ডিহিউম্যানাইজেসন , পোল্যান্ডের ট্যুর ও কিছু বিক্ষিপ্ত চিন্তা:

লিখেছেন লিখেছেন প্রো_যুক্তি ১৪ জানুয়ারি, ২০১৪, ০২:৫২:১৯ রাত

بِسْــــــــــــــــــمِ اﷲِالرَّحْمَنِ اارَّحِيم

এই বছরের শুরুর দিকে দেখে আসলাম নাৎসি বাহিনীর তৈরি করা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মানব হত্যার কারখানা। পোল্যান্ডের ক্রাকোভ নগরীতেই কুখ্যাত আসউইজ(Auschwitz) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পটি। এর পর থেকে মানসিকভাবে স্বাভাবিক থাকতে পারেনি অনেক দিন। কেন ? কিভাবে সম্ভব এত নিষ্ঠুর হওয়া ? কিভাবে পারে এই সব কাজ করতে মানুষ?? ঐখান থেকে এসে অনেক ডকুমেন্টারি দেখলাম কিন্তু ঐরকম অনুভূতি পাইনি যেরকম সরাসরি উপস্থিত হয়ে পেয়েছি। এ নিয়ে আমার নিজস্ব চিন্তা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখব লিখব করে লিখা হয়ে উঠে নি। অবশেষে লিখেই ফেললাম। আর ভাষার উপর আমার দক্ষতা অসম্ভব খারাপ। এই জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

আগের সেই প্রশ্ন ,কেন? এই উত্তর পুরাপুরি জানি না তবে এইটা নিয়ে কিছু বলার আগে স্ট্রাওসের থিওরি নিয়ে কিছু বলি।



//আসউজ এর প্রবেশ পথ।//

স্ট্রাওস [Leo Strauss (September 20, 1899 – October 18, 1973)] আমেরিকান এক থিওলজিস্ট। তিনি মানুষদের ঐক্য করার জন্য যে থিওরি দেয় তা এখন রিপাবলিকান পার্টিরা অনুসরণ করে। তার মতে একটা বিশাল দল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বাইরে থেকে শত্রুর প্রয়োজন।



//Leo Strauss//

একটা উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। মনে করুন আপনার এলাকায় মারামারি। কেউ কারও কথা শুনতে চায় না মতানৈক্য ইত্যাদি। এমন অবস্থায় যদি আরেকটি এলাকা থেকে কেউ আসে আপনার এলাকায় আক্রমণ করে দেখা যাবে আপনার এলাকার মানুষ সব ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের প্রতিরোধে একযোগে কাজ করতেছে। সহজ-ভাষায় এইটাই থিওরিটি।

রোনাল্ড রিগানতো এক বক্তিতায় বলে ফেলেছে পৃথিবীর সব মানুষকে এক করার জন্য বাইরের বিশ্ব থেকে একটা শত্রু প্রয়োজন। এইজন্যই মনে হয় এলিয়েন ধারণাটি আমেরিকা মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে নরমালাইজ করছে যাতে মানুষ মনে করে এলিয়েনের অস্তিত্ব আছে। এতে লাভ কি ? ঐ বাইরে থেকে এলিয়েন আসলে পৃথিবীর সব মানুষ এক হবে কার নেতৃত্বে ? আমেরিকা ছাড়া আর কে ?

মূলত এইটাই হচ্ছে মানুষকে এক করার জন্য স্ট্রাওসের একটি থিওরি। কিন্তু এই থিওরি কার্যকর করতে একটি ব্যাকগ্রাউন ওয়ার্ক করা লাগে। তা হল, যে কোন একটি গোষ্ঠী বা দলের উপর ঘৃণা ছড়াতে হবে। Dehumanization প্রক্রিয়া যাকে বলে। ব্যাপক প্রচার করতে হবে এইরাই আমাদের শত্রু আর আমাদের ধ্বংসের জন্য এরাই দায়ী। আমাদের যা অমঙ্গল হচ্ছে তার পিছনে মূলত এই অপশক্তির বিষাক্ত হাত আছে। মিডিয়াতে অবশ্যই শক্ত অবস্থান থাকতে হবে এই প্রচারের জন্য।

কম সময়ে বিশাল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি এইরকম একটা ডিহিউম্যানাইজড দল বা গোষ্ঠী থাকলে আরও অনেক কাজ সহজ হয়ে যায়। যেমন কোথাও কোন অঘটন সন্ত্রাসবাদ ঘটলে খুব সহজেই এদের ঘাড়ে চাপানো যায় আর জনগণ বিশ্বাস করবেই, না করার কোন কারণ নেই যদিও তারা না করে। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ডিহিউম্যানাইজড দলের কেউ প্রতিশোধ নিলে তো আর কোন কথাই নেই। ফলাও ভাবে প্রচার করা হয় এদের কার্যক্রম। মাত্রাধিক ঘৃণায় অন্ধ হয়ে যাওয়া জনগণ তো বিশ্বাস করবেই। কোন অপরাধ ঐ গোষ্ঠীর কেউ করলে তার মাত্রাটি অনেক বেশি হয় স্বাভাবিকের চেয়ে।

আর কোন বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে এই ডিহিউম্যানাইজড দলের প্রসঙ্গ কোনভাবে টেনে আনলে খুব সহজ হয়ে যায় সব কিছু। আপাতত short term solution এর জন্য এখনও জনপ্রিয় ডিকটেডরদের কাছে এই থিওরি।

আর একটা বিষয় হচ্ছে ডিহিউম্যানাইজড দলের মানবধিকারতো দুরের কথা কোন আলোচনায় করা মহাপাও। আর ওদের সাথে কোনরূপ সম্পর্ক রাখা, আর কিছু কথা বললে যদি কোনভাবে ডিহিউম্যানাইজড দলের দিকে যায় তাহলে তা দেশদ্রোহীতা সমপর্যায়ের পাপ বলে গণ্য হবে।

আমেরিকা আগে এই ডিহিউম্যানাইজড গোষ্ঠীকে বানিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে আর নিজের দেশের মানুষকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে এরাই শত্রু। আশির দশকে যত মুভি আছে দেখবেন সব জায়গায় রাশিয়ানরাই ভিলেন। এরা চলে গেলে এই খালি জায়গা পূরণ করল ইসলাম। এ নিয়ে আপনারা সবাই জানেন যে ওয়ার অন টেররিজম এর নামে বিশ্বে কি চলছে। বার্মায় মসলিমদের উপর একই কাজ করছে ঐখানকার জান্তা সরকার। তাই দেখা যায় ওদের উপর গনহত্যা চালালেও শান্তিতে নোবেল পাওয়া আং সাং সুচিরও কোন অনুভূতি কাজ করে না। কি পরিমাণ ঘৃণা থাকলে এই অনুভূতি চলে যায়?

ঠিক একই কাজ করে হিটলার। এক প্রচণ্ড করমের ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়িয়েছিল ইহুদীদের উপর। বলা হয়েছিল এদের কারণে আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরেছি। এরা এসেছে এই দেশে খালি হাতে আর এখন পুরা দেশের সম্পদ ওদের হাতে আর আমাদের করে দিয়েছে গরিব। ওরা আসলে মানুষ না। এদের মানুষ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। এইরকম হাজারো অভিযোগে অভিযুক্ত করে এক প্রচণ্ড ঘৃণা জার্মান মানুষের মনে তৈরি করতে সফল হয়েছিল তার প্রোপাগান্ডা মেশিন দিয়ে।



//ইহুদীদের ডিহিউম্যানাইজেসন//

স্কুলের পাঠ্যবই এও এইসব বিষয় পড়ানো হত। পোল্যান্ডেই একজনের রেকোমেন্ডেশনে The boy in the striped pajamas মুভিতে তাই দেখলাম। ফলাফল ও পেল। পুরা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করল। ইহুদী পাইলেই যা করার করত কিন্তু কোন অনুভূতি কাজ করত না কারণ ওরা তো মানুষ-না। এইরকম ঘৃণা । ওদের এমনকি মহিলা শিশুও মরলে করো কিছু হত না বরং খুশি। এইটা ঠিক যে ইহুদীদের অনেকেই যথেষ্ট কুকর্ম করে বেড়িয়েছে। যেখানেই গেছে সেখানেই অর্থনীতির ধ্বস নামিয়ে দিয়েছে।আরও কত কি। তাই বলে সব ইহুদীরা তো খারাপ নয়। কিন্তু ওদের উপর ঘৃণা অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে হিটলার বাহিনী।

এই আসউইজ দেখে কিছুটা রিসোনিং খুঁজে পেলাম কেমনে প্রচণ্ড ঘৃণা মানুষ থেকে অনুভূতি সরিয়ে নেয়। কেমনে এই বাঁধভাঙ্গা ঘৃণা ড. মেঙ্গেলের মত মানুষের মত জন্ম দেয়। এই ডাক্তার কে বলা হত, Angel of Death। এই ক্যাম্পে আসা মানুষদের ভাগ্য নির্ধারণ হত এই ডাক্তারের হাতে। ট্রেন থেকে নামা মানুষদের সে এক নজর দেখত আর ডানে বামে ইঙ্গিত দিত। যাদের একটু স্বাস্থ্য ভাল ওদের ডানে আর মহিলা , শিশু আর বৃদ্ধরা হল বামে। আর বামদিকে মানে সোজা গ্যাস চেম্বারে। খারাপ লোকদের ঘৃণা করব ঠিক আছে কিন্তু এই ঘৃণা করারও একটি সীমা আছে যা অতিক্রম করলে যে মানুষের তৈরি হয় তা আরও ভয়াবহ। ঠিক এই নাৎসি বাহিনী। জঘন্যতম গণহত্যা করার পরও কোন অনুভূতি নেই আর এদের ফাঁসির আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কোন আক্ষেপ নেই আর বলে যা করছি ঠিকই করছি। আরেক সাবেক নাৎসি বাহিনীর সদস্যকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল , তুমি যখন গুলি করতা কি চিন্তা আসত মাথায় ? ও বলল , কি চিন্তা আর। টার্গেট ঠিক মত করতেছি কিনা তা চিন্তা করি। আসউজ ক্যাম্পের এক রুমে গিয়ে দেখলাম রুম ভর্তি চুল। গ্যাস চ্যাম্বারে ঢুকানোর আগে চুল কেটে নেওয়া হত। পড়ে ঐ চুল দিয়ে জামা কাপড় বানাত! মূলত ঘৃণা তাদেরকে অন্ধ বানিয়ে দিয়েছে।



//ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে ইহুদীদের আনার রেইলাইন এর ব্যবস্থা//



//আসউজ ক্যাম্পে হাজির। এদের বলা হত এখানে প্রচুর কাজ আছে, বিনোদনের ব্যবস্থা সহ অনেক সুযোগ সুবিধা। সুন্দর সুন্দর পোষ্টার ও বিজ্ঞাপন বানাত আকৃষ্ট করার জন্য।//



//ডাঃ মেঙ্গেলে বাছায় করছে কাদের জীবত রাখবে আর কাদের গ্যাস চেম্বারে পাঠাবে। মহিলা ও শিশু সোজা গ্যাস চেম্বারে। আর লোকদের মধ্যে বৃদ্ধ ও দুর্বলদের ও গ্যাস চেম্বারে।//



//গ্যাস চেম্বারের পথে... ওরা জানত না যে আর কিছুক্ষণ পরই মারা যাবে। শুধু জানে গোসল করতে যাচ্ছে..//



//চেম্বারের কি হয় তার মডেল।//



//চেম্বারে ঢুকানোর আগে চুল কেটে নেওয়া হত। চুল দিয়ে বানানো জামার কিছু অংশ।//



//গ্যাস চেম্বার//

তবে আইরনি হচ্ছে যাওনিজরা ঠিক একি থিওরি এপ্লায় করেছে ফিলিস্তিন আর আরবদের উপর।

যারা খারাপ কাজ করে তাদের স্বাভাবিক ভাবেই ঘৃণা করব। আর জার্মানদের যথেষ্ট কারণ ছিল ইহুদীদের ঘৃণা করার। নাৎসিরা দাবী করত ইহুদীদের কারণেই তারা প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে হেরেছে। এই রকম করে ওদের লিস্টের শেষ নেই। তাই বলে এই ঘৃণার লিমিট কতটুকু? কতটুক ঘৃণা করতে হয় পাপীদের? কারণ সীমার অতিরিক্ত ঘৃণার পরিণতি দেখে আসলাম যা রাতে দুঃস্বপ্ন হয়ে বার বার ফিরে আসছে।

এই প্রশ্ন গুলো করছি কারণ আমাদের দেশেও একি কাহিনী দেখছি। এক দল অন্য দলের উপর ঘৃণা ছড়াচ্ছে রীতিমত। আমাদের দেশেও ডিহিউম্যানাইজড দল আছে, দেশের সব সমস্যার জন্য ওরাই দায়ী, কেউ কোন সত্য কথাও বলতে পারবেনা ওদের ব্যাপারে যা ওদের পক্ষে চলে যায়। এর পর একে অপরকে বিভিন্ন বিশেষণে লেবেলিং করা... স্ট্রাওসের এই লুপে পরলে এর শেষ নেই। এই থিওরি অজান্তেই মানুষকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাবে যেখানে সে ঘৃণায় অন্ধ হয়ে যাবে। আর ইতিহাসে কেউ কোন দলকে নির্মুল করতে পারেনি আর করার চেষ্টা করা হলে তা সবসময় ব্যাকফায়ার করছে। এটা কোনদিনও সম্ভব না যে আপনি আপনার বিরোধীদের নির্মুল করতে পারবেন। দিনে ৩০,০০০ মানুষ মারার ক্ষমতা সম্পন্ন আসউইজ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেও হিটলার ইহুদী নিধোন করতে পারেনি।

আমরাও যে এ লুপের মধ্যে নেই এটা অস্বীকার করা কঠিন। এই লুপ থেকে বেড়িয়ে আসার উপায়? এর জন্য একটু ত্যাগ স্বীকার করা লাগবে। ঘৃণা, ভেদাভেদ একটু ছেড়ে দিয়ে একে অপরকে বুঝতে হবে। আলোচনায় বসতে হবে বিপরীত আইডিওলজির মানুষদের সাথে। এই আমার বিক্ষিপ্ত কিছু চিন্তা...

শেষ করি ক্যাম্পে ঢুকার সময় এইটি উক্তি দিয়েঃ



বিষয়: বিবিধ

১২৮৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

162275
১৪ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০২:৫৩
প্রো_যুক্তি লিখেছেন : সামুতে আমার ব্লগ http://somewhereinblog.net/blog/irobot/29915136
162279
১৪ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০৩:১০
শেখের পোলা লিখেছেন : শুনেছিলাম, আজ ছবিতে দেখলাম৷ আপনাকে ধন্যবাদ৷

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File