বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা প্রতীকে পরিণত হয়েছে
লিখেছেন লিখেছেন Democratic Labor Party ০৫ এপ্রিল, ২০১৬, ১০:৪৩:৫৩ সকাল
মাজ হুসাইন | ৫ এপ্রিল ২০১৬, মঙ্গলবার
বাংলাদেশি সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহা হত মাসে ঢাকায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দ্বারা অপহৃত হওয়ার আগে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেনÑ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ চুরি নিয়ে মিডিয়ায় মন্তব্য করার কারণে গ্রেপ্তার হতে পারেন। হ্যাকাররা নিউইয়র্ক ফেডে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল থেকে ফিলিপাইনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৮১ মিলিয়ন ডলার ট্রান্সফার করে। বিরাট অঙ্ক লোপাট হওয়ায়Ñ কিভাবে অ্যাকাউন্টের নিরাপত্তা লঙ্ঘন হয়েছিল তা নিয়ে বড় ধরণের কেলেঙ্কারি সৃষ্টি হয়েছে।
তদন্তকারীরা যখন ঘটনাপ্রবাহ মেলানোর চেষ্টায় রত, তখন ১১ই মার্চ একটি সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন জোহা। ব্যাংকের কম্পিউটার সার্ভারে নিরাপত্তার মানদন্ড ও সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ তুলে ধরতে এবং ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তাদের দোষারোপ করতে তিনি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন।
জোহা এও দাবি করেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের হয়ে কাজ করতেন। সাইবার নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে সরকারকে পরামর্শ দিতেন। তবে, জোহার মন্তব্য সম্প্রচার হওয়ার পরই, আইসিটি একটি বিবৃতি দিয়ে বলে, তাদের সঙ্গে জোহার কখনও কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
কর্তৃপক্ষ অর্থ লোপাটের মামলা থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়। এ ঘটনার একজন গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। জোহার পরিবার দাবি করছে, ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সমালোচনা করে দেয়া তার মন্তব্যই হয়তো তার গুমের পেছনে ভূমিকা পালন করেছে। এই কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ এক সপ্তাহ নিখোঁজ থাকার পর এখন নিজ বাড়িতে। কিন্তু কে বা কারা তাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল? কেনই বা নিয়ে গিয়েছিল? এসব নিয়ে তিনি কিছু বলছেন না।
বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা অবশ্য এতে বিস্মিত নন। তারা বলছেন, রাষ্ট্রের দ্বারা জোরপূর্বক গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এমন বাকসংযম স্বাভাবিক ঘটনা। হংকং ভিত্তিক বাংলাদেশি মানবাধিকার কর্মী মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলছেন, এটা নিয়মিত একটি রীতি। এশিয়ান লিগ্যা রিসোর্স সেন্টারের (এএলআরসি) লিয়াজোঁ কর্মকর্তা আশরাফুজ্জামান ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন গুমের শিকার হওয়ার পর যারাই ঘরে ফিরেছেই, তারা সবাই একই ধরণের নিরাবতার রীতি অনুসরন করেছেন। ফলশ্রুতিতে, সত্য প্রকাশ থেকে আপনাআপনিই বিরত থেকেছেন। আমার মনে হয় জোহাও তার গুম নিয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করবেন না। অন্তত, বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করার আগপর্যন্ত নয়।’
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বলপূর্বক গুমের অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। গুমের শিকার বেশিরভাগই আওয়ামি লীগের বিরোধী দলগুলোর কর্মী ও নেতা।
FILE - Bangladeshi opposition activists shout slogans carrying a portrait of Elias Ali, an opposition politician who is suspected to have been abducted by security forces in Dhaka, May 9, 2012.
বাংলাদেশি মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে কমপক্ষে ২৪০ জন ব্যক্তি বলপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন। সংগঠনটি শুধু সেইসব ঘটনা নথিভূক্ত করেছে যেখানে প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছে যে ভুক্তোভোগীকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মতো দেখতে লোকজন উঠিয়ে নিয়ে গেছে। অধিকারের নথিভূক্ত ঘটনাগুলোর মধ্যে ৩২ জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ১০১ জনকে আটক দেখানো হয়েছে বা জীবিত ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ওদিকে, ১০৭ জন কোথায় আছে তা অজানাই রয়ে গেছে।
জোরপূর্বক গুমের বেশিরভাগ ঘটনার দায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চাপানো হলেও, ভুক্তোভোগী বা তাদের পরিবার আটকাদেশের জন্য আইনি প্রতিকার চেয়েছেন কদাচিত।
২০১৩ সালে ঢাকায় বিরোধী দল বিএনপির স্থানীয় এক নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন সহ ৬ জনকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা উঠিয়ে নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, প্যারামিলিটারি বাহিনী র্যাবের কালো উর্দি পরা ব্যক্তিরা তাদের একটি ভ্যানের মধ্যে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যায়।
সুমনের বোন সানজিদা আখতার তুলি ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, ‘এর পরপরই আমরা অপহরনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা করার চেষ্টা করি। কিন্তু পুলিশ আমাদের অভিযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বলে, আমার যদি অভিযোগে র্যাব বা অন্য কোন নিরাপত্তা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করি তাহলে তারা অভিযোগ নেবে না। যদি আমরা অভিযোগে লিখি যে, সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি, সে নিখোঁজ তাহলেই অভিযোগ নেবে।’
মানবাধিকার গ্রুপ আইন ও শালিশ কেন্দ্রের (এএসকে) পরিচালক নুর খান উল্লেখ করেনÑ যারা গুম হওয়ার পর বাড়িতে ফিরেছে তাদের মধ্যে শাস্তি পাওয়ার ভয় খুব জোরালোভাবে ভর করে থাকে। ভয়েস অব আমেরিকাকে তিনি বলেন, ‘তাদের শঙ্কা হয় যে, নিজের গুম নিয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করলে, আবারও হয়তো গুমের শিকার হতে হবে বা জীবনের ওপর মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি হতে হবে। মূলত এ কারণেই তারা চুপ থাকেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা তাদেরকে আটক রেখেছিল তারা অনেক ক্ষমতাধর বলে বিশ্বাস করেন গুমের শিকার ব্যক্তিরা। তারা মনে করেন, ওই ব্যক্তিদের যোগসূত্র আছে উচু জায়গায়। তাদের এমনও সন্দেহ হয় যে বন্দিকর্তারা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করে বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হতে পারে।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলপূর্বক গুমের ঘটনাগুলো তদন্তে স্বাধীন প্যানেল গঠন করতে বাংলাদেশের কাছে নিয়মিত দাবি জানিয়ে থাকে। কিন্তু অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই।
-----
ভয়েস অব আমেরিকায় প্রকাশিত http://www.voanews.com/content/bangladesh-cyber-expert-becomes-symbol-for-forced-disappearances/3266604.html শীর্ষক রিপোর্টের তরজমা
বিষয়: বিবিধ
৬৭৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন