বারসিসার কাহিনী: যেভাবে শয়তান মানুষকে ধোঁকা দেয়

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ ওমর ফারুক ডেফোডিলস ১০ মার্চ, ২০১৪, ০৯:১০:৪৮ সকাল



বনী ইসরাইলের সময় এক ছোট্ট গ্রামে বারসিসা নামে অত্যন্ত ধার্মিক এক ব্যক্তি ছিল। তাকে সন্ন্যাসী বলা যেতে পারে। সে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করত এবং বিশ্বাস করত যে ঈসা আলাহিসসালাম আল্লাহর একজন রাসুল।

সেই গ্রামে তিন ভাই ও এক বোন থাকতো । সেই ভাইদের জিহাদের জন্য ডাকা হল । কিন্তু তারা বোনকে একা রেখে যেতে চাইল না। কার কাছে রাখবে চিন্তা করতে লাগলো। গ্রামবাসি বারসিসার কথা বলল। কারণ গ্রামের সবাই বারসিসাকে উত্তম চরিত্রবান হিসাবে জানতো । তো তারা বারসিসার কেছে গেল, যখন তার কাছে তাদের বোনকে রাখতে চাইলে সে রাজি হল না এবং বলল 'আমি অভিশপ্ত শয়তানের কাছ থেকে পানাহ চাই।'

কারণ সে ভয় করছিল যে সে গুনাহে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। তখন শয়তান বারসিসার মনে কুমন্ত্রণা (ওয়াসওয়াসা) দিতে আসল। চালাক শয়তান জানতো যে বারসিসার মন খুবই নরম। সে কানে কানে বারসিসাকে বলল - "তারা যদি ভাল কাউকে তাদের বোনের জন্য খুঁজে না পায় এবং খারাপ কারো কাছে মেয়েটিকে রেখে যায় তখন কি হবে ! এই পরিণতি কি তোমার ভুলের জন্য নয়?"

বারসিসা বুঝতে পারেনি যে এটা শয়তানের কুমন্ত্রণা। মানুষের প্রতি দরদের কারনে মেয়েটিকে সে সাহায্য করতে রাজি হল।

সে মেয়েটিকে গির্জার বিপরীতে একটি ঘরে থাকতে দিল। গির্জার সামনে মেয়েটির জন্য খাবার রেখে আসত, মেয়েটি নিজে এসে খাবার নিয়ে যেত। বারসিসার সাথে তার দেখা হত না।

শয়তান বারসিসার কাছে আবার আসল এবং বলল, "তুমি কেন মেয়েটির খাবার তার ঘরের সামনে রেখে আসো না? এর ফলে মেয়েটাকে ঘর থেকে কেউ এতটা পথ একা একা হেঁটে বের হতে বা ফিরে যেতে দেখবে না!"

বারসিসা রাজি হল এবং মেয়েটির ঘরের সামনে খাবার রেখে আসতে শুরু করল। শয়তান এতেও খুশি হল না, সে আবার আসলো এবং কানে কানে বলল – ‘কেন তুমি তার ঘরে ভিতরে খাবার দিয়ে আসো না? ফলে মানুষ তাকে ঘর থেকে একা একা বের হতে আর ঢুকতে দেখত না!’ এবার বারসিসা তার ঘরের মধ্যে খাবার দিয়ে আসতে শুরু করল। শয়তান আবার আসলো এবং বলল – ‘মেয়েটার সাথে তোমার কথা বলা উচিত ,এভাবে একা থাকলে তো সে পাগল হয়ে যাবে’। বারসিসা মেয়েটির কথা চিন্তা করে তার সাথে রুমের আড়ালে কথা বলতে শুরু করল ।

শয়তানের কুমন্ত্রণায় এক সময় তারা একই রুমে কথা বলতে লাগল।

এভাবে শয়তান তার কাজের কঠিন অংশ বাস্তবায়ন করল। এই পর্যায়ে বারসিসা এবং মেয়েটা একে অপরের প্রতি দুর্বল হল এবং এক সময় ব্যভিচারে লিপ্ত হল। মেয়েটি গর্ভবতী হল , একটি বাচ্চা জন্ম দিল। বাচ্চা জন্মের সময় শয়তান বারসিসার কাছে আবার আসল এবং বলল, "এটা তুমি কি করলে? তোমার পাপের প্রমাণ সরিয়ে ফেল, না হলে মেয়েটির ভাইরা ফিরে আসলে তোমাকে খুন করবে!"

বারসিসা বাচ্চাটিকে খুন করল এবং ঐ ঘরের মেঝেতে পুতে ফেলল।

শয়তান এবার বলল , "তুমি এক নারীর সন্তান হত্যা করেছ এবং আশা করছ যে সে এটা কাউকে বলবে না?"

তখন বারসিসা মেয়েটিকেও খুন করল এবং তাকেও ঐ ঘরের মেঝেতে পুতে রাখল। মেয়েটির ভাইরা ফিরে আসলে তাদেরকে একটা মিথ্যা কবর দেখিয়ে বলল "তোমাদের বোন অসুখে মারা গিয়েছে এবং ঐ কবরে দাফন করা হয়েছে"। তারা বারসিসার কথা বিশ্বাস করল।

সেই রাতে শয়তান তিন ভাইকে একই স্বপ্ন দেখাল যে "বারসিসা তোমাদের বোনকে হত্যা করেছে, প্রমান হিসাবে তোমাদের বোন যে ঘরে থাকত তার মেঝে খুঁড়ে দেখতে পারো"। ঘুম ভাঙ্গলে তারা একে অপরকে স্বপ্নের কথা বলল এবং বুঝতে পারল তারা তিনজন একই স্বপ্ন দেখেছে।

যাচাই করার জন্য তারা বারসিসার এলাকায় যেয়ে প্রথমে বারসিসার দেখানো কবর খুঁড়ল, দেখল কিছু নেই, এর পর যে ঘরে তাদের বোন থাকত তারা ঐ ঘরের মেঝে খুঁড়ে তাদের বোনের এবং বাচ্চার লাশ পেল। তারা বারসিসাকে ধরল এবং বলতে বাধ্য করলো আসলে কি হয়েছিল।

তারপর তারা তাকে রাজার কাছে নিয়ে গেলে রাজা তাকে শিরচ্ছেদ করতে আদেশ দিল। যখন বারসিসাকে শিরচ্ছেদ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন শয়তান কাছে আবার আসল। এবার ওয়াসওয়াসা না, মানুষের রূপ নিয়ে সে আসল। এসে বলল, "শুনো বারসিসা, আমি হলাম শয়তান, তোমার এই অবস্থা তোমার নিজের চিন্তায় হয়নি, আমিই করেছি আর একমাত্র আমিই তোমাকে বাঁচাতে পারি যদি তুমি আমার কথা মেনে চল।" বারসিসা বলল, "আমাকে কি করতে হবে?"

শয়তান বলল" আমাকে সেজদা কর আমি তোমাকে রক্ষা করবো" তো বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে বারসিসা শয়তানকে সিজদা করল এবং কাফের হয়ে গেল। সিজদা করার সাথে সাথে শয়তান তাকে বলল – ‘আমি এখন তোমার থেকে মুক্ত। আমি আল্লাহকে ভয় করি যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক’। এই বলে শয়তান সেখান থেকে পালালো , এবং বারসিসার শিরচ্ছেদ করা হল। কেয়ামতের দিন বারসিসাকে যখন জীবিত করা হবে তখন সে শয়তানকে সিজদা করতে করতে উঠে দাঁড়াবে!

দেখুন শয়তান কিভাবে বারসিসাকে ফাঁদে ফেলেছিল। সে এসেছিল বন্ধুর বেশে, ভালো ভালো কথা বলতে আর আপাত:দৃষ্টিতে ভালো কাজে উৎসাহ দিতে, কিন্তু আসলে সে ছিলো সবচেয়ে বড় শত্রু!

আল্লাহ বলেন ,

তাদের দৃষ্টান্ত শয়তান যে মানুষকে বলে কুফরি করো। অতঃপর যখন সে কুফরি করে , তখন শয়তান বলে: আমি তোমার থেকে মুক্ত। আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।

[সুরা হাশর ৫৯:১৬]

ঘটনা থেকে শিক্ষা:

১) শয়তান কখনোই আপনাকে সরাসরি এসে পাপ করতে বলবে না। সে সব সময়ই আপনাকে ভালো ভালো কারণ দেখিয়ে ধোঁকায় ফেলবে, এবং শয়তান আমাদের যে কারো চাইতেই বেশী ধৈর্য্যশীল। কাজেই আমরা সবসময়ই আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবো শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।

২) কখনোই ভাববেন না যে আপনার অনেক জ্ঞান আছে, বিচার-বুদ্ধি আছে, শয়তান কিছুতেই আপনাকে ধোঁকায় ফেলতে পারবে না। বরং, প্রকৃত জ্ঞানীরা শয়তানের ফাঁদে পড়ার ভয় সবচাইতে বেশী করে। এই কারণেই আপনি দেখবেন আলেমদের তাকওয়া (আল্লাহভীতি) সবচাইতে বেশী।

৩) কাহিনীটা নিয়ে চিন্তা করুন। শয়তান যদি প্রথমেই এসে বারসিসাকে বলত – ‘আমাকে সিজদা কর’ – বারসিসা কখনোই তা করতো না। কিন্তু শয়তান তার পরিকল্পনা মাফিক ধীরে ধীরে একটার পর একটা ছোট ছোট ধাপে বারসিসাকে দিয়ে ভুল করিয়ে অবশেষে তাকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয় যে জীবন রক্ষার তাগিদে সে অবশেষে শিরক করে ফেলে, যে পাপ আল্লাহ কিছুতেই ক্ষমা করবেন না।

৪) শেষ কথা, আল্লাহ যা করতে আমাদের নিষেধ করেছেন, তা থেকে আমরা বিরত থাকবো। নিজে থেকে যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করব না যে – এটা করলে কি হয়? এ আর এমন কি? আল্লাহ নিষেধ করলে কি হবে দেখতে তো মনে হয় এটা একটা ভালো কাজ! এটা তো ছোট্ট একটা পাপ! না, আল্লাহর যে কোন অবাধ্যতাই পাপের পথে নিয়ে যায়, আপাত:দৃষ্টিতে পাপটা যত ছোটই হোক না কেন, ছোট পাপই বড় পাপের দিকে টানে, বড় পাপ টানে কুফরীর দিকে।

রেফারেন্স:

১. ইমাম আন্‌ওয়ার আল আওলাকির লেকচার – The story of Barsisa

কার্টেসিঃ ফেসবুক পেজ NOOR

বিষয়: বিবিধ

১৫০৪ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

189766
১০ মার্চ ২০১৪ সকাল ০৯:৪১
সজল আহমেদ লিখেছেন : ইয়া খোদা আমরা যেন কেউ বারসিসার মত শয়তানের ফাঁদে পরে ব্যাভিচার লিপ্ত না হই এবং তোমায় না ভুলি সেই তৌফিক দান করুন।
১০ মার্চ ২০১৪ সকাল ১০:০০
140822
মোহাম্মদ ওমর ফারুক ডেফোডিলস লিখেছেন : আমিন চুম্মা আমিন!
১০ মার্চ ২০১৪ দুপুর ১২:১৯
140889
শফিউর রহমান লিখেছেন : There is no খোদা, but ALLAH.
খোদা না বলে আল্লাহ বা তার যতগুলো নাম কুরআন-হাদীসে আছে সেগুলো বলুন। 'খোদা' শব্দটি কুরআন-হাদীসের কোথাও নাই। কেন আমরা আল্লাহকে ডাকতে এমন একটি শব্দ ব্যবহার করবো, যা কোরআন বা হাদীস কোথাও নাই? ধন্যবাদ।
১০ মার্চ ২০১৪ দুপুর ০২:০৪
140979
মোহাম্মদ ওমর ফারুক ডেফোডিলস লিখেছেন : কোরান শরীফ আরবী ভাষাতেই নাজিল হয়েছে
এর অর্থ এই নয় যে আল্লাহ শব্দটি আরবীতেই বলতে হবে
কোরানে কোথাও নেই যে আল্লাহ শব্দটা অন্য কোন আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করা যাবেনা, বরং যার যার সুবিধামত ডাকা যাবে,
শুধু নিয়ত টিক রাখতে হবে
যেমন আমরা অনেকে প্রভু বলে ডাকি এটাতে কোন সমস্যা নেই, খোদা শব্দ হচ্ছে ফার্সি/উর্দ ভাষা, আমরা যে ভাষাতেই বলিনা কেন আল্লাহ তায়ালা ওয়াকিপ হাল আছেন
189822
১০ মার্চ ২০১৪ সকাল ১০:৩৯
হতভাগা লিখেছেন : অসাধারন লিখা

আ'উজুবিল্লা হিমিনাশ শাইত্বোয়ানির রাজিম
১০ মার্চ ২০১৪ দুপুর ০২:০৫
140981
মোহাম্মদ ওমর ফারুক ডেফোডিলস লিখেছেন : আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
আপনি আমার জন্য একটু দোয়া করিয়েন যাতে শয়তান থেকে হেফাজত থাকতে পারি
189839
১০ মার্চ ২০১৪ সকাল ১০:৫৮
ফাতিমা মারিয়াম লিখেছেন : চমৎকার শিক্ষণীয় পোস্টের জন্য ধন্যবাদ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সব সময়ই যেন শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করেন। আমীন।
189849
১০ মার্চ ২০১৪ সকাল ১১:০৫
জাগো মানুস জাগো লিখেছেন : nice write up. may allah give the realization from this.
189909
১০ মার্চ ২০১৪ দুপুর ১২:২১
শফিউর রহমান লিখেছেন : মানুষ যেদিকে দূর্বল বা সপ্ট সেদিকটিই বেছে নেয় ধোঁকা দেয়ার জন্য। সেটাকে সে পজিটিভ দেখিয়েই তার পথে নিয়ে যায় একটু একটু করে।
189937
১০ মার্চ ২০১৪ দুপুর ০১:২৯
সন্ধাতারা লিখেছেন : It is a nice story for good lesson, we need to avoid single simple sin to hold our iman. Thanks
190142
১০ মার্চ ২০১৪ রাত ১০:৫৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ শিক্ষামুলক পোষ্টটির জন্য। আল্লাহতায়লা আমাদের শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে রক্ষা করুন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File