ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জওয়ানের মৃত্যুদন্ড
লিখেছেন লিখেছেন নয়ন কুষ্টিয়া ০৬ নভেম্বর, ২০১৩, ০২:১৩:০৭ দুপুর
পিন্টুসহ ১৬২ জনের যাবজ্জীবন
# ২৫৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ॥ খালাস ২৭১
# রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আসামীদের নির্দোষ দাবি করে চিৎকার
# রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট ॥ গোঁজামিল বলছে আসামীপক্ষ
# বিচারকের পর্যবেক্ষণ : ‘অপারেশন ডাল-ভাত’ একটি বড় কারণ
তোফাজ্জল হোসেন কামাল : ২১৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্থা সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীখ্যাত বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সদর দফতর পিলখানায় চার বছর আট মাস আগে কথিত দাবি-দাওয়ার আড়ালে যে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল গতকাল মঙ্গলবার তার আইনী সমাধান আপাতত শেষ হয়েছে। সে সময় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে তৎকালীন ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ আসামীর বিরুদ্বে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। এ মামলার ৮৪৬ জন জীবিত আসামীর মধ্যে বিএনপি নেতা সাবেক এমপি নাসির উদ্দিন পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬১ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে। বাকি ২৫৬ জনকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ- দিয়েছেন ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ড. আখতারুজ্জামান। গতকাল মঙ্গলবার ২৩২ কার্যদিবস পর ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদরাসা মাঠে হত্যা মামলার বিচারে গঠিত বিশেষ জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে বহুল আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন তিনি। এই রায় ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্বের ইতিহাসে কোন মামলায় এক সাথে এত ব্যক্তির ফাঁসির আদেশ দেয়ার ঘটনা ঘটলো। ফলে এটি গিনেজ বুক ওয়ার্ল্ডে রেকর্ড করার তালিকায় স্থান করে নিবে। রায় ঘোষণা উপলক্ষে বিশেষ আদালত ঘিরে নেয়া হয় চার স্তরের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সকাল ১০টায় আদালতের বিচারকার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিচারক এজলাসে হাজির হওয়ার পর আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়।
রায় ঘোষণার সময় একাধিকবার বিচারককে থামতে হয়েছে। দ-প্রাপ্তরা কখনও চিৎকার করে বলেছেন তারা নির্দোষ, কখনও তারা বিচারকের কাছে কিছু বলার সুযোগ চেয়েছেন। কেউ কেউ ক্ষোভে চিৎকার করতে থাকলে বিচারক রায় ঘোষণা থামিয়ে পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কাউকে আবার উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে দেখা গেছে। প্রিজনভ্যানে তোলার সময় দ-প্রাপ্তদের কেউ কেউ সাংবাদিকদের বিষোদ্গারও করেছেন, নিজেদের পরিণতির জন্য দায়ী করেছেন সাংবাদিকদের।
রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের বলেন, হত্যাকা-ে জড়িত থাকার দায়ে আদালত ১৫২ জনকে মৃত্যুদ- দিয়েছে। আসামীপক্ষের আইনজীবী শামীম সরদার জানিয়েছেন, তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
এ মামলার ৮৫০ জন আসামীর মধ্যে কারাগারে থাকা ৮১৩ জনকে গতকাল সকালেই আদালতে নিয়ে আসা হয়। জামিনে থাকা ১৩ আসামীর মধ্যে দশজনও আদালতে উপস্থিত হন। মামলায় ২০ জন আসামী পলাতক রয়েছেন। বিচার চলার সময়ে ডিএডি রহিমসহ চার আসামীর মৃত্যু হয়। গতকাল ৮৪৬ জন আসামীর ব্যাপারে রায় ঘোষণা করা হয় ।
আদালত পিন্টু ও তোরাব আলীকে যাবজ্জীবন কারাদ- ও পাঁচ লাখ টাকা করে প্রত্যেককে জরিমানা করেন; অনাদায়ে আরও পাঁচ বছরের কারাদ-ের আদেশ দেন। ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের পাশাপাশি প্রত্যেককে অবৈধভাবে অস্ত্র লুণ্ঠনের দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদ- দেন আদালত। ২৫৬ জনের মধ্যে ২০৭ জনকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- ও পাঁচ হাজার টাকা করে প্রত্যেকের জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে তাদের আরেকটি অভিযোগে আরও তিন বছরের সাজা দেয়া হয়। এ নিয়ে মোট ১৩ বছর কারাভোগ করতে হবে। বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়।
আসামীদের ডা-াবেরি পরানো অবস্থায় আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশ, এপিবিএন, র্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা চারদিক দিয়ে আদালত এলাকা ঘিরে রাখেন। বকশিবাজার ও উর্দু রোড দিয়ে প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নামে পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে ঘটেছিল এক নারকীয় হত্যাকা-। এ ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। বিচারের মুখোমুখী হয়েছেন বিডিআর জওয়ানসহ ৮৫০ জন। আসামীর সংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা।
পিন্টু-তোরাবসহ ১৬১ জনের যাবজ্জীবন
পিলখানা হত্যাকা-ের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় বিএনপির নেতা সাবেক এমপি নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলীসহ ১৬১ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে। আদালত পিন্টু ও তোরাবকে যাবজ্জীবন কারাদ- ও পাঁচ লাখ টাকা করে প্রত্যেককে জরিমানা অনাদায়ে আরও পাঁচ বছরের কারাদ-ের আদেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া পিন্টু, তোরাবসহ ১৬১ জনের প্রত্যেককে অবৈধভাবে অস্ত্র লুণ্ঠনের দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদ- দেন আদালত।
রায় ঘোষণার পর আসামীরা এজলাসে চিৎকার শুরু করেন। কেউ বলেন, ‘আল্লাহর দরবারে বিচার হবে।’ আবার কেউ বলেন, ‘এ দেশে কোনো বিচার নাই।’ এ সময় আসামীপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম মাইক্রোফোনে এই ১৬১ জনের উদ্দেশে অনুরোধ করে বলেন, ‘আপনারা কেউ কথা বলবেন না। আমি আপনাদের হয়ে লড়েছি। আপনাদের ওপর আমার অধিকার আছে। এরপর আরও আদালত আছে। আমরা সেখানে আপিল করব। দয়া করে কেউ কথা বলবেন না।’ কিন্তু তার কথা কানে না তুলে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে চিৎকার করতে থাকেন।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে নিহত ১০ সেনা কর্মকর্তা কর্নেল মুজিব, কর্নেল আনিস, কর্নেল শামসুল আরেফিন, কর্নেল কাজী এমদাদুল হক, লে. কর্নেল ইমসাদ ইবনে আমিন, লে. কর্নেল শামসুল আজম, লে. কর্নেল আবু মুসা মোঃ আইয়ূব কায়সার, মেজর মোসাদ্দেক ও মেজর সালেহর পরিবারের সদস্যরা আদালতে উপস্থিত হন। তবে আসামী জওয়ানদের স্বজনদের আদালত চত্বরে দেখা যায়নি।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল সুসজ্জিত দরবার হল থেকে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক শাকিল আহমেদের বক্তব্যের সময় দু’জন সিপাহী অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন। এরপর জওয়ানেরা দু’দিন ধরে বিডিআর মহাপরিচালকসহ ৭৪ জনকে হত্যা করেন। কর্মকর্তাদের বাড়িঘরে লুটপাট ও ভাঙচুর চালান। সরকারি নথিপত্রেও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। বিদ্রোহ শুরুর ৩৩ ঘণ্টা পর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান হয়।
এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবোজ্যোতি খীসা একটি হত্যা মামলা করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ মামলাটি তদন্ত করেন। তাকে সহযোগিতা করেন ২০০ কর্মকর্তা। ৫০০ দিন তদন্তের পর ২০১০ সালের ১২ জুলাই এ আদালতে হত্যা এবং অস্ত্র-বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে দু’টি অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। এতে ৮২৪ জনকে আসামী করা হয়। পরে অধিকতর তদন্তে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে বর্ধিত অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সব মিলে আসামীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫০ জন। এর মধ্যে বিচার চলার সময় চারজন মারা যান।
এই মামলায় নথির সংখ্যা ৮৭ হাজার পৃষ্ঠা। আসামীদের মধ্যে বিডিআর জওয়ান ৭৮২ ও বেসামরিক সদস্য ২৩ জন। এর মধ্যে ২০ জন এখনো পলাতক, জামিনে আছেন ১৩ জন।
২০১১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মামলার বিচার শুরু হয়। চার বছর আট মাসে মামলাটি ২৩২ কার্যদিবস অতিক্রম করে। গতকাল রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ মামলার সব কার্যক্রম।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আসামীদের চিৎকার
যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় ঘোষণার পর এজলাসে চিৎকার শুরু করেন আসামীরা। কেউ বলেন, ‘আল্লাহর দরবারে বিচার হবে।’ আবার কেউ বলেন, ‘এ দেশে কোনো বিচার নাই।’
এ সময় আসামীপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম মাইক্রোফোনে এই ১৬১ জনের উদ্দেশে অনুরোধ করে বলেন, ‘আপনারা কেউ কথা বলবেন না। আমি আপনাদের হয়ে লড়েছি। আপনাদের ওপর আমার অধিকার আছে। এর পর আরও আদালত আছে। আমরা সেখানে আপিল করব। দয়া করে কেউ কথা বলবেন না।’ কিন্তু তার কথা কানে না তুলে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে চিৎকার করতে থাকেন।
নিরাপত্তাবলয়
রায় ঘোষণার জন্য সকাল থেকে আদালতের প্রস্তুতি শুরু হয়। আসামীদের ডা-াবেড়ি পরানো অবস্থায় আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশ, এপিবিএন, র্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা চারদিক দিয়ে আদালত এলাকা ঘিরে রাখেন। বকশিবাজার ও উর্দু রোড দিয়ে প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়া হয়।
২৭১ জনের উল্লাস ‘খালাস পেয়েছি, খালাস’
পিলখানা হত্যাকা-ের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় ২৭১ জন বেকসুর খালাস পেয়েছেন। রায় ঘোষণার পরপরই বেকসুর খালাস পাওয়া ২৭১ জন আদালতের ভেতরে উল্লাস প্রকাশ করেন। তারা আঙুল উঁচিয়ে বিজয়সূচক চিহ্ন দেখান। পরে তাদের গাড়িতে করে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদেরই একজন মোস্তফা কামাল। তিনি ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের সময় ল্যান্স নায়েক ছিলেন। তার বাড়ি কুমিল্লায়। রায় জানতে সকালবেলা তার স্ত্রী পারভীন আকতার বড় ছেলে ফয়সালকে নিয়ে পুরান ঢাকার বকশিবাজারের আলিয়া মাদরাসার পাশে উপস্থিত হন।
স্বামী খালাস পাওয়ায় কিছুটা খুশি হয়ে পারভীন আকতার বলেন, ‘আমার বিশ্বাস ছিল আমার স্বামী নির্দোষ। এর বিচার আজ পেয়েছি। খালাস পাওয়ার বিষয়টি আইনজীবীর মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।’
পারভীন আকতার দাবি করেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহের দিন সকালবেলা আমার স্বামী তার শোবার ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু সাক্ষী দিতে হবে অথবা আসামী হতে হবে তাকে এমন দুইটা বিকল্প দেয়া হয়েছিল। সাক্ষী দেননি বলে, তাকে আসামী করা হয়।’
পারভীন আরও জানান, দীর্ঘ চারটি বছর তাদের পুরো পরিবারকে মানসিক ও আর্থিকভাবে প্রচ- কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। নানা ধরনের কথা শুনতে হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের সাহায্যে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ ও সংসার চলেছে।
নিজেদের আইনজীবীর কাছ থেকে রায়ের খবর জানতে পারলেও পারভীন আক্তার পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছেন বিকাল সোয়া চারটার দিকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে মোস্তফা কামালসহ আরও কয়েকজনকে বহনকারী প্রিজনভ্যানটি থামার পরই আনন্দের এই সংবাদটি পান তিনি। এ সময় প্রিজনভ্যানের ভেতর থেকে চিৎকার করে মোস্তফা কামাল তার স্ত্রী ও ছেলেকে বলেন, ‘খালাস পেয়েছি, খালাস।’
রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট, গোঁজামিল
বলছে আসামীপক্ষ
বিডিআর বিদ্রোহের মামলার রায়ে বাহিনী কলঙ্কমুক্ত হয়েছে বলে মনে করছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক। রাষ্ট্রপক্ষও এতে সন্তুষ্ট। তবে আসামীপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, রায়ে গোঁজামিল দেয়া হয়েছে। নিচে তাদের প্রতিক্রিয়া বিস্তারিত তুলে ধরা হলো :
কলঙ্কের তিলক উঠে গেছে
বিজিবির মহাপরিচালক
বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘বাহিনীর ওপর কলঙ্কের তিলক ছিল। এ রায়ের মাধ্যমে সেটা উঠে গেল। রায় দেখে আমি বাহিনীর প্রধান হিসেবে অত্যন্ত খুশি। বিদ্রোহের সময় যারা মারা গেছেন, এ রায়ে তাদের আত্মা শান্তি পাবে। রায়ের মাধ্যমে মামলা থেকে যারা খালাস পেয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা না থাকলে তারা চাকরি ফেরত পাবেন।’
আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে যে বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন, সেগুলোর মধ্যে বাহিনীর জন্য প্রযোজ্য বিষয়গুলো তারা বিবেচনা করবেন।
২৭১ জন আসামীর খালাসের বিষয়ে জানতে চাইলে আজিজ আহমেদ বলেন, এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা ব্যবস্থা নেবেন।
মামলার রায়ে আমরা সন্তুষ্ট : রাষ্ট্রপক্ষ
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেছেন, মামলার রায়ে তারা সন্তুষ্ট। এ রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রায়ে ২৭১ জন খালাস পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, খালাস পাওয়ার ব্যাপারটা খতিয়ে দেখে তারা আপিল করবেন।
এটা গোঁজামিলের রায় : আসামীপক্ষের আইনজীবীরা
সবচেয়ে বেশি আসামীর আইনজীবী আমিনুল ইসলাম, ফারুক আহমেদ ও শামীম সরদার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, এটা একটা গোঁজামিলের রায়। এ রায়ে তারা সংক্ষুব্ধ। তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। যাদের খালাস দেয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল, সেসব অভিযোগ ফাঁসির আদেশ পাওয়া অনেক আসামীর বিরুদ্ধেও ছিল না। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মাত্র সাক্ষ্য দিয়েছেন একজন।
‘পিন্টু রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার’
বিএনপির নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুর আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘পিন্টু রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হয়েছেন। তিনি যাবজ্জীবন কারাদ- হওয়ার মতো কোনো অপরাধে জড়িত ছিলেন না। তার বিরোধী পক্ষের একজনকে (স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী) শাস্তি দেয়ার ঘটনাকে ব্যালান্স করার জন্য পিন্টুকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। আমরা সংক্ষুব্ধ। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। এটা একটা প্রহসনের বিচার হয়েছে।’
মামলার সারসংক্ষেপ
পিলখানার ঘটনায় তিন মামলা : ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। বিদ্রোহের মামলার আসামী ছয় হাজার ৪৬ জন। হত্যা মামলার আসামী ৮৫০ জন। বিস্ফোরক দ্রব্য মামলার আসামী ৭৮৭ জন।
লাশ উদ্ধার : হাসপাতালের হিমঘর থেকে নয়টি, গণকবর থেকে ৪৮টি, ডিজির বাংলো থেকে দুটি ও অন্যান্য জায়গা থেকে বাকি লাশগুলো উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহত ৭৪ জনের মধ্যে সেনা কর্মকর্তা ছিলেন ৫৭ জন ও বিডিআর সদস্য ছিলেন ১০ জন। দরবার হল ও আশপাশে হত্যা করা হয় ৪৫ জনকে।
পিলখানা হত্যাকা-ের দিনের চিত্র : পিলখানার মোট আয়তন চার বর্গকিলোমিটার। ঘটনার সময় পুরো পিলখানায় বিডিআরের সদস্য ছিলেন ছয় হাজার ৯০৩ জন। দরবার হলে ৯৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ বিডিআরের মোট দুই হাজার ৪৮৩ জন উপস্থিত ছিলেন।
এ ঘটনায় দুই হাজার ৪১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলী করা হয়েছিল। এর মধ্যে এক হাজার ৮৪৫টি রাইফেল, ৫২৮টি সাব মেশিন গান, ২৩টি পিস্তল ও ১৮টি এলএমজি।
ফিরে দেখা পিলখানা হত্যাকা-
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নামে পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে ঘটেছিল এক নারকীয় হত্যাকা-। এ ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। বিচারের মুখোমুখি করা হয় ৮৫০ বিডিআর জওয়ানকে। আসামীর সংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল সুসজ্জিত দরবার হল থেকে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক শাকিল আহমেদের বক্তব্যের সময় দুজন সিপাহী অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন। এরপর জওয়ানেরা দু’দিন ধরে বিডিআর মহাপরিচালকসহ ৭৪ জনকে হত্যা করেন। কর্মকর্তাদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও ভাংচুর চালান। সরকারি নথিপত্রেও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। বিদ্রোহ শুরুর ৩৩ ঘণ্টা পর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান হয়।
এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবোজ্যোতি খীসা একটি হত্যা মামলা করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ মামলাটি তদন্ত করেন। তাকে সহযোগিতা করেন ২০০ কর্মকর্তা। ৫০০ দিন তদন্তের পর ২০১০ সালের ১২ জুলাই এ আদালতে হত্যা এবং অস্ত্র বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। এতে ৮২৪ জনকে আসামী করা হয়। পরে অধিকতর তদন্তে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে বর্ধিত অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সব মিলে আসামীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫০।
এই মামলায় নথির সংখ্যা ৮৭ হাজার পৃষ্ঠা। আসামীদের মধ্যে বিডিআর জওয়ান আছেন ৭৮২, বেসামরিক সদস্য ২৩ জন। এর মধ্যে ২০ জন এখনো পলাতক। বিচার চলার সময় চারজন মারা গেছেন, জামিনে আছেন ১৩ জন। জামিনে থাকা ১৩ জনের মধ্যে ১০ জন আজ আদালতে হাজির হন। বাকি তিনজন জোহরা খাতুন, আব্দুস সালাম ও লোনা আক্তার হাজির হতে পারেননি।
২০১১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মামলার বিচার শুরু হয়। চার বছর আট মাসে মামলাটি ২৩২ কার্যদিবস অতিক্রম করে। গতকাল রায় ঘোষণার মধ্যে শেষ হলো এ মামলার সব কার্যক্রম।
বিচারকের পর্যবেক্ষণ
‘অপারেশন ডাল-ভাত’ একটি বড় কারণ
পিলখানা হত্যাকা-ের ঘটনায় তৎকালীন বিডিআরের ‘অপারেশন ডাল-ভাত’ কর্মসূচিসহ বেশ কয়েকটি বিষয়কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন আদালত।
ঘটনার ব্যাপারে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, অপারেশন ডাল-ভাত কর্মসূচি একটি বড় কারণ। কোনো শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী যেমন সেনাবাহিনী বা আধা-সামরিক বাহিনী বা সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে অপারেশন ডাল-ভাতের মতো কাজে যুক্ত রাখা উচিত নয়।
পিলখানার ভেতরে স্কুলগুলোতে বিডিআর জওয়ানদের সন্তানদের ভর্তি করতে পারার বিষয়ে আরও ছাড় দেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে আরও স্কুল তৈরি করা যায় কি না, তা কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা উচিত।
সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মতো বিডিআর সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠানো যায় কি না, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ভেবে দেখতে পারেন।
এছাড়া সেনা সদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে বিডিআর সদস্যরা দেশের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত আছেন। এ জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো ২০ শতাংশ ভাতা তাদের পাওয়া উচিত। তাদের ঝুঁকি ভাতা দেয়া যায় কি না, তাও দেখা উচিত।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক আরও বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের কারণ হিসেবে সামরিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত কারণ থাকতে পারে; যাতে আমাদের সেনাবাহিনীর মনোবল নষ্ট করা যায়। কূটনৈতিক কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বহির্বিশ্বে আমাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীকে উচ্ছৃঙ্খল দেখানো, যাতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এ ছাড়া অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দেশে গ-গোল থাকলে বাহিনীর মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা থাকবে। এতে বিনিয়োগ হবে না। অর্থনৈতিক মেরুদ- দুর্বল করার জন্য হতে পারে। সামাজিক কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীকে নিরুৎসাহিত করার জন্য।
আদালত তার পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, আমাকে রায় দিতে হবে। আমার বিবেচনায় যা মনে হয়েছে তাই দিয়েছি। আসামীরা উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন।
এ মামলার শুনানিতে বিজিবির সিকিউরিটি ইউনিটের মেজর আরএমএম আসাদ-উদ-দৌলা আদালতকে জানান, বিদ্রোহ শুরুর চারদিন আগে (২১ ফেব্রুয়ারি) বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও ডাল-ভাত কর্মসূচি নিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ সংবলিত একটি প্রচারপত্র পিলখানায় পাওয়া যায়।
আসাদ তার জবানবন্দিতে বলেন, “২৫ ফেব্রুয়ারি দরবার শুরুর পর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ ডাল-ভাত কর্মসূচি নিয়ে বক্তব্য দেয়ার সময় সৈনিক মইন মঞ্চে উঠলে হৈ চৈ শুরু হয়। এ সময় গুলীর শব্দ শোনা যায়।” রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ অন্তত ৭৪ জন নিহত হন।
রায়ের বাস্তবায়ন দেখতে
চায় নিহতদের পরিবার
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নামে পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে নৃশংস হত্যাকা-ে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের দাবি এখন রায় বাস্তবায়ন। তারা এই হত্যাকা-ের পেছনের কারণ জানতে চান। পরিবারের সদস্যরা রায়ের পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এসব দাবির কথা বারবার উচ্চারণ করেন। সেদিনের নৃশংসতায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান।
পিলখানায় নিহত কর্নেল মুজিবুল হকের স্ত্রী নেহরীন ফেরদৌসি বলেন, ‘আমরা এ রায়ের দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চাই। রাষ্ট্রের কাজ রাষ্ট্র করেছে। আমরা আজ সেই বিচারের রায় দেখতে এসেছি। প্রতিক্রিয়া এমন কিছু নেই। আমাদের সবার চাওয়া, যেন দ্রুত রায় কার্যকর হয় এবং দোষীরা যাতে শাস্তি পায়।’
এ রায়ে আপনি সন্তুষ্ট কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নেহরীন ফেরদৌসি বলেন, ‘এখনো এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। এ রায় কার্যকর করার ব্যাপার আছে। কোনো কারণে রায় যদি কার্যকর না হয়, সেজন্য আমরা আগে থেকে সন্তুষ্টির কথা বলতে পারছি না।’
নিহত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এনশাদ ইবনে আমিনের স্ত্রী রাজিনা মতিন বলেন, ‘আমরা এত দিন এ রায়ের জন্য অপেক্ষা করেছি। দরকার হলে আরও অপেক্ষা করব। তার পরও এর কার্যকরিতা দেখে যেতে চাই।’
মেজর মোহাম্মদ সালেহর স্ত্রী নাসরিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা পেছনের ঘটনাটি জানতে চাই। কারা, কিভাবে এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে, আমরা সে বিষয়ে এখনো কিছুই জানি না। আমাদের পেছনের কারণ জানাতে হবে।’
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু মুছা মোঃ আইয়ুব কায়সারের স্ত্রী মুশরাত জাহান বলেন, ‘অতি দ্রুত ভালো একটা সমাধান চাই। এ রায় যাতে দ্রুত কার্যকর হয় সেজন্য আমরা অপেক্ষা করব।’
কর্নেল সামসুল আরেফিনের স্ত্রী হাসিনা মমতাজ বলেন, ‘রায় যদি কার্যকর না হয়, তাই রায় নিয়ে আগাম কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে চাই না। কেননা রায় যদি কার্যকর না হয় তাহলে আমাদের আক্ষেপের আর শেষ থাকবে না। রায় যথাসময়ে কার্যকর করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
‘আপিল হবে’
পিলখানা হত্যা মামলায় দেড়শ’র বেশি আসামীর মৃত্যুদ-াদেশ আসার পর আপিল করার কথা জানিয়েছেন আসামীপক্ষের আইনজীবীরা। তারা বলছেন, এই রায়ে ন্যায়বিচার হয়নি।
রায়ের পর আসামীপক্ষের আইনজীবী শামীম সরদার বলেন, এই রায়ে ১৫২ জনের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। তাদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় শামীম সরদার বলেন, “আমরা মনে করি, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব।”
আসামীপক্ষের আরেক আইনজীবী এসএম রিফাজ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “ন্যায় বিচার পাইনি। আমার ক্লায়েন্টের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও প্রমাণ করতে পারেনি। তবু তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আপিলে যাব।”
এ মামলায় সিপাহী এরশাদের পক্ষে শুনানি করেন রিফাজ উদ্দিন।
মৃত্যুদ- পাওয়া আরেক আসামী সিপাহী খায়রুল আলমের আইনজীবী আতাউর রহমান রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন।
খালাসে উল্লাস, সাজায় ক্ষোভ-কান্না
রায়ের পর একদিকে যেমন দেখা গেছে কারো কারো খালাসের আনন্দ, অন্যদিকে দ-িত হয়ে ক্ষোভের প্রকাশ। চার বছর আগে সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা করা হয় গতকাল মঙ্গলবার।
সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একে একে আনা হয় ৮১৩ জন আসামীকে। বিশাল এই বিচারকাজের এজলাস কক্ষও ছিল কিছুটা ভিন্ন ধরনের। সাধারণ অন্য বিচারে আসামীদের জন্য ছোট একটি কাঠগড়া থাকলেও এই এজলাস কক্ষের বড় অংশজুড়েই ছিল আসামীদের বসার জায়গা।
ওই কাঠগড়া আবার তিনভাগে বিভক্ত। পেছনের দিকে বড় অংশে আসামীদের এনে রাখা হয়। রায় ঘোষণা সময় বিচারক আসামীদের ‘সিএস (চার্জশিট) ক্রম’ উল্লেখ করছিলেন।
ক্রম অনুযায়ী আসামীরা এসে সামনের মধ্যবর্তী আরেকটি কক্ষে এসে বসতে থাকেন। বিচারক দ- ঘোষণার পর সেখান থেকেই আসামীদের নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় কারাগারে। এভাবেই সব দ-ের আসামীদের ক্রম ঘোষণা, আসন গ্রহণ, দ- ঘোষণা এবং কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
সোয়া ১০ টার পর আসামী আনা শেষ হয়। ১২টার পর বিচারক আদালতে আসেন। ১২ মিনিটে ৩৩ মিনিটে রায় ঘোষণা শুরু করেন বিচারক। প্রথমে বিভিন্ন মেয়াদে দ-িতদের সাজা ঘোষণা করা হয়। এরপর ঘোষণা করা হয় খালাসপ্রাপ্তদের দ-।
এ মামলার ৮৪৬ জন জীবিত আসামীর মধ্যে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। বাকি ২৫৬ জনকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ- দেয় ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ।
খালাস ঘোষণার পর আসামীরা বিভিন্নভাবে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন। এ সময় অনেকেই ‘মারহাবা মারহাবা’ বলে কোলাকুলি করতে থাকেন পরস্পরের সঙ্গে। আঙ্গুলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে তারা বিজয় প্রকাশ করেন। ডা-াবেড়ি ও হাতকড়া পরা আসামীদের কোলাকুলির সময় ‘ঝনঝন’ শব্দ হচ্ছিল। এ সময় প্রায় ১২ মিনিট বিচারক রায় ঘোষণা বন্ধ রাখেন।
এরপরই আসামীদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ে যাওয়ার সময় আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের প্রিজনভ্যান থেকে চিৎকার করে নাম জানিয়ে প্রতিক্রিয়া দেন খালাসপ্রাপ্তদের অনেকে।
রংপুরের বাসিন্দা সিপাহি জুবায়ের হোসেন ভ্যান থেকে চিৎকার করে বলেন, “সত্যের জয় হয়েছে, আমরা মুক্ত হতে পেরেছি। আদালত বলেছে আমরা নির্দোষ।”
দোয়া চাইলেন বরিশালের বাসিন্দা নুরুল আমিন। “আপনারা সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
একই গাড়ি থেকে নায়েক সুবেদার ইদ্রিস আলী চিৎকার করে তার খালাসের কথা গণমাধ্যমকে জানান। ঢাকা মেট্রো-ম ০৫-০১৫৩ নম্বর প্রিজনভ্যানেই ছিল অন্তত জনাপঞ্চাশেক খালাসপ্রাপ্ত আসামী।
পেছনের ভ্যানে হাবিলদার ওমর আলী ও সিপাহী তারিকুল টাঙ্গাইলে ভুয়াপুর এলাকার বাসিন্দা উল্লেখ করে তাদের খালাস পাওয়ার কথা জানান।
আসামীদের নিয়ে যাওয়ার পর বিচারক আবার রায় ঘোষণা শুরু করেন। ক্রম উল্লেখ করার পর এবার সংশ্লিষ্ট আসামীরা মধ্যবর্তী একটি কক্ষে আসেন। এরপর তাদের যাবজ্জীবন দ- ঘোষণা করেন।
এরপর নাসির উদ্দিন পিন্টু ও তোরাব আলী যাবজ্জীবন ও জরিমানার দ- আলাদাভাবে ঘোষণা করা হয়।
রায়ের পর নীরব থাকেন তোরাব আলী। তবে পিন্টু বলেন, “সেই দিন স্কুল বন্ধ ছিল। সাক্ষী ছাড়া আমাকে দ- দেয়া হয়েছে। নির্দোষ একটি মানুষকে এই দ- দেয়া হল।”
পরে প্রিজনভ্যানে নিয়ে যাওয়ার সময় পিন্টু গণমাধ্যমকর্মীদের ক্যামেরা লক্ষ্য করে হাত নাড়েন। ১০-১৫ গজ দূরে পুলিশি ব্যারিকেডের বাইরে থাকা কোনো কোনো গণমাধ্যমকর্মী তাকে কিছু বলতে চিৎকার করে অনুরোধ করে। জবাবে হাত ইশারায় ‘না’ করে দেন তিনি।
পরে আদালত আবার আসামীদের সিএস নম্বর উল্লেখ করতে থাকেন। যাবজ্জীবন দ-ের পরের দ- হিসাবে ওই সিএস নম্বরধারীদের মৃত্যুদ- দেয়া হবে বলে তখনই অনুমান করা যাচ্ছিল। তবে নম্বর উল্লেখের সময় এক আসামী চিৎকার করে কেঁদে উঠেন।
তিনি বলেন, “আমাকে ১ মিনিট সময় দেন। আমাকে এই সময়টা দিতেই হবে। এরপর আমাকে যা দ- দিবেন আমি মেনে নেব।”
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বারবার একই কথা বলতে থাকেন। তার চিৎকারের এক পর্যায়ে বিচারক তাকে থামানোর জন্য পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেন।
এ সময় পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে গেলে রেজাউল আদালত কক্ষে থাকা বিজিবি মহাপরিচালককে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ডিজি স্যার, ডিজি স্যার, আমাকে বাঁচান। আমি সেই রেজাউল না। সেই রেজাউল পলাতক। আমি নির্দোষ। আমাকে বাঁচান।”
এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা তাকে থামালেও উচ্চস্বরে কাঁদছিলেন। পরে বিচারক নম্বর ঘোষণা শেষ করে মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদ-ের রায়ের পর আসমিদের অনেকেই রেজাউলের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেছে- “এই বিচারই শেষ বিচার না। একদিন আল্লাহর কাছে এটার আবার বিচার হবে। সাক্ষী প্রমাণ ছাড়া মৃত্যুদ- দেয়ায় সেইদিন আপনার বিচার হবে।”
প্রিজনভ্যানে তোলার সময় আসামীদের অনেকে সেখানে থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের লক্ষ্য করে গালাগালি করেন। তাদের বলতে শোনা যায়, “ওই ছবি তুলিস কেন? তোদের সাক্ষীর কারণেই আমাদের দ- হয়েছে।”
এই মামলায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও সাক্ষ্য দিয়েছেন।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নামে পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে ঘটেছিল এক নারকীয় হত্যাকা-। এ ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। বিচারের মুখোমুখি করা হয় বিডিআর জওয়ানসহ ৮৫০ জনকে। আসামীর সংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা।
এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবোজ্যোতি খীসা একটি হত্যা মামলা করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ মামলাটি তদন্ত করেন। তাকে সহযোগিতা করেন ২০০ কর্মকর্তা। ৫০০ দিন তদন্তের পর ২০১০ সালের ১২ জুলাই এ আদালতে হত্যা এবং অস্ত্র-বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দু’টি অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। এতে ৮২৪ জনকে আসামী করা হয়। পরে অধিকতর তদন্তে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে বর্ধিত অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। বিএনপির নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলীসহ সব মিলে আসামীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫০। বিচার চলাকালে মারা গেছেন চারজন।
২০১১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মামলার বিচার শুরু হয়। চার বছর আট মাসে মামলাটি ২৩২ কার্যদিবস অতিক্রম করে। আজ রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হলো এ মামলার সব কার্যক্রম।
এ মামলায় কারাবন্দী ৮১৩ আসামীর সবাইকে সকালেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। জামিনে থাকা ১৩ আসামীর মধ্যে দশজনও আদালতে উপস্থিত হন। রায় জানতে আদালতে এসেছেন পিলখানায় নিহত দশ সেনা কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরাও।
রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পুনর্গঠন করা হয়। নাম বদলের পর এ বাহিনী এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হিসেবে পরিচিত।
বিদ্রোহের ঘটনার বিচার সীমান্তরক্ষা বাহিনীর নিজস্ব আইনে সম্পন্ন হয়েছে। আর পিলখানায় বাহিনীর সদর দফতরে ৭৪ জনকে হত্যা, লুণ্ঠনসহ অন্য অভিযোগের বিচার হচ্ছে প্রচলিত আইনে।
দেশের ইতিহাসে বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ ৮৫০ জন আসামী। এর মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুও রয়েছেন। আসামীর সংখ্যার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা। মামলায় ২০ জন আসামী পলাতক রয়েছেন। বিচার চলার সময়ে ডিএডি রহিমসহ চার আসামীর মৃত্যু হয়।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে পিলখানার দরবার হল থেকে বিডিআর বিদ্রোহের সূচনা হয়। বিডিআরের তখনকার মহাপরিচালক শাকিল আহমেদের বক্তব্যের সময় দুজন সিপাহি মঞ্চে উঠে পড়ে, শুরু হয় রক্তাক্ত বিদ্রোহের।
পরের দুই দিন ধরে বিডিআর মহাপরিচালকসহ ৭৪ জনকে হত্যা করে বিদ্রোহী জওয়ানরা। পিলখানার ভেতরে কর্মকর্তাদের বাড়িঘরে চালানো হয় ব্যাপক লুটপাট ও ভাঙচুর। ৩৩ ঘণ্টা পর শ্বাসরুদ্ধকর এ বিদ্রোহের অবসান হয় আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।
শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় এ বিদ্রোহের ঘটনা নানা জল্পনা আর অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। পুরো বিশ্বেই ঘটনাটি আলোড়ন তোলে।
বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ঘটনায় প্রথমে লালবাগ থানায় হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা হয়। পরে এসব মামলা স্থানান্তরিত হয় নিউমার্কেট থানায়।
সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়।
এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়। দুই মামলার বিচার একইসঙ্গে চলে।
২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি এই বিচার কার্যক্রম শুরু করেন ঢাকার বিশেষ জজ জহুরুল হক। ওই বছরের ২৪ আগস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। বর্তমানে এই আদালতের বিচারকের দায়িত্বে রয়েছেন মো. আখতারুজ্জামান।
মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সাবেক ও বর্তমান সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা, পুলিশের সাবেক ও বর্তমান আইজি, বেসামরিক ব্যক্তিসহ এ মামলার ১ হাজার ৩৪৫ জন সাক্ষী ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ৬৫৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নেয়া হয়।
সাক্ষ্য ও সাফাইসাক্ষ্য শেষে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। পরে নয় কার্যদিবসে আসামীপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়।
আসামী পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে গত ২০ অক্টোবর বিচারক এ মামলার রায়ের জন্য ৩০ অক্টোবর দিন ঠিক করে দেন। কিন্তু ওইদিন রায়ের জন্য ৫ নবেম্বর নতুন তারিখ রাখেন বিচারক।
বিষয়: বিবিধ
৯৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন