পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ ধর্ম ইসলাম। অথচ আমাদের অর্ধশিক্ষিত মোল্লারা এটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ধর্মে পরিণত করেছেন।
লিখেছেন লিখেছেন আনোয়ার আলী ১৩ আগস্ট, ২০১৭, ০৬:১৭:০০ সন্ধ্যা
আবহমান কাল ধরে আমাদের এই উপমহাদেশের আরবী শিক্ষিত কতিপয় আলেম-ওলামা নামধারী ব্যক্তিরা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার যে ব্যাখ্যা দিয়ে এসেছেন, তা এক কথায় বড়ই জটিল এবং চরম কঠিনও বটে। ইসলামকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে খুবই কঠিন একটা ধর্ম হিসাবে। কঠিন বিধি নিষেধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কঠিন ও রসকস বিহীন এক জীবন ব্যবস্থা হিসেবে তারা ইসলামকে ব্যাখ্যা করে এসেছেন। তাদের ব্যাখ্যা মানলে মুসলমানের জীবনে আরাম আয়েশ বলে কিছুই থাকে না। চোখের সামনে ভাসতে থাকে দাঁড়ি টুপিওয়ালা খটখটে কোন এক গুরুগম্ভীর মানুষ। অনুমিত হয়, হিন্দুধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মের ছাঁচে তারা ইসলামকে টেনে এনেছেন নিজেদের অজান্তেই। সহজাতভাবে ভেবে নিয়েছেন, কঠোরতায় অনেক বেশী পূণ্য অর্জন করবেন। কঠোরতার জালে নিজেদের জড়াতে গিয়ে যুগে যুগে তারা ফরজের চাইতেও অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন নফল এবাদতের। নানা নফল এবাদতের বেড়াকলে নানা মনগড়া ব্যাখ্যায় মানুষকে কঠোর থেকে কঠোরতার দিকেই ঠেলে দিয়েছেন। ধর্মবেত্তারা সাধারণ মানুষজনের কাছে নফল এবাদতের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে করেই জীবন পার করে দিয়েছেন। সাথে পীর-দরবেশের নানা নফল মুস্তাহাবের রেফারেন্স তো আছেই, আছে তাদের কঠোর জীবন যাপনের চটকদার কাহিনীও। টুপি দাড়ি না হলে ধর্ম হবে না, ইংরেজদের মত প্যান্ট শার্ট পড়লে, বা ইংরেজী শিখলে মুসলমান থাকা যাবে না, ইত্যকার মনগড়া ফতোয়ায় তারা নিজেদের অজান্তেই ইসলাম ধর্মের বারটা বাজিয়েছেন। ধর্মবেত্তাদের এই কর্মযজ্ঞের ফলস্বরুপ এই উপমহাদেশের মানুষ টুপি পাওয়া না গেলে নামাজই পড়েন না। ফরজ নয়, কেবল নফল, সুন্নত, ওয়াজিব মোস্তাহাবের গুরুত্ব বর্ণনা্ করেই তারা ক্ষান্ত হয়েছেন। কোরআন নয়, দূর্বল আর জাল হাদীসগুলোকেও তিলকে তাল বানিয়ে সাধারণ মানুষের সামনে পেশ করেছেন। বেশীদিন আগের কথা নয়, প্যান্টশার্ট পরা থাকলে মসজিদে ঢোকা যেতো না। ফরজ নামাজ না পড়লেও, তারাবীর নামাজ তারা ঠিকই পড়েন। ফরজ নামাজ পড়েন না, কিন্তু শবে বরাতের রোজা, মহরমের রোজা. শাওয়াল মাসের রোজা ঠিকই রাখেন। কেউ কেউ আবার শির্ক মিশ্রিত এবাদতেও লিপ্ত হয়ে পড়েন। এসব মানসিকতায় সাধারণ মানুষের দোষ দেয়া যায় না। ধর্মবেত্তাদের যুগে যুগে কঠিন পরিশ্রমের (কু)ফল এটা। যার কারনে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ জীবনের সব কাজ শেষ করে বৃদ্ধ বয়সে ধর্মকর্ম করবেন বলে নিয়ত করে থাকেন। অনেক যুবককেই বলতে শোনা যায়, এটা কি ধর্মকর্ম করার বয়স? ধর্ম কি এতো সহজ?
এবার আসুন কোরআন থেকেই শুনি।
আমি তোমার উপর কুরআন এ জন্য নাযিল করিনি যে তুমি দু:খ-কষ্ট ভোগ করবে। (সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১-২)
আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ্ তাই চান ও তোমাদের পক্ষে যা কষ্টকর তা তিনি চান না...”[সূরা বাকারাহ্; ০২:১৮৫]
আল্লাহ তোমাদের উপর কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না। (সূরা আল মায়েদা, আয়াত ৬)
“তিনি (আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন) দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি’ ”[সূরা হজ্ব; ২২:৭৮]
‘আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাজিল করেছি; সেটি এমন যে, প্রত্যেক বস্তুর সত্য ও সুস্পষ্ট বর্ণনা; হেদায়াত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ (সূরা নাহল, আয়াত ৮৯)।
আল্লাহতালা সহজ করে দিলেও, গোমরাহীতে লিপ্ত লোকেরা কঠোরতার পথ বেছে নিয়েছে। আল্লাহপাক বলেন, ‘একদল লোককে তিনি সঠিক পথ দেখিয়েছেন, আর দ্বিতীয় দলটির উপর গোমরাহী ও বিদ্রোহ ভালোভাবেই চেপে বসেছে; এরাই (পরবর্তী পর্যায়ে) আল্লাহ তালাকে বাদ দিয়ে শয়তানদের নিজেদের অভিভাবক বানিয়ে নিয়েছে, (এ সত্বেও) তারা নিজেদের হেদায়াতপ্রাপ্ত মনে করে। (সুরা আল আ’রাফ ৭: ৩০)
জীবনকে শরীয়ত সম্মতভাবে উপভোগ করার জন্যে আল্লাহপাক বরং তাগিদ দিয়েছেন, একই সুরার পরবর্তী আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, হে আদম সন্তানেরা, তোমরা প্রতিটি এবাদতের সময়ই তোমাদের সৌন্দর্য গ্রহন করো, তোমরা খাও এবং পান করো, তবে কোন অবস্থাতেই অপচয় করো না। আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। (সুরা আল আ’রাফ ৭: ৩১)
‘(হে নবী)তুমি বলো, আল্লাহতালার (দেয়া) সেসব সৌন্দর্য এবং পবিত্র খাবার তোমাদের জন্যে কে হারাম করেছে? যেগুলোকে তোমাদের জন্যে আল্লাহতালা স্বয়ং উদ্ভাবন করেছেন ; তুমি বলো এগুলো হচ্ছে যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্যে পার্থিব পাওনা, (অবশ্য) কেয়ামতের দিনও এগুলো ঈমানদারদের জন্যেই (নির্দ্দিষ্ট থাকবে); এভাবেই আমি জ্ঞানী সমাজের জন্যে আমার আয়াতসমুহ খুলে খুলে বর্ণনা করি।’ (সুরা আল আ’রাফ ৭: ৩২)
নিম্নোক্ত হাদিসটিও উপরিউক্ত আয়াত দুটির স্বপক্ষের দলীলঃ
“দ্বীন সহজ এবং যে কেউ দ্বীনকে নিজের জন্যে কঠিন করে ফেললে সে তা আর পালন করতে পারবেনা। সুতরাং, তোমাদের উচিৎ হবে না চরম পন্থীহওয়া। বরং সাধ্যমত নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা কর এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর যে তোমরা প্রতিদান প্রাপ্ত হবে; এবং সকালে ও রাতে ইবাদতের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় কর।” [সহীহ্ আল-বুখারী; ১:২:৩৮]
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : অবশ্যই
ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: অযথা কঠোরতা অবলম্বনকারীরা ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি এ কথাটি তিন বার বলেছেন। (মুসলিম)
হযরত আয়শা (রাঃ) হইতে বর্ণিত, নবী করিম (দ) সাহাবীদের কোন আমলের আদেশ করিতে এমন আমলের আদেশ করিতেন যা সর্বদা সহজে করে নেয়া সম্ভব হয়। সে জন্যে তিনি যথাসম্ভব অল্প ও সহজ আমলের শিক্ষা দিতেন। সাহাবীগণ নেক কাজের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহশীল ছিলেন। তারা বেশী বেশী ও কঠিন কঠিন এবাদত ও সাধনা নিজেদের উপর টেনে নেওয়ার চেষ্টায় থাকতেন এবং মনে মনে এরূপ ভাব পোষন করতেন যে, রসুল (দ) নিষ্পাপ, তার মর্তবা অতি উর্ধ্বে, সেজন্যে এবাদতের প্রয়োজন তার নেই। এই ভেবে তারা কোন কোন সময় বলে ফেলতেন, এয়া রসুল (দ) আমরা তো আপনার মতো নই, আপনি সম্পূর্ণ নিষ্পাপ-পূর্বাপর সমস্ত গুনাহই আপনার জন্যে মাফ করে দেয়া হয়েছে। (তাই আপনার ন্যায় আমরা কম এবাদত করলে চলবে কেন?) এরূপ শুনে রসুল (দ) রাগান্বিত হয়ে উঠতেন। তার চেহারা মোবারকের উপর রাগ প্রকাশ পেতো।) তারপর ঐ ভুল ধারনা নিরসনে বলতেন-নিশ্চয় জেনো, আল্লাহকে আমি সবচেয়ে বেশী ভয় করে থাকি। কারণ, আল্লাহর মা’রেফাত ও তত্ত্বজ্ঞান সকলের চেয়ে বেশী আছে আমার। (বুখরিী ১ম খন্ড, হাদীস নং-১৯ (ঈমান অংশ)
হযরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত আছে, নবী করিম (দ) বলেছেন, দ্বীন (অর্থাৎ দ্বীনের বিধি বিধান ও তার পন্থাসমূহ) অত্যন্ত সহজ ও সরল। কিন্তু যে কোনও ব্যাক্তি দ্বীনের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করতে সে পরাজিত হবে। তাই সকলের কর্তব্য হবে, ঠিকভাবে দৃঢ়তার সাথে ইসলামের নির্দেশিত পথ অবলম্বন পূর্বক অতিরিক্ত তাড়াতাড়ি বা বাড়াবাড়ি না করে ধীরস্থির গতিতে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে চলা এবং আল্লাহর রহমত ও করুনার আশা পোষন করা। (বুখরিী ১ম খন্ড, হাদীস নং-৩৫ (ঈমান অংশ)
এটা জানা কথা যে, রাসূল মুহাম্মদ সা: ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি বা চরম পন্থাকে সর্বদাই প্রতিরোধ করেছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবন আমর রা:-কে এক দিন তিনি বললেন, আমি কি এটা ঠিক শুনেছি যে, তুমি প্রতিদিনই রোজা রাখো এবং সারা রাত সালাত আদায় করো?’ তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসূল সা:।’ তখন রাসূল সা: বলেছিলেন, তা কোরো না। রোজা রাখবে। আবার খাওয়াপিনাও করবে। সালাত আদায়ের জন্য দাঁড়াবে; আবার ঘুমাবেও। কারণ তোমার ওপর তোমার দেহের অধিকার আছে; তোমার ওপর তোমার চোখের অধিকার আছে; তোমার স্ত্রীর অধিকার রয়েছে তোমার ওপর; তোমার মেহমানেরও অধিকার আছে তোমার ওপর’ (আল বুখারি, ১২৭)।
বিষয়: বিবিধ
১১৭৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন