বিরোধীরা হয় পাকিস্তানি অথবা ভারতীয় দালাল!
লিখেছেন লিখেছেন Democratic Labor Party ২৫ মে, ২০১৫, ০৯:১৩:০৩ রাত
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন
২৫ মে, ২০১৫
সুশীলসমাজের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা ক্ষমতাসীনদের জন্য নতুন কিছু নয়। সুশীলসমাজ যে তাদের নিজেদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কথা বলছেন না, তা বুঝতে নেতারা চেষ্টা করবেন না। দেশ সবার, সে হিসেবে সবাই মিলে ভালো থাকার কথাই সুশীলসমাজের লোকেরা বলে থাকেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কারচুপির তথ্য তুলে ধরায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সমালোচনা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রধান মুখপাত্র সুশীলসমাজের একাংশকে পাকিস্তানি দালাল বলেছেন।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, সুশীলসমাজের সদস্যদের একটি অংশ সুযোগ পেলেই সরকারের সমালোচনা করেন। এরা আসলে পাকিস্তানের দালাল। তিনি আরও বলেন, এরা হলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির অবশিষ্টাংশ। তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সাম্প্রতিক সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মূল্যায়ন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে উপরোক্ত মন্তব্য করেন। টিআইবি তার মূল্যায়নে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, কোথায় অনিয়ম হয়েছে সেটা টিআইবি প্রমাণ করুক। একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীও টিআইবির সমালোচনা করতে গিয়ে ক্ষিপ্ত হয়েই বলেছেন, তারা শুধু সরকারের দোষ খুঁজে বেড়ায়। সরকারের ভালো কাজ তাদের নজরে পড়ে না।
সব স্বৈরশাসকদের এটি বড় ক্ষোভ যে, জনগণ তাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করে না। তারা তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাদের পতনের জন্য। আসলে দেশের উন্নয়নের অর্থ যে জনজীবনে শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা তা স্বৈরশাসকরা উপলব্ধি করতে পারে না। পুলিশি রাজত্বের আতংক ও জীবনের অনিশ্চয়তা যে স্বাধীনতা নয়, মানুষের উন্নতি নয়, তাও তাদের জানা থাকে না। সরকারি নেতাদের অসহনশীল কথাবার্তা শুনলে মনে হয় গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলা তারা ভুলে গেছেন।আমরা মুক্তিযুদ্ধের তথ্যাবলী নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নই।
মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীগুলোর মধ্যে অনেক ফাঁকিঝুঁকি আছে। এসব যত কম প্রকাশ পায় ততই আমাদের জন্য ভালো। বাংলাদেশীরা তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশী দেশপ্রেমের সনদ গ্রহণ করে না, যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়া ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।বাস্তবে বাংলাদেশের জনগণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় একাত্তরের জনযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিল। দেশে অবস্থানকারী বাঙালি জনগোষ্ঠীর সমর্থন ছাড়া ভারত কেন, কোনো দেশই আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে এগিয়ে আসত না। এখন যদি কিছু লোক বাংলাদেশের জনগণের একটি অংশকে পাকিস্তানেরদালাল হিসেবে খুঁজে পেতে চান, তাহলে অন্যরা অপর একটি অংশকে ভারতের দালাল হিসেবে খুঁজে পাবেন।যারা মুক্তিযুদ্ধের নামে সব ধরনের বিকৃত তথ্যকে জায়েজ করতে চাচ্ছেন, স্বাধীনতা অর্জনের সব বাহাদুরি দাবি করছেন, তাদের সতর্ক থাকতে বলা প্রয়োজন সবার মঙ্গলের জন্য। অসহায় জনগণকে জীবন-মরণ প্রশ্নে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে ওই সময়ে যারা ভারতে গিয়েছিলেন তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অহংকার করতে পারেন না।
জাতীয় সংকটের সময়ে নানা ধরনের লোক নানা উদ্দেশ্যে কাজ করছে। কিন্তু যা সত্য তা হল, বঙ্গবন্ধু সবাইকে জনগণের পাশে থেকে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলতে বলেছিলেন। কেন তা করা হল না, তার সদুত্তরতো থাকতে হবে। সুতরাং আমাদের জনগণের ওপর পাক সামরিক হামলার মুখে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে দেশে রেখে যারা ভারতে গিয়েছিলেন, এখন অন্যদের দেশপ্রেম সম্পর্কে কটাক্ষ করছেন,হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, তাদের কারও কারও তৎকালীন এবং বর্তমান সময়ের ভূমিকা সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এসব বিতর্ক এখন তোলা হলে রাজনৈতিক পরিবেশ বিষাক্তই হবে- যা কাম্য নয়।এমনিতেই দেখা যাচ্ছে, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক শেষ হচ্ছে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালই একমাত্র সংস্থা নয় যারা এ নির্বাচনকে ব্যাপক কারচুপির নির্বাচন বলেছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আরও অনেক সংস্থা অনুরূপ মূল্যায়ন করেছে। রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবতা সবারই জানা বিষয়। তাই কিছু লোক সেই বাস্তব ঘটনাকে চিৎকার দিয়ে বড় গলায় অস্বীকার করলেই তা অসত্য হয়ে যাবে না।নির্বাচন সম্পর্কে সমালোচনাকারীদের আওয়ামী লীগ নেতা ‘পাকিস্তানি দালাল’ বলার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কারণ বিষয়টি জনগণের ভোটের ব্যাপার, তাই জনগণের কাছে এটি গোপন থাকার মতো বিষয় নয়। যারা সহজেই বিদেশীদের দালাল হতে পারেন তাদের পক্ষে এরূপ ভাবা স্বাভাবিক যে, সরকারি কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সমালোচনা করলেই সে বিদেশী এজেন্ট। তারাই বলতে চাচ্ছেন, আমাদের দেশ বা আমাদের সরকার আমাদের নয়।
যদি পাকিস্তানি দালালদের নিন্দা জানানো হয় তবে ভারতের দালালদেরও নিন্দা জানাতে হবে। তবে এদেশের জনগণকে জানতে হবে কারা পাকিস্তানি দালাল এবং কারা ভারতের দালাল।জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব হচ্ছে বিদেশী দালালদের শনাক্ত করা, যারা দেশের ভেতরে থেকে গণবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছে। গণমুখী এবং স্বাধীনতার সপক্ষের কার্যক্রম দ্বারা প্রত্যেককেই তার দেশপ্রেমের প্রমাণ রাখতে হবে। কাউকে বিদেশের দালাল বলা রাজনৈতিক ইস্যু হতে পারে না, এটা বাংলাদেশবিরোধী জঘন্য অপরাধ এবং এ ব্যাপারে আইনানুযায়ী বিচারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর এটি হতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থে।
এটিও সত্য আমাদের একশ্রেণীর জ্ঞানসম্পন্ন লোকের স্বার্থপরতার কারণেই কিছু লোক পূর্বাপর চিন্তা না করেই যা খুশি তাই বলার সাহস পাচ্ছেন।দেশপ্রেমিক সবাই অতীত ভুল-ভ্রান্তিকে ভুলে যেতে চান বাংলাদেশের জনগণের ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে। আমি বিশ্বাস করি, কেউ কারও দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করার ঔদ্ধত্য দেখাতে পারেন না, যদি তিনি নিজে দেশপ্রেমিক হন।ব্যক্তি বিশেষের সব উক্তিকেই আমি গুরুত্ব সহকারে দেখি না।
কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না বাংলাদেশে এমন কিছু লোক আছেন যারা নিজেদের ভারতে থাকাকালীন বীরত্বের গল্প-কাহিনী শোনাতে গিয়ে এমন সব বক্তব্য রাখতেও দ্বিধাবোধ করেন না যাতে মনে হয় তাদের মতো কিছু লোক ভারত থেকে এসে বাংলাদেশ নিজেদের জন্য জয় করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা ও জনগণের সার্বভৌমত্বসবকিছুই তাদের মনগড়া ব্যাখ্যার ওপর নির্ভরশীল। যে দেশের মানুষ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তাদের অসহায় ভাবা হচ্ছে।
এ ধরনের অদ্ভুত চিন্তার লোকদের বুঝতে হবে দেশের অভ্যন্তরে থেকে যারা শত্রুর মোকাবেলা করেছে, জীবন দিয়েছে, তাদের দেশপ্রেমের ভিত্তি অনেকের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।৪৩ বছরের বেশি হল বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিপরীতে আমাদের জনজীবনে শান্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদাবোধ রক্ষার্থে নেতারা কতটা সফল, সে কথা বলুন। পুলিশি ক্ষমতার রাজনৈতিক অপব্যবহার করে রাজনীতির স্বার্থে মিথ্যা মামলা এবং গুমের আতংক সৃষ্টি মুক্তিযুদ্ধের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না। এটি সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোনো গৌরবের বিষয়ও নয়। ক্ষমতার দাপট দেখানো পাকিস্তান আমলের স্বৈরশাসকদের বৈশিষ্ট্য ছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য হতে হবে ভয়ভীতিমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। নিজেদের মধ্যে শত্রু খোঁজা নিজেদের মধ্যে অনৈক্যই সৃষ্টি করবে, সংঘাত-সংঘর্ষই বৃদ্ধি করবে।সুশীলসমাজকে ভয়ভীতির মধ্যে রাখলেই সরকারের ভুল-ভ্রান্তি শেষ হবে না। সুশীলসমাজ নীরব থাকলে মাস্তান চক্র তো বসে থাকবে না। দেশের সর্বত্র যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে তা তো অস্বীকার করা যাবে না। পুলিশি শাসন যে দেশ শাসন নয়- এতটুকু তো বুঝতে হবে। সবাই মিলে শান্তিতে থাকার চিন্তাভাবনাই হবে দায়িত্বশীল নেতৃত্বের পরিচয়।
অবশেষে যা বলতে চাই তা হল, দেশ শাসন করতে হলে শুধু নির্বাচন ঠেকালেই চলবে না। অভাবের তাড়নায় এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় দেশের শত শত নারী-পুরুষকে যে সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে তার দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।
পাশের দেশ থাইল্যান্ডে মুক্তিপণ দিতে না পারায় অসংখ্য বাংলাদেশীকে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়েছে, মেয়েদের ওপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে, সে ব্যাপারেও সরকারের জবাবদিহিতা থাকতে হবে। মানব পাচারকারীরা তো এদেশের লোকদের সহযোগিতায় এসব অমানবিক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার কাদের উন্নয়নের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে, তাও এদেশের অসহায় গরিব জনগণকে বুঝতে দিতে হবে।
====
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
Email:
বিষয়: বিবিধ
৮১৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন