডিসেম্বর নারায়নগঞ্জ সদরের পাইনাদী নতুন মহল্লা এলাকায় হরতালে গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে এক জামায়াতকর্মীকে আটক করতে এসে তার বাসা তল্লাশি করে পুলিশ। এ সময় তাকে না পেয়ে বাসা থেকে বিভিন্ন কুরআন- হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য এবং সাংগঠনিক কাগজপত্র জব্দ করে। সাথে তার বোনকে আটক করে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ধারায় মামলা দেয়া হয়। এমনকি নিরীহ এই নারীকে রিমান্ডে নিয়েও হয়রানি করা হয়। ১০ দিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান তিনি।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে পর্দানশীন নারীদের নির্যাতনের সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে। ১৭ ডিসেম্বর বিকালে মগবাজার ওয়ারলেছ রেলগেট সংলগ্ন ইসলামী ছাত্রী সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংগঠনিক বৈঠক চলাকালে অভিযান চালায় রমনা থানা পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সহায়তায় এ অভিযান পরিচালিত হয়। কোন কারণ ছাড়াই উপস্থিত নেতা-কর্মীদেরকে অফিসে অবরুদ্ধ রেখে দীর্ঘ প্রায় ৩ ঘণ্টা অভিযানের সময় জিনিসপত্র তছনছ করা হয়। এ সময় পুলিশের পুরুষ সদস্য পর্দানশীন নারীদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করে। একপর্যায়ে তারা অফিসের নগদ টাকা-পয়সা, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, কম্পিউটার-ল্যাপটপসহ মূল্যবান জিনিসপত্র জব্দ করে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয় সংগঠনটির ২০ নিরীহ নেতা-কর্মীকে। অভিযানের খোঁজ নেয়ার সময় ওই ভবন থেকে আটক করা হয় জামায়াতে ইসলামী মহিলা বিভাগে কর্মপরিষদ সদস্য সানোয়ারা জাহানকে। পরদিন ৫৪ ধারায় তাদের আটক দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে ২ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। আটক ২০ জনের মধ্যে একজন অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রী, সদ্য বিবাহিতা ও ৩ জন পরীক্ষার্থী ছাত্রীও ছিলেন। আদালতে নেয়ার সময় অন্তঃসত্ত্বা নারীকে পরিকল্পিতভাবে অমানুষিক কষ্ট দেয়া হয়। লিফট থাকা সত্ত্বেও তাকে সিঁডি বেয়ে ৭ম তলা আদালত এজলাসে উঠতে বাধ্য করা হয়। এছাড়া কোর্ট হাজতে বোরকা খুলতে বাধ্য করা হয় পর্দানশীন এসব নারীকে। বিনা অপরাধে আটক পরীক্ষার্থীরা জেল থেকে পরীক্ষা দিতে বাধ্য হয় এবং অসুস্থ অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা নারী দীর্ঘ ২০ দিন কারাবরণ করে জামিনে মুক্তি পান। পর্যায়ক্রমে অন্যরাও জামিন এবং মামলা থেকে মুক্তি পান। নিরীহ এসব নারীর আটক ও আদালতে নেয়ার দৃশ্য দেখে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে পর্দানশীন ২১ নারীকে আটকের ঘটনায় প্রতিবাদ জানাতে ও তাদের মুক্তি দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘নারী অধিকার আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠন গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করলে সেখানেও হানা দেয় পুলিশ। ওই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ শেষে বের হওয়ার সময় ভাষা সৈনিক অধ্যাপিকা চেমন আরা, কলেজ শিক্ষিকা ও ছাত্রীসহ ১৩ নারীকে আটক করে পুলিশ ও র্যাব। রাতে চেমন আরাসহ ৬ জনকে ছেড়ে দিলেও বাকিদেরকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর তারা একে একে জামিনে মুক্তি পান।
এ বছরের ১৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানা ছাত্রী সংস্থার সভানেত্রী নাসিমা আক্তারের বাসায় জেএসসি-জেডিসি কৃতী সংবর্ধনা অনুষ্ঠান চলাকালে হানা দেয় পুলিশ। রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠকের অভিযোগ তুলে আটক করা হয় অভিভাবকসহ ১৮ ছাত্রীকে। পরদিন ১২ জনকে ছেড়ে দেয়া হলেও ৬ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। পরে তারা হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ করেন।
১৫ মে রাজশাহী মহানগর জামায়াত নেতা আবুল কালাম আযাদের বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকেসহ স্কুল পড়–য়া দুই মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে যায়। পরে তার মেয়েকে একটি মামলায় জড়িয়ে রিমান্ডেও নেয়া হয়। এছাড়া তাকে নিয়ে ছাত্রীসংস্থার অন্য নেতা-কর্মীদের ধরতে অভিযান চালানো হয়। ২১ দিন পর জামিনে মুক্তি পায় ওই মেয়ে।
২৮ আগস্ট বরিশালের মুলাদী উপজেলার গাছুয়া ইউনিয়নের হোসনাবাদ গ্রামে ঈদপুনর্মিলনী অনুষ্ঠান থেকে ২২ জন ছাত্রীকে আটক করে ৫৪ ও ৫৭ ধারায় মামলা দেয় পুলিশ। ৩ দিন কারাভোগের পর তারা মুক্তি পায়। ১ জুন নোয়াখালীর মাঈজদী এলাকা থেকে একজন, ২৭ আগস্ট নোয়াখালীর সোনাপুর থেকে দুই ছাত্রীকে আটক করে পুলিশ।
২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বদরুন্নেছা কলেজ হল থেকে বের হওয়ার সময় বোরকাধারী দুই ছাত্রীকে ছাত্রলীগ নেত্রীরা আটক করে হল ইনচার্জের মাধ্যমে জোরপূর্বক সিট বাতিল করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। মিথ্যা মামলায় ১৪ দিন কারাভোগ করেন তারা। ১০ অক্টোবর কুষ্টিয়ার আড়–য়াপাড়া হতে পর্দানশীন ৬ ছাত্রীকে আটক করলে এলাকাবাসী তাদের ছাড়িয়ে আনে। পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। ২১ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জামায়াতের মহিলা বিভাগের সেক্রেটারির বাসা থেকে তাকে এবং এক ছাত্রীকে আটক করে বিস্ফোরক মামলায় জড়িয়ে কারাগারে পাঠায়। তাদের এখনও জামিন হয়নি বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে গত ৫ বছরের বিভিন্ন সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণসহ নানা অনৈতিক কর্মকা-ের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগ ক্যাডারসহ বখাটেদের হাতে লাঞ্ছনা ও যৌন হয়রানির শিকার হন অনেক ছাত্রী ও শিক্ষিকা। এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার পায়নি সংশ্লিষ্টরা। সর্বোপরি মহাজোট সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে ডিসেম্বরে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনরত বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দমনের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের হাতে নিগ্রহের শিকার হন বহু নিরীহ নারী-শিশু।
অথচ এবারও একদলীয় নির্বাচনের আগে দেয়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা’ শীর্ষক প্যারায় ১২.২ অনুচ্ছেদের বলা হয়েছে, “নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি, বৈষম্য বন্ধ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে গৃহীত আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে।” এছাড়া ১২.৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নারীর কমের্র স্বাধীনতা, কমর্ক্ষেত্রে এবং চলাফেরায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
বর্তমানে দেশের শীর্ষ দুই দলের প্রধানই নারী। একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত ১০ম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতাও এখন নারী। তারপরও এ দেশে নারীরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন, নির্যাতিত হচ্ছেন নানাভাবে।
সূত্রঃ দৈনিকসংগ্রাম
২৯.১.২০১৪
http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=137351
বিষয়: বিবিধ
১৬০৪ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর রিপোর্ট করেছে, মাঝে মাঝে দিবেন এভাবে, যাতে সেখানে না গিয়েও – এখানে দেখে পড়া যায়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন