প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
লিখেছেন লিখেছেন তুনীরের শেষ তীর ০১ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৭:১৯:৫৮ সন্ধ্যা
সাইফ সাইফ
কই গেলি??
কোথায় যে যায় ছেলেটা, এতো করে বলি ভালো করে পড়ালেখা কর্। না, তা না সারাদিন টো টো করে পাড়া বেড়ানো আর ক্রিকেট খেলা। এতো কষ্ট করে চাকরি করি ছেলেমেয়েগুলোকে মানুষ করবো এই আশায় কিন্তু আমার দুঃখ বোঝার কেউ নাই। এরচেয়ে বরং ওয়ার্কশপে দিয়ে দিলেই ভালো করতাম। এতো কষ্ট পেতে হতনা....
ঠুংঠাং ....শব্দ করে কিছু ফেলার আওয়াজ।
দু'কানে আঙ্গুল চেপে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে দেখছিল এসব সাইফ। এসব প্রতিদিনকার ব্যাপার। মায়ের এতো বকুনি স্বত্তেও ডানপিঠে স্বভাব ছাড়তে পারেনা। জীবনের একটা অংশতো সে ব্যাট-বলেই কাটিয়েছে। ভালো প্লেয়ার হিসেবে এলাকায় তার খুব সুনাম।
মা রুমে ঢুকে পড়লে আস্তে করে সে ঘরে ঢোকে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসে।
প্রায় আধঘন্টা পর মা রুম থেকে বের হয়। আড়চোখে তাকায় সাইফ। না, থমথমে না বরং বিমর্ষ হয়ে আছে মায়ের সুন্দর চেহারাটি। জানতে ইচ্ছে করলো কিন্তু ভয়ে করলোনা।
সাইফের বাবা নাঈম ঊদ্দীন পেশায় একজন দোকানদার। হয়তো আরো ভালো পজিশনে যেতে পারতেন। কিন্ত ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রের সাথে তার পরিচয়। তাই ছোটবেলা থেকেই অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজতে হয়। সাইফের মা স্থানীয় স্কুলে চাকরি করেন। দুজনের অল্প বেতনে মধ্যম এই পরিবারের ভরনপোষণ চালাতে হয়। এতো অর্থকষ্টের মাঝেও সাইফের মা বাবা স্বপ্ন দেখেন তাদের সন্তানেরা অনেক বড় হবে।
রাত প্রায় ১০:৫০ পর্যন্ত পড়ালেখা করলো সাইফ আজ। সে এতটা সময় কখনো পড়েনা। ভাত খাওয়ার সময় ও খেয়াল করেছে মায়ের চোখ ফোলা। মা কেঁদেছে!!!
মায়ের রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো, মা বোন দুটিকে ঘুম পাড়াচ্ছে আর উদাস দৃষ্টিতে একদিকে চেয়ে আছে।
-আম্মু, আসব??
-আয়।
-আম্মু স্যরি।
-আম্মু প্লীজ.........
-আজ ওরা খেলনা কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু মাসের প্রায় শেষের দিকে । বাকী খাতায়ও জমেছে অনেক। খুব বকা দিয়েছি ওদেরকে...
কিছু বলতে পারলোনা সাইফ। নীরবে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
ভাবছিল, ওর আঙ্কেলদের কত টাকা। কত খেলনা ওদের বাচ্চাদের। ওরা কত পার্কে যায়। কত মজার মজার খাবার খায়। নামীদামি স্কুলে পড়ে বলে সাইফদের সাথে কত অহংকার দেখায়। সাইফরা লোয়ার স্ট্যাটাসের মানুষ তাই ওদর সাথে মিশতেই চায়না ওরা। ছেলেমেয়েদের মন ছোট হবে ভেবে সাইফের মাও তাদের বাসায় খুব একটা যাননা।
সাইফের মনে পড়ে, দুবছর আগে যখন সে নবম শ্রেণীতে পড়তো...
সাইফ সাইফ
যাবি খেলতে??
সাইফ দরজা খুলে দেখে সুন্দর নতুন একটা সাইকেলে বসে আছে তার বন্ধু তামিম।
-নতুন সাইকেল?
-হ্যা। আব্বু জন্মদিনে গিফ্ট করেছে।
-খুব সুন্দর।
-তুই সাইকেলের পেছনে বস্। খেলার মাঠে যাব।
ঐদিন তামিমের সাথে সাইকেলে চড়ে অনেক ঘুরে। ঘরে ফিরে পড়তে বসে। মন বসেনা পড়ায়। তাকে সাইকেলের ভুত চাপে। কল্পনায় সে সাইকলে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। সে ভাবে, তামিমের বাবা কত ভালো। সে যখন যা চায় তাই দেয়।
তামিমের বাবা একজন উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে। তামিম বাবামায়ের একমাত্র ছেলে। তামিমের বাবাও চাননা তামিম সাইফের সাথে মিশুক। তুখোড় মেধাবী ও অসাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকায় সাইফ ছাত্র শিক্ষক সবারই খুব প্রিয়। তামিম সাইফকে খুব পছন্দ করে তাই আর তার বাবা খুব একটা বাধা দেয়নি।
রাতে সাহস করে মায়ের কাছে যায় সাইকেলের আবদার করবে ভেবে।
-আম্মু..
-কিছু বলবি?
-আম্মু ২২ তারিখ আমার জন্মদি...
-জানি। কিন্তু কেন?
-আম্মু জান? তামিমের আব্বু তামিমকে খুব সুন্দর একটা সাইকেল উপহার দিয়েছে তার জন্মদিনে।
-ও বুঝেছি। যাও পড়তে বস।
ফাঁটা বেলুনের মত চুপসে গেল সাইফে চেহারা। বেরিয়ে এলো মায়ের রুম থেকে।নিজের রুমে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল আর কাঁদতে লাগলো।
যতটা কড়া মেজাজ দেখাননা কেন অন্তরটা ভেঙে যাচ্ছিলো মায়ের। চরম অর্থাকষ্টে থেকেও কখনো ছেলেমেয়েকে তা বুঝতে দিতে চাননি। দুচোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুর দুটি ধারা।
সাইফ,ভাত খেয়ে যা।
সে শুনেও জবাব দেয়না।
সাইফ.............অনেক আদর করে ডাকেন মা।
এই ডাকটি সাইফের খুব প্রিয়। দরজা খুললে মা তাকে নিয়ে বিছানায় বসেন, ছেলের মাথাটা কোলে নিয়ে পরম আদরে হাত বুলিয়ে দেন।
বলেন, বাবা, তোকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন। আমরা চাই তোরা সংগ্রাম করে বড় হ।আমি আর তোর বাবা স্বপ্ন দেখি তুই একদিন অনেক বড় ডাক্তার হবি। তোর বাবাকে যারা অপমান করে তাদের দেখিয়ে দিবি তোরা অবহেলার পাত্র নয়। বল্ পারবিনা তোর বাবার গর্বের ধন হতে?
পারবিনা তোর মায়ের স্বপ্নপূরণ করতে?
আম্মু, তুমি শুধু দোয়া করো। ইনশা'আল্লাহ আমি পারবো তোমাদের স্বপ্নপূরণ করতে।
এরপর থেকে আর কখনো সে কোন আবদার করেনি।
এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন সে মাকে বলল, আম্মু আমি টিউশনি করবো।
-না, ভালোমত পড়ালেখা কর। সামনে পরীক্ষা।
-আম্মু প্লীজ। আমি সামলাতে পারবো।
শুরু হলো তার নতুন জীবন। প্রথম যেদিন সে টিউশনির টাকা পায় ছোট দুবোনের জন্য দুটো খেলনা আনে। ওরা সে কি খুশি।
হাতখরচটা রেখে বাকি টাকা মাকেই দিয়ে দিত সে।
এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি দুটোতেই এপ্লাস পায় সে। তার মাবাবার আশার আলো আরো বেশি দিপ্তী ছড়াতে থাকে।
একদিন সে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যদিয়ে স্বপ্নসিড়ির নাগাল পেয়ে যায়...........
********************************
চায়ে চুমুক দিয়ে দূর দিগন্তপানে তাকিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন ডাঃ সাইফ। আজ তার পেশেন্ট ছিল তারই সেই আঙ্কেলের ছেলেটি যে তাকে খেলনা দিতে চাইতোনা।
ভাবছিলেন, কি অদ্ভুত এই পৃথিবী!!শুধুই ছুটে চলা কিছু মিছে মায়ার পেছনে............কখনো খরগোশ জেতে কখনো কচ্ছপ..
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন