ত্রৈমাসিক উন্মুখে প্রকাশিত শিক্ষনীয় গল্পঃএকটু মেঘের ছায়া
লিখেছেন লিখেছেন সত্যের সুবাতাস ০৮ মে, ২০১৪, ১১:৩৩:১৮ রাত
তাছিম ও তার ছোট বোন তানহি বাড়ির উঠানে খেলছিল।তাছিমের বয়স ৭ ও তানহির ৫।ওদের কিছুটা দূরে গেইটের বাইরে খেলছিল বস্তির আরও কয়েকজন ছেলে-মেয়ে।ওদের অনেকের গায়ে জামাও নেই।তাছিমদেরও মন চায় ওদের সাথে খেলতে।কিন্তু মা যেতে দেননা।তাই চার দেয়ালের মাঝেই ওরা খেলে।হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল।বৃষ্টি শুরু হতেই ওদের খুব ভাল লাগছিল।গেইটের দিকে চোখ যেতেই দেখল বস্তির ছেলে-মেয়েরা খুব আনন্দ করছে,কেউ কেউ দু’হাতে পানি ধরছে,আবার অনেকে হা করে মুখের ভিতর পানি নেওয়ার চেষ্টা করছে।এসব দেখে তাছিমেরও ওদের মত করতে ইচ্ছে হল।কিন্তু ওর মা ঘর থেকে বের হয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল,
-তাছিম,তানহি, তোমরা তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতরে চলে এসো।বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ করবে।
একথা বলেই তিনি ওদের দু’জনকে টেনে টেনে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল।তাছিম কান্না শুরু করে দিল এবং বলতে লাগল,
-আম্মু,আমি একটু বৃষ্টিতে ভিজব,ওই দেখ,ওরা কত সুন্দর করে বৃষ্টিতে খেলছে।
-না বাবা,বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ করবে।
-ওরা ভিজছে যে?ওদের কি অসুখ হবেনা?ওদের মা তো ওদেরকে কিছু বলছেনা।তুমি কেন এমন করছ?
-জেদ করেনা বাবা,ওদের অসুখ হবেনা,হলেও আমাদের কি দরকার এসব চিন্তা করার?ওদের মা’রা ভাল না, তাই কিছু বলছেনা। অনেকেরতো মা নাই।আমি ভাল মা বলেই এমন করছি।
-না,তুমি ভাল না।পাশের বাসার আন্টি তোমাকে খারাপ বলেছে বলার পর তুমিইতো ঐ দিন বলেছ, ‘যারা অন্যকে খারাপ বলে তারা ভাল না।’এখন তো তুমি ওদের আম্মুকে খারাপ বললে,তাহলে তুমিও ভাল না।
-তাছিম বেশি কথা বলিও না।তাহলে আমি তোমার আব্বুকে পিটা দিতে বলব।
-আচ্ছা মা,ওদের অনেকের মা নেই কেন?তারা কোথায় গেছে?আর ওদের অসুখ হবেনা কেন?তাহলে আমারও তো অসুখ হবেনা।
-ওদের মা মারা দেছে,তাই নেই।ওরা গরীব,তাই ওদের অসুখ হবেনা।গরীবদের অসুখ হতে নেই।
-মারা গেছে কেন মা?আর গরীব মানে কি?
-তুমি এত প্রশ্ন করছ কেন বাবা?এসব আব্বুর কাছ থেকে জেনে নিও।
-বলনা মা,তুমি না আমার ভাল আম্মু?মারা গেছে কেন?
-হয়ত অসুখ হয়েছিল।চিকিৎসা করাতে না পারায় মারা গেছে।
-চিকিৎসা করাতে পারেনি কেন আম্মু?তুমিতো এখনই বলেছ গরীবদের ওসুখ হয়না।তাহলে ওদের অসুখ হল যে?
-ওরা গরীব বলে চিকিৎসা করাতে পারেনি।ঠিক আছে আব্বু,মেনে নিলাম ওদেরও অসুখ হয়।
-হা হা হা,আমি জিতে গেলাম।কি মজা,কি মজা,আম্মু হেরে গেছে।আচ্ছা আম্মু,গরীব মানে কি?
-এবার থাম বলছি তাছিম।আমি আর জবাব দিতে পারব না।
-আর বেশি না আম্মু,আর কয়েকটামাত্র।বল মা?
-গরীব হচ্ছে যাদের টাকা নেই,থাকার জন্য ভাল ঘর-বাড়ি নেই,ভালভাবে খেতে পায়না,ভাল জামা পরতে পারেনা তারা।
-আম্মু,আব্বুর তো অনেক টাকা।তাহলে আমি ওদেরকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসি?ওদের যেহেতু অসুখ হবে,তাহলে আব্বুর টাকা দিয়ে ওদের চিকিৎসা করাতে পারবে।আমার তো অনেক ভাল জামা,সেখান থেকে ওদের পরাতে পারব।আমাদের বাসায় অনেক খাবার,সেখান থেকে খাওয়াতে পারব।
-ওরাতো আমাদের কেউ না,ওদেরকে আমরা এসব করব কেন?
-আম্মু,ওরা আমাদের কেঊ না হলে কি ওদের জন্য কিছু করা যাবে না?
-না,করা যাবেনা।করতে হবেও না।এসব বন্ধ করে পড়তে বস।
-তাহলে ওরা যে আমার জন্য করেছে?একদিন আমি স্কুল থেকে আসার সময় একটা কুকুর আমাকে কামড়াতে এসেছিল।আমি ভয়ে কান্না শুরু করলে ওরা এসে কুকুরটিকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।আর আমাকে গেইটের ভিতরে দিয়ে গেছে।
-দেখি আব্বু কোথায় লেগেছে তোমার?আমাকে বলনি কেন?
-লাগেনিতো আম্মু,ওরা কামড়াতে দেয়নি।আর তুমি বকা দিবে বলে ভয়ে তোমাকে বলিনি।
-ঐ দিন ওদেরকে বাসায় ডাকনি কেন তুমি?
-আমি ডেকেছিলাম,কিন্তু ওরা এলো না,বলল ওদেরকে নিয়ে এলে তুমি আমাকে বকবে।আর তুমিইতো একটু আগে বলেছ ওরা আমাদের কেউ না,তাহলে এখন ডাকতে বলছ যে?
-ওরা তোমাকে বাঁছিয়েছে জেনেও আমি বকব?আমি কি এতই খারাপ?দুঃখিত আব্বু,আর বলব না।আমার ভুল হয়েছে।আসলে আমরা ধনীরা যেভাবে সবখানে সার্থ খুঁজি,গরীবরা তেমন না।ধনীদের ধন আছে,কিন্তু একটু সহানুভুতি করার মত মন নেই।অথচ গরীবদের ধন না থাকলেও নিঃসার্থ ভালবাসা আছে,সহানুভূতি করার মন আছে।আজ আমি তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখলাম।তুমি আমার অন্ধ চোখ খুলে দিয়েছ।
ওর মায়ের চোখ দিয়ে পানি নেমে এলো।৭ বছরের একটা শিশু যা বুঝে,তা ক্ষণস্থায়ী ধনের লোভে পড়ে সকলে ভুলে যায়।
-না আম্মু,তুমি আমার খুব ভাল আম্মু।আম্মু,আমি তাহলে এখন ওদেরকে নিয়ে আসি?তুমি কাদঁছ কেন আম্মু?
এটা বলে তাছিম মায়ের চোখ মুছে দিতে লাগল।
-না,মানে।এমনি আব্বু,আমার খুব খুশি লাগছে,তাই আনন্দে কাঁদছি।আমি যাব না,তুমি যাও।
-চল আম্মু তুমিও চল আমার সাথে।আমি আজ ওদের সাথে নাস্তা করব।
এই কথা বলে তাছিম ওর আম্মুকে টানতে টানতে বস্তির ছেলে-মেয়েদের কাছে নিয়ে গেল এবং ওদের সকলকে বাড়িতে নিয়ে এলো।তাছিমের আম্মু নিজের হাতে নাস্তা তৈরি করে সকলকে নিজে হাতে খাওয়ালো।ওরা সকলে খুব খুশি। কতদিন পর এমন ভাল খাবার খাচ্ছে ওরা!মায়েরও খুব ভাল লাগছে।হটাৎ তাছিমের আম্মু খেয়াল করল একটা ছেলের চোখে পানি।ও আনমনা হয়ে কি যেন ভাবছে আর নিরবে কাঁদছে।মা বলল, ‘কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?’
ছেলেটি কিছু না বলে ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো।তাছিমদের কাজের বুয়াও ঐ বস্তিতে থাকে।সে বলে উঠলো, ‘ওর মা মারা গেছে একমাস হলো। মা মারা যাবার পর থেকেই ও মাঝে মাঝে এভাবে কাঁদে।ও ছোট থাকতে ওর বাবা মারা যায়।ও বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে।ওর মা ওকে খুব ভালবাসত।নিজে না খেয়ে ওকে খাওয়াত।ও যে বস্তিতে থাকে তা ওকে বুঝতেও দিত না।মারা যাওয়ার আগে ওর মা খুব অসুস্থ হয়।ওর মা যাদের বাড়িতে কাজ করত তারা ওর মায়ের চিকিৎসা না করিয়ে বরং অসুস্থ অবস্থায়ও কাজ করিয়েছে।তারপর একদিন ওর মা ওকে ছেড়ে বিনা চিকিৎসায় না ফেরার দেশে চলে গেছে।ও প্রথম শ্রেণীতে পড়ত।এখন ওর পড়া-লেখাও বন্ধ হয়ে গেছে।’
এটা বলে সেও কেঁদে উঠলো।তাছিমের আম্মু ছেলেটির কাছে গেল।ছেলেটিকে নিজের বুকে টেনে নিল।ওর মায়ের মনটা প্রশান্ত হয়ে গেলো।মনে হলো যেন তাছিমকেই জড়িয়ে ধরেছে।আলতো করে একটা চুমু একেঁ দিয়ে বলল, ‘তোমার মা নেইতো কি হয়েছে? আমিতো আছি।আজ থেকে তুমি আমার আরেক ছেলে।আজ থেকে তুমি আমাদের সাথেই থাকবে।আর তাছিমের সাথে স্কুলে যাবে।’
ছেলেটির মন খুশিতে ভরে উঠলো।হয়ত ভূলে গেছে যে ওর মা নেই।তাছিমের আম্মুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগলো।তাছিমের আম্মু তাছিম ও তানহিকেও কাছে টেনে নিলো এবং ভাবতে লাগলো, ‘আমরা ধনীরা যদি একটু সহানুভূতিশীল হতাম!তাহলে আমাদের দেশে কোন বস্তি থাকত না।তাছিমের মতো একটা ছোট্ট শিশুর মাঝে যে সহানুভূতি আছে,আমাদের মাঝে তাও নেই।আজ আমি তাছিমের কাছ থেকে যে শিক্ষা লাভ করলাম,তা যদি আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থায় থাকত!তাহলে আমাদের সমাজ অনেক সুন্দর হয়ে যেতো।কোন গরীব বিনা চিকিৎসায় মারা যেতো না।অসহায় কাউকে অন্যের কাছে ভিক্ষার আশায় হাত পাততে হত না।আমরা কি হতে পারিনা তাছিমের মতো একটু সহানুভূতিশীল?’
বিষয়: বিবিধ
১৪৮৪ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ক্ষুদ্র এই অধমের পোষ্ট পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন