একজন ক্ষণপ্রভ তারকা

লিখেছেন লিখেছেন হংসপুরুষ ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১০:১৫:৫৯ রাত



আজ আপনাদের অসম্ভব উজ্জ্বল এক প্রতিভার কথা বলব, যাঁর তুলনা কেবল তিনি নিজেই । নাম তাঁর থমাস শ্যাটার্টন (১৭৫২- ১৭৭০ )। মাত্র সতের বছর বেঁচেছিলেন এই ক্ষুদে কবি । অথচ এই ছোট্ট ছেলে এতই আলোড়ন জাগাতে পেরেছিলেন, অল্প অথচ এতই মেধাবী সাহিত্য কর্ম রেখে গিয়েছিলেন যে পরবর্তীতে শেলী, কোলেরিজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, জন কীট্স প্রমুখ নাম করা সাহিত্যিকসহ বিশ্বের আরো অসংখ্য সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্য কর্ম, তাঁর অকাল প্রয়ান, তাঁর জীবন যাপনের দুর্দশা ইত্যাদি নিয়ে গান, নাটক, কবিতা লিখেছেন ।

অতএব বুঝতেই পারছেন ব্যাপার যেন তেন নয় । তাঁর প্রতিভার পরিচয় আরো দেব । আগে একটু চেনার মাঝে অচেনাকে খুঁজে আসি চলুন ।

ভানুসিংহ ঠাকুরকে চেনেন আপনারা ? নাম চিনি চিনি কিন্তু স্পষ্ট মনে করতে পারছি না— এই তো ?

মনে করিয়ে দিই, এই ভানুসিংহই হলেন রবীন্দ্রনাথ ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশ বিরাট, সেখানে সবাই ছিল শিক্ষিত আর রুচিবান । ওরকম পরিবারের ছেলে কিশোর বয়সে প্রেম বুঝলেও, তাঁর কবি হৃদয় প্রেমের কবিতা লিখতে চাইলেও বড়দা'দের কান মলুনি আর রক্তচক্ষু তিরস্কারের ভয়ে সাহস করে উঠতে পারেননি । ওরকম রুচিবান পরিবারে জন্ম নেওয়া ছেলের এত অল্প বয়সে কি চুম্বন নিয়ে কবিতা লেখা সাজে ? যৌনতা নিয়ে কবিতা লেখা সাজে ?

রবীন্দ্রনাথ তখন সাহায্য নিয়েছিলেন এই কবি শ্যাটার্টনের । তিনি প্রাচীন ব্রজবুলি ও প্রচ্ছন্ন সহজিয়া ভাষা দিয়ে লিখতে শুরু করলেন "ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি" ।

তিনি বৈষ্ণবী ঢঙে লিখলেন,

"মরণ রে,

তুঁহুঁ মম শ্যামসমান ।"

দাদারা ডেকে পাঠালেন, কী ব্যাপার ? এই বয়সে তোমার মরণ ভাবনা জাগল কোত্থেকে ? কী শুরু করেছ এসব ?

পূর্বপ্রস্তুত রবীন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ উত্তর করলেন, এ তো আমি লিখিনি । এটি ভানুসিংহ ঠাকুর নামে এক প্রাচীন বৈষ্ণব কবির লেখা !

অবশ্য অনেক পরে সবাই চালাকিটা ধরতে পেরেছিলেন । শ্যাম (বিষ্ণু/কৃষ্ণ) বৈষ্ণবদের পরম আরাধ্য । তাঁকে বৈষ্ণবরা কখনই মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করবে না ।

এই যে চালাকি, এটি রবীন্দ্রনাথ শিখেছিলেন ক্ষুদে কবি থমাস শ্যাটার্টন হতে । এতিম শ্যাটার্টন রেডক্লিফ গীর্জার পাশে একটি কুটিরে বড় হয়েছিলেন । সেই গীর্জার প্রাচীনত্বের সাথে পরিচিত হয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন প্রাচীন এক কল্পনার জগৎ । প্রাচীন শব্দ (ইংরেজি সাহিত্যে যাকে আমরা আর্কেয়িক ল্যাঙ্গুয়েইজ বলি), প্রাচীন লেখন শৈলী দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন ভিন্ন এক সাহিত্য- ধারা ।

তিনি লিখেছিলেন "Excelente Balade of Charitie." আর সবাইকে বলে বেড়িয়েছিলেন যে, এটি থমাস রাউলি নামে এক প্রাচীন পাদ্রী কবির লেখা— যার পাণ্ডুলিপি তিনি গীর্জা হতে আবিষ্কার করেছেন । তাঁর সে রচনা এতটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল যে, কেউ কেউ তখন ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে থমাস রাউলিকে অন্তর্ভূক্ত করতে শুরু করলেন । বুঝুন সে কত বড় প্রতিভা !

ক্ষণজন্মা এই কবি । জন্ম হতে এতিম । মা সারাহ এবং বোন মেরী অসহায় দুইটি মুখ । সংসার চালাতে তাঁর মা সেলাই কর্ম করেন । তাতে সংসার চলে না । শ্যাটার্টন পরিবারের জন্য কিছু করতে চাইলেন । তাঁর একমাত্র যোগ্যতা তাঁর কলম । মাত্র বার বছর বয়সে যে কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন তা বেচে দিয়েছিলেন টাকার বিনিময়ে, অভাবের তাড়নায় ।

ষোল বছর বয়সে তিনি ব্রিস্টলের শহরে যান উদ্দেশ্য অর্থোপার্জন । লেখক হিসেবে তিনি উদীয়মান । কেউ চেনে না, তার ওপরে বয়স কম । কবিতা কেউ পড়েই দেখতে চায় না । তাই তিনি বের করলেন রাউলি নামের এই প্রাচীন কবির বানানো কবিতা । তখন উইলিয়াম বেরেট তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করেন । কিন্তু সাহিত্যে এটি জালিয়াতি বলে পরিচিত হওয়ায় বেরেট ক্ষিপ্ত হয়ে পরবর্তীতে তাঁকে বিতাড়িত করেন । অবশ্য ততক্ষণে শ্যাটার্টন সাহিত্যাঙ্গনে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন । তাঁর অভাবগ্রস্ততার সুযোগ নিয়ে সম্পাদকেরা তাঁকে ঠকাতে থাকে । একেকটি কবিতার জন্য ধার্য হয় সামান্য সিক্সটি পেন্স থেকে ওয়ান শিলিং । তাও ঠিক মত পরিশোধ করা হত না । অধিকাংশই থাকত বকেয়া ।

এমনও ঘটনা আছে, তিনি দুই তিনদিন ধরে অনাহারে থেকেছেন । যা টের পেয়ে তাঁর প্রতিবেশিনী তাঁকে ডিনারের দাওয়াত দেন । কিন্তু আত্মসম্মানের দরুণ শ্যাটার্টন তা প্রত্যাখ্যান করেন । এই কবি এভাবেই অভাবের কাছে পরাজিত হয়ে শেষে আত্মহত্যা করেন । মৃত্যুর সময়ে তাঁর পকেটে একটি কবিতার দুর্বোধ্য ছেঁড়া পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় ।

শ্যাটার্টন কবিতা, গান ও রাজনৈতিক সমালোচনায় তাঁর মেধা প্রয়োগ করেছিলেন । গ্রন্থের সংখ্যা মোট তেরোটি ।

ইংরেজি সাহিত্যে এরকম কনিষ্ঠ অথচ অসামান্য প্রতিভাবান আর কোন কবি জন্মায়নি ।

এরকম অনেক প্রতিভাই মৃত্যুর পরে কদর পেয়েছেন, অথচ জীবদ্দশায় ধুকে ধুকে মরেছেন । আমাদের অবহেলায় আর দারিদ্যের কাছে হেরে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন । এঁদের মৃত্যুর জন্য আমরা অহঙ্কারী উপেক্ষাপ্রবণ সমাজই দায়ী ।

আমরা ব্যর্থ হয়েছি এবং ব্যর্থ হচ্ছি তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতে ।

¤

বিষয়: সাহিত্য

৯৯৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File