তাদাব্বুরে কুর’আনঃ কুর’আনের স্বাদ, গভীরতা, মু’জিযা ও প্রজ্ঞার আরেক খনি – ২য় পর্ব
লিখেছেন লিখেছেন আহমাদ আল সাবা ২৩ নভেম্বর, ২০১৫, ০৭:২৬:৫৯ সন্ধ্যা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
দুটি প্রশ্নাকারে অভিযোগ ও প্রতিউত্তর
নযম বা যোগসূত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে যারা সঠিক ধারণা পোষণ করে না, তারা বলেনঃ
১। কুরআনে যদি যোগসূত্র থেকেই থাকে তা সুক্ষ্ণ ও তত্বীয় এবং এর উপর কুরআনের বুঝ বা উপলব্ধিহীনতা নির্ভর করে না।
২। যদি নযম(সাজানো যোগসূত্র)থেকেই থাকে তবে এর সন্ধান পেতে এত বছর লাগল কেন? বা কতিপয় লোকের কাছেই কেন তা ধরা দিল? অন্যান্ন এত আলেমদের নিকট কেন এটা উপস্থিত হলো না বা বোধগম্যতায় আসলো না?
প্রথম অভিযোগের উত্তর
যোগসূত্রের মর্যাদা ও মূল্যমান
“কুরআনের মূল উদ্দেশ্য ও ভাবের সাথে যোগসূত্রেরর নিবিড় কোনো সম্পর্ক নেই মনে করা এবং ভাবের দৃষ্টিকোণ থেকে এর মর্যাদা ও মূল্যবান অস্বীকার করত একে নিছক জ্ঞানগত সুক্ষ্ণ তত্ত্বের দিশারী সাব্যস্ত করা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত্রিকর কথা। আমরা তো এর মূল্যমান এভাবে নির্ধারণ করে থাকি যে, কুরাআনী হেকমত ও জ্ঞান ভান্ডারে পৌছতে হলে একমাত্র এর মাধ্যমেই সম্ভব। তাই আমাদের মতে যোগসূত্রের নির্দেশনা ছাড়া কুরআন অধ্যয়নকারী ব্যক্তি বড়জোর বিচ্ছিন্ন কতিপয় বিধিবিধান আর আলগা ধরণের কিছু হেদায়েত লাভে সক্ষম হতে পারে—এর বেশি কিছু নয়। অবশ্য আল-কুরআনের ন্যায় একটি মহাগ্রন্থের ছিন্নই হোক আর আলগা যে কোনো হুকুম-হেদায়েত লাভ করতে পারা কম কথা নয়। তবে পারিবারিক চিকিৎসার বই পড়ে কয়েকটা জটিবটির দ্রব্যগুণ জেনে নেওয়া আর বিজ্ঞ চিকিৎসক সেটাকে রাসায়নিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জীবন রক্ষাকারী ঐষধে রুপান্তরিত করার মধ্যে আকাশ পাতালের পার্থক্য ব্যবধান…আরবী ভাষা-ব্যাকরণ ও বাকরীতি অনুসারেই কুরআনের শব্দ ও বাক্য সমষ্টি গঠিত, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু আসমানী বিন্যাসধারা একে যে পূর্ণতা ও ভাব মাধুর্যের শৈলচূড়ায় আসীন করেছে, জগতের কোনো জিনিস তার মোকাবিলা করতে পারে না।”
“ইসলামের শাশ্বত মূল্যবোধ ও দ্বীনের হেকমত যে ব্যক্তি জানতে আগ্রহী, ভাল-মন্দ, সত্য-অসতের পার্থক্য, গুণগত পরিচয় এবং পর্যায়ক্রমিক গতিধারা অবশ্যই জানতে হবে। নতুবা যক্ষা রোগের আলামতকে সর্দী জ্বরের লক্ষণ আর সর্দীর উপসর্গ দেখা দিলে ক্ষয়রোগের আগমনী বার্তা সাব্যস্ত করে বসা তার পক্ষে বিচিত্র নয়। এমনকি আশংকা প্রবল বলাই সমীচীন। কুরআনের এ তত্ত্বকথা কালামের অংশ দ্বারা নয়, পূর্বাপর মিলিয়ে পূর্ণ বিষয়বস্তুর আলোকেই বরং স্পষ্ট হতে পারে। কেউ যদি একটি সূরার আয়াতসমূহের পারস্পারিক তত্ত্বপূর্ণ যোগসূত্র বিষয়ে অবগতি লাভ করতে সমর্থ না হয়, তাহলে কেবল পৃথক পৃথক আয়াতের অনুশীলন দ্বারা যে জ্ঞান আদৌ আসতে পারে না ”
পক্ষান্তরে তারতীব তথা বিন্যাসধারা সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তি খন্ড বিষয়ে একটা আবছা ও অস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে বটে, কিন্তু সূরায় বর্ণিত হেকমত ও তত্ত্বজ্ঞানের পরশ থেকে তাকে পুরোপুরি বঞ্চিতই থাকতে হবে। এটা হলো আলোচ্য বিষয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও একটা বাঞ্চিত দিক…”।
“মুসলিম জাতির ঐক্য আল্লাহর রশি দিয়ে বাঁধা, কথাটা সকলের জানা। বলা হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে নয়, আল্লাহর রশিকে তোমরা শক্ত হাতে ধর এবং সম্মিলিতভাবে। অতএব আমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হলে আসমানী গ্রন্থ আল-কুরাআনের ফায়সালাকে চূড়ান্ত সমাধানরুপে মেনে নেওয়াটাই এ আদেশের স্বাভাবিক চাহিদা। কিন্তু দূর্ভাগ্য বলতে হয়—যে কুরআনের নির্দেশ মেনে চলা আমাদের ঈমানের দাবী, স্বয়ং সে কুরআন সম্পর্কেই আমরা ঐক্যমত্যের প্রমাণ দিতে সক্ষম হই না। একই আয়াতের শত ব্যাখ্যা শত মত। যা বিপরীত অর্থ বহন করে ভিন্ন পথে ছুটে। অথচ নিজেদের কাছে এমন কোনো জিনিসও নেই যদ্বারা সঠিক-সত্যে মতটি বেছে নেয়া যায়। কোনো কথার ব্যাখ্যায় মতানৈক্য দেখা দিলে তার পূর্বাপর সম্পর্ক এবং আনুষঙ্গিক পরিবেশ পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই হলো তা দূর করার সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য উপায়। কিন্তু কুরআনের ব্যাপারে সর্বনাশা বিপদ হলো, এর মধ্যে যে পূর্বাপর সম্পর্ক ও গভীর যোগসূত্র জড়িয়ে আছে সে কথাটা লোকেরা স্বীকারই করে না। ফলে দূর্গতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের সমাজে সৃষ্ট মতবিরোধগুলোর সুরাহা তো হয়ইনি, বরং এর প্রত্যেকটি নিজস্ব ধারায় শক্তি সঞ্চয় করে স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। আমাদের ফেকাহ শাস্ত্রীয় বহু মতবিরোধ শুধু পূর্বাপর সম্পর্ক ও অন্তর্নিহিত যোগসূত্রের তলিয়ে না দেখার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। আগে-পিছের ও যোগসূত্র বিবেচনা করা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে একের অধিক দ্বিতীয় মতের কোনো অবকাশই পাওয়া যায় না।”
“ফেকাহর মতানৈক্য যতটুকু ক্ষতিকর তার চেয়েও মারাত্বক ও ভয়াবহ ক্ষতি করেছে আমাদের সমাজের বেদাতী ফের্কাগুলো। যার যার সমর্থনে দলীল হিসেবে এদের অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছে কুরআন কারীমকে। পূর্বাপর সম্পর্ক ছিন্ন করে আয়াতের ভিতর মনগড়া অর্থ ঢুকিয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, আপন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার কৌশল এরা উত্তমরুপে কাজে লাগিয়েছেন। ব্যস- শব্দ এখন শুণ্য ঘরে এসে গেল। এবার তাকে নিজস্ব অর্থের পোশাকে সাজাও, বানোয়াট মর্মের লেই দিয়ে মেরামত কর, সবই সহজ—সবই কুরআন। ঠেকায় কে? এভাবে শব্দের খোলসে এমন অর্থ ঢোকানো যায়, স্বয়ং বক্তা যার কল্পনা-ই করেনি…অপরদিকে কোন পরিবেশে আয়াত নাযিল হয়েছে, কোন পরিস্থিতি কি ছিল এবং এর সাথে পূর্বাপর সম্পর্কই বা কি? এসব কথা তলিয়ে দেখার ভাগ্য কারো হয় না। মোটকথা তাদের মতে কুরআনী আয়াতের গভীরে পারস্পারিক সম্পর্ক, পূর্বাপর যোগসূত্র, নাযিল হওয়াকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি ইত্যাদি আনুষঙ্গিক অথচ অনিবার্য বিষয়গুলোর কোনো গুরুত্ব আছে বলে আদৌ মনে হয় না। এ বিষয়ে তারা মাথা ঘামাতেও রাজি নয়।”
“আলোচ্য তাফসীর গ্রন্থে যোগসূত্র ও পারস্পারিক সম্পর্ক বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বিধায় আগাগোড়া সর্বত্র আমি একই মত অনুসরণ করেছি। অন্য কথায় অভিন্ন ও একক মত অনুসরণে আমি বাধ্য হয়েছি। কারণ আমার মতে যোগসূত্রকে অপরিহার্য বিষয় ও অনিবার্য দিশারী স্বীকার করত লক্ষ্যপানে অগ্রসর হলে মতবিরোধের তেপান্তরে চক্কর খাওয়ার প্রশ্নই থাকে না। কোনো সহীহ-শুদ্ধ বিষয়টি তখন জীবন্ত আকারে সামনে এমনভাবে উপস্থাপিত হয়—কেউ যদি একেবারে অন্ধ, বোবা কিংবা পক্ষপাতিত্ব রোগে আক্রান্ত না হয়, তবে সে জীবন দিতে পারে, কিন্তু তাকে পরিত্যাগ এমনকি সামান্য উপেক্ষার নযরে দেখাও তার পক্ষে সম্ভব হতে পারে না”।
যোগসূত্র বাক্যে অর্থ যোগ করে এবং আল্লাহর চূড়ান্ত ইচ্ছাকে নির্দেশ করে
একটি বাক্যের সাজানো বর্ণনা বা ভাষণ পূর্ণ বাক্যের সাথে অর্থ নির্দেশ করে। নতুবা একটি আয়াত বা সূরাকে অন্য আয়াত বা সূরা থেকে পৃথক করার উদ্দেশ্য কি যদি এর মাঝে কোন উদ্দেশ্য নাই থাকে। উদ্দেশ্য আছে বলেই তো পৃথক করা হচ্ছে। তাই একই আয়াতের কোনো কিছু বিচ্ছিন্ন নেওয়া যাবেই না—কারণ তাহলে পূর্ণ বাক্য বা ভাষণের যে গাঠনিক ইচ্ছা বা সংকল্প ছিল তা আর থাকবে না। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা ও নির্দেশকে পূর্ণ আয়াত বা বাক্যের মাঝে দিয়েছেন আর আমরা তা থেকে খন্ডাকারে বা বিচ্ছিন্নভাবে নিলে আল্লাহর নির্দেশনা পূর্ণ পাবো না কখনই।
মাওলানা ফারাহী (রাহিমাহুল্লাহ) হযরত আবু বুকর(রাজিয়াল্লাহু আনহু) এর উদাহরণ এনেছেন। যে ব্যক্তি সালাত আদায় করত কিন্তু জাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল। ওমর(রাজিয়াল্লাহু আনহু) বলেছিলেন আপনি কেমন করে তাকে কুফুরিতে ফেলছেন অথচ সে ‘লা ই লাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে ও সালাত আদায় করে। আবু বকর(রাজিয়াল্লাহু আনহু) কি বলেছিলেন?…যে ব্যক্তি সালাত এবং জাকাতের মাঝে পার্থক্য করে…।
কেন বলেছিলেন এই কথা? যারা মুসলিম কমিউনিটির মাঝে রয়েছে তারা যদি সালাত আদায় না করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কুরআনে যেহেতু সালাত আদায়ের সাথে জাকাতের কথা এসেছে একই সাথে, তাই যারা জাকাত দেবে না তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করা যাবে। কারণ পবিত্র কুরআনে সালাত এবং জাকাত একই সাথে একই ধারাবাহিকতায় এসেছে ৮০বারেরও উপরে। বিচ্ছিন্নভাবে নিলে একে অপ্রাসংগিকভাবে নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারবেন কিন্তু আবু বকর(রাজিয়াল্লাহু আনহু) দেখিয়েদিলেন আল্লাহর কালামের ধারাবাহিকতার ব্যবহারেই প্রজ্ঞা এবং এই ধারাবাহিকতা না নিলে বিশৃংখলা হবেই।
আর জাকাতকে রিবা বা সুদের বিপরীত করা হয়েছে। তাই যেহেতু আল্লাহ রিবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন আর এভাবে যাকাত না দিলেও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন- তবে এতদিন গোপন ছিল কেন?
প্রথমত – গভীর দৃষ্টিতে চিন্তার আশ্রয় নিলে অনায়াসে বুঝা যাবে এ প্রশ্ন আসলে কুরআনের প্রতি আসেই না। আমরা নিজেরা বরং এর আওতায় পড়ে যাই। কেননা কুরআন প্রথম অবস্থায় যাদেরকে সম্বোধন করেছে, তাদের মধ্যে কোন জটিলতা ছিল না, প্রশ্নের অবকাশও দেখা দেয়নি। ভাষা তাদের নিজস্ব, পারিপার্শ্বিক অবস্থায় তারাই জড়িত। দৈনন্দিন জীবনের সকল সমস্যা, নিত্যদিনের আপত্তি-অভিযোগ ইত্যাকার যাবতীয় প্রশ্ন তাদের আপন ঘরের বিষয়। কুরআন যাদের উদ্দেশ্যে কথা বলেছে তারা সবাই উপস্থিত। কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি, ধ্যান-ধারণা আর লালিত মূল্যবোধ সম্পর্কে তারা সম্যক অবগত।[b]
ভাব ও ভাষার সাথে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আদৌ কো%
বিষয়: বিবিধ
১৭১৫ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চোখ বুলিয়ে গেলাম, আরেকবার গভীরে যাবার ইচ্ছে রইল!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
এখানে পূর্ণ আর্টিকেলটি আসেনি। তাই আবার পোষ্ট করে দিয়েছি - সম্ভব হলে পড়ে নিবেন।
জাজাকাল্লাহ আপনাকেও ভাই।
সঠিকভাবে কোরআন বোঝার জন্য আরবী ভাষা জানা আসলেই জরুরি আর এখানে আমরা অধিকাংশ অনারব মুসলিম আটকে যাই। আরবী না জানা এবং ইংরেজীর উপর দখল না থাকাতে আমরা সবখানেই অচল।
লিখাটা পড়ে অনেক উপকৃত হলাম, জাযাকাল্লাহু খাইর।
নিঃসন্দেহে আরবী না জানা কুরআনের গভীরে প্রবেশের পথে বাধা। আর যেহেতু বর্তমানে ইংরেজিতেও প্রচূর কাজ হচ্ছে, সেকারণে এ ভাষাটা আয়ত্ব করাও দরকার।
আগেরবার পূর্ণ আর্টিকেলটি না আসায় এখন আবার পোষ্ট করে দিয়েছি - সম্ভব হলে পড়ে নিবেন। আশা করি এখন আরো ভালো উপকার পাবেন।
জাজাকাল্লাহ খাইর
এখন নতুনভাবে পূর্ণ আর্টিকেলটি প্রকাশ করেছি- সেখানে রেফারেন্স অংশটি দেখে নেবেন আশা করি।
জাজাকাল্লাহ খাইর।
আর তাদাব্বুরে কুরআন তাফসিরটি পড়লেই পূর্ণ কুরআনের আন্তমিল দেখতে পাবেন।
এখানে পূর্ণ আর্টিকেলটি আসেনি। এখন আবার পোষ্ট করে দিয়েছি - সম্ভব হলে পড়ে নিবেন। আশা করি সেখানে ভালোই পাবেন, বিশেষত রেফারেন্স অংশটি দেখার অনুরোধ রইল।
জাজাকাল্লাহ খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন