গল্প: আরেকটা আইটেম বাড়ান যায় না?
লিখেছেন লিখেছেন হিমায়িত হিন্দোল ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১১:৩৮:৩৯ রাত
১৯৯৮ সাল, সারা দেশ বন্যার পানিতে ভাসছে। জন্ম থেকেই ঢাকায় থাকার কারণে একসাথে এতো পানি এর আগে খুবএকটা দেখিনি। ঢাকা শহর পানির নিচে। আমাদের বাসার সামনে হাঁটুপানি। কোথাও আবার কোমর পানি। ঢাকার রজপথে সর্বোত্র অবাধে নৌকা চলছে। কাঠের নৌকার চেয়ে স্টিল বডির নৌকাই বেশী।
আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। দুরন্ত কৈশর। ঢাকায় থাকলেও আমরা বর্তমান সময়ের ফার্মের মুরগীর মত পরিবেশে বড় হইনি। বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে স্কুলে যেতাম. স্কুল থেকে এসে বিকেলে সোজা খেলার মাঠে, রাতে লোডশেডিং হলে সবাই বের হয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো হয়ে হইহুল্লোর করার সুযোগ; আমাদের কিছুটা স্বাধীন ভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। এলাকার ২০/২৫ জনের একটি গ্রুপ ছিল আমাদের; যারা প্রায় সবাই স্থানীয় ও সমবয়সি।
সেবার বন্যার কারণে ২য় সাময়িক পরীক্ষা এগিয়ে আনা হলো। চারদিকে প্রতিদিন ফুসফুস করে পানি বাড়ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মাঝেও উত্তেজনা বাড়ছে। মূলত: দুধরনের উত্তেজনা, একটি হচ্ছে পরীক্ষা শেষ হবার আরেকটি হচ্ছে বন্যার পানি বাড়ার। আমাদের সে-কি আনন্দ। যদিও ঢাকার আশেপাশে পানি বৃদ্ধির কারণে ছিন্নমূল মানুষ তাদের সহায় সম্পদ, গরু-বাছুর, হাস-মুরগি নিয়ে শহরমূখি হচ্ছে; কিন্তু মানুষের এই কষ্ট আমাদের খুবএকটা স্পর্শ করছে না। তাড়াহুড়া করে পরীক্ষা শেষ হলো। পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্কুল বন্ধ। স্কুল চলে গেলো বর্ন্যাতদের দখলে। সব রুমের চেয়ার, টবিল, বেঞ্চ খালি করে বন্যাদূর্গতদের ক্যাম্প করা হলো। স্কুলের মাঠে পানি থৈ থৈ করছে। এক একটি রুমে ২৫/৩০জন মানুষ ঠাসাঠাসি করে উঠেছে। স্কুলের বারান্দায় উঠেছে গরু-ছাগলগুলো। আমরা মাঝেমাঝে দলবেধে বন্যার্তদের দেখতে যেতাম। বিশুদ্ধ পানি, খাবার আর সেনিটেশনের চরম সংকট আমরা জীবনের প্রথম তখনই এতা কাছ থেকে দেখলাম।
পরীক্ষা শেষ, স্কুলও বন্ধ। কিন্তু এই বন্যা আমাদের সব পূর্ব পরিকল্পনাগুলো ভন্ডুল করে দিল। টুর্ণামেন্ট আর ক্রিকেট খেলা বাদ দিয়ে তখন শুরু হলো ‘নৌকা ভ্রমণ’। প্রত্যেকেই প্রতিদিন ৫-১০টাকা পকেটে নিয়ে বের হচ্ছি। আমরা প্রতিদিনই দলবেধে নৌকাভ্রমনে যাচ্ছি কখনো বা কোন ঝিলে সবাই মিলে গোসল করছি আরো কতরকম আনন্দ আর মজার মজার খেলা আমরা আবিষ্কার করলাম।
দেখতে দেখতে বন্যা প্রায় ১মাস হয়ে গেল। আমাদের আত্নোভোলা আনন্দের পাশাপাশি মানুষের নিদারুন কষ্ট ও মানবিক বিপর্যয় এবার আমাদেরও হৃদয় স্পর্শ করলো। আমরা ২০/২৫ জন বন্ধু (যার সবাই ক্লাস এইট নাইনে পড়ি) কিছু করার তাগিদ অনুভব করলাম। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য কাজ করবো বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু কি করবো? কিভাবে শুরু করা যায়? কেউ কি আমাদের কথা বিশ্বাস করবে? সেই দিনই আমাদের এলাকার রিপন ভাই নামে একজন বড় ভাইকে আমাদের পরিকল্পনার কথা জানালাম। সবশুনে তিনি আমাদের দারুন উৎসাহিত করলেন, সাহস দিলেন এবং বন্যার্তদের সহায়তার জন্য ফান্ড কালেকশনের সুন্দর একটা পরিকল্পনা করে দিলেন।
রিপন ভাইদের সাথে পেয়ে আমাদের উৎসাহের আর সীমা রইলোনা। পরের দিনই আমরা ত্রাণ কালেকশনে নেমে পড়লাম। আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল; বন্যাকবলীত এলাকায় আমরা শুকনো খাবার আর ঔষধ বিতরণ করবো। আর এগুলো কেনার জন্য নগদ অর্থ কালেকশন করা হবে। বিপুল উৎসাহে শুরু হলো বন্যার্তদের সহায়তার জন্য ফান্ড কালেকশন। পুরো এলাকাকে ভাগ করে ৩/৪টা গ্র“পে আমরা নেমে পড়লাম। প্রথমে একটি পাঁচতলা বিল্ডিং থেকে আমাদের কালেকশান শুরু হলো। ঐ বাড়িটাকে আমরা ‘সিংহ মার্কা’ বাড়ি বলতাম। কারণ বাড়ির গেইটে একটা হা কারা ভয়ংকর সিংহ ছিল। বিল্ডিং এর বাড়িওয়ালার ছেলে পলকও আমাদের বন্ধু। আমরা সবাই এলাকায় পরিচিত হওয়াতে খুব ভাল সাড়া পেলাম। প্রতি দিন ২/৩ ঘন্টা করে আমরা ৫দিন কালেকশন করলাম। আমাদের এক বন্ধু শিমুল (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসি) হিসাবের দায়িত্ব পালন করতো। ৫দিন পর আমরা দেখলাম মোট নয়হাজার সাতশত টাকা কালেকশন হয়েছে।
এবার ত্রাণ বিতরণের পালা। রিপন ভাই, জাকির ভাইদের সহযোগিতায় শুকনো খাবার, ওরস্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ টেবলেট কেনা হলো। ৪বস্তা চিড়া, ২পাটা গুড় ও ঔষধ ভাগ করে মোট ৩৩০ প্যাকেট ত্রাণ করা হলো। প্রতি প্যাকেটে ১কেজি চিড়া, গুড়, ৩টি ওরসেলাইন, ১পাতা পানি বিশুদ্ধ করণ ট্যাবলেট। আমরা সবাই মিলে আমাদের স্থানীয় মসজিদের ২য়তলায় এগুলো প্যাকেট করলাম। এবার কিভাবে কোন এলাকায় ত্রাণবিতরণ করা হবে..এ বিষয় আলোচনা।
সিদ্ধান্ত হলো: যেহেতু আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সরকারী সহযোগিতা আসছে সেহেতু আমরা দূর্গত নিচু এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করবো। মাত্র ৩০০ প্যাকেট ত্রাণ যেহেতু খুবই কম তাই ত্রাণবিতরনের জন্য আগেই একটি নির্দিষ্ট স্থান ঠিক করতে হবে এবং যাদেরকে ত্রাণ দেয়া হবে তাদেরকে স্লিপ দিতে হবে। স্লিপ দেয়ার জন্য একদিন পূর্বে আমি, আরাফাত এবং রিপন ভাই নৌকায় করে সবুজবাগের মাদারটেকের দক্ষিণগাঁও নামক পানিতে নিমজ্জিত এক এলাকায় গেলাম। আমরা যখন সেখানে পৌছেছি তখন আনুমানিক বিকাল ৫টা। আমি দেখলাম; প্রায় সব ঘর-বড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। ঘরের টিনের চালের উপর কেউ কেউ বসবাস করছে। যতদূর চোখ গেল পানি আর পানি। এরমধ্যে একটা দোতলা বিল্ডিং আমাদের চোখে পড়লো। রিপন ভাই বললেন: ‘ঐ বিল্ডিংএর কাছে চলো, এই বাড়ি থেকেই ত্রাণ দিতে হবে। বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে যাই’। বাঁশের শাকো পার হয়ে আমরা ঐ বাড়িতে ঢুকলাম। একজন পঞ্চাশোর্ধ মুরুব্বি বেরোলেন। সবশুনে তিনি অনুমতি দিলেন যে, আগামী কাল সকাল ১০টায় তার বাসা থেকে ত্রাণ বিতরন করা হবে। আমরা এবার স্লিপ বিতরণের জন্য নৌকায় উঠলাম। আমাদের নৌকাটি আস্তে আস্তে একেকটি ঘরের কাছে যাচ্ছে আর আমি আমার স্বাক্ষর করা একটি স্লিপ হাতে দিয়ে বলছি “আগামী কাল সকাল ১০টায় হাজী মোসলেম সাহেবের বাসা থেকে ত্রাণ দেয়া হবে, আপনারা আইসেন”। আমার হাতে ২০০টি স্লিপ। ২০টির মতো বিতরণ করেছি মাত্র। এরমধ্যে পুরো এলাকায় আজগুবি ভাবে খবর রটে গেল “সরকারী লোক আইছে, ত্রাণের কার্ড দিতাছে, ঐ যে নৌকায়.. ধর!!”
এরপরের ঘটনাটি সবাই অনুমান করতে পারছেন। বিভিষিকাময় সেই ঘটনা কিছুই আমার মনে নেই। কারণ একটি দৃশ্য আমার চোখ, অন্তর, চিন্তা শক্তিকে নিথর করে দিলো। ৯৮ সালের পর থেকে বহুরাতে আমি এই ঘটনাটি স্বপ্নে দেখেছি। আমার জীবনের স্মরণীয় কোন ঘটনা কেউ জিজ্ঞাস করলে প্রথমেই আমার এই দৃশ্মটির কথা চোখে ভাসে, কিন্তু বলতে পারিনা।
আমি দেখলাম: একটি পনিতে ডোবা দোচালা টিনের ঘর। ঘরটির চালে বালিকা বয়সি এক মা তার ২/৩বছর বয়সি একটি শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পরনে কমলা রঙের মলিন একটি শুকনো সারি। ঘরের চালের উপর কয়েকটি পাতিল, বালিশ, কাঁথা আরো যেন কি কি এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে। চারদিক থেকে যখন চিৎকার উঠলো “ত্রাণের কার্ড দিতাছে.....” তখন সেই মহিলা চোখের পলকে কোলের শিশুটিকে টিনের উপর রেখে পানিতে ঝাপিয়ে পড়লো। অনেক দূর থেকে আমি মহিলাকে দেখছি। আমাকে ঘিরে ধরেছে শ’খানেক মানুষ। আমাদের নৌকা প্রায় ডুবে যাচ্ছে। চারিদিকে চিৎকার চেচামেচি। এর মধ্যে সেই মহিলাও সাতরে এসে নৌকার গলুই ধরলো। চিৎকার করে বলতে লাগলো ‘আমারে একটা দেন, আমি পাই নাই আমারে একটা দেন’। কিন্তু তখন আমার হাতে আর কোন কার্ড নেই। নৌকার মাঝি বৈঠা দিয়ে মানুষ তাড়াচ্ছে। ধ্র“ত নৌকা বেয়ে বের হয়ে আসছে কোলাহল থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাগরিবের আজান হলো। আস্তে আস্তে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলো।
বাসায় এসেই সব বন্ধুদের ফোন দিলাম; এশার নামাজে মসজিদে আসতে। নামাজের পর আমার দেখা জীবনের সবচেয়ে করুন ও বিভৎষ চিত্রটি বন্ধুদের বললাম। খুব আফসোস হলো, কেন আমরা মাত্র ৩০০ প্যাকেট ত্রাণ নিয়ে এই কাজ করলাম। মানুষতো অনেক কিছু আশা করছে, কিভাবে এতো কম জিনিষ নিয়ে কাল সেখানে যাবো? কিন্তু আমাদেরই বা কি করার আছে। আমি বললাম: আচ্ছা আরেকটা আইটেম কি বাড়ানো যায় না? কিন্তু কি বাড়াবো? টাকা পাবো কোথায়? অবশেষে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম প্রত্যেক প্যাকেটের সাথে একটি করে ‘মধুবন রুটি’ দেয়া হবে। মসজিদের সাথেই পরিচিত এক চাচার কনফেকশনারী দোকান ছিল; তাকে সব খুলে বললাম: “চাচা আমাদের যে ভাবেই হোক আগামী কাল খুব সকালে ৩০০পিস মধুবন দিতে হবে। টাকা আমরা পরে দেবো”। তিনি সবশুনে বেকারীতে ফোন করলেন। বললেন সকাল ৬টার মধ্যে রুটি আসবে। সবাইকে বলে দিলাম সকাল ছয়টায় মসজিদের দোতলায় হাজির হতে হবে। কারণ সবগুলো প্যাকেট খুলে ভিতরে রুটি ভরে আবার প্যাকেট করতে হবে। অনেক কাজ।
সারা রাত আমার ঘুম হলো না। বারবার ঐ মহিলা আর তার কোলের শিশুটির মুখ ভেসে উঠছে। আহারে! হয়তো সারারাত ভিজা কাপড় পরেই তাকে বসে থাকতে হবে খোলা আকাশের নীচে। বেচারীকে একটা কার্ড দিতে পারলেও মনে শান্তি পেতাম।
সকাল ৬টায় রুটি আসলো। কিন্তু একি! সব রুটি প্রচন্ড গরম। প্যাকেট হবে কিভাবে? আর আমার বন্ধুদেরও খবর নেই। ত্রাণ বিতরণে সবাই যাবার কথা। সবার জন্য রিপন ভাই ২টি নৌকা রিজার্ভ করে রেখেছেন। কিন্তু সব মিলে ৫/৬জন এলো। মসজিদের সব ফ্যান ছেড়ে দিয়ে রুটি ঠান্ডা করে প্যাকেট করা হলো। অবশেষে সকাল ৮টায় আমরা মাদারটেক রওয়ানা হলাম।
গিয়ে দেখি, ২০০কার্ড বিতরণ করলেও হাজী সাহেবের বাসার সামনে প্রায় ৩০০ মানুষের ভিড়। হাজী সাহেব ও স্থানীয়দের সহায়তায় ৫বস্তা ত্রাণ (৩৩০ প্যাকেট) তার বাসা থেকে বিতরণ করা হলো। আমি বারবার খুঁজতে থাকলাম সেই মহিলাকে। বাচ্চা কোলে নিয়ে যেই আসে আমি নিবিড় ভাবে দেখি। কিন্তু নাহ! পেলাম না। ত্রাণ বিতরণ শেষ করে বিকাল ৩টার দিকে ১০টা প্যাকেট নৌকায় নিয়ে রিপন ভাই আর আমি আবার বের হলাম। সেই বাড়ির কাছে গেলাম। কিন্তু আমার খুব ছোট বয়সে পাওয়া সেই কষ্টটার পরিসমাপ্তি হলো না।
বিষয়: সাহিত্য
২৩৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন