যুগোপযোগী ও আধুনিক তাফসির (তাফসির আল-শারাওয়ী - মূল ইমাম মুতওয়াল্লী আল-শারাওয়ী রাহিমাহুল্লাহ)
লিখেছেন লিখেছেন আহমাদ আল সাবা ১৪ অক্টোবর, ২০১৮, ০৫:২৪:২৭ বিকাল
বাংলাভাষায় যুগোপযুগী তাফসির বলতে যা বোঝায় তার অনুবাদ নেই বললেই চলে। এর বহুবিদ কারণ রয়েছে। প্রথম নাযিলকৃত ৫ আয়াতে ৩ ধরণের জ্ঞানের কথা আছে। এর মাঝে আসমান থেকে নাযিলকৃত ওহী আর কলমের মাধ্যমে শেখানো দুনিয়ার জ্ঞান। কিন্তু আমাদের আলেমরা দুনিয়ার জ্ঞানে পারদর্শিতা না হওয়ার কারণে দুনিয়ার যাবতীয় ফিতনা থেকেও মুক্তি পাচ্ছে না। এর মাঝে বিপুল পরিমাণ ছেলে-মেয়ে আধুনিকতার নামে সেক্যুলার ও নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ হলো ইসলাম সেকেলে। না, ইসলাম সেকেলে নয় বরং আমাদের আলেমদের জ্ঞানের জায়গাটা সেকেলে রয়ে গেছে অনেকটাই। শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) যখন ‘হুজ্জাতিল্লাহিল বালিগা’ লেখেন তখন অনেক সংখক হিন্দু বইটা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করে!! কারণ দুনিয়া ও আখিরাতের জ্ঞানের সমন্বয়তা, যুগোপযোগিতা। বাংলাভাষায় তাই এই যুগের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় এই তাফসিরের অনুবাদ কার্যক্রম শুরু হলো। বইটি এ মাসেই ইন শাআ আল্লাহ প্রকাশিত হবে Bookish Publisher থেকে।
যুগোপযোগিতার দিক থেকে আধুনিক বলতে বর্তমান যুবক-যুবতীদেরকে আধ্যাত্বিক ও যৌক্তিক সমন্বয়ের মাধ্যমে ইসলামকে তুলে ধরা। এখানে দার্শনিকতা সমস্যা, সেক্যুলার সমস্যা, বিজ্ঞানের প্রভূ হয়ে ওঠার সমস্যা এবং সামগ্রিক জীবনদর্শনের ভোগবাদিতায় গা ভাসানোর মতো বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোকে তুলে আনা হয়েছে, দেওয়া হয়েছে সামগ্রিক মূখ্য ঔষধ।
এই যুগোপযোগিতার বইটির ৩য় নাম্বার বৈশিষ্ট নিয়ে বই থেকে কিছু কথা।
যুগোপযোগী তাফসির ও জীবনঘনিষ্ঠতা
আমি কিন্তু আধুনিক তাফসির শব্দটি ব্যবহার করি নি। আধুনিক কথাটায় একটা ফাঁক আছে। যদিও আমরা আধুনিক শব্দটিকে যুগোপযোগী অর্থেই অনেক সময় ব্যবহার করি।
যুগ পরিবর্তিত হয়েছে (হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহই যুগকে পরিবর্তন করেন), সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়সহ ভোগবাদিতার গঠনে পরিবর্তন এসেছে, শারীরিক সাইকোলজির অনেক বিষয়ে, পরিবর্তন এসেছে বিজ্ঞানীয় উন্নতিতে এবং অনেক জ্ঞানের নতুন উন্মেষের ফলে। এর ফলে এক হাজার বছর আগের সামাজিক-অর্থনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক-ভোগবাদিতা ইত্যাদি পরিবর্তনীয় গাঠনিক প্রেক্ষাপটের বর্ণনা যদি এখনও দেই তবে আমরা ইসলামী মূলনীতিগুলোর আলোকে যুগোপযোগী নই, আমরা ইসলামকে সকল দেশ ও যুগের প্রেক্ষাপটে মুয়ামালাত (দুনিয়াবী সকল লেনদেন-আচার-আচরণ) সংক্রান্ত বিষয়ে যথেষ্ঠ অজ্ঞ রয়ে গেছি।
ফলে আমরা যে ইসলামের কথা বলি পুরাতন সামাজিক ভাষ্যে সেই ইসলামের কথাগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্জীব হয়ে আছে, সমাজ ও এর মানুষকে বর্তমানের সমস্যার সমাধান ও ভবিষ্যতের আশাকে জীবিত ও পুনর্জীবিত করার কোনো পথ দেয় না। এজন্য আপনার ইসলাম দুনিয়াবী অর্থে বিজয়ী হওয়ার পথে ব্যর্থ হবেই, কারণ আপনি দুনিয়ার হাওয়া বুঝেন নি, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে আপনার মুয়ামালাতের ইসলাম এই দুনিয়ার সাথে জড়িত বিষয়াবলির ক্ষেত্রে যুগোপযোগী নয়।
মুয়ামালাতের (দুনিয়াবী লেনদেন) নব পরিবর্তনের সাথে সাথে আপনি যদি উসূলের (মূলনীতির) আলোকে আগাতে না পারেন তবে আপনি আল্লাহ প্রদত্ব দায়িত্ব পাবার আশা কখনই করতে পারেন না। দুনিয়াটা একটা দক্ষতার জায়গা, আল্লাহ আপনাকে এই দক্ষতা অনুসারেই দেবেন। ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) একটি সভ্যতার স্রষ্টা, এই সভ্যতা মুখে মুখে আসেনি, কুরআনের বাণী দিয়েই কেবল আসেনি, দক্ষতা দিয়ে এসেছে।
দুনিয়ার পট-পরিবর্তনের সাথে সাথে আপনার কোন কোন জায়গায় জ্ঞানের ইজতিহাদ করতে হবে সেগুলো যদি না জানেন তবে আপনার ধর্ম অনুপযোগী হিসেবে মানুষ বিবেচনা করে, জীবনের সাথে অপ্রাসঙ্গিক মনে করে এ পথে আর আগায় না। ইসলামের ইবাদাতের বিষয়গুলো নির্দিষ্ট, এরপর মুয়ামালাত বা দুনিয়াবী বিষয়ের সাথে যদি আপনি ইসলামকে বাস্তবসম্মত সমাধান হিসেবে উপস্থাপিত করতে না পারেন – হোক সেটা জ্ঞান, বস্তুবাদিতা, সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন, হতাশাবোধ বা বিচ্ছিন্নতা, তবে এই ইসলাম নিয়ে আগাতে পারবেন না। যুগের উপযোগী বিষয় লাগবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়।
বর্তমান যুগে অনেক মুসলিম ভাই-বোন সেক্যুলার হওয়ার কারণ ঠিক এই জায়গায়। তারা সেক্যুলার হচ্ছে কারণ ইসলাম তাদের জীবনঘনিষ্ঠ নয়, তাদের সমস্যার বাস্তবিক সমাধান পায়নি, যে বইগুলো বর্তমান আছে সেগুলো তাদের জীবনের জন্য প্রাসঙ্গিক আকারে হাজির হতে পারেনি।
একজন নতুন ইসলামে এসেছে, আপনি তাকে বিশুদ্ধ বলে একটা তাফসির ধরিয়ে দিলেন। তাফসিরের নামটি কি? তাফসির ইবনে কাসির। তাফসির ইবনে কাসির বিশুদ্ধ, কিন্তু আপনার অজ্ঞতার জন্য এই তাফসির এই লোকের পরিস্থিতি ও সমাজের জন্য নতুন ইসলামে আসামাত্রই প্রযোজ্য নয় এইটুকু বোধ আপনার জন্মায় নি। এই না জন্মানোর ফল আমাদের যুগের বাস্তবিক পরিবর্তনশীল দৃষ্টির ব্যাপারে অজ্ঞতা, ইসলামের প্রাধান্যের উসূল সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যাত্ব-স্থবিরতা। যুগের চ্যালেঞ্জ আপনি জানেন না, এজন্য আপনি এমন তাফসির এই যুগের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া লোকের কাছে দিচ্ছেন যার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সে দিশেহারাই থেকে যাবে। অর্থাৎ সেক্যুলার যেমন হয়েছিলো ইসলামী ব্যাখ্যার জীবনঘনিষ্ঠতাহীনতার কারণে, আবার কোনভাবে ইসলামে ফিরে আসার পরও সেই সেক্যুলার থাকার কারণের রিসোর্সই দিলেন আবারো!
জীবনঘনিষ্ঠতাহীনতা, যুগের সাথে সম্পর্কহীন অবাস্তব ব্যাখ্যাগুলো।
যুগের পরিবর্তনের সাথে প্রতি যুগে যতকিছু আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হয় সেগুলো দিয়েই আপনাকে নতুন রিসোর্স গড়ে তুলতে হবে। আপনি গবেষণা বা উচ্চতর পড়াশোনার জন্য অবশ্যই তাফসির ইবনে কাসির পড়বেন, কিন্তু যেই ব্যক্তি নবতর যুগের চ্যালেঞ্জ, নির্লজ্জতার ছড়াছড়ি, ভোগবাদিতার অবাধ বিচরণ, বিজ্ঞানধর্মের আস্ফালন, সংশয়ের দোলাচল, চারিদিককার হতাশা ইত্যাদির মাঝে ডুবে আছে সেই ব্যক্তি ইসলামে আসার সাথে সাথেই যদি এগুলোর উত্তর না পেয়ে বণী ইজরাঈলের বিশাল শুদ্ধ-অশুদ্ধ রেওয়াআত দেখে, বর্তমান যুগের প্রেক্ষাপটে এগুলোর বর্ণনা না থাকে তবে তার পিপাসা মিটবে কীভাবে? রোগ না ধরতে পারা মানে আমি নিজেই অজ্ঞ, আবার এমন মেডিসিন দিলাম ফলে রোগী আরো উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেলো! (ভুল) ডাক্তার আর (ভুল) ঔষধের কাজটা কি?! উল্টো বক্র পথে যাত্রা।
ফলে আপনাকে যুগোপযোগী তাফসির আনতে হবে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর বা বিশ বছর পর আবার নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে, নতুন যুগের আবহাওয়া বিরাজ করবে, সামাজিক পরিবর্তন আসবে, আসবে ভিন্ন ও নবতর জাহেলিয়াত। আপনাকেও হতে হবে যুগোপযোগী, ক্লাসিকাল রিসোর্স নিয়ে নবতর যুগের সাথে ইজতিহাদ করতে হবে বর্তমান প্রেক্ষাপটের জীবনঘনিষ্ঠতা আমলে নিয়ে, নতুবা আপনি ব্যর্থ হতে বাধ্য। চিন্তাশীলতা দরকার, দরকার যুগোপযোগী ও জীবনঘনিষ্ঠ বাস্তবিক মুয়ামালাতের মূলনীতির আলোকে যুগোপযোগী ব্যাখ্যা ও কাজ।
ইমাম শারাওয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) ঠিক এই জায়গায় হাত দিয়েছেন, যুগের পট-পরিবর্তনের আলোকে দ্বীনকে উপস্থাপিত করেছেন যুগোপযুগী ব্যাখার আলোকে। ফলে যেসব লোক আধুনিক চ্যালেঞ্জে যেমন ক্ষতবিক্ষত হয়েছে আবার আধুনিক চ্যালেঞ্জ থেকে বের হতে চাওয়া অসংখ যুবক-যুবতীদের জন্য হয়েছে আলোক-দিশা এবং আমাদের জন্য রয়েছে যুগোপযোগী মূলনীতি, প্রাধান্যনীতি আর হাজির আছে চিন্তাশীলতার এক বিশাল ময়দান।
বইঃ আল-ফাতিহা – ইমাম মুতওয়াল্লী আল-শারাওয়ী রাহিমাহুল্লাহ
প্রকাশকঃ Bookish Publisher
ইমাম আল-শারাওয়ী আল-কুরআন নিয়ে সাপ্তাহিকভাবে আলোচনা করতেন মিশরের টিভিতে, যা তৎকালীন সময়ে ৭ কোটি লোক (70 million) তাকে নিয়মিত দেখতো, শুনতো। এতটাই জীবনঘনিষ্ঠ ছিলো সেসব আল্লাহর কালামের আলোচনা। তার আলোচনাগুলো এতটাই জীবন্ত ও জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলেন ধরতেন যে সবশ্রেণীর মানুষেরা ইমাম আল-শারাওয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) এর এই সিরিজটির জন্য অধীরা আগ্রহে থাকতো এবং একই সিরিজটি বারবার অন্যান্য টিভিওতেও প্রচারিত হতো নিয়মিত।
বাংলাভাষায় তাফসিরের ক্ষেত্রে এক নক্ষত্র হয়ে ফুটে উঠবে নতুন ধারার এই তাফসিরটি ইন শাআ আল্লাহ।
বিষয়: সাহিত্য
১১১৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন