ফুটো ডিম্যান্ড বালতি আর অযাচিত সাপ্লাই কল !!!
লিখেছেন লিখেছেন ইমরোজ ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১০:১৪:৫৭ রাত
২০০৯ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় অন্যান্য খাতের মতই মেরিন সেক্টর বেসামাল হয় । অন্যান্য সেক্টর উঠে দাঁড়ালেও, এই খাত এখনও খাদেই । তাই কচ্ছপ গতির অগ্রগতি এখানে । কার্গো ভাড়া আর জাহাজ চালানোর খরচের ভারসাম্য করতে না পেরে বিশ্বের অনেক পুরানো জাহাজ স্ক্র্যাপ হয়েছে । নতুন জাহাজ বানানো আশঙ্কাজনক হারে কমেছে । মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটে তেলের জাহাজগুলোর মন্দা চলছে ।
এবার আসি আমার দেশের কথায় । বং দেশের প্রাইভেট কোম্পানির জাহাজের সংখ্যা দিন দিন কমছে । SOLAS/MARPOL/ISM/ISPS/MLC ধারাগুলোর কড়া নিয়মের বেড়াজালে জাহাজ চালানো এখন কঠিন । দুরনিতি, অনিয়ম আর যোগ্য লোকের অভাবে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এখন মৃতপ্রায় । বর্তমানে বিএসসির জাহাজের সংখ্যা ২১টি যার বেশিরভাগই স্ক্র্যাপ তুল্য । সবচেয়ে নতুন জাহাজটি ২৫ বছর আগে কেনা । অনেকগুলি আবার মহাসমুদ্রে চলাচল বা বিদেশের বন্দরে যাওয়ার মত SEA WORTHY নয়। যে ৬টি নতুন জাহাজ চায়না থেকে কেনা হচ্ছে তা মেয়াদ উত্তীর্ণ মাল কিনা তা নিয়ে ফিসফাস চলছে ।
অথচ কি তুঘলকি ব্যাপার!!!! হঠাত করে আমরা গত পাঁচ বছরে সরকারী মেরিন একাডেমিতে দুই তিনগুন ক্যাডেট বাড়িয়ে ফেললাম । প্রাইভেট একাডেমী গুলোকে ব্যাঙের ছাতার মত গজাতে দিলাম ।
একাডেমীর ছেলেরাই চাকরি না পেয়ে বেসামাল । তাদের জন্য একাডেমী বা সরকারি কোন পৃষ্ঠ পোষকতা নেই । আর অনেকগুন বেশি টাকা খরচ করে প্রাইভেটের ছেলেগুলোর কোথায় জায়গা হবে বা আদৌ জায়গা হবে কিনা আমি তা নিশ্চিত নই । তারা কি আমাদের অতি চেনা আদম ব্যাপারীর বদি আলম !!!
অথচ জাহাজে যেতে না পারলে আপনার ক্যাডেট সী টাইম কমপ্লিট হবে না। পারবেন না আপনি আপনার স্বপ্নের প্রথম ধাপ জুনিয়র অফিসার হবার জন্য পরিক্ষা দিতে । এই প্রফেশন চলে ডিমান্ড আর সাপ্লাইয়ের ভিত্তিতে ।
আপনার ডিমান্ড এর বালতি ফুটো; অথচ শুধুমাত্র আপনার ব্যক্তি স্বার্থে আপনি সাপ্লাই কলের সংখ্যা বাড়িয়েই চলছেন । সত্যি কি সেলুকাস!!!!
যেখানে ভারত , চায়না আর ফিলিপিনের মত মেরিন বান্ধব পরিবেশে একজন ক্যাডেট কে জাহাজে উঠতে এখন নিদেন পক্ষে ১বছরের বেশী অপেক্ষা করতে হয় সেখানে বাংলাদেশী ক্যাডেটরা কিভাবে সহসা বিদেশী কোম্পানির জাহাজ পাবে তা আমার বোধগম্য নয় । বেশীর ভাগ কোম্পানির মুল সাপ্লাই ঐ দেশগুলো থেকেই । তাছাড়া একজন ক্যাডেটকে জাহাজে উঠলেই হবে না, তাকে নিদেনপক্ষে ১২ মাস কমপ্লিট করতে হবে । বিদেশী কোম্পানিতে আই এল ও র MLC ২০০৬ এর চক্করে এখন আর ৮ মাসের বেশী কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়না । সুতরাং আপনার পরীক্ষা দিতে নুন্নতম সি টাইম কভার করতে দুইটি জাহাজ লাগবে ।
এক প্রাইভেট একাডেমীর মালিককে নিয়ে একটা মজার গল্প আছে , তিনি তার একাডেমীর ক্যাডেটকে জাহাজে তুলে জাহাজের ক্যাপ্টেন কে মালিক দিয়ে চাপ দেন, যাতে সেই ক্যাডেট কে ৩/৪ মাস পর যে কোন একটা কারন দেখিয়ে নামিয়ে দেয়া হয়, আর তাতে তিনি তার একাডেমির আরেকটা ক্যাডেটকে তুলতে পারেন !!!
মনে রাখতে হবে বেশির ভাগ বিদেশী কোম্পানি যেহেতু ইউএসএ ট্রেড করে তাই আপনাকে ইউএসএ সিম্যানদের ভিসা (C1/D) পেতে হবে । আর ২০০১ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশীরা নানা কারনে ইমেজ সঙ্কটে ভুগছে । ফলের বিভিন্ন দেশে ভিসা সঙ্কটে বং রা পেরেশান । ভিসা হয় দেয়া হয়না অথবা অনেক সময় লাগে । ফলে কোম্পানিকে নানা ঝুট ঝামেলায় পড়তে হয় । আর এই কারনেই বাংলাদেশী নাবিক নিতে অনেক কোম্পানির অনাগ্রহ । অনেক জুনিয়র অফিসাররা ই এখন চাকরি সঙ্কটে ভুগছেন । আমাদের দেশে যেসব নাবিক রিক্রুটমেন্ট এজেন্ট আছে তারা বেশিরভাগই সাব এজেন্ট । সোজা কথায় কাউকে চাকরি দেয়ার মত সুপারিশ করার ক্ষমতাও তাদের নেই ।
এবার আসি শেষ খবরে ,পত্রিকায় অনেক ফলাও করে প্রচার হচ্ছে এই প্রথম বারের মত ১৩ জন মহিলা নাবিক যোগ দিচ্ছেন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজে ।
আমার মত মুখ পোড়া নিন্দুকের কেন জানি মনে হয়
" WE ARE NOT READY FOR THIS. WE ARE JUST MAKING IT MOCKERY !!!"
কারন সামাজিক ভাবে যেসব দেশে মেয়েরা আমাদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে সেখানে এটি নিদারুন বাতিল প্রজেক্ট । তাদের মেয়েরা এই বিশ্ব বিচ্ছিন্ন কঠিন পেশায় মাসের পর মাস সমুদ্রের বুকে থাকতে্ পারেন নি । পারেন নি প্রাথমিক জীবনের কায়িক পরিশ্রমের টাল সামলাতে । মাল্টি ন্যাশনাল সংস্কৃতিতে তারা লিঙ্গ বৈষম্যের স্বীকার হয়েছেন । তাছাড়া এই প্রফেশনে একজন নারীর তার পারিবারিক জীবনে যে ভারসাম্য আনবেন তার জন্য তাদের সমাজ ও প্রস্তুত নয় । ফলে দুই দশক আগের থেকে আসা বেশির ভাগই নারীই এই প্রফেশনে বেশীদিন থাকতে চান নি বা পারেন নি । আচ্ছা বলতে পারেন , কয়জন নারী এই প্রফেশনে কাপ্টেন / চীফ অফিসার / চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন???
হাতে গোনা !!!
মধ্যরাতে আপনার যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে কি আপনি আপনার পরিবারের নারী সদস্য কে পাঠাবেন ?? নাহ!! কারন পুরুষশাসিত সমাজে সেসময় তার পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই ।
এখন আমাদের মত অনগ্রসর সমাজে আমাদের মেয়েরা পুরুষ অধিষ্ঠিত রাফ ন টাফ লাইফে কিভাবে নিজেকে সামলাবেন তা দেখবার বিষয় ?? নিশ্চয়ই তাদেরকে পুতু পুতু হিসাবে জাহাজে আগলে রাখা হবে না । তাদের প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপ করতে হলে তাদেরকে আর দশটা নাবিকের মতই টাফ লাইফ পার হয়ে আসতে হবে । নতুবা তারাও আর কিছুদিন পর মানে মানে করে এখান থেকে কেটে পড়বেন !!!
মাছরাঙা টিভিতে দেখলাম তাদেরকে নিয়ে নারী অগ্রায়নের অনেক তাফালিং হচ্ছে । মিডিয়া কিংবা বাস ট্রাকের পরিবহন নেতা কাম নৌ মন্ত্রি তার অল্প বিদ্যা ভয়ংকরীতে বা রাজনৈতিক স্টাণ্টবাজিতে মহিলা নাবিক নিয়ে অনেক স্বপ্নদোষের কথা বলতেই পারেন কিন্তু তারসাথে আমার জাত ভাইরা যখন তাতে ঘি ঢালেন তখন খুব লজ্জা লাগে । আমার ঐসব জাত ভাইরা কি তার কন্যা , বোনদের এই প্রফেশনে পাঠাবেন ??? মনে হয়না !!! অবশ্য এইসব মহামান্যরা বেশীর ভাগ ই দেশী প্লেয়ার ( শুধুমাত্র দেশী জাহাজে পুতু পুতু চাকরি ) । অধুনা নাবিক জীবন সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা ক্যাপ্টেন ফিলিপ্স আর টাইটানিকের পরিচালকের মতই ধোঁয়াশা । গুঞ্জন শুনি , ২০০৯ পরবর্তী বাংলাদেশী সার্টিফিকেট আই এম ও র ব্ল্যাক লিস্টেডের খাতায় নাম লেখাতে চলেছে !! যদি সত্যিই তাই হয় তখন কি হবে আল্লাহই জানেন !!!!
একটি ছেলে যখন মেরিন একাডেমী থেকে বের হয়ে মাসের পর মাস চাকরি পায়না, তখন তার হতাশাটা কি পরিমান তা কি শিপিং সেক্টরের মহামান্যদের জানা আছে ?? নিজেকে অসহ্য অথর্ব মাদনা এতিম মনে হয় ।
আমি এইধরনের অনুভুতির সাথে একবছর সহবাস করেছি ?? তাই প্রাথরনা করছি এই ছেলেগুলো একসময় আমার মত এই কঠিন সময় উতরে যাবে !!! তাদের স্বপ্ন তাদের হাতের মুঠোয় আসবে ।
আর, মহামান্য আপনারা !! দয়া করে এই প্রফেশনকে পান দোকানদারের প্রফেশন বানাবেন না !!!!
বিষয়: বিবিধ
১১৩৪ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এমনও প্রফেশন দেশে আছে – যা একসময় চরম সম্মানের ছিলো, এখন তারা পান দোকানে বসে ৩ টা পান আর ২ কাপ চায়ের সার্ভিস দিয়ে যায়, অবশ্য এরা প্রফেশন ভুলে গিয়ে অন্যভাবে চামারি করলে এখনও সদ্য-সমাপ্তদের বাজার মূল্য লাখ টাকা!
দেশটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে আল্লাহ মালুম!
মন্তব্য করতে লগইন করুন