কেন পশ্চিমারা বস্তুবাদী নিরীশ্বর বাদে আর পূর্বেরা ঈশ্বরবাদে আঁকড়ে আছে??
লিখেছেন লিখেছেন ইমরোজ ০১ আগস্ট, ২০১৮, ০৭:৩৯:৫৪ সকাল
২০০২ সালে পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সৌদি আরবের 'আরব নিউজ' পত্রিকায় ইংরেজিতে ধর্ম নিয়ে একটি আত্নউপলব্ধি মুলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আমার মনে হয় ইমরান খানের লেখাটি আমাদের মত আইডেন্টি ক্রাইসিসে ভুগা জন্মসুত্রে মুসলিমদেরকে ভাবনার খোরাক দিবে।
আর্টিকেলের শিরোনাম ...কেন পশ্চিমারা বস্তুবাদী নিরীশ্বর বাদে আর পূর্বেরা ঈশ্বরবাদে আঁকড়ে আছে??
আক্ষরিক অনুবাদ করার মত কারিশমা আমার নেই... তাই আমি আমার বুঝার ভাবার্থ থেকেই খুব সহজ ভাষায় অনুবাদ করার চেস্টা করলাম ...যা হয়তো জায়গায় জায়গায় তার মুল লেখা থেকে হেরফের হবে, সেজন্য আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এই অনুবাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হল ইসলাম নিয়ে ইমরান খানের কমপ্লেক্স চিন্তাধারা ... ব্যক্তি ইমরানের সাথে তার সামঞ্জস্য আছে কিনা এই বিতর্কে আমার কোন আগ্রহ নেই।
.........................................................
আমার জেনারেশনের এমন এক সময় বেড়ে উঠা যখন আমাদের ঔপনবেশিক মানসিকতা তুঙ্গে । আমাদের পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশদের গোলামী করার ফলে তাদের মধ্যে সবসময়ই একধরনের হীনমন্যতা ছিল। আমি যে স্কুলে পড়তে গেলাম তা আর দশটা অভিজাত বনেদী স্কুলের মতই। যদিও আমরা স্বাধীন কিন্ত তারা পাকিস্তানী বানানোর বদলে ব্রিটিশ আমলের গোলামী মানসিকতার সেই রেপ্লিকাই তৈরি করতে লাগল।
আমরা সেক্সপিয়ার পড়লাম...তা না হয় ঠিক আছে ; কিন্তু তা আল্লামা ইকবালকে একেবারে বাদ দিয়ে। ইসলামী শিক্ষাদানের পাঠ্যসূচীকে তেমন গুরুত্ত্ব দেয়া হল না। আমি যখন স্কুল থেকে বের হলাম তখন আমার পরিচিতি... আমি একজন অভিজাত বনেদী।কারন আমি ইংরেজিতে কথা বলতে পারি আর পশ্চিমাদের ফ্যাশনে কেতাদুরস্থ। যদিও নিয়মিত স্কুলের অনুষ্ঠানে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে স্লোগান দেই কিন্তু আমার কাছে ততদিনে নিজের সংস্কৃতি বাতিল মাল আর ধর্ম অর্থহীন অচল। কেউ ধর্ম নিয়ে কথা বললে বা দাড়ি রাখলে আমরা তাকে মোল্লাহ বলে নাক সিটকাতাম। শক্তিশালী পশ্চিমা মিডিয়ার বদৌলতে আমাদের সব নায়করা ছিল পশ্চিমা মুভির নায়ক কিংবা পপ স্টার।
আমি যখন অক্সফোর্ডে পড়তে গেলাম আমার এই ধারণাটাই আরো পাকাপোক্ত হল। আসলে অক্সফোর্ডে ইসলাম কেন... যেকোন ধর্মকেই সময়ের অসংগতি মানে কালবৈষম্য হিসাবে গণ্য হত। তাদের ধারনা বিজ্ঞান ধর্মকে অসার করে দিয়েছে। যা কিছু যুক্তি দিয়ে প্রমান করা যায় না... তার আসলে কোন অস্তিত্ত্ব নেই। এমনকি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে বিতর্কিত ডারউইনের অর্ধ সিদ্ধ বিবর্তনবাদ যাকে মানুষের জন্ম এবং ধর্মের অসারতা প্রমান করে বলে ভাবা হত... তাই খুব জোরালো ভাবে হাইলাইট করা হত।
আসলে ইউরোপের ইতিহাস... ধর্ম নিয়ে তাদের নিদারুন অভিজ্ঞতার কথাই বলে। ক্যাথলিক চার্চের শাসনামলে ধর্ম যাজকরা ধর্মের নামে যে অন্যায় অত্যাচার আর বিভীষিকা চালিয়েছেন তার একটা গভীর প্রভাব আছে পশ্চিমাদের মনে। পশ্চিমারা কেন সেকুলারিজমে এত আগ্রহী তা বুঝতে হলে স্পেনের করডবার মত জায়গাগুলিতে আমাদের যাওয়া উচিত। ধর্মযাজকরা সেই যুগে কি বীভৎস বিভীষিকাটাই না চালিয়েছেন ততকালীন বিজ্ঞানীদের উপর। যা আপনাকে প্রকান্তরে ধর্ম সম্পর্কে একটা পশ্চাদ্মুখী নেগেটিভ ধারনা দিবে।
তবে, আমার মত ব্যাক্তিরা আসলে যেই কারনে ধর্ম থেকে দূরে রইল তা হল আমাদের সমাজের হুজুরদের সিলেক্টিভ ইসলাম প্রচারনা। তারা যা উপদেশ দেয় আর যা পালন করে তার মধ্যে একটা বিশাল ফারাক আছে। তাছাড়া ধর্মীয় দার্শনিক ব্যাখ্যার বদলে তারা ধর্মীয় রীতিনীতির আনুষ্ঠানিক বিধিনিষেধগুলিকেই মাত্রাতিরিক্ত হাইলাইট করেন।
আমি মনে করি মানুষ আর অন্যান্য প্রানীর মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে । ভয় বা শক্তি দিয়ে অন্যান্য প্রানীকে কাবু করা যায় কিন্ত মানুষকে কনভিন্স করতে হয় যুক্তি আর জ্ঞান দিয়ে। আমার মনে হয় এখানেই কোরআনের সবচেয়ে বড় আকর্ষন। কোরআন আমাদের অনেক কিন্তুর জবাব দেয়। অবশ্য সবচেয়ে খারাপ ফল হল কোরআনের খণ্ডিত আয়াতগুলি যখন আমরা ব্যক্তি বা দলীয় বা বিশেষ রাজনৈতিক সুবিধায় ব্যাবহার করি।
তাই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে আমার নাস্তিক না হওয়াটা আসলে একটা আশ্চর্যের বিষয়ই বটে। তবে আমার এই না হওয়াটার পেছনে একমাত্র কারনটা হল আমার শৈশবে আমার মায়ের ধর্মীয় ভুমিকাটা। এটা আসলে যত না বিশ্বাস তার চেয়ে বেশী ছিল তার প্রতি আমার ভালবাসা থেকে। অবশ্য আমার ইসলাম ধর্ম পালনটা ছিল খুবই সিলেক্টিভ ; আমি ততটুকুই পালন করতাম যতটুকু আমার লাইফস্টাইলের সাথে টক্কর খায় না। আমার নামাজ ছিল ঈদের নামাজ আর মাঝে মাঝে জুমার নামাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
মানে আমি আসলে ধীরে ধীরে একজন খাঁটি বাদামী সাহেবে রূপান্তরিত হচ্ছিলাম। আর হবই না কেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত ভাবে লোটা বাদামী সাহেব হবার সমস্ত রসদই আমার ছিল। কিন্তু এতকিছুর পর কি কারনে আমি তা না হয়ে দেশী থেকে গেলাম... তার অনেক কারন আছে । অবশ্য তা রাতারাতি সম্ভব হয়নি।
প্রথমত আমি নিজেকে একজন বিশ্বমানের অ্যাাথলেট হিসাবে গড়ে তোলার সুবাদে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সাদাদের প্রতি গোলামীর যে হীন মানসিকতা... তা আমি আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠলাম। দ্বিতীয়ত আমার সৌভাগ্য যে আমার দুটি সংস্কৃতিকেই কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ফলে উভয় সমাজের সুবিধা /অসুবিধা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি। পশ্চিমা দেশে সবচেয়ে শক্তিশালী হল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি... যা আমাদের দেশে ধারাবাহিক ভাবে নস্ট হয়ে যাচ্ছে । কিন্তু যে জায়গাটিতে আমরা শক্তিশালী তা হল আমাদের পারিবারিক বন্ধন। আমি মনে করি এটাই পশ্চিমা সমাজের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। ধর্মযাজকদের নিপীড়ন থেকে মুক্ত হতে গিয়ে তারা তাদের জীবন থেকে ধর্ম এবং ঈশ্বর উভয়কেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিল। আমি মনে করি... বিজ্ঞান সময়ের সাথে যতই আগাক না কেন দুটি প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান কখনই সন্তোষজনক ভাবে মানুষকে দিতে পারবে না??
পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বের ( জীবনের ) উদ্দেশ্যটা কি??
মারা যাবার পর আমাদের (আত্মার) আসলে কি হয়??
আমার মনে হয় এই উত্তর না পাওয়ার এক বিশাল শুন্যতা বস্তুবাদী এবং ভোগবাদী পশ্চিমা সমাজকে ঘিরে রাখে। এইটাই যদি একমাত্র জীবন হয় তবে সময় থাকতে তা উপভোগ কর। আর উপভোগ করতে হলে যত তাড়াতাড়ি পার... ধন সম্পদ বিত্ত লাভ কর। আর উপভোগের এই লিপ্সা এবং অর্জনের এই প্রচন্ড চাপের সংস্কৃতিতে আপনার মানসিক সমস্যা হতে বাধ্য। কারন সময়ে সময়ে শরীরের সঙ্গে আত্মার টক্কর খাবেই। আমেরিকার কথাই ধরেন। নাগরিকের মোলিক অধিকারের কোন কমতি নেই তারপর ও জনসংখ্যার প্রায় ৬০% মানসিক চিকিৎসা নিতে জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে মানসিক ডাক্তারের দ্বারস্থ হয়। মজার ব্যাপার হল আধুনিক মনোবিজ্ঞানে মানুষের আত্মা নিয়ে কোন গবেষনা নেই। সুইডেন/ সুইজারল্যান্ডে যেখানে সবচেয়ে বেশী নাগরিক সুযোগসুবিধা সেখানেই আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশী। তার মানে হল ... মানুষ এই ইহলৌকিক ভোগ আর বস্তুবাদী সমাজের চাহিদা মিটিয়েই সন্তুষ্ট নয়..বরং তার আরো কিছুর দরকার হয়।
নশ্বরতার মূল শিকড়টা আসলে ধর্মে ... কিন্তু ধর্মই যদি না থাকে তবে অবিনশ্বরতার আকাঙ্খা মানুষকে ছাপিয়ে বসে। ৭০ সালের পর থেকে আমরা সেই আকাংখাটাকেই উত্তরতর ছাপিয়ে উঠতে দেখলাম। আর তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ল পশ্চিমাদের পারিবারিক জীবনে।ইংল্যান্ডে ডিভোর্সের হার ৬০% আর ৩৫% মত সিংগেল মাদার। এত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও প্রত্যেকটা পশ্চিমাদেশে অপরাধ প্রবনতা পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলল। কিন্তু সবচেয়ে ডিস্টার্বিং ব্যাপার হল রেসিজম আবার বিপদজনক হারে বৃদ্ধি পেল। মজার ব্যাপার হল বিজ্ঞান সবসময়ই প্রমান করতে চেয়েছে সব মানুষ সমান নয়। সাম্প্রতিক এক গবেষনায় বলা হয়েছে আমেরিকান কালোরা জিনগত ভাবে সাদাদের চেয়ে কম বুদ্ধিমান। অথচ ধর্মচর্চাই একমাত্র জায়গা যেখানে মানুষকে শিখায় যে ইহলোকে সব মানুষই সমান।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে আনুমানিক ৫ লাখ ২০হাজার অভিবাসী ইউরোপে আশ্রয় নেয়। আর সেই সময়েই ফ্রান্স, ইংল্যান্ড আর জার্মানিতে বর্নবাদী আক্রমণ আশংকাজনক হারে বাড়ে। অন্যদিকে আফগান যুদ্ধে পাকিস্তানে প্রায় ৪০ লাখ আফগান অভিবাসী আশ্রয় নেয়। আমাদের প্রচন্ড দারিদ্রতা সত্ত্বেও বর্নবাদী আক্রমনের কোন দুশ্চিন্তা নিতে হয়নি।
৮০র দশকের কিছু কিছু ধারাবাহিক ঘটনাই আমাকে বিধাতার প্রতি আগ্রহী করে তুলল। কোরআনে যাকে বলা হয় আলোর দিশা পাবার প্রাক সংকেত। সেইসব ঘটনার মধ্যে একটি হল ক্রিকেট। যেহেতু আমি বরাবরই ক্রিকেটের একজন নিবেদিত ছাত্র, তাই অভিজ্ঞতার সাথে যতই খেলাটি বুঝতে পারছিলাম ততই আমি গভীর ভাবে অনুধাবন করতে পারছিলাম... আমি যাকে সুযোগ ভাবতাম তা আদতে আল্লাহর ইচ্ছে। আমি এই প্রাক সংকেতের ধারাবিন্যাসে ধর্মের কাছাকাছি যেতে লাগলাম। তবে আমার এই বোধশক্তির তাত্ত্বিক বিকাশ সালমান রুশদীর সাটানিক ভার্সেস প্রকাশের আগে নয়। এই বইটি প্রকাশের পর থকেই প্রকৃত অর্থে ইসলামকে আমার বোঝা শুরু।
আমার মত মুসলিম যারা পশ্চিমা সমাজে বাস করত ...এই বই প্রকাশের পর তাদেরকে ইসলাম বিদ্বেষের বিষবাস্পের জ্বালা রন্ধ্রে রন্ধ্রে সহ্য করতে হল আর সেই সাথে এই বইয়ের প্রতি মুসলিম বিশ্বের চরম প্রতিক্রিয়া। আমার সামনে তাই দুটো চয়েজই অবশিষ্ট ছিল ফাইট অর ফ্লাইট। যেহেতু আমার মধ্যে জোরালো বিশ্বাস ছিল এই বইটি ইসলামের বিপক্ষে একটি কুসংস্কারমূলক অন্ধ বিদ্বেষ। আমি পালানোর বদলে এই বিদ্বেষের মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। ঠিক এই সময়টাতেই আমি প্রথম বুঝলাম ইসলাম নিয়ে আমার ধারণাটা বড্ড ভাসা ভাসা। তাত্ত্বিক আলোচনার জন্য একেবারেই অপ্রতুল। ইসলামকে জানার গবেষনা আরম্ভ হল... আমার জীবনের এই সময়টাই হল সবচেয়ে গরুত্তপুর্ন এবং উপভোগ্য জ্ঞান আরোহনের সময়। আমি পণ্ডিত আলী শারিয়াতি, মুহাম্মদ আসাদ , ইকবাল , গাই ইটন আর তার সাথে মূল কোরআন খুব বিশদভাবে পড়লাম।
আমি খুব সুনির্দিস্টভাবে ব্যাখ্যা করার চেস্টা করব আমার জীবনে 'সত্য উদ্ভাবনের' মানে কি?? কোরআনে যখন বিশ্বাসীদের সম্বোধন করা হয় তখন সবসময় সুনির্দিস্ট ভাবে বলা হয় " তোমরা যারা বিশ্বাস কর এবং ভাল কাজ কর"। অন্যভাবে বললে প্রত্যেকটি মুসলমানের দুটি ঈমানিক দায়িত্ব আছে... একটি তার প্রভুর প্রতি অন্যটি তার সংগী মানব জাতির প্রতি। বিধাতার প্রতি বিশ্বাসে আমার মধ্যে সবচেয়ে যে বড় পরিবর্তন এল তা হল আমার ভয় বা ডর উবে গেল, আমি খুব পরিস্কার ভাবে বুঝতে পারলাম কোন মানুষকে ভয় পাবার আসলে কিছু নেই । কোরআনে যখন বলা হয় জন্ম মৃত্যু সন্মান এবং অপমান আল্লাহর ইচ্ছায় নির্নায়ক হয় তা আসলে মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে। আমি সেদিন পরিস্কার ভাবে বুঝতে পা্রলাম... আল্লাহ ছাড়া কোন মানুষের কাছে মাথা নত করার কোন মানে নেই।
ইহলোকের ক্ষণস্থায়ী জাগতিক জীবন হল পরকালের অনন্ত জীবনের প্রস্তুতি। আমি যেদিন ইসলামের এই মৌলিক ধর্মীয় বিশ্বাসটা ঠিক ঠিক ভাবে আত্মস্থ করতে পারলাম। আমি সেদিনই অনেক আমিময় নিয়মের বিধিজাল থেকে মুক্ত হলাম। এই যেমন যৌবন হারিয়ে বুড়ো হয়ে যাবার দুশ্চিন্তা। পশ্চিমা সমাজে ... বয়স ঠেকাতে প্লাস্টিক সার্জারীর কি বাজারটাই না আজকাল !! যাই হোক জাগতিক জীবনের সম্পদ লাভের নিয়ন্ত্রনহীন বাসনা, ইগো , পাছ লোকে কি বলে ? এবং এই ধরনের আরো অনেক অনেক দুশ্চিন্তা আমার জীবন থেকে উবে গেল। না ! না! আমি বলছি না ... মানুষ তার জাগতিক জীবনের সব আকাংখা/বাসনা থেকে মুক্ত হতে পারে । যা সে পারে তা হল... নিজে নিয়ন্ত্রিত হবার বদলে বরং নিজেই তার আকাংখাগুলোর উপর ইচ্ছেমত ছড়ি ঘুরাতে।
ইসলাম ধর্মে পরিপুর্ন বিশ্বাসের ফলে আমার মধ্যে দ্বিতীয় যে পরিবর্তনটি এল... তা হল আমি টের পেলাম মানুষ হিসাবে আমার অনেক আত্মিক উন্নতি হচ্ছে। স্বার্থপরতার আমিময় কেন্দ্রিক আমার জীবনচিন্তার আমুল পরিবর্তন এল। আমি বুঝতে পারলাম বিধাতা আমাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশীই দিয়েছেন... সুতরাং ভাগ্যবঞ্ছিত দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করা আমার ঈমানিক দায়িত্ব। এই ভাগ্যবঞ্ছিতদের সাহায্য করতে আমাকে এ কে ফরটি সেভেন চালানো ধর্মান্ধ জিহাদী হবার দরকার নেই বরং ইসলামের মৌলিক স্তম্ভগুলি অনুসরন করেই আমি তা আরো ভালোভাবে করতে পারলাম।
মানুষ হিসাবে আমি আগের চেয়ে অনেক ধৈর্যশীল, দানশীল এবং অবহেলিত মানুষের প্রতি আরো সহানুভূতিশীল হলাম। নিজেকে আরো সফল করে তোলার প্রতিযোগিতায় খ্যামা দিয়ে ... আমি অহংকার ঝেড়ে ফেলে বিনয়ী হবার চেস্টা করলাম। কারন ব্যক্তি হিসাবে আমার সফলতা পেছনে বিধাতার ইচ্ছেটাই সবচেয়ে জরুরী। তাই নিজের লোকদেরকে হেয় করে লোটা বাদা্মী সাহেব হয়ে জাতে উঠার অনুভুতির চেয়ে সাম্যতার এক অনাবিল অনুভূতি জন্মাল। সমাজের দুর্বল মানুষদের উপর চলে আসা শ্রেণী বৈষম্যের অবিচার অনাচারগুলো আমি খুব ভালভাবে আত্মস্থ করতে পারলাম।
কোরআনে আছে অনাচার/ অত্যাচার করা হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ। আসলে ইসলামের মুল মাজেজাটা আমি এখন ঠিক ঠিক বুঝতে পারি... তুমি যদি আল্লাহতে নিঃর্শত বিশ্বাস / সমর্পন কর মানে তাকওয়া অর্জন কর তবেই তুমি আত্মিক প্রশান্তি লাভ করবে। তাকওয়া লাভের প্রচেস্টায় আমি আমার নিজের ভিতরের অনেক নতুন নতুন আত্মিক শক্তির সাথে পরিচিত হলাম ... যা আমি আগে কখনোই কল্পনা করিনি আমার মধ্যে থাকতে পারে।
আমি বুঝতে পারলাম... পাকিস্তানে ইসলাম বলতে যা আছে... তা হল পাপ পুণ্যের আচার রীতিনীতি ভিত্তিক সিলেক্টিভ ধর্ম পালন। আমি শুধু খোদা আছে বলে মানলাম আর সময়ে সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার রীতিনীতি পালন করলাম!! প্রকৃত ইসলাম ধর্মপালনের জন্য তা কখনই যথেস্ট নয়। তার সাথে আপনাকে অবশ্যই একজন ভাল মানুষ হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। সেই আপেক্ষিক অর্থে অনেক পশ্চিমা দেশই পাকিস্তানের চেয়ে বেশী ইসলামী আবহে চলে মানে তারা যেভাবে সমাজের অনগ্রসরদের অধিকার রক্ষা করে এবং তাদের বিচার ব্যাবস্থাও চমৎকার। আসলে বলতে কি ...আমার জীবনে দেখা চমৎকার ভাল মানুষগুলির অনেকেই কিন্তু পশ্চিমা সমাজের নাগরিক। তবে পশ্চিমা সমাজের যেটা আমি সবচেয়ে বেশী অপছন্দ ... তা হল তাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। তারা যেভাবে নিজেদের নাগরিকের অধিকারের কথা ভাবে; অন্যের বেলায় তার কানাকড়ি ও ভাবে না। ভাবার প্রয়োজনও মনে করে না। কারন তারা মানুষের সাম্যতায় বিশ্বাস করেনা। তাই তারা তৃতীয় বিশ্বে এসে তাদের রাসায়নিক ক্ষতিকর বর্জ্য ফেলে ...যা তাদের দেশে আইন বিরোধী তাই তারা অন্যদেশে অবলীলায় অনুমোদন দেয়।
পাকিস্তান একটি বড় সমস্যা হল সমাজে দুই বিপরীত মেরুর দলের আক্রমণাত্মক অবস্থান । একদিকে পশ্চিমা ঘরানার প্রগতিশীল যারা ইসলামকে পশ্চিমা সমাজের চোখ দিয়ে দেখে কারন তাদের ইসলাম সম্পর্কে নিজস্ব কোন পড়াশুনা নেই। এরা কোন কিছুতেই ইসলামের নিশানা পেলেই আপত্তি দেখায়। কারন তারা ইসলামকে তাদের সুবিধামত সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। অন্যদিকে চরমপন্থি মৌলবাদী যারা এই পশ্চিমা অভিজাত প্রগতিশীলদের প্রতিটি কার্যকলাপেই মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়। যারা ইসলামকে রক্ষা করার সমস্ত ঈমানিক দায়িত্ত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে... সময়ে সময়ে চরম অসহিষ্ণু এবং পাশবিক আচরন করে। অথচ এই আচরন ইসলামের আদর্শ বা চেতনার সাথে কোনভাবেই খাপ খায় না।
আমি মনে করি এই অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য দুই দলের মধ্যে একটা আন্তরিক সংলাপের প্রয়োজন। কিন্তু এটা হবার জন্য দুই দলের মধ্যে যারা উচ্চশিক্ষিত তাদেরকে অবশ্যই পরিপুর্ন ভাবে ইসলামকে জানতে / পড়তে হবে। না না আমি এটা বলছি না ... ইসলামি পাঠ নেয়ার পর তাদেরকে প্র্যাক্টিসিং মুসলিম কিংবা আস্তিক হয়ে যেতে হবে। এটা তার ব্যক্তিগত পছন্দ । ইসলাম ধর্মে কোন জোরজবরদস্তির জায়গা নেই। তবে তাদের ইসলামী পাঠ নেয়াটা এইজন্য জরুরী । কারন জ্ঞান হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকরী অস্র... যা তাদেরকে চরমপন্থীদের মোকাবেলা করতে সাহায্য করবে। নাক কুঁচকে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আসলে সমস্যার আদৌ কোন সমাধান হবে না।
কোরআন মুসলিমদেরকে 'দি মিডল ন্যাশন' বলে ; চরমপন্থী নয়। মহানবী (সাঃ) আমাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে বলেছেন, চাপিয়ে দিতে বলেননি। জোর করে ইসলামের দাওয়াত কবুল করাতে বলেন নি। ইসলামে... কোন মতামত কারো উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়ার কোন নির্দেশনা নেই। বরং অন্য ধর্মকে যথাযথ সন্মান দেখাতে বলা হয়েছে। মজার কথা হল কোন মুসলিম যাজক কিংবা শাসককে ধর্ম প্রচারে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়াত।।যেতে হয়নি। স্থানীয় লোকরা মুসলিম বনিকদের সততা আর নীতিতে মুগ্ধ হয়েই ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।
বর্তমানের এই সময়ে ইসলাম ধর্মের ক্ষতিকর প্রচারনা হচ্ছে সেই সব সিলেক্টিভ ইসলাম পালনের দেশগুলি... যারা ধর্মকে ব্যাবহার করে দুর্বলদের ঠকায়। আসলে যে সমাজ ইসলামের মুল বেসিকগুলি মেনে চলা হয়... সে সমাজ কখনই চরমপন্থি হবার কথা নয় বরং উদারপন্থি।
আমি মনে করি পাকিস্তানের পশ্চিমঘরানার প্রগতিশীল সমাজ যদি সঠিকভাবে ইসলামকে অধ্যায়ন করে তবে তারা শুধু সমাজে নাস্তিক্যবাদ এবং ধর্মীয় মৌলবাদকেই মোকাবেলা করতে পারবে না বরং তারা অনুধাবন করতে পারবে ধর্ম হিসাবে ইসলাম নিজেই কতটা প্রগতিশীল!! অনেক ইসলামিক ধ্যান ধারনা তারা পশ্চিমা সমাজেও সফল ভাবে প্রয়োগ করতে পারবে। সম্প্রতি যুবরাজ চার্লস বলেছেন... ইসলাম থেকে পশ্চিমা বিশ্বের অনেক কিছু শিখার আছে। কিন্তু যাদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পশ্চিমারা জানতে পারে বা শিখতে পারে তারাই যদি ইসলাম ধর্মকে পশ্চিমাদের অ্যাটিচুডে ব্যাকডেটেড হিসাবে ভাবে... তবে তা কিভাবে সম্ভব? অথচ ইসলাম হচ্ছে সার্বজনীন একটি বৈশ্বিক ধর্ম। তাই তো রসুলুল্লাহ (সাঃ)কে সমগ্র মানব জাতির জন্য একজন অনুগ্রহকারী হিসাবে ভাবা হয়।
বিষয়: রাজনীতি
১০২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন