কষ্টের সাথেই স্বস্তি (২)

লিখেছেন লিখেছেন রেইন স্পট ২৩ নভেম্বর, ২০১৩, ০৭:১০:০৭ সন্ধ্যা

অবশেষে প্রফ শেষ হল। ফাইয়াজের বাবা ঢাকার বাইরে ক্লিনিকে গেল জব করতে। আর আমি চলে আসলাম বাবা মায়ের কাছে। ততদিনে আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত। প্রফের ধকল মনে হচ্ছিল তখনও যায়নি। তবুও প্রশান্তি এটুকু ছিল যে ফাইনাল প্রফ অবশেষে শেষ হল। বাবার বাসায় আসার পর সর্বপ্রথম আমার খুব অপরাধবোধ হচ্ছিল এটা ভেবে যে ফাইয়াজ পেটে আসার পর অতিরিক্ত টেনশানে প্রথম ভেবেছিলাম এমআর করব কিনা ( আল্লাহ মাফ করুক) । বাবার ওখানে পাশের এক আপু এসেছিল, যে গত কয়েক বছর ধরে কনসিভ করছে কিন্তু এবরশন হয়ে যাচ্ছে। এজন্য সেই দম্পতি খুব মনোকষ্টে ছিল। আমার কাছে এসেছিল ভাল একজন গাইনি ডাক্তারের খোজ নিতে। তাদের ঘটনা শুনে আমার অপরাধবোধ আরো বেড়ে গিয়েছিল। ভাবছিলাম আল্লাহ আমাকে এত বড় একটা উপহার না চাইতেই দিয়ে দিল, আর আমি কিনা সেজন্য শুকরিয়া পর্যন্ত আদায় করলাম না!

প্রফের রেসাল্ট দেয়ার পূর্বে আমার টেনশান এত বেশি হচ্ছিল যে ঠিকমত কারো সাথে কথাও বলতে ইচ্ছা করতনা। মেজাজ সবসময় খিটখিটে হয়ে থাকত। তার উপর একা একা সংসার সামলানো আমার জন্য পুরাই অসম্ভভ হয়ে পড়ছিল। রান্না ঘরে গেলেই বমি হত। কিছু খেতে গেলেও বমি। এমতাঅবস্থায় যদি রেসাল্ট খারাপ হয় তাহলে এই শরীরে আবার কিভাবে সাপ্লি দিব !! সাতপাচ অনেক কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম বাবা-মায়ের সাথে একসাথে বাসা নিয়ে থাকব। আমার শাশুড়ি,ননদ কেউই ঢাকায় থাকেনা। তাই প্রফের রেসাল্টের কিছুদিন আগেই বাসা শিফট করে আমার হাসপাতালের কাছে বাবা-মায়ের সাথে নতুন বাসায় উঠলাম। এরপর এক বিকেলে প্রফের রেসাল্ট বের হল এবং আমার রিডিং পার্টনার প্রথমেই ফোন করে আমাকে কংগ্রাচুলেশান জানাল যে আমি ডাক্তার হয়ে গিয়েছি। সেই মুহূর্তটা যে কি পরিমান আনন্দের ছিল ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। সত্যি কথা বলতে কি আমার তখন মনে হচ্ছিল ফাইয়াজের সুবাদেই আল্লাহ আমাকে সাপ্লি দেবার মত অনেক বড় বোঝা থেকে মুক্তি দিয়েছে। তারউপর বাবা-মায়ের সাথে বিয়ের পরেও একসাথে থাকার যে উসিলা সেটাও ফাইয়াজের কথা ভেবেই। আসলে আল্লাহ মানুষের জন্য যা প্ল্যান করেন সেটাই উত্তম যদি একাগ্রচিত্তে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা যায়।

আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে ফাইয়াজকে পেটে নিয়ে যখন মেডিসিন ভাইভা দিতে যাই তখন কেবলই মনে হচ্ছিল প্রফের মত পার্থিব আজাব মনে হয় আর কোন কিছু হয়না। আমার লং কেইস ছিল একজন এসাইটিস(পেটে পানি জমা) এর পেশেন্ট। তার উপর হিস্ট্রি,পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে আমার বমি চলে এসেছিল। কোনরকম এন্টিএমেটিক খেয়ে পরীক্ষাটা শেষ করেছিলাম। সার্জারী পরীক্ষায় পুরা হল জুড়ে ছিল এক ভয়ার্ত নিরবতা। কারণ সার্জারী ডিপার্টমেন্টাল হেডের চিল্লাচিল্লিতে সবার ত্রাহি অবস্থা। লং কেইস, শর্ট কেইস শেষে যখন স্যারের কাছে ভাইভা দিতে যাব তখন কেবলই মনে হচ্ছিল পাশ-ফেইল যাইহোক এই ভয়ার্ত নিরবতা থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই। ভাইভাতে স্যারের বকাবকি ছাড়াই আমি উতরিয়ে গেলাম,আলহামদুলিল্লাহ। আর গাইনি বরাবরি আল্লাহর রহমতে ভাল পরীক্ষা হল। সবমিলিয়ে আমার তখন কেবল একটাই অনুভূতি, বিরাট সমুদ্র ছোট তরী নিয়ে সুন্দর ভাবে পাড়ি দেবার রহমত ফাইয়াজের জন্যই। তাই যারা কেবল ক্যারিয়ারের জন্য বিয়া,সংসার,বাচ্চা-কাচ্চা নিতে ভয় পায়, আমার ধারণা তারা ক্যারিয়ারের সবচেয়ে রহমতের অংশটুকু মিস করে যায়।

এরপর শুরু হল ইন্টার্নি। পেশাগত ডাক্তার হবার প্রথম ট্রেইনিং। অনেকেই তখন আমাকে ইন্টার্নি করতে নিষেধ করল। বাসায় রেস্টে থাকতে বলল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি হাসপাতালে যাওয়া, রোগী দেখা, ডাক্তার হিসেবে নিজের হাসপাতালে বিচরণ করার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। আর ততদিনে আমার সেকেন্ড ট্রাইমেস্টার চলছিল। পুরাপুরি সুস্থ ছিলাম, শারীরিক-মানসিক সব সমস্যা থেকে মুক্ত। আল্লাহর উপর ভরসা করেই ইন্টার্নি শুরু করলাম। চেয়েছিলাম গাইনি দিয়ে শুরু করতে। কিন্তু একাডেমিক্যালি আমার রোস্টার পড়ল সার্জারীতে। প্রথমে এজন্য কিছুটা মন খারাপ ছিল। মন খারাপটা আরো তীব্র হয়েছিল যখন আমাকে ডিপার্টমেন্টার হেডের ইউনিটে ইন্টার্নি করতে হবে এটা ভেবে। কিন্তু ইউনিট চেইঞ্জ করার কোন সুযোগ ছিলনা। পুরা চারমাসে সার্জারীতে ডিউটি করতে গিয়ে প্রতি পদক্ষেপে আমি বুঝেছিলাম সার্জারী ইউনিট-১ ছিল আমার জন্য আরেকটি বিশাল বড় রহমত। সবকিছুতে অতিরিক্ত কিছু সুবিধা ভোগ করছিলাম। আমার ফ্রেন্ড কাম কলিগরাও আমাকে অনেক ফেবার করত যেকোন কাজে। নাইট ডিউট মেয়েদের ছিলনা। ইভিনিং ডিউটিতে কখনও খুব খারাপ লাগলে আমার ফ্রেন্ড কে ডিউটি হ্যান্ডওভার করে চলে আসতে পারতাম। সবমিলিয়ে সার্জারীতে কাজ শেখা, ডিউটি করা, সবার কাছে সহযোগীতা পাওয়া আমার ইন্টার্নি কে খুব অর্থবহ করে তুলেছিল। তারউপর স্যার-ম্যাম দেরও আমার প্রতি আলাদা কেয়ারিং এটিচিউড আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল সব আল্লাহর বিশেষ রহমত যা কেবল আমি ফাইয়াজের সুবাদে উপভোগ করছিলাম। আর আল্লাহর উপর ভরসা করে ইন্টার্নি শুরু করার সিদ্ধান্ত যে মোটেই ভুল ছিলনা এটাই আরো বেশি করে বুঝলাম।

দীর্ঘ নয় মাস পর যখন ফাইয়াজ জন্ম নিল তার পরের দিন ফাইয়াজের বাবার বিসিএসের গেজেট প্রকাশিত হল। একসাথে দুই আনন্দে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করার ভাষা খুজে পাচ্ছিলামনা। বছর শেষে আমার ক্যারিয়ারে তখন দুইটা ডিগ্রি যুক্ত হল। এক. এমবিবিএস ডিগ্রি, দুই. মাতৃত্বের অনুভূতি। আসলে ক্যারিয়ার নিয়ে যেসব মেয়েরা অতিমাত্রায় সচেতন, এবং যেকারণে তারা সময়মত বিয়ে,সংসার,বাচ্চা নিতে ভয় পায় তাদের জন্য আমার একটাই পরামর্শ, আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না। আর আল্লাহর উপর ভরসা করলেই কেবল এই বিশেষ পরামর্শের উপযোগীতা উপলব্ধি করা যায়। কোন কিছুই একাডেমিক ক্যারিয়ারের জন্য থেমে থাকবেনা। বরং জীবনের সব পর্যায়কে ক্যারিয়ারের একটা পার্ট হিসেবে দেখলে দেখা যায় একসাথে সবকিছুই সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়ে যায়। এই আমি যদি কেবল ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করতাম তাহলে কি বছর শেষে এত মূল্যবান দুইটা ডিগ্রি অর্জন করতে পারতাম ?? গভীরভাবে কি উপলব্ধি করতে পারতাম যে নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে?? নিশ্চয় সব প্রশংসা এবং ক্রেডিটের একমাত্র অধিকারী পরম করুণাময় আল্লাহ যিনি মানুষের প্রতিটা প্রার্থনায় সাড়া দেন।

বিষয়: বিবিধ

১৭১৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

299884
০৯ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৩:০১
জোনাকি লিখেছেন : খুব ভাল্লাগ্লো।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File