সরল কবিতা, জটিল কবিতা

লিখেছেন লিখেছেন মন সমন ০৭ জুলাই, ২০১৪, ০১:৩৩:১১ দুপুর

সরল কবিতা, জটিল কবিতা

... ... মুহাম্মদ ইউসুফ

Email :

আধুনিক কবিতা অস্পষ্ট, বোধগম্য নয়, সহজ-সরল নয়, কনফিউশনে ভোগায় – এই অভিযোগ প্রবল, উচ্চকণ্ঠে উচ্চকিত । সাধারণ পাঠক একারণেই কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন – মোটাদাগে এই অভিযোগ করা হয় । এই সরল সমীকরণ কি মেনে নেয়া যায় ?

জীবনের বোধ কি খুব সহজ-সরল ? জনসাধারণের আই.কিউ, মননমাত্রাকে সন্তুষ্ট রাখার লক্ষ্যেই কি সাহিত্য রচিত হবে ? নাকি জনমননমাত্রা-কে উচ্চতর বিভাগে, ডাইমেনশনে নিয়ে যাবেন লেখক-কবি ?

কবিতা থেকে পাঠক মুখ ফিরিয়েছেন । মুখ ফিরিয়ে পাঠক কোনদিকে মুখ ঘুরিয়েছেন ?

অবাধ, মুক্ত আকাশের অন্যসংস্কৃতিতে, বাকলখোলা ত্বকচর্চা ও রিপুপূজার কর্পোরেট সংস্কৃতিতে ? সংসারের কূটকাচালি আর গহনা প্রদর্শনের হিন্দি ও বাংলা ভারতীয় টিভি

সিরিয়ালে ? টিভি সিরিয়াল আসক্তি আমাদের নারীগণকে কি মেজাজের মননভিত্তি, মননমাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে –এটি গবেষণা করে দেখতে হবে । সম্পূর্ণ ভোগবাদী কর্পোরেট কালচার, বাণিজ্য, পণ্যের বিজ্ঞাপনই টিভি চ্যানেলগুলোর মূল লক্ষ্য ।

উচ্চ মানবিক মূল্যবোধ নির্মাণে টিভি চ্যানেলগুলো যে ব্যর্থ হয়েছে তা সমাজে মূল্যবোধের ক্রমশ নিন্মগতি দেখেই বোঝা যায় । গত ৪০ বছরে সমাজে মানবিক মূল্যবোধের কেবলই অধঃপতন হয়েছে । অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে চরম আকারে । একহাজার কোটিপতি পরিবার ঘুরেফিরে সমাজ ও দেশ শাসন করছে । ২২ পরিবারের বদলে ১০০০ পরিবার !! কালো টাকা, অসুস্থ রাজনীতির এই যুগে কবি লিখবেন সরল কবিতা ? গণতন্ত্র নয়, লুটপাটতন্ত্রের এই জমানায় সহজসরল কবিতা ?

কাজেই কবিতা থেকে পাঠক দূরে সরে যাচ্ছে – এজন্যে কবিকে, কবিতাকে, কবিতার অস্পষ্টতাকে এককভাবে দায়ী করা ন্যায়পূর্ণ, ন্যায়সঙ্গত, যুক্তিসঙ্গত নয় । সমাজ ও সমাজমানসের রক্তাক্ত চিত্র কবির হৃদয়কে জটিল ও রক্তাক্ত করেছে । জীবনের বোধসাগরে কুল পাচ্ছেন পাচ্ছেন না কবি, জটিলতা - দুর্বোধ্যতায় আক্রান্ত হবেনই কবি।

সরল অংক যেমন সরল নয়, জীবনের সামগ্রিক বোধও তেমনি সরল নয় । ‘সমগ্র জ্ঞান’ ( Total Wisdom ) মানুষকে দেয়া হয়নি । কাজেই ‘সামগ্রিক জীবনচেতনা’ অর্জনে কবিকে নিরলস জ্ঞানচর্চার শ্রমঘন পথে হাঁটতে হয় । জীবন রহস্যময় ; স্রষ্টা, সর্বশক্তিমান, সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী, সর্বপ্রদাতা আল্লাহ্‌ তায়ালা একইসাথে প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত ; মানুষের সমগ্র চেতনা-কল্পনা-বোধ-মনন স্রষ্টার সত্ত্বাকে পুরোপুরি ধারণই করতে পারে না, আমরা অদৃশ্যে ( গায়েবে ) বিশ্বাস করি ; বিশ্বাসের স্তরভেদে, দৃঢ়তাভেদে একেক মানুষের মানসিক অবস্থা একেক রকম, বেশিরভাগ মানুষই পার্থিব জীবনের সমস্যা ও ভোগবাদিতা নিয়ে মহাব্যস্ত, আল্লাহ্‌ময় সত্যজগতের সন্ধানে চিন্তাভ্রমণের সময় মানুষের নেই, বেশিরভাগ মানুষের অবস্থা -- ‘জীবনের দৌড়ের উপর আছি’ ; কবিতা বোঝার সময় কোথায় ?

এই সময়ে, এই অবস্থায় কবিতা হয়ে যাবে সহজসরল, মেদহীন ?

জীবন-জগতের রহস্য অন্বেষণে-উন্মোচনে সকল পাঠক সিরিয়াস নন । হালকা ও চটুল বিষয়েই বেশিরভাগের আগ্রহ । সাধারণ চিরকালই সাধারণ । সাহিত্যের দুই ধারা ; জনপ্রিয় ধারা, সিরিয়াস ধারা । পাঠকের শিল্পমাত্রাকে, মননমাত্রাকে বেড়ে উঠতে হলে পাঠককেই আনন্দের সাথে কঠোর শ্রম দিতে হবে, গবেষণাধর্মী মন তৈরি করতে হবে । জগতের সকল অর্জনই শ্রমসাপেক্ষ । কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই, লেন-বাইলেনও নেই । সত্য-সুন্দরের বিমূর্ত জগতের রাজপথে বোনা আছে শ্রমের পুস্পবীথি ।

সঙ্গীতের সুরে আকৃষ্ট হন সকলেই । মনের বিভিন্ন অবস্থায়, সময়ে একেক ধরনের গান একেক জনের কাছে ভালো লাগে । কিন্তু শুদ্ধ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সমঝদার শ্রোতা নগণ্য সংখ্যক । কারণ কি ? কারণ এই যে, উচ্চাঙ্গের শ্রুতিচেতনা সকলের অর্জিত হয়নি ।

কাজেই পাঠককে এগিয়ে আসতে হবে । শ্রোতাকে, দর্শককে উচ্চ মননশীলতা অর্জনে পরিশ্রমী হতে হবে । খুব সাধারণ কথা কবিতায় প্রকাশ করার প্রয়োজন কি ? সঙ্গীতে প্রকাশ করার প্রয়োজন কি - যা সাধারণ পাঠক, শ্রোতা, দর্শক জানে-বুঝে ? কবি সাজা সহজ, হওয়া কঠিন, শিল্পী সাজা সহজ, হওয়া কঠিন । আর এখন তো, অধিক শক্তিশালী স্বল্প সংখ্যক লেখকের দিন নয়, এখন হলো স্বল্প শক্তিশালী অধিক সংখ্যক লেখকের দিন । কবি, লেখক-কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবি-সুশীল সমাজ – সচেতন নাগরিক সমাজের রাজনৈতিক মেরুকরণ হচ্ছে নগদ সুবিধাপ্রাপ্তির কারণে । নির্মোহ-নিরপেক্ষ সচেতন সুশীলের সংখ্যা খুবই কম, ফলে তীক্ষ্ণকণ্ঠে সত্য উচ্চারণে খুব কম জনকেই আমরা পাই । অসহায় ‘সাইলেন্ট মেজরিটি’ কেবলই ভোট দিয়ে যায় ‘লিপ-সার্ভিসের গণতন্ত্রকে’ লুটপাটতন্ত্রে পরিণত করার লক্ষ্যে । সাংস্কৃতিক সংহতির পরিবর্তে রাজনৈতিক বিভাজন প্রবল ও প্রকট ।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন, স্নায়ুসুখে ডুবে থাকাই তো সাধারণের লক্ষ্য । রাজনীতি, ব্যবসা, চাকুরির লক্ষ্যও তাই । দেশদখল, ক্ষমতা-পূজার লক্ষ্যও একই । তারা কবিতাকে, শুদ্ধ পাঠকে, সুন্দরকে আমন্ত্রণ জানাবেন কেন আকাশসংস্কৃতির এই ত্বকচর্চার, ভোগচর্চার যুগে !!

বেসুরো-বেয়াদব সমাজের নির্মাতা কে ?

কবি ?

না ।

ইলেকট্রনিক পর্দার বাকল-ছাড়ানো নারী ? দেহপণ্যে বানিয়ে দিয়েছে বেয়াদব সমাজ ?

অর্থরোগী ব্যবসায়ী ?

শীতল রক্তের শয়তান আমলা ?

পচা রাজনীতিবিদ ?

কে ? কারা দায়ী সমাজের এই অবক্ষয়ের জন্যে ?

যে এবং যারা দায়ী তাদেরকে নিয়ে আমরা কি করব ?

সহ্য করে যাব পতনের শেষ ধাপ পর্যন্ত ?

চিহ্নিত করে বিচার করব, জবাবদিহিতায় নিয়ে আসব ?

নাকি শুধু আল্লাহ্‌র বিচারের আশায় অপেক্ষা করব ?

নিজেরা কিছুই না করে পলায়নপর মনোবৃত্তির দাসত্ব করব ?

এই সময়ে, এই অবস্থায় সহজ কথা সহজে ? সরল কবিতা ?

চারিদিকে প্রবল প্রতাপে অপশক্তির পিচাশহাত সক্রিয় ।

শয়তানের চামুণ্ডাদের জয়ধ্বনি ।

সরল কবিতা লিখব ?

সহজ ছন্দে জীবনের সরল সুখের গান ?

সারল্য–বিভায় নেচে উঠবে বাঙালির মন ?

বাংলা কবিতা ?

০৫-০১-২০১৪

ঢাকা, বাংলাদেশ ।

বিষয়: বিবিধ

১০৪৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

242571
০৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:০৪
সুমন আখন্দ লিখেছেন : দিন ও রাত মিলিয়ে যেমন আমাদের দিনগুলো অতিবাহিত হয়; তেমনি কবিতা ও অকবিতার ধারা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে কবিতা হিসেবেই পরিচিত। আমরা, মানে নিম্নআদালতের লোকেরা, হয়তো কৌশলের অভাবে আলাদা করতে পারি না; কিন্তু সময় হলো হাইকোর্ট বা সর্বোচ্চ আদালত, সে ঠিকই হীরাকে হীরা এবং কাচকে কাচ বলেই আলাদা করে রাখবে। কবি সাধারণত মানবপ্রেমী হয়। আর এজন্যই তাকে বেশ বেগ পেতে হয়, শাস্তি পেতে হয়
ভালো লাগলো, ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File