আমার ঘটকালি বেলা
লিখেছেন লিখেছেন ডাক্তার রিফাত ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪, ০১:১৪:৫৩ রাত
পরশু এক্সাম।প্যারাসাইটোলোজি মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে!অথচ মাত্র ২টা চ্যাপ্টার শেষ হয়েছে।মনে মনে একটাই প্রাথর্না হে আল্লাহ তুমি তাড়াতাড়ি এই প্যারাসাইট থেকে মুক্তি দাও।পড়ার টেনশনে মাথা যখন আউলা তখনই মোবাইল বেজে উঠে। হাতে নিয়ে দেখি স্ক্রিনে ভাইয়ার নাম্বার।বুয়েট থেকে সদ্য পাস করা রাকিব আমার বড় ভাই-ই না সবচাইতে কাছের বন্ধুটিও।বই পাশে রেখে রিসিভ করতেই ভাইয়া বলল,কি করিস?
-কিছু না ভাইয়া।
-মন খারাপ কেন বুড়িটার?
-তুমি কিভাবে বুঝলে আমার মন খারাপ?
-আমার বুড়ি বোনটার মন খারাপ থাকবে আর আমি বুঝবনা!!বল কি হয়েছে।
-পরশু পরীক্ষা!অথচ দেখ মাত্র ২চ্যাপ্টার শেষ করতে পেরেছি।
-এই কথা!!আয় তোকে ফুঁ দিয়ে দেই!দেখবি সব শেষ করে ফেলতে পারবি!
প্রচন্ড বিরক্তির মাঝেও ফিক করে হেসে ফেলে বললাম,হায়!হায়!!আমার ভাইয়াটা দেখি ফুঁ বাবা হয়ে গিয়েছে।এবার বলো কি খবর?
-আমার খবর রাখার কি আর কেও আছে যে খবর থাকবে!
-বুঝেছি বুঝেছি আর বলতে হবেনা।পাত্রী তো রেডিই আছে!
-হু।কিন্তু বাসার সবারও তো মতামত আছে তাই না?
-ঠিক বলেছো।তা তোমার কি বলতে লজ্জা হচ্ছে!আহারে আমার লাজুক লাজুক ভাইয়াটা!
-মজা নিচ্ছিস নে কিন্তু বাসায় মা-বাবাকে বলনা আমার বিল্লি বোনটা বলেই রাকিব লাইন কেটে দিল।কারণ,দুষ্ট বোনটা এক্ষুনি ব্ল্যাকমেইল শুরু করে দেবে বাসায় বলার বিনিময়ে!
দেখতে যেমন সুইট তেমনি আচার-আচরনের শালীন ফাতেমার সাথে মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর পরই পরিচয় ।প্রথম দিন এতটাই মুগ্ধ হয়ে যাই যে মনে মনে ভাইয়ার জন্য ফাতেমাকে ঠিক করে ফেলি।কিন্তু,আমার কথায় পাত্তা দেবে কি ভাইয়া?শেষে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে ভাইয়াকে বললাম,তুমি যদি ফাতেমাকে বিয়ে না করো তাহলে বুঝব তুমি আমাকে একটুও ভালবাসনা !আদরের ছোট বোনটির কথা রাখতেই ফাতেমাকে বিয়ে করতে রাজী হয় রাকিব।শর্ত একটায় বুয়েট থেকে পাস করে বের হলে।
ভাইয়া পাস করে বের হয়েছে।এবার বাসায় বলার পালা!ভাইয়ার যেহেতু বলার সাহস নেই তাই আমাকেই বলতে হবে।একটু ভাব নিয়ে আম্মুকে কল দিতেই আম্মু বলল,মা কেমন আছিস?
-ভাল আছি।জরুরী কথা আছে?
-তোর আর জরুরী কথা!!বল দেখি।
-দেখো মা মজা করবা না।কাজের কথা শোন।ভাইয়া না বড় হয়েছে?এবার ওকে বিয়ে দিতে হবে।আমি একটা পাত্রী ঠিক করেছি।
এরপর মা'কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লাইন কেটে দিলাম।কয়েকঘন্টা যেতে না যেতেই জয় হল আমার। বাসার সবাই রাজী হলো পাত্রী দেখতে।তিনদিনই পরই নাকি পাত্রী দেখতে আসবে।আমি এতটা আশা করি নি।একটু অবাক হয়েছিলাম বৈকি।
তিনদিন পর মা-বাবা,আপু-দুলাভাইরা রাকিবকে নিয়ে চট্রগ্রাম এসে পৌছাতেই টেনশনে মরি মরি অবস্থ।যদি পাত্রী পছন্দ না হয়!এদিকে ফাতেমাটা ও যে কিনা!সাজুগুজু করতেও লজ্জা হয়!
মা-আপু প্রথম দেখাতেই ফাতেমাকে পছন্দ করে ফেলল।এবার পাত্র-পাত্রীকে নিজেদের মধ্যে পরিচয় হবার সুযোগ দিতে সবাই বেরিয়ে এল!
একি!প্রায় ২ঘন্টা হতে চলল!এখনো কিসের কথা বলছে?
তাই খুক খুক কাশি দিয়ে রুমে ঢুকেই বললাম,এক্ষুনি এত কথা বললে পরে কি বলবে শুনি!
-উফ!আর একটু।ঢাকায় গেলে কি আর কথা হবে?
-হায়!হায়!!প্রথম দেখাতেই এত ভালবাসা!উঠো উঠো।
-বিয়ের পর এমন বাঁধা দিস তোর পা ভেঙে ফেলব।
-তুমি আমাকে মারলে ভাবী তোমার পা ভেঙে দেবে।তাইনা ভাবী?
লজ্জায় ফাতেমা মাথা নীচু করতেই ভাইয়াকে রুম থেকে বের করে দিলাম।
দুই পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা ফাইনাল হওয়ার পর বিয়ের তারিখ ঠিক হল।হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে বিয়ের কেনাকাটা বিয়েতে কি করব এসব ভাবতে ভাবতেই বিয়ের দিন এসে গেল।
আজ রাকিব-ফাতেমার বিয়ে।দুপুরে জুম্মা নামাজের পর বিয়ের আনুষ্টানিকতা শেষ হতেই খাবারের ডাক পড়তেই ভাইয়া স্টেজ থেকে নামতে যাবে এমন সময় ভাইয়ার চাচাত-মামাত শালা-শালীরা বাঁধা দিতেই এগিয়ে গেলাম।
-কি হয়েছে শুনি?
-স্টেজ থেকে নামতে হলে ১০হাজার লাগবে।এক টাকাও কম হবেনা।
মামার বাড়ির আবদার পাইছ!মনে মনে দেখাচ্ছি মজা বলেই বললাম,ওকে ১০ হাজার দেব।তবে একটি সহজ প্রশ্নের উওর দিতে হবে।রাজী?উওর দিতে হবে ১৫ সেকেন্ডের ভেতর।উওর ভুল হলে উল্টো ১০হাজার দিতে হবে।
পাত্রী পক্ষের লোকজন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে বলল,ওকে রাজী।বলুন আপনার প্রশ্ন কি?
-১ টাকায় যদি ১০০পয়সা হয় তাহলে ৯৬৩৮টাকায় কত পয়সা হবে?
১,২,৩....১১,১২,১৩,১৪,১৫ পেরিয়ে গেলেও উওর দিতে পারলো না ভাবীর ভাই-বোনেরা!যেখানে বিয়ের আসরে পাত্রের পকেটের তেরটা বাজে সেখানে পাত্রী পক্ষ থেকে ১০হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া!আমি আবার দয়ার সাগর কিনা!তাই ১০০টাকা মাফ করে দিয়ে ৯৯০০টাকা নিয়েছি!!বিনিময়ে একটা উপাধী পেয়েছি ভাইয়ার শালাশালীদের কাছ 'বাটপার বেয়াইন'!
দেখতে দেখতে বিদায়ের ক্ষনটিও চলে এলো।কান্নাকাটির মুহুর্ত।ছেলের হাতে মেয়েকে সমর্পন।বর-কনে,কনের বোন,আমার বড় আপু আর বাবা এয়ারে করে যাবে।বাকিরা বাসে ব্যাক টু দা ঢাকা।পুরাই কিমা হয়ে যাই।১দিনে ঢাকা-চিটাগাং-ঢাকা।খুব কাহিল হয়ে পরি সবাই :(
ঐদিকে বর-কনে পৌছে যায় রাত ৮টার দিকেই।বাসার মুরব্বিরা তাদেরকে মিষ্টি মুখ করিয়ে বরন করে নেয়।
৫দিন পরে ওয়ালিমার অনুষ্ঠান ।এই ৫দিন ছিলো সবচেয়ে উৎসবমুখর।গ্রামের বাড়িতে প্রায় ২৫০০ মানুষের আয়োজন করা আসলে চাট্টিখানি বিষয় না।রাকিব একটু সৌখিন টাইপসের।আর ঠিক এ কারনেই ইউজুয়াল কমিউনিটি সেন্টার বিষয়টা তাঁর পছন্দ ছিলো না।পুরা বাড়িকে লাল-নিল রঙ এ মোড়ানো হয়েছিলো।রাতের আর দিনের ২ ধরনের দৃশ্য...বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চা,রাকিবের বুয়েটের আর্কিটেকচার ফ্রেন্ডরা সবাই মিলে আলপনা করে বাড়ির চেহারাই পালটে দেয়...
ওয়ালিমার আগের দিন এক কালচারাল প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়।যেখানে ছিলো না হিন্দি গানের মহোৎসব,নোংরা নাচের আসর,মদ নিয়ে মাতলামি।ইসলামি সংগীত,বিয়ের গান,বাচ্চাদের কবিতা পরিবেশন ইত্যাদি ইত্যাদি।বাগান বাড়িতে স্টেজ।চটপটি দিয়ে সবাইরে নাস্তা করানো।যদিও ভাইয়া এটাকে গায়ে হলুদ বলে চালাতে চায়।আর এ নিয়ে আমার সাথে এখন ও প্রায়ই ঝগরা হয়।
-বিয়া করছে হের পর গায়ে হলুদ :/
-ওই হারামি কালকে না ওয়ালিমা।বিয়া তো তোর ভাবি করছে।আমারটা এহনও বাকি আছে বুঝলি :D আর তার আগের রাত যেহেতু সেহেতু এটাই গায়ে হলুদ। :D
পরদিনের অনেক কাজ। আমার দায়িত্ব ভাবিকে সাজানো-গোছানো।মেহমান রিসিভ করা।
২৫০০ মানুষের এরেঞ্জমেন্ট।নিজ বাড়িতেই !!রান্না-বান্না হয়তোবা বাবুর্চি করবে।তবু তদারকি।খাবার-দাবার সার্ভ।সবকিছুই নিজেদের করা।খুব কঠিন একটা বিষয়।
তারউপর সকালে উঠেই সবার মাথায় হাত।মুষলধারে বৃষ্টি।কি হবে?সবাই কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা শুরু করে।যাই হোক ১০টা নাগাদ বৃষ্টি কমে আসে।আলহামদুলিল্লাহ।
মোটামুটি সবারই আগ্রহ ছিলো গ্রামের বিয়ে দেখার।১টার মধ্যেই সব মেহমান চলে আসে।খাবার ছিলো কাচ্চি।দধি।মিষ্টি।
মহিলাদের খাবার ব্যাবস্থা আলাদাভাবে করা হয়।আর আমাকে তাদের তদারকির দায়িত্বে রাখা হয়।খাবার শেষে একে একে সকলেই বিদায় নেয়।
আর এভাবেই শেষ হলো সুন্দর কিছু মূহুর্ত,কিছু আনন্দ,কিছু কষ্ট,আর কিছু ঠাট্টা-তামাশার।
যা আমার জন্য এক সুখময় স্মৃতি হয়ে থাকবে চিরকাল।
তবে এই বিয়ের পর কপালে আরো এক চাকরি জুটেছে ।সবাই এহন পাত্র-পাত্রির খোঁজে আমার কাছে ধরনা দেয়।আসলে সফল ঘটকাকালি বলে কথা :P
বিষয়: বিয়ের গল্প
২৫৯৪ বার পঠিত, ৩৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাল লাগলো। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ
তবে লিখাটি অনেক মজা লাগলো ।
এত্তদিন পরে একজন সফল ঘটকের দেখা, আমার কাজে লাগতে পারে
গল্প কিন্তু বেশ মজা লাগলো।
আপনার আত্মীয় হওয়া অবশ্য লাভজনক
থুক্কু বউ আবার শুনে ফেললো নাকি?
মন্তব্য করতে লগইন করুন