মাঝ রাতের মাস্তানি!!
লিখেছেন লিখেছেন নয়ন কুষ্টিয়া ১২ নভেম্বর, ২০১৩, ০৩:০৩:০৪ দুপুর
১৯৯৭ সালের নভেম্বর মাস। হেমন্তের বাতাসে তখন একটু একটু শীতের আমেজ। রোদ ভালা লাগা শুরু হয়েছে। আমি আর আমার বন্ধুবর মহাত্মা মামুন-আর-রশীদ সেপ্টেম্বর মাস থেকে কলাবাগান মরম চাঁদের গলিতে এক বিশাল ব্যাচেলর বাড়ির বাসিন্দা। ধানমন্ডি শংকর আমাদের রুমমেট ছিল আইউব নেওয়াজ খান। তো নেওয়াজ বললো, আমি যেখানে থাকি সেখানে প্রতি মাসেই দুই-চার-পাঁচটা সিট খালি থাকে। আপনারাও উঠতে পারেন। বিশাল এপার্টমেন্ট। কোনো এক রহস্যময় কারণে সেই এপার্টমেন্ট গোটাটাই ব্যাচেলরদের ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নেওয়াজের পরামর্শ অনুযায়ী, আমরা গিয়ে দেখে মাথা গোজার জন্য নেওয়াজের পাশের রুমেই উঠে গেলাম। আমাদের রুমে আমি আর মামুন ছাড়াও আরো তিন আদমি। একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী, একজন মার্কেটিং অফিসার আর একজন এইচএসসি কোচিং করতে পটুয়াখালী থেকে ঢাকায় এসেছে।
আমি তখন এলিফ্যান্ট রোডে একটি নোটবই ও গাইড বই প্রকাশনায় তিন হাজার টাকার পার্টটাইম চাকরি ধরেছি। দুপুর দুইটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত আমার লিখতে হয়। আমার বিষয় ইকোনমিক্স হলেও আমি তখন ফিলোসফি, ইসলামের ইতিহাস, বাংলাদেশের রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও গণিতের উপর লেখালেখি করি। ত্রিশ দিনই আমার অফিস। কোনো ছুটি নেই। যেদিন চারঘণ্টার চাকরিতে না যাই, সেদিন বেতন থেকে ৬৭ টাকা কাটা যায়। মালিক শাহজাহান সাহেব খুব সুন্দর করে কথা বলেন। আমাদের ছুটি'র আগে আগে আমাদের জন্য পার হেট দুইটা করে গরম পুড়ি'র নাস্তা আসে। আমরা গরম গরম পুড়ি খেয়ে বাড়তি দশ পনেরো বা আধাঘণ্টা, যার হাতে যেমন কাজ অবশিষ্ট থাকে, তা শেষ করে মহা আনন্দে যার যার আস্তানায় বা আড্ডায় চলে যাই।
সন্ধ্যার পর আমরা তখন আড্ডা মারতাম সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে। অথবা সংসদের ঠিক পূর্বপাশে মনিপুরীপাড়ার মেইন রাস্তায় আমাদের তিন বন্ধুবর মহাত্মা ইফতেখার ডন, মোহাম্মদ রফিক ও শাহেদের যৌথ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাউন্ড এন্ড ভিশনে। সাউন্ড এন্ড ভিশনে তখন ঢাকার নানা ধরনের বিয়ের অনুষ্ঠানের ভিডিও এডিটিং হত। আমরা আড্ডা দিতে দিতে ডনের ভিডিও দেখতাম আর বিনা পয়সায় অন্য মানুষের সুন্দরী বউ দেখে অনেক রাত করে কলাবাগানের ব্যাচেলর বাসায় ফিরতাম।
বন্ধুবর মহাত্মা মামুন তখন এমআরসি মোড নামে একটি স্যোসিও ইকোনমিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো। আমিও কিছু দিন সেখানে কাজ করেছিলাম। কিন্তু লেখালেখি'র কাজটা পাওয়ায় আর আমার বিসিএস পরীক্ষা থাকায় আমি আর মামুনের সঙ্গে নতুন প্রজেক্টে গেলাম না। তো মামুন রংপুরে প্রায় একুশ দিন গবেষণার কাজ শেষে ঢাকায় আসলো। পরদিন মামুন বেতন পাবে। আমরা কোথাও একটা ভুড়িভোজ দেব এই হল পরিকল্পনা। সন্ধ্যায় আমি, মামুন আর বন্ধুবর মহাত্মা শ্যামল মিত্র আর বন্ধুবর মহাত্মা প্রকাশ মন্ডল সংসদের ঠিক দক্ষিণ-পূর্ব কোনে ঘরোয়ায় বিশাল এক ভুড়িভোজ দিলাম নানরুটি আর গরম গরম মাংস দিয়ে। মিষ্টিও খেয়েছিলাম হয়তো। মামুনের সঙ্গে কোন কোন মেয়ে সেবার রিসার্সে গিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে মামুনের কাছ থেকে খোঁজখবর নিলাম আমরা। শুনলাম, মামুনের সঙ্গে নতুন একটা মেয়ের বেশ খাতির হয়েছে। মেয়ের বাবা জাপান থাকে। মামুনকে খুব পছন্দ করে সেই মেয়ে। মামুন নাকি রাত জেগে জেগে সেই মেয়ের কোশ্চেন পেপার চেক করে দিয়েছে। তো আমরা মামুনের কাছে আবদার করলাম, ওই মেয়েকে একদিন আমাদের দ্যাখা? আমরা সায় দিলে মামুন প্রেম চালিয়ে যাবে। সেদিন আমরা প্রায় রাত এগারোটা পর্যন্ত সংসদ চত্বরে আড্ডা দিলাম।
শ্যামল ভূতের গলি'র বাসায় গেল। প্রকাশ ইন্দিরা রোডের বাসায় গেল। মামুন আর আমি কলাবাগান ব্যাচেলর হাউজে ফিরে আসলাম। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে আমাকে আড্ডার বাইরে দেশ বিদেশের নানান খবরেও নাক গলাতে হয়। টুকটাক নোট টুকতে হয়। নেওয়াজের ছিল একটি পকেট রেডিও। বাসায় ফিরে নেওয়াজ আর আমি ছাদে গিয়ে রেডিও শুনতাম। নেওয়াজেরও আন্তর্জাতিক খবরের প্রতি খুব নেশা ছিল। পরে আমরা সেসব সংবাদ ডিটেইল আলোচনা করতাম। তো ছাদ থেকে নামতে নামতে আমাদের রাত একটা দুইটা বাজতো। ছাদে বেশি সময় ধরে থাকার আরেকটা কারণ ছিল। নেওয়াজ একদিন আবিস্কার করলো যে, বিপরীত পাশের একটা বাসায় নব দম্পতি ভালোবাসা বিনিময় করে। আর তা করার সময় তাদের জানালার পর্দা ঠিক ঠাক থাকে না। ফলে বিনে পয়সায় গরম মুভি দেখার মত একটা ব্যাপার আরকি!!
তো সেদিন আমরা রাত দেড়টা নাগাদ রুমে ফিরলাম। দেখি, মামুন কি যেনো লেখালেখি করছে। বললো, অফিসে ফিল্ড রিপোর্ট জমা দিতে হবে। তাই লিখছি। তোর ঘুম আসলে ঘুমা। আমি বিছানা ঠিকঠাক করছি, এমন সময় একটা ছেলে আমাদের জানালায় নক করলো। জানতে চাইলো, এখানে মামুন থাকে কিনা? মামুন সেদিকে তাকিয়ে বললো, আমি-ই মামুন? কে খুঁজছে আমাকে? ছেলেটি বললো, এক বড় ভাই আপনার সঙ্গে কথা বলবে, একটু বাইরে আসেন। আমরা সাত তলা বিল্ডিংয়ের পঞ্চম তলার বাসিন্দা। তো মামুন দরজা খুলে বাইরে গেল। মামুনের আসতে একটু দেরি দেখে আমিও বের হলাম। গিয়ে দেখি, বিশ বাঁইশ জনের একটা জটলা। কিসের জটলা?
মহল্লার পোলাপাইন এসে আবদার করেছে, মামুনের ব্যাগের মধ্যে নাকি আমাদের রুমের যে মার্কেটিং অফিসার ছেলেটি থাকে, তার গার্ল ফ্রেইন্ডের ছবি লুকানো আছে। ওই ছেলেটি সেরাতে আসেনি। সন্ধ্যায় নাকি তারা একবার মামুনকে খুঁজতে এসেছিল। না পেয়ে আরো কয়েকবার এসেছিল। এখন মামুনের ব্যাগ তারা চেক করবে। মার্কেটিং অফিসার আর মামুন সেদিন সকালে একসঙ্গে বের হয়ে মরম চাঁদে নাস্তা খেয়েছিল। সঙ্গে ছেলেটির কথিত একজন গার্ল ফ্রেইন্ডও ছিল। সে উপরে এসে ছেলেটিকে নিয়ে নেমেছিল। মামুন বেশি খাতির দেখিয়ে তাদের নাস্তা অফার করেছিল। রুমমেটের গার্লফ্রেইন্ড বলে কথা!!
তো পোলাপানদের দাবী, ওই ছেলেটি খুব খারাপ। এরকম অনেক মেয়ের সঙ্গেই তার খাতির হয়। চেহারা সুরত ভালো। সেটাই খাতিরের প্রধান কারণ। কিন্তু এবার যে মেয়েটির সঙ্গে ছেলেটি প্রতারণা করেছে, সে নাকি মহল্লার মেয়ে। ছেলেটি কি সে কারণে সেদিন লুকিয়ে ছিল?
মামুন পোলাপাইনদের সরাসরি বললো, তার ব্যাগে ওই ছেলের কোনো গার্ল ফ্রেইন্ডের ছবি থাকার প্রশ্নই ওঠে না। মামুনের একটা পারসোনাল অ্যালব্যাম আছে ব্যাগে। সেখানে মামুনের খালাতো বোনের ছবি আছে। তবুও পোলাপাইন গুলো মামুনের ব্যাগ চেক করতে চাইলো। মামুন রাজী না। এক পর্যায়ে সেই বড় ভাই হুমকি দিলেন, ব্যাগ তাদের দেখাতেই হবে। অগত্যা মামুন তাদের নিয়ে রুমে ঢুকলো। মামুনের ব্যাগ তালা মারা ছিল। মামুন বললো, আপনারা বসেন, আমি আমার অ্যালবাম দেখাচ্ছি। মামুন তালা খুলে অ্যালবাম বের করলো। ছবি দেখালো। পোলাপাইন গুলো মামুনের খালাতো বোনের ছবি খুব ভালো করে দেখলো।
একজন বললো, অ্যালবামের বাইরে হয়তো সেই ছবি লুকিয়ে রাখা আছে। আমরা গোটা ব্যাগই চেক করতে চাই। তখন পরিস্থিতি মামুনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। একজন ব্যাগ ছিনিয়ে নিল। ভেতরে মামুনের জামাকাপড়। জামাকাপড়ের ভেতরে একটা খাম। খামের ভেতরে মামুনের সদ্য বেতন পাওয়া চৌদ্দ হাজার টাকা। একটা ছেলে সেই খামটি পকেটে ঢুকালো। আমি বাধা দিলাম। আরেকটি ছেলে আমাকে জাপটে ধরলো। আরেকটি ছেলে ঘোষণা দিল, ছবি পাওয়া গেছে।
মামুন বললো, ওই খামে আমার বেতনের পুরো টাকা। আমি এখনো বাসা ভাড়া দেই নি। মেসে খাবারের টাকা দেইনি। ওটা নিয়ে আমাকে বিপদে ফেলবেন না। আমি বললাম, ওই খাম চেক করেন? যদি ওখানে টাকার বাইরে কোনো ছবি থাকে তো ছবি নিয়ে যান। ওরা খাম খুললো। সব পাঁচশো টাকার নোট। মামুনের দিকে তখন তাকানো যায় না। আমি বললাম, এই টাকা আপনারা নিতে পারেন না।
ইতোমধ্যে আশে পাশের রুম থেকে সবাই বের হয়েছে। তাদের আমি বললাম, ওরা মামুনের টাকা নিয়ে যাচ্ছে। অনেকে আমার সঙ্গে ওদের বাধা দিতে তখন প্রায় প্রস্তুত। একটা ছেলে খপ করে আমার গেঞ্জি'র কলার ধরলো। আমার মাথায় পিস্তল ঠিকিয়ে বললো, এক্কেরে পচা পুশকুন্নিতে পাঠাই দিমু। আমি কইলাম, কলাবাগান কোনো পচা পুশকুন্নি নাই। ছেলেটি জবাবে বললো, তোর টাকা? তুই কেন মরতে আইছোস?
মামুন আমাকে টেনে ছাড়ালো। তখন কথিত সেই বড় ভাই নেওয়াজকে ডেকে বললো, তোমার কাছে সাদা কাগজ আছে? নেওয়াজ বললো, আছে, ক্যান? বড় ভাই বললো, তোমার রুম কোনটা? চল তোমার রুমে?
মামুন, নেওয়াজ, বড় ভাই আর তার চ্যালাচামচা নেওয়াজের রুমে ঢুকলো। আমি বললাম, আমাকে একটু বাথরুমে যেতে হবে। একটা ছেলে আমার সঙ্গে বাথরুমে আসলো। সে দরজার বাইরে পিস্তল উচিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো। আমার আসলে তখন কোনো হিসি পায় নাই। আমি একটা ফাঁক খুঁজতেছিলাম। বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে জল ছিটালাম। কি করা যায় ভাবছি। আয়নায় নিজের চেহারা বারবার দেখলাম। ছেলেটি বাথরুমের লাইট বাহির থেকে অফ করে দিয়ে একটা সংকেত পাঠালো। আর কইলো, হারামির পোলা, মুততে এতোক্ষণ লাগে? বাইর হ?
আমি হাফপ্যান্টের চেইন আটকানোর ভান করতে করতে দরজা খুলে বাইরে আসলাম। আমাকে নিয়ে ছেলেটি নেওয়াজের রুমে ঢুকলো। সাদা কাগজে লেখা হয়েছে- কথিত আক্কাস ভাই মামুনের কাছে দশ হাজার টাকা পেত। সেই পাওনা টাকা আক্কাসের প্রেরিত লোকের কাছে বুঝিয়ে দিলাম। নিচে মামুনকে তখন স্বাক্ষর করতে বললো। মামুন নেওয়াজের হাত থেকে কলম নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে স্বাক্ষর করলো। বড় ভাই খাম খুলে টাকা গুনলেন। পাঁচশো টাকার কুঁড়িটি নোট নিজের কাছে রেখে বাকি টাকা না গুনেই মামুনের হাতে দিল। তারপর যেতে যেতে বললো, মামুন ভাই, আপনার কোনো সমস্যা হলে, আমাকে গলিতে পাবেন। আপনার কোনো সমস্যা হলে আমরা দেখবো। আমরা সিড়িতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ছেলেগুলো পিস্তল উচিয়ে নেমে যাচ্ছে। একেবারে নিচতলার গেইট থেকে একে একে বের হল ঊনিশ জন। উল্টোপাশের একটা নির্মাণাধীন ভবে ঢুকতে ঢুকতে তারা বেশ খোশ মেজাজ দেখালো। সে রাতেই আমরা ওই বাসা ছেড়ে দেবার নোটিশ করলাম...
বিষয়: বিবিধ
১০২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন