বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দুঃখ

লিখেছেন লিখেছেন Democratic Labor Party ১৭ মে, ২০১৬, ০১:১১:২৫ দুপুর

হামিদ মীর

১৬ মে ২০১৬,সোমবার



যদি আপনি এটা ভাবেন যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে শুধু পাকিস্তানপ্রীতির অপরাধে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, তাহলে জেনে রাখুন, এটা পুরো সত্য নয়। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ‘আদালতি হত্যা’কে কেন্দ্র করে কিছু পাকিস্তানি পত্রিকায় হেডলাইন দ্বারা এ কথা বোঝা যাচ্ছে যে, নিজামী সাহেব বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের অনুগত ছিলেন। এ মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া বাস্তবতা পরিপন্থী এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নীতির একেবারে বিপরীত।

হাসিনা ওয়াজেদের সরকারের পক্ষ থেকে গঠন করা আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির যেসব নেতাকে দণ্ড দিয়েছে, পাকিস্তানি মিডিয়া ওই নেতাদের ‘পাকিস্তানপন্থী’ অভিহিত করে হাসিনা ওয়াজেদের দাবিকেই সমর্থন জোগাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানের মিডিয়া ভারত সম্পর্কে বেশি এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে কম জানে।

আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী জানেন না যে, ১৯৭১ সালে সেনা অভিযানের আগে পূর্ব-পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর নেতা প্রফেসর গোলাম আযম স্পষ্ট ভাষায় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেছিলেন। জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তানের মজলিসে শূরা দীর্ঘ তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার পর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, যদি পাকিস্তানের ঐক্য অটুট না থাকে, তাহলে জামায়াতে ইসলামী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরিবর্তে আইনগত বিচ্ছিন্ন হওয়াকে প্রাধান্য দেবে।

সেনা অভিযান শুরু হলে গৃহযুদ্ধ কঠোররূপ ধারণ করে। জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা আলবদর ও আলশামস নামে সংগঠনগুলোতে যুক্ত হয়ে পড়ে এবং তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে মিলে মুক্তিবাহিনীর মোকাবেলা শুরু করে, যারা ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং প্রফেসর গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামীর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেন। আর বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট প্রফেসর গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বহাল করেন।

প্রকাশ থাকে যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্তানপন্থী ছিলেন না। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের আগে পাকিস্তানের প্রতি বিদ্রোহ করেছিলেন এবং একজন মেজর হিসেবে চট্টগ্রামে রেডিও স্টেশন কব্জা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগের বিদ্বেষের কারণে জামায়াতে ইসলামীর সাথে সমঝোতা করেন। তার মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেন। জামায়াতে ইসলামী খালেদার বিএনপিকে সমর্থন জানায় এবং ১৯৯১ সালে বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করে। ওই নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসন লাভ করে কিং মেকার হয়ে সামনে চলে আসে।

আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী ও অপর কিছু দলকে সাথে নিয়ে সরকার গঠনের চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জামায়াত নেতাদের মন্ত্রী করার প্রস্তাব দেয়া হয়। জামায়াতে ইসলামী এ প্রস্তাব উপেক্ষা করে এবং খালেদা জিয়া ক্ষমতায় চলে আসেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কে এক আকর্ষণীয় মোড় তৈরি হয়। আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর সাথে মিলে আন্দোলন করে এ দাবিতে যে, নতুন নির্বাচন বিএনপি সরকারের অধীনে নয়, বরং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে হবে। আওয়ামী লীগের সাথে জোট করে জামায়াতে ইসলামীর মারাত্মক ক্ষতি হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তারা মাত্র তিনটি আসনে জয়লাভ করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি দ্বিতীয়বার জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ওই নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ১৭টি আসনে জয়লাভ করে। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী বানানো হয়। তার কর্মকাণ্ড বিএনপির অন্য মন্ত্রীদের তুলনায় বেশ ভালো ছিল। এতে বিএনপির মন্ত্রীরা তার সাথে হিংসা করতে থাকেন।

বিএনপি কিং মেকারকে সাথে রাখতে চেয়েছিল, তবে কিং মেকারের ক্রমবর্ধমান গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভয়ও ছিল।

বিএনপির মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কারণে জামায়াতে ইসলামীর মারাত্মক ক্ষতি হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তারা মাত্র দুটি আসন লাভ করে। এটা ওই সময়ের কথা, যখন আওয়ামী লীগের ভেতর হাসিনা ওয়াজেদের মিত্রদের একটি গ্র“প তার ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য জামায়াতে ইসলামীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও তার নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের দাবি করে। ওই দাবির সমর্থনকারীরা ঢাকার শাহবাগ এলাকায় অনেক দিন ধরে আন্দোলনও করে। সেখানে বারবার এটা বলা হয়েছে যে, পাকিস্তান ১৯৭১ সালের সেনা অভিযানে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি। সুতরাং ওই অভিযানের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতাকারীদের বিচার করা হোক।

স্মর্তব্য যে, ২০০২ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফকে ঢাকায় স্মৃতিসৌধে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে অতিথিদের মন্তব্যের জন্য রাখা বইয়ে মোশাররফ ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। বিএনপি ওই দুঃখপ্রকাশকে নিজেদের বিশাল কৃতিত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ দুঃখ প্রকাশের পরিবর্তে ক্ষমাপ্রার্থনার দাবি করতে থাকে।

হাসিনা ওয়াজেদের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির নেতাদের বিচার শুরু করা হলে বাংলাদেশে এ প্রশ্ন ওঠে যে, যখন আওয়ামী লীগ বিএনপির সাথে মিলে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করল, তখন তারা ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের কথা ভুলে গেল কেন? আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে যখন জামায়াতে ইসলামীর সাথে মিলে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, ওই সময় আওয়ামী লীগের কাছে জামায়াতে ইসলামীকে নিষ্পাপ মনে হলো কেন? বাস্তবতা হলো, বিএনপি মারাত্মক অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের শিকার। আর জামায়াতে ইসলামী বিকল্প বিরোধী দল হিসেবে সামনে এসে হাজির হয়েছে। ভারতে বিজেপির মতো ধর্মভিত্তিক দলের উত্থান বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে সেকুলার ও প্রগতিবাদী দলের বিকল্প হিসেবে দীপ্তিমান করেছে।

জামায়াতে ইসলামীর কিং মেকার অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগেরও ভয় ছিল। আওয়ামী লীগের এ শঙ্কাও রয়েছে যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীতে জামায়াতে ইসলামীর শেকড় অনেক গভীরে। সুতরাং যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর দুর্বল ও অসুস্থ নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর মূল উদ্দেশ্য এক ঊর্ধ্বমুখী রাজনৈতিক শক্তিকে খতম করা।

মানবাধিকারের বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দণ্ড নিয়ে আপত্তি তুলেছে। সুতরাং এ দণ্ড বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। হাসিনা ওয়াজেদের সরকার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আপত্তিগুলো পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করতে পারে না।

আমি অনেকবার বলেছি যে, পাকিস্তান সরকারের উচিত, ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য নিছক দুঃখপ্রকাশের পরিবর্তে ক্ষমাপ্রার্থনা করে বাংলাদেশের সাথে বিদ্বেষ দূর করে দেয়া। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নতুন বিদ্বেষ জন্ম দিচ্ছে।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি বিদ্বেষের আগুন আরো বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে নামসর্বস্ব আখ্যায়িত করা হয়। এ দল আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি, ন্যাশনাল পার্টি ও বেলুচ ন্যাশনাল পার্টি বিএনপির রূপ ধরে আজো বিদ্যমান। পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। তার দলও নিঃশেষ হয়নি। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে এ দল নতুন নাম নিয়ে আবির্ভূত হবে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান অনুধাবনের জন্য প্রফেসর গোলাম আযমের ওই চিঠিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা তিনি ২০১২ সালে গ্রেফতারের আগে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে লিখেছিলেন। তিনি ওই চিঠিতে স্পষ্ট করে বলেছেন ‘আমি ১৯৭১ সালে ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনা অভিযানের বিরোধিতা করেছিলাম।’ ‘বাংলাদেশে জুলুমের রাজত্ব’ শিরোনামে ওই চিঠি জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান লাহোরের মনসুরা থেকে প্রকাশ করেছে। চিঠির শেষে প্রফেসর গোলাম আযম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিরাপদ থাকার জন্য দোয়া করেছেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দুঃখ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে তাদের মিত্র ছিল। আর ২০১৬ সালে ১৯৭১ সালের ঘটনায় তাদের আমিরকে যুদ্ধাপরাধী আখ্যায়িত করছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বেশ কিছু কৃত ও অ-কৃত ভুলের সাজা ভুগল। একসময় আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সামনে জবাবদিহিতার এই প্রশ্ন আসবে যে, ১৯৯৬ সালে আপনার রাজনৈতিক মিত্র ২০১৬ সালে কিভাবে যুদ্ধাপরাধী হয়ে গেল?

---

সোর্স:পাকিস্তানের [b]দৈনিক জং (১২ মে, ২০১৬)

উর্দু থেকে ভাষান্তর-ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

* হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক[/b]

বিষয়: রাজনীতি

৯৭৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

369402
১৭ মে ২০১৬ দুপুর ০৩:৩৩
কুয়েত থেকে লিখেছেন : বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতি সড়যন্ত্রের ফসল। আওয়ামীলীগ সুষ্টধারার রাজনীতি থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে। যাকে দালালী ছাড়া কিছুই বলা যায়না। প্রতিটি মুসলমান আল্লাহর গোলাম তারা আল্লাহকে ছাড়া কারো দাসত্ব গ্রহন করেনা। প্রতিটি মৃসলমান একটি মাত্র দেহ। ভালো লাগলো লেখাটি ধন্যবাদ আপনাকে
369418
১৭ মে ২০১৬ বিকাল ০৫:৪২
হতভাগা লিখেছেন :
একসময় আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সামনে জবাবদিহিতার এই প্রশ্ন আসবে যে, ১৯৯৬ সালে আপনার রাজনৈতিক মিত্র ২০১৬ সালে কিভাবে যুদ্ধাপরাধী হয়ে গেল?


০ টয়লেট পেপার দিয়ে কাজ সারার পর সেটাকে কি সাথে রাখা হয় ?

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File