বিনোদনমাধ্যমে অশালীনতা : সমাজ ভিত্তিতে ভূকম্পন
লিখেছেন লিখেছেন Democratic Labor Party ০২ মে, ২০১৬, ০৪:৩৮:১৭ রাত
সুমাইয়া হাবীবা
৩০ এপ্রিল ২০১৬,শনিবার
সম্প্রতি জার্মান আইনমন্ত্রী ‘সুড়সুড়িমূলক’ বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আইনমন্ত্রী হাইকো মাসার মতে, বর্ষবরণের রাতে কোলনের রেলস্টেশনে অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য বিনোদনমাধ্যমের অতিরিক্ত যৌনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের প্রভাব রয়েছে। এসব বিজ্ঞাপন তৈরি ও প্রদর্শনের ফলে মানুষের মনে কুচিন্তার আবির্ভাব হয়। জার্মানির কোলন রেলস্টেশনে নব বর্ষবরণের রাতে কয়েকজন নারীর ওপর যৌন হয়রানিমূলক হামলা হয়েছিল। উল্লেখ্য, জার্মানিতে এমন কয়েকটি পার্ক রয়েছে যেখানে সম্পূর্ণ নগ্ন হওয়া যায়। ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’র দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি উঁচু অবস্থানে রয়েছে।
নির্মল বিনোদন আর বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষাদান একই কথা। যে বিনোদনের মাধ্যমে মানুষ সুশিক্ষা পায়, বোধবুদ্ধির উন্নয়ন ঘটে, সেটাই নির্মল বিনোদন। বিনোদনের সব চেয়ে বড় মাধ্যম হলো বেতার ও টেলিভিশন। তাই এ দুই মাধ্যমের অনুষ্ঠান নীতিমালায় সামাজিক, জাতীয় ও ধর্মীয় প্রভাব এসেই যায়। প্রতিটি দেশের মতো আমাদের দেশেও সেটা মানা হতো। লিখিত আর অলিখিত দু’ভাবেই এটি বলবৎ ছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেতারে নব্বই দশক পর্যন্ত অনুষ্ঠানগুলো পর্যালোচনা করলে এর সত্যতা পাওয়া যায়।
জার্মানির আখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ও মিডিয়া বিশেষজ্ঞ সেভন কমারের মতে, যেসব বিজ্ঞাপনে নারীদের যৌন দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তোলা হয়, সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। এ ধরনের উপস্থাপন কিশোর ও তরুণদের মনে নারী সম্পর্কে ভুল ও নিচু ধারণা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। বিজ্ঞাপন ও বিনোদন বিপণন মাধ্যম জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মানুষের ধারণা বিন্যাস করে থাকে। কাজেই আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কী ধরনের বিশ্বদর্শন প্রচার করতে চাই।
প্রায়ই বলতে শোনা যায়, সমাজটা বদলে গেছে। সময়ের প্রয়োজনে যুগে যুগে সব সমাজই বদলেছে। তবে, বদলানো মানে বিলীন হয়ে যাওয়া নয়; কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে বদলানোর নামে সমাজব্যবস্থার মৌল ভিত্তিটিই যেন বিলীন হতে চলেছে। নানা ধর্ম বর্ণের মানুষ নিয়ে সমাজ গঠিত। তাই একটি সমাজে সব ক্ষেত্রে একই রকম রীতিনীতি বজায় না থাকলেও কিছু মৌল বিষয় ঐতিহ্য বা প্রথা হিসেবে প্রচলিত থাকে। সে কারণে কোনো মুসলিমপ্রধান সমাজে হিন্দু বা খ্রিষ্টান বা অন্য ধর্মাবলম্বী পরিবার থাকলেও সামাজিক ব্যবস্থায় তেমন হেরফের হয় না। একইভাবে অন্য ধর্মের অনুসারীপ্রধান সমাজের বেলাতেও এটাই হয়। প্রতিটি ধর্ম ও সমাজের মৌল ভিত্তিগুলো প্রায় একই। যেমন সহমর্মিতা, সহযোগিতা, শালীনতা, নম্রতা প্রভৃতি। এগুলোই সমাজের ভিত্তি। এগুলো যখন সমাজব্যবস্থায় গৌণ বলে গণ্য করা হয়, তখনই দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা।
ইদানীং আমাদের বিনোদনমাধ্যমে এক প্রকার উদ্দাম আবেগের উচ্ছ্বাস চলছে। এতে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তিই নড়বড় হতে চলেছে। নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন সবখানেই ব্যক্তিস্বাধীনতা বা মুক্ত মননের আড়ালে বিনোদনমাধ্যম থেকে শালীনতাবোধের অনেকটা বিলুপ্তি ঘটছে। নীতিমালার মধ্যে সামাজিক নৈতিক চেতনার যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি যেটুকু নৈতিকতা রয়েছে নীতিমালায় সেটিও মানা হচ্ছে না। অথচ বিদ্যমান নীতিমালা মানা না মানার বিষয়ে কোনো মনিটরিংও করা হচ্ছে না। পোশাক আশাক, ভাষার ব্যবহার, বডি ল্যাঙ্গুয়েজÑ এমনকি অনেক সময় থিমের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সংস্কৃতির ছাপ থাকে না বললেই চলে। আবহমান বাংলার প্রতিরূপ ফুটিয়ে তোলার পরিবর্তে কল্পনাপ্রসূত অতিবাস্তব বা পরাবাস্তব বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। সমাজের প্রতিনিধিত্ব করা বৃহত্তম অংশকে বাদ দিয়ে ক্ষুদ্রতর এক অংশের কাহিনীই আবর্তন করা হচ্ছে নাটক বা প্রদর্শনীতে।
উন্নত বিশ্বের, যাদের আমরা অনুসরণ করে অশালীনতাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছি, সাধারণত সে সমাজের কেবল তৃতীয় সারির অশালীন বিনোদনগুলোই আমাদের দেখানো হয়। সাধারণ লোকেরা এটা দেখে ভেবে নেয়, উন্নতির চাবিকাঠি হলো আধুনিকতার মোড়কে থাকা অশালীনতা। অথচ ইউরোপ আমেরিকার প্রায় প্রতিটি অফিসেই নির্দিষ্ট ড্রেস কোড কঠোরভাবে মানা হয়। স্কুল কলেজ ভার্সিটিতেও মার্জিত পোশাকের ওপর জোর দেয়া হয়। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও তা দেখা যায়। অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ক্ষেত্রেও তারা তাদের মতো করে নীতিমালা মেনে থাকে। কোনো ‘অ্যাডাল্ট’ অনুষ্ঠান মাঝরাতের আগে দেখানো হয় না। এমনকি জনবহুল স্থানগুলোতে বা যত্রতত্র নারী-পুরুষ ঘনিষ্ঠতা অনুমোদন করা হয় না। শিশুদের বিনোদনের স্থানে তো নয়ই।
ব্যক্তিস্বাধীনতা আর অশালীনতা এক নয়। পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেও শালীন থাকা যায়। হোয়াইট হাউজের ড্রেস এটিকেটেও রুচিশীল ও মার্জিত পোশাক ব্যবহারের কথা বলা আছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অশালীনতাকে গুলিয়ে ফেলা যায় না। যারাই এ দু’টি ভিন্ন বিষয়কে গুলিয়ে ফেলেছেন, ইতিহাসে দেখা যায় তাদের পরিণতি শুভ হয়নি। কুরআন, বাইবেল এবং হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লিখিত অশালীনতার প্রসার ঘটা সময়গুলোর বিবরণ থেকে বোঝা যায় পৃথিবী নিয়ন্ত্রণের মুকুট তাদের মাথায়ই উঠেছে, যারা সমাজকে স্থিতিশীল করতে সচেষ্ট ছিলেন।
মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরব বংশের দুর্দশা বিশেষ করে রাজ্য ক্ষমতা হারানো, সম্রাজ্ঞী দ্রৌপদীকে অপমান করাসহ সে রাজ্যের নারীকুলের দুর্বিষহ অমর্যাদাকর জীবনে ফেলা, তথা অশ্লীলতার ব্যাপক প্রসার ঘটার পরিণতি বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বাইবেলেও বহু জাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গভীর ও নির্ভুল বর্ণনা করেছে কুরআন। কুরআনে বর্ণিত আদ, সামুদসহ নানা জাতিগোষ্ঠীর জীবনাচরণ থেকে এটা স্পষ্ট, অশ্লীলতার প্রসার সমাজকে হঠাৎ নেমে আসা অজগরের মতোই গ্রাস করে ফেলে। পরবর্তী সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের নিদর্শন ছাড়া এদের আর কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায় না, যা কেবল ভূবিজ্ঞানী, গবেষক বা অতি উৎসুক পর্যটককেই আকর্ষণ করে থাকে; কিন্তু মানবকল্যাণের কোনো কাজে তা আসে না, যেমন কাজে এসেছে ইবনে সিনা, খারেজমি বা মাদাম কুরি, আইনস্টাইনের অমর কীর্তি।
সম্প্রতি চীনের সাংহাইতে পাবলিক বাসে মহিলাদের জন্য বিশেষ একটি সিটের ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন। যেটি গোলাপি পর্দা দিয়ে চার পাশ ঘিরে ফেলে একটি কেবিনের মতো করে ফেলা যায়। মায়েরা যাতে শিশুকে নির্বিঘেœ দুধপান করাতে পারেন, তাই এই ব্যবস্থা। শিশুসন্তান সাথে নিয়ে কোনো মা বাসে উঠলে বাসচালক তাকে সে সিটে বসতে অনুরোধ করছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এমন ব্যবস্থা তারা করবেন বলে জানিয়েছেন।
যেটি ভাবার বিষয় তা হলো, চীন একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। আর সেখানে বাকস্বাধীনতার বিষয়টি যে অবস্থায়ই থাকুক, চলাফেরার স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত। অনেক মা-ই প্রকাশ্যেই শিশুকে দুধ পান করান। কিছু মা রয়েছেন যারা প্রকাশ্যে তা করান না। এতে সেসব কর্মজীবী মায়ের শিশুরা ঘরের বাইরে গেলে অভুক্ত থেকে যায়। প্রশাসন সেসব মায়ের কথা চিন্তা করে এমন একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। লক্ষ করা গেছে, যেসব মা ব্যক্তিস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে প্রকাশ্যেই দুধ পান করাতেন, তাদের অনেকে যখন বাসে উঠছেন তখন ওই সিটটি খালি রেখে প্রকাশ্যে কাজটি করতে লজ্জা পাচ্ছেন। আবার অনেক জায়গায় বাসের লোকেরাই মাকে সে সিটে গিয়ে দুধ পান করাতে অনুরোধ করছেন।
অর্থাৎ, শালীনতাবোধের স্থান ও মর্যাদা সব সমাজে রয়েছে। শালীনতা হারিয়ে গেলে সমাজ বিশৃঙ্খল হতে বাধ্য। বিশৃঙ্খলা কোনো সমাজকেই উন্নত করতে পারে না। শালীনতাবিবর্জিত কোনো সমাজ টিকে থাকতে পারে না। ইতিহাস বলে, যখনই কোনো সমাজ থেকে শালীনতাবোধ বিদায় নিয়েছে, সে সমাজ খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে। যা হোক্, এক সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ তরুণ টিভি বা অন্যান্য বিনোদন সেলিব্রেটি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। সুতরাং বিনোদনমাধ্যমকে অবহেলা করা যায় না। যারা সমাজ নিয়ে ভাবেন, সামাজিক মৌলিক ভিত্তিগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বিনোদনমাধ্যম নিয়ে তাদের গভীরভাবে ভাবত হবে।
-----------------------
লেখিকা : সমাজ ও মানব উন্নয়ন কর্মী
- Source: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/114748
বিষয়: বিবিধ
৯৬৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন