অপরাধের আখড়া হাতিরঝিল
লিখেছেন লিখেছেন ওয়াজেদ আহমেদ ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১০:৩০:২৬ রাত
নৈসর্গিক শোভা আর আধুনিক নির্মাণশৈলীর মনোমুঙ্কর হাতিরঝিল এখন অপরাধ অপকর্মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ছিনতাই, রাহাজানি, ঝাপটাবাজি, চাঁদাবাজি, প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চলছে হরহামেশা। দেহপসারিণী আর বখাটেদের মাত্রাতিরিক্ত উপদ্রবের পাশাপাশি মাদক কেনাবেচাও চলছে বেশুমার। পাঁচটি থানার আওতাভুক্ত রাজধানীর হাতিরঝিল বিনোদন কেন্দ্রটি মহানগরীর উঠতি সন্ত্রাসীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও বেনজরদারি যেমন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে হাতিরঝিলকে, তেমনি অব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশ হয়ে উঠেছে পুঁতিগন্ধময়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাজুক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে এখানকার পরিবেশ। প্রায় প্রতিদিনই হাতিরঝিলের বিভিন্ন পয়েন্টে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ঝিলের সংযোগ সেতুর নিচে কম আলোয় বসে চলে গাঁজা সেবনের ধুম। গাঁজার উৎকট গন্ধে নাক চেপে হেঁটে চলেন পথচারীরা। ঝাউগাছের ঝোপে দিনদুপুরে ঘুরতে আসা তরুণ-তরুণীদের আপত্তিকরভাবে বসে থাকায় বিব্রত পথচারী ও ভ্রমণপিপাসু মানুষ। প্রকল্পের কয়েকটি পয়েন্ট ছাড়া কোথাও কোনো টহল পুলিশকে দেখা যায় না। গত কয়েক দিন হাতিরঝিল প্রকল্পটি ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
পশ্চিম প্রান্তের টঙ্গী ডাইভারশন রোডের দিক থেকে হাতিরঝিলে প্রবেশপথের ডান দিকে আলোর ব্যবস্থা নেই। তেজগাঁওর কুনিপাড়ার দিক থেকে হাতিরঝিলে যাতায়াতের পথটিও অন্ধকারে ডুবে থাকে। পূর্ব দিকে রামপুরার ব্রিজ ঘেঁষা ও দক্ষিণে মহানগর প্রজেক্ট সংলগ্ন প্রবেশপথে আলোর ব্যবস্থা থাকলেও বাকি সব রাস্তা আলো-অাঁধারির লুকোচুরিতে নিমজ্জিত রয়েছে। স্বল্প আলোতে তৎপর মাদক সেবনকারী ও সরবরাহকারীরা। হাতিরঝিল প্রকল্পের মগবাজার ও তেজগাঁও এলাকার আশপাশে রয়েছে কিছু বস্তি এলাকা। আর এসব এলাকাকে ঘিরে চলে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ। প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তার পাশে বসেই চলছে হরহামেশা মাদক গ্রহণ। সন্ধ্যা হতেই শুরু হয় যৌনকর্মীদের উপস্থিতি। রাত গভীর হতে থাকলে তাদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। হাতিরঝিল ঘেঁষা উত্তর পাশে বেশ কিছু বাড়িঘরের বাসিন্দা মাদক ও নারী দেহের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, আশপাশের মহল্লার মাস্তানরা যৌনকর্মীদের মাধ্যমে শিকার ধরে মারধর করে তাদের মোবাইল ফোন, পকেটের টাকা, ক্রেডিট কার্ডসহ মূল্যবান সব কিছু ছিনিয়ে নিচ্ছে।
হাতিরঝিলের প্রতিটি ব্রিজের নিচে এবং আশপাশে কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবকের আড্ডা বসে। সকাল-বিকাল এমনকি মধ্যরাতেও হাতিরঝিলের ব্যস্ততম সড়কগুলোতে বিপজ্জনক কার ও মোটরবাইক রেসিং চলে। বিকট শব্দে বেপরোয়া রেসিং কার ও মোটরসাইকেলের এদিক-সেদিক ছোটাছুটিতে নারী-শিশুসহ ভ্রমণপিয়াসীরা চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এসব রেসিংয়ের ঘটনায় প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে, আহত হচ্ছে সাধারণ পথচারী। গত তিন মাসে হাতিরঝিলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ১০ জন। আহত হয়েছেন শতাধিক। মেরুল বাড্ডার মোড়ে কথা হয় ব্যবসায়ী সবুর মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, হাতিরঝিলের বহির্গামী গাড়ির চাপে কখনো কখনো মেরুল বাড্ডার মোড়ে এত বেশি যানজট লাগে যে, তা সরতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লেগে যায়। একমুখী পথ হওয়া সত্ত্বেও উল্টো দিকে বেপরোয়া গাড়ি চালানোই এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। এ ছাড়া রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও রাত-দিন চলাচল করছে রিকশা, ভ্যানসহ অযান্ত্রিক যানবাহন। হাতিরঝিলে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ট্রাফিক) অতিরিক্ত কমিশনার মিলি বিশ্বাস বলেন, হাতিরঝিলে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনতে ট্রাফিকের উত্তর ও পূর্ব বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি কড়াকড়িভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।
হাতিরঝিল প্রকল্প নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনকারী সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু সাঈদ এম মাসুদ জানান, 'এখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষের আগমন দেখে মনে হয় হাতিরঝিলটি যদি আরও সুন্দর করা যেত তাহলে ভালো হতো। মানুষের কাছে স্থানটি আরও আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যেত। আমরা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। যখন নানা রকম বিনোদন অবকাঠামো তৈরি শেষ হবে তখন এটি মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হবে।' তিনি জানান, এখনো কাজ চলছে। হাতিরঝিলের বাড্ডামুখী রাস্তায় ছোট ফ্লাইওভার নির্মাণের মাধ্যমে যান চলাচল বাধাহীন ও যানজটহীন করার কাজ চলছে।
ডাস্টবিন থাকা সত্ত্বেও যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। লেকের পানিতে দুর্গন্ধ। ভেঙে পড়েছে প্রকল্পের বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা। রাস্তায় কাদাপানি। হাতিরঝিল উদ্বোধনের পর থেকেই সান্ধ্যকালীন নিয়মিত ভ্রমণকারী কায়েস আহমেদ সেলিম। বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকায় তার বাসা। কায়েস বলেন, ঝক্কি-ঝামেলার রাজধানীর কোথাও দুই দণ্ড নিরিবিলি সময় কাটানোর উপায় নেই। হাতিরঝিল আমাদের আপ্লুত করেছিল। কিন্তু দিনদিনই এর পরিবেশ চরম খারাপ আকার ধারণ করে চলছে। এখানে সপরিবারে বেড়ানোর উপায় থাকছে না। তিনি আরও বলেন, গোটা হাতিরঝিল কয়েক দফা ঢুঁ মেরেও কোনো নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। কোনো থানা পুলিশের উপস্থিতিও চোখে পড়ে না সেখানে। অপর দর্শনার্থী আলমগীর সেলিম জানান, রাতের অাঁধারে কখনো কখনো পুলিশ ঢোকে হাতিরঝিলে। তবে তারা দর্শনার্থীদের জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ান।
হাতিরঝিলের গুলশান শুটিং ক্লাব-সংলগ্ন প্রবেশ পথটুকু গুলশান থানার আওতাধীন হলেও সেখানে মাঝে-মধ্যেই বনানী থানার একজন সাব ইন্সপেক্টর সঙ্গীয় সোর্সদের নিয়ে দর্শনার্থীদের হয়রানি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মালিবাগ থেকে বেড়াতে আসা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই তরুণী একই ধরনের অভিযোগ করেন বাড্ডা থানার একজন এএসআইর বিরুদ্ধে। তারা জানান, গত বুধবার বিকাল সাড়ে ৫টায় ওই এএসআই সাদা পোশাকে কোমরে অস্ত্র ঝুলিয়ে বাড্ডামুখী প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে মেয়েদের নানা রকম টোন করছিলেন। প্রতিবাদ করায় বাজে ভাষায় গালাগাল দেন এবং পতিতা হিসেবে গ্রেফতার করে কোর্টে চালান দেওয়ারও হুমকি দেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারটি প্রায়ই বাড্ডামুখী হাতিরঝিল পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে নানাভাবে দর্শনার্থীদের হয়রানি করে থাকেন।
- See more at: http://www.bd-pratidin.com/2014/02/15/43566#sthash.bZcNBJJi.dpuf
বিষয়: বিবিধ
১২০৪ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বিষয় টা আন্তরিকতার।
মন্তব্য করতে লগইন করুন