"তরুণ নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হচ্ছে জামায়াত"
লিখেছেন লিখেছেন জিনান মামনি ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১১:১৯:৪১ রাত
রাজনৈতিকভাবে বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। হাইকোর্টে নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার পর তাদের এ অবস্থা । আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। রাজনৈতিক মাঠে টিকে থাকতে তাই নতুন নতুন কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে দলটির বর্তমান নেতৃত্ব।
দলের নিবন্ধন ফিরে পেতে আইনি প্রক্রিয়া ও মাঠের রাজনীতি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দলের কেন্দ্র থেকে জেলা-মহানগরে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে করণীয় ঠিক করতে ব্যস্ত রয়েছেন শীর্ষ নেতারা। যদিও দলের শীর্ষ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল বা দলের ওপর সরকারের পক্ষ থেকে খড়গ নেমে আসবে এ ব্যাপারে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন তারা।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং এ ইস্যুতে আন্দোলন করতে গিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাবরণ করতে হয়েছে। এর ফলে শীর্ষ নেতাদের অবর্তমানে কেন্দ্র থেকে জেলা, মহানগর সর্বত্র চলছে ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে। এদের অনেকে বয়সে নবীন। এদের বিরুদ্ধে নেই বিতর্কিত কোনো কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ। বিশেষ করে যারা ৮০ এবং ৯০ দশকে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন তারাই এখন দলের গুরুত্বপুর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। জামায়াতের সূত্রটি জানিয়েছে, কোনো কারণে আপিল বিভাগের রায় বিপক্ষে গেলে বিকল্প হিসেবে কয়েকটি উপায় ঠিক করে রেখেছে দলটি।
প্রথমত, চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন বাতিল হলে নির্বাচনে দলীয় প্রতীক পাওয়া যাবে না। সে চিন্তা মাথায় রেখেই আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি আছে তাদের।
সে ক্ষেত্রে বিএনপি জোটে থেকে প্রয়োজনে নিজেদের আসনে স্বতন্ত্রভাবেই ১৮ দলের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করবে। এজন্য জামায়াত সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি তালিকাও ইতোমধ্যে ঠিক করে রেখেছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের বিশ্বাস, জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা বর্তমান সরকারের আমলে যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষ দলটির ওপর সহানুভূতিশীল। এছাড়া গত সাড়ে ৪ বছরে যেভাবে জামায়াত রাজপথে ভূমিকা রেখেছে তাতে ১৮ দলসহ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও সন্তুষ্ট। দ্বিতীয়ত, হাইকোর্টের রায় সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখলে নির্বাচন কমিশনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী আবারো তারা জামায়াতের নামেই নিবন্ধন পাওয়ার চেষ্টা করবে। যদি তা সম্ভব না হয় তখন নতুন কোনো নামে দলের রেজিস্ট্রেশন নেওয়া যায় কিনা তাও ভাবা হচ্ছে। অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, এ ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি সমমনা ইসলামী দলের সমন্বয়ে নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হতে পারে। তবে, নতুন কোনো নামে হোক আর আপিলে নিবন্ধন বহাল থাক, উভয় ক্ষেত্রেই প্রস্তুত তারা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, আমীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমীর মাওলানা একেএম ইউসুফ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আব্দুস সোবহান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, এটিএম আযহারুল ইসলাম ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার চলছে। তাদের অধিকাংশকেই মৃত্যুদ-সহ বিভিন্ন সাজা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শেষ পর্যন্ত যদি আদালতের রায়ের কারণে তারা রাজনীতি ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হন সে ব্যাপারেও করণীয় ঠিক করে রেখেছে জামায়াত।
জামায়াতের এক নেতা জানান, বর্তমানে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে মহানগর, জেলা-উপজেলায় নেতৃত্বের প্রায় ৮০ ভাগই তরুণ। যাদের বয়স ৩৫-৫০ এর মধ্যে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতের ওপর নির্যাতনমূলক আচরণের কারণে দলে যে নেতৃত্ব সংকট তৈরি হয়েছিল তা ইতোমধ্যে দলটি কাটিয়ে উঠেছে। কেন্দ্র থেকে জেলা-মহানগর পর্যন্ত এখন ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই শেষ পর্যন্ত যদি শীর্ষ নেতারা রাজনীতি ও নির্বাচনে অযোগ্য হন তাহলে অবশিষ্ট সিনিয়র ও তরুণ নেতৃত্বের সমন্বয়ে দলকে পুনর্গঠিত করা হবে বলে জানান জামায়াতের ওই নেতা।
সূত্রমতে, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক নেতাদের বাইরে দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ, সিনিয়র নায়েবে আমীর অধ্যাপক একেএম নাজির আহমাদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক মুজিবুর রহমান (কারাগারে আটক), ডা. শফিকুর রহমান (কারাগারে আটক) নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা রফিউদ্দিন আহমাদ ছাড়া বর্তমান নেতৃত্বের অধিকাংশই ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা। দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ৯০’র দশকে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। দলের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার (কারাগারে আটক) ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা। কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, প্রচার সম্পাদক অধ্যাপক তাসনিম আলম (কারাগারে আটক), ভারপ্রাপ্ত প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। জামায়াতের ওই সূত্র বলছে, শুধু কেন্দ্র নয়, মহানগরগুলোতেও ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতারা নেতৃত্বে চলে এসেছেন। ঢাকা মহানগরের নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা হামিদুর রহমান আযাদ এমপি। আরেক নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল হালিমও ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল। ঢাকা মহানগরী সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বুলবুলও ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি। তারা একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদেরও সদস্য। ঢাকা মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মো. সেলিম উদ্দিন (কারাগারে আটক), ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও সাবেক শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল মঞ্জুরুল ইসলাম ভুইয়া। এর বাইরে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড শাখাতেও শিবিরের সাবেক নেতারা দায়িত্বে আছেন।
চট্টগ্রাম মহানগরী আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা শামসুল ইসলাম এমপি। একই শাখায় সহকারী সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শিবিরের আরেক সাবেক সভাপতি আ জ ম ওবায়দুল্লাহ। একইভাবে খুলনা মহানগরী আমীর আবুল কালাম আযাদ শিবিরের অর্থ সম্পাদক ছিলেন। রাজশাহী মহানগরী আমীর অধ্যাপক আতাউর রহমানও শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সিলেট মহানগরী আমীর এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বরিশাল মহানগরী আমীর এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, রংপুর মহানগরী আমীর এডভোকেট মাহবুবুর রহমান বেলাল ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কক্সবাজার জেলা আমীর মু. শাহজাহান ছিলেন ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি।সূত্রটি বলছে, শেষ পর্যন্ত যদি দলটির নিবন্ধন বাতিল হয় এবং শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের রায়ের কারণে নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হয় তাহলে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে।
সে ক্ষেত্রে দলের আমীরের দায়িত্ব পেতে পারেন:-
• বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ,
• সিনিয়র নায়েবে আমীর অধ্যাপক একেএম নাজির আহমাদ
নায়েবে আমীর হতে পারেন :-
• অধ্যাপক মুজিবুর রহমান,
• ডা. শফিকুর রহমান,
• রফী উদ্দিন আহমাদ,
• অধ্যক্ষ ইজ্জত উল্লাহসহ আরো কিছু সিনিয়র নেতা।
দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। প্রায় সবাই তাকে সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দেখতে চান। কিন্তু তিনি পেশাগতভাবে এতটাই ব্যস্ত যে, দলের বৃহত্তর প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখেই সংগঠনের নায়েবে আমীর হিসেবে তাকে রাখা হতে পারে। সেক্ষেত্রে,
সেক্রেটারি জেনারেল হতে পারেন:-
• প্রচার সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনিম আলম কিংবা
• বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হতে পারেন:-
• সাইফুল আলম খান মিলন
• ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের
• মিয়া গোলাম পরওয়ার
• চট্টগ্রাম মহানগর আমীর মাওলানা শামসুল ইসলাম
• ঢাকা মহানগরীর নায়েবে আমীর ও সংসদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ
• নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল হালিম
• সিলেট মহানগরী আমীর এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের
• চবির সাবেক ভিপি এডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার
• রাজশাহী মহানগরী আমীর আতাউর রহমান
প্রচার সেক্রেটারি হতে পারেন:-
• মতিউর রহমান আকন্দ
ঢাকা মহনগরীর আমীর হতে পারেন:-
শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি নুরুল ইসলাম বুলবুল
চট্টগ্রাম মহানগরীর আমীর হতে পারেন:-
• কক্সবাজার জেলা আমীর ও শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মো: শাহজাহান
রাজশাহী মহানগরীর আমীর হতে পারেন:-
• শিবিরের সাবেক প্রভাবশালী নেতা ইমাজ উদ্দিন মণ্ডল
এছাড়া বাকি মহানগর ও জেলা শহরগুলোতেও থাকবে শিবিরের সাবেক নেতাদের দাপট।
পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি:-
• শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ব্যারিস্টার হামিদ হোসাইন আজাদ
• ডা. আমিনুল ইসলাম মুকুল
• সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ডা. এম এ বারী
• ব্যারিস্টার নজরুল ইসলাম
এছাড়া শিবিরের সাবেক সভাপতি এনামুল হক মঞ্জু, মুজিবুর রহমান মঞ্জু, সেলিম উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম মাসুদ, জাহিদুর রহমান, মু: রেজাউল করিম, ফখরুদ্দিন মানিক পেতে পারেন দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ।
জামায়াতের ওই সূত্র বলছে, গত জুন মাসে দলটির ১৫টি সাব-কমিটি সারাদেশ সফর করে রুকনদের সঙ্গে বৈঠক করে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলের করণীয় বিষয়ে মতামত নিয়েছে। দলের এ ক্রান্তিকালে রুকন সম্মেলন ও শুরা সদস্যদের মাধ্যমে গঠনতন্ত্র পরিবর্তন-পরিবর্ধন অসম্ভব। তাই রুকন ও শুরা সদস্যদের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে দলটি। ফলে যেকোনো সময় যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে বর্তমান নেতৃত্বের কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে রাজপথে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালনকারী দলের মাঠকর্মীদের মনোভাব স্পষ্ট। তাদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, নেতৃত্বে কে আসবেন তা নিয়ে চিন্তা নেই তাদের। বর্তমান নেতৃত্ব বহাল থাকুক আর পরিবর্তন হোক সমানতালে কাজ করে যাবেন তারা। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বেশ বেকায়দায় থাকলেও দলের বর্তমান শীর্ষ নেতাদের নিয়ে কমই আপত্তি আছে কর্মীদের। তারা বিশ্বাস করেন তাদের নেতারা নির্দোষ। সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকেই নেতাদের বিচার করছে।
বিষয়: রাজনীতি
১৬৭২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন