সালমার আত্তহুতি
লিখেছেন লিখেছেন ইমরোজ ২৮ জানুয়ারি, ২০১৪, ১০:১৮:০১ রাত
বুর্জোয়া এই বৈষম্যমূলক সমাজের বিবেকের মুখে পদাঘাত করে আত্মহত্যা করলেন রানা প্লাজায় আহত গার্মেন্ট শ্রমিক সালমা । কিন্তু তাতে কি? জাতি হিসেবে আমরা স্বার্থপর, নির্লজ আর বেহায়া। সুতরাং সালমার এই অভিমান, মানবিক বিপর্যয়ের এই সময়ে আমাদের মনে তেমন রেখাপাত করবে না । রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সালমা মাথায় আঘাত পেয়েছিল । এতে তার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতো। দীর্ঘ নয় মাস মাথার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছেন তিনি। একদিকে অর্থাভাব অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যয় মেটানো ছিল তার জন্য দুঃসাধ্য। রানা প্লাজা ধসে আহত হওয়ার পর সে সরকারি ও বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার কাছ থেকে মোট এক লাখ ২০ হাজার টাকা পেয়েছিল। কিন্তু এক লাখ ২০ হাজার টাকায় বাংলাদেশে আর যাই হোক দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা হয়না । আর টাকা না থাকলে এদেশে আপনার জীবন কুকুর, বিড়ালের মতই সস্তা এবং অর্থহীন । কোন দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা শুধু লাশ পর্যন্তই দুঃখটা অনুধাবন করতে পারি , কিন্তু এক একটা লাশের উপর যে জীবনগুলো নির্ভর করে ছিল বা যারা আহত হয়েছেন ; তারা আজ কে কোথায় আছে, তারা আজ তিন বেলা খেতে পারছে কিনা তা আমরা জানি না , জানার সময়ও আমাদের নেই । তাই এইসব সালমারা এক একটা জীবন্ত লাশ হয়ে সময়ের পরিক্রমায় ধুঁকে ধুঁকে মরেন।
ছুটা কাম করতে গিয়ে এই এক বছরে অনেক অনেক সালমাদের সাথে পরিচয় হয়েছে । কি কঠিন তাদের এই কর্মময় অভাবী জীবন। অথচ এইসব স্কিলফুল সালমারা এত সুশৃঙ্খল আর প্রফেশনাল তা আপনি এখানে না এলে কখনও বুঝবেন না । তারা একটা ছোট আগুন যাতে বড় না হয় সেজন্য ফায়ার এস্টিংগুইশার ব্যাবহার করা শিখতে পারবেন না , বড় আগুন হলে কিংবা অন্যান্য বিপদ হলে জরুরি নির্গমন পথ দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার পদ্ধতিগুলো শিখতে পারবেন না ; কোন দুর্ঘটনা হলে বের হয়ে বাসায় চলে না যেয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে ফ্লোর বা লাইন ভিত্তিতে গুণতে পারবেন না (যাতে মোটামুটি একটা ধারনা করা যায় কতজন লোক কোথায় আটকা পড়ে আছে) _তা আমাদের কখনও মনে হয়নি। বরং ২/৩ ঘণ্টার প্রশিক্ষণেই তারা অনেক কিছুই বুঝেন । অনেক চমকপ্রদ যৌক্তিক সাজেশান দেন কি করে তাদের কাজের পরিবেশ আরও নিরাপদ করা যায় ।
ফায়ার ম্যানেজমেন্ট আর সেফটি কালচার এর উপর কাজ করতে গিয়ে গত এক বছরে BV র পক্ষ হয়ে অনেক কারখানায় গিয়েছি। এই ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন হলেও, এখনও এক বিরাট শুভংকরের ফাঁকি রয়ে গেছে । কিছু কিছু অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী আর সবজান্তা শমসের মালিকপক্ষের অনীহা , ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ, "ট্রেনিং দিয়ে কোন লাভ নাই " এই মন মানসিকতার সাথেও আমাদের অহরহ ঠোক্কর খেতে হচ্ছে ।
আমরা জানি তাদের এই ভয়ের কারন । এইসব প্রশিক্ষণ নিয়মিত দিলে সালমারা হয়তো কারখানার অবাবস্থাপনা গুলো সহজেই টের পেয়ে যাবেন । কারখানার safety hazard গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন । দায়সারা মহড়ার পোস্ট মরটেম করবেন। অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা, জরুরী নির্গমনব্যবস্থা বলে শব্দগুলো আর কাগজে কলমে রাখা যাবে না। আবছা আবছা ও ভাসা ভাসা হিসাব দিয়ে ফ্যাক্টরির কমপ্লায়েন্স আর সেফটি ইস্যুগুলো চাপা দেয়া যাবে না ।
শুধু আগুন শত্রুতামূলক ভাবে লাগে আর বিল্ডিং মখার নড়াচড়া থিউরিতে ধ্বসে পড়ে, এই বলে বছরের পর বছর সালমাদের রক্তের বিনিময়ে ডলার, ইউরো মুনাফা করবেন , সেই দিন এর অবসান অচিরেই ঘটবে। আজ যেসব "ভবিষ্যৎ তাঞ্জিন আর রানা প্লাজারা" সময় নেই, প্রোডাকশনের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে , সালমাদেরকে ট্রেনিং দিয়ে কোন লাভ নাই ইত্যাদি বলে ফেনা তুলে তাদের জীবনের নিরাপত্তা আর কর্ম পরিবেশ মানবিক করার বিভিন্ন মৌলিক প্রশিক্ষণ/ মহড়া নিয়মিত দেন না, তাদের হাতে একদিন অনেক সময় থাকবে কিন্তু অর্ডার থাকবে না । আমি সেই দিনের উদ্ভাসিত আলোতে রানা প্লাজার এই অভিমানী সালমার আত্তহুতি উৎসর্গ করলাম ।
বিষয়: বিবিধ
১১২২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সালমার আত্তহুতির জন্য সরকার দায়ী।
মন্তব্য করতে লগইন করুন