একজন হিজাবী মেয়ের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হতে না পারার নেপথ্য কাহিনী
লিখেছেন লিখেছেন সিরাজুম মুনিরা রুমি ০২ জানুয়ারি, ২০১৪, ১১:৫৩:০৫ রাত
আজ এক বছর হতে চলল কানাডা আসলাম। গত বছর ঠিক এই দিন রাতে (৩০ ডিসেম্বর, ২০১২) দেশ ছেড়েছিলাম অনেক চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে। আমার বিয়ের মাত্র দুই মাস পরেই চলে এলাম। বাবা, মা, ভাই আপনজন, আর প্রিয় মানুষটাকে ছেড়ে নয় হাজার মাইল দূরে অজানা অচেনা এক দেশে। কানাডা তে প্রচন্ড শীত। আমি যখন আসি ঐ দিন তাপমাত্রা ছিল মাইনাস উনিশ। তার মধ্যে আমি হয়ে পরেছিলাম মারাত্মক অসুস্থ। ঠিক প্লেন এ ওঠার ঘণ্টা খানিক পরেই আমার খুব জ্বর আসে। তারপর সমস্ত শরীরে গোটা গোটা কি যেন উঠতে থাকে। পরে বুঝতে পারলাম এটা ছিল চিকেন পক্স। যাই হোক এভাবেই কানাডা আসি সাথে আরো দুজন বাংলাদেশী ভাই ছিলেন। আমরা একসাথে এসেছিলাম। এজন্য কিছুটা সাহস ছিল। এয়ার পোর্ট থেকে বাসা পর্যন্ত নিয়ে আসেন আর একজন বাংলাদেশী ভাই। আমি ওনাদের কাছে ও আমার সুপারভাইজারের কাছে আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ।
কিন্তু আমি কেন এই ডিসিশন নিয়েছিলাম? আমার মা-বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল আমাকে নিয়ে। বিশেষ করে আমার মা। আম্মুর ইচ্ছা ছিল আমাকে ডাক্তার বানাবে। কিন্তু ভাগ্যে ছিল না হয় নি।যদিও আমার এটা নিয়ে খুব একটা কষ্ট ছিল না। যখন খুলনা ইউনিতে ভর্তি হলাম আমার মা বাবা দুজনেই বলে দিল তোমাকে আমরা ইউনিভার্সিটি শিক্ষক হিসেবে দেখতে চাই। কথাটা আমার মাথায় ছিল। সেভাবেই করে যাচ্ছিলাম পড়ালেখা। আটটা টার্ম এর মধ্যে সাতটায় আমি ফার্স্ট হই। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হলাম। সিজিপিএ ৩.৯৫/৪ । আমার টিচাররাও অনেক পছন্দ করতেন আমাকে। পড়ালেখার পাশাপাশি ডিবেট করতাম টুকটাক। এই কারণে বাড়তি একটা পরিচিতি ছিল। কিন্তু আমাকে সহ্যই করতে পারতেন না একরকম একজন টিচার ছিলেন। তিনি আবার ভীষণ প্রগতিশীল, মুক্তমনা ক্ষমতাধর। ওনার বড়ই ক্ষোভ একটা বোরখা পরা মেয়ে এমন হল কি করে!!! আমাকে এক দিন উনি বলেই ফেললেন কেন আমি বোরখা পরি। কিন্তু তখন অনেক কিছুর ভয়ে ওনার কথার উত্তরটা দিতে পারি নি। তিনি এমনই একজন মানুষ যিনি আমাকে ফাইনাল ইয়ারে লাস্ট সেমিস্টারে ওনার কোর্সে ভাইভাতে তিন দিয়েছিলেন ত্রিশ এর মধ্যে। কিন্তু আল্লাহর রহমত অন্য স্যাররা রেজাল্ট করার সময় খেয়াল করেন আমার সব সাবজেক্টে এ প্লাস। কিন্তু ওনার কোর্সে তিন পেয়েছি। আল্লাহর রহমত আর অন্য স্যারদের চেষ্টায় উনি নিজের ভুল স্বীকার করে বলেন উনি নাকি ভুলে তেইশ এর জায়গায় তিন দেয়েছেন (আল্লাহ জানে ওনার মনে কি ছিল)। ওনাকে নিয়ে আরো অভিযোগ আছে। সেগুলো আর নাই বা বলি।
পরবর্তীতে এম এস এ ভর্তি হই। মাস্টার্সে পাঁচটা টার্মের মধ্যে যখন দুইটা শেষ হয় তখন ডিপার্টমেন্টে লেকচাচার নিয়োগ হয় তিন জন। আমি এপ্লাই করলাম। ভাইভা অনেক ভালো দিয়েছিলাম।কিন্তু রেজাল্ট জিরো। আমাকে বলা হল তুমি জুনিয়র। নেক্সট বার তোমাকে নিব। আচ্ছা আশা নিয়ে থাকলাম। এর মধ্যে যখন মাস্টার্স প্রায় শেষ তখন আবার সার্কুলার হল। আবার এপ্লাই করলাম। কিন্তু ভাইভার আগেই বুঝতে পেরেছিলাম কোন কাজ হবে না। আমাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আমার বাবা কোন রাজনীতি করে, আমার দাদা কি করতেন। আমার কথা জানত যে আমি কোন রাজনীতির সাথে ছিলাম না তারপরও আমার বাবা জামাত করে সুতরাং প্রশ্নই আসে না। আমাকে সেই প্রগতিশীল টিচার (উনি তখন ডিপার্টমেন্ট হেড) কোন ক্যান্ডিডেট হিসেবেই মনে করলেন না। ওনাকে একজন জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনার এত রাগ কেন মেয়েটার উপর। ওনার সোজা সাপটা উত্তর। ওর বাবা জামাত করে
তারপরও আমি ভাইভা দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার ভাইভাতে আর কিছু জিজ্ঞাসা করে নাই কারন আমি যদি ভাইভাতে ভালো করে ফেলি (যদিও ওদের কিছুই এসে যায় না) শুধু এক স্যার বলেছিলেন তোমার মাস্টার্স এ তো রেজাল্ট ফোর আউট অফ ফোর তাইনা। আর কোন কোন জবের জন্য ট্রাই করছি। এইতো ভাইভা শেষ। দুই মেয়াদে ৬ জন টিচার নিয়েছিল। আমার ব্যাচ থেকেও নিয়েছিল। ৬ জনের মধ্যে চারজন একটি বিশেষ ধর্মের আর দুজন মুসলিম। সবাই ঐ টিচাররের অতি আপনজন। সবার চাইতে আমার জিপিএ, পাবলিকেশন্স সবই ভালো ছিল। কিন্ত তাতে কি এসে যায়।
পরে বাংলাদেশ এর আরো অনেক ইউনিতে ভাইভা দিয়েছি। কিন্তু প্রবলেম এক জায়গায় আমার বাবা ইসলামী আন্দোলন করেন।
আলহামদুলিল্লাহ আমার বেশীদিন কষ্ট পেতে হয় নি । কিছুদিনের মধ্যে আমার স্কলারশিপ হয়ে যায় কানাডাতে।মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য তাই আর দেরী না করে চলে এলাম। আমি আসার কিছু দিন পর আমার জামাই ও চলে আসে তার বিশ্বের অন্যতম মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির জব ছেড়ে।
এই খবরটা কিভাবে জানি আমার খুলনা ইউনির টিচাররা জেনে ফেলেছিলেন। আমার খুব পছন্দের একজন টিচার (মানুষ হিসেবে স্যার অসাধারন) আমাকে ফোনে বলেছিলেন “ সিরাজুম মুনিরা আমরা তোমাকে রাখতে পারলাম না”। আমাকে কেউ দয়া করে ভাববেন না। আমি অন্য ধর্মের কাওকে সমান ভাবে দেখি না। আমার সেই পছন্দের স্যার ছিলেন অন্য ধর্মের।
যাইহোক, আমার এই লেখার কারণ নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করার জন্য না। আমার মত অনেকেই আছে বাংলাদেশে যারা তাদের প্রাপ্য টুকু বুঝে পায় না। আর এখন দেশের যা অবস্থা মানুষের জীবনেরই দাম নেই। আর জামাত শিবির হলে তো প্রগতিশীল দের কাছে মানুষই মনে হয় না। দেশের জন্য সারাক্ষণ মন কাঁদে। মানুষের এত কষ্ট আর সহ্য হয় না। নিজেকে মাঝে মাঝে স্বার্থপর মনে হয়। যে দেশের খেঁটে খাওয়া মানুষের রক্ত পানি করা পয়সা দিয়ে আমাকে এত দূর নিয়ে এল তাদের জন্য কি করলাম! জানিনা কবে দেশের কাছে মাটির কাছে ফিরে যাব। কিন্তু আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ইনশা'আল্লাহ কিছু তো করতেই হবে দেশের জন্য তথা মানুষের মুক্তির জন্য।
বিষয়: বিবিধ
৩৬৮১ বার পঠিত, ২৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পরীক্ষা।
, take care
তাই আপনাকে সান্তনা দিয়ে ছোট করতে চাই না, এটুকু বলতে চাই, মন খারাপ করবেন না। রাসুলুল্লাহ (স) এবং তাঁর সাহাবাদেরকেও নিজ দেশ মক্কায় সম্মান ও মূল্যায়ন করা হয় নাই, সম্মান ও মূল্যায়ন করা হয়েছে ভিন দেশ মদীনায়। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনার ভবিষ্যত উজ্জ্বল করবেন এ ভরসা রাখি।
আমি ফেস বুক ও অন্যান্য মাধ্যমে লেখালেখি করার চেষ্টা করি। আপনার অনুমতি পেলে দেশবাসীর কাছে শিক্ষক নামের কলঙ্ক তথাকথিত প্রগতিশীল মুক্তমনাদের স্বরূপ উন্মোচন করার জন্য উদাহরন বা দৃষ্টান্ত (Example) হিসাবে আপনার এ লেখাটা উদ্ধৃতি (Qute) করতে চাই। অনুমতি দিলেন কিনা আপনার মতামত জানাবেন আশা করি।
নাম-রেহনুমা বিনতে আনিস।
ফেসবুক লিংক-Click this link
ব্লগ লিংক-http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/bloglist/3047/rehnuma
আল্লাহ সহায় হোন।
আমিও নিজে এরকম বেশ কিছু ঘটনার স্বাক্ষী । আমি জানি, বুঝি --- এজন্য প্রিয় কিছু মানুষদের সহযোগীতার চিন্তা করছি। মেধাবীরা যাতে দেশের সীমানার বাইরে গিয়েও কিছু করতে পারে এজন্য কাজ করব বলে চিন্তা করছি । আপনি ভালো থাকুন
মন্তব্য করতে লগইন করুন