সাহাবীদের দ্বন্দ-সংঘাত এবং ইতিহাসের বিভ্রান্তি
লিখেছেন লিখেছেন আনোয়ার আলী ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১০:২৮:২১ রাত
খোলাফায়ে রাশেদীনের শেষ পর্যায়ে, তথা ইসলামী রাষ্ট্রের উত্থানের উষালগ্নে কতিপয় সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে নানা দ্বন্দ সংঘাত, অনৈক্য ও রক্তপাতের নানা ঘটনায় ইতিহাসের পাতা কলঙ্কিত হয়ে আছে। আর এসব অনৈক্য ও দ্বন্দ সংঘাত থেকে সৃষ্টি হয়েছে নানা মত ও পথের। শিয়া, সুন্নি, রাফেজী, খারেজী, নাসিবী আরো কত কি! সেই যুগ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি মুসলমানেরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে ‘মুসলিম’ থেকে বেরিয়ে গিয়ে এই গ্রহকে জাহান্নামে পরিণত করতে আর তেমন কিছু বাকি রাখেনি। আমাদেরকে সর্বপ্রথম মনে রাখতে হবে মুসলমানের ইতিহাস আর ‘ইসলাম’ কিন্তু এক জিনিস নয়। মুসলমানদের ইতিহাস দিয়ে ইসলাম-কে বিচার করা যায় না। কেননা, ইসলামের ঠিকানা হলো, কোরআন-হাদীস। এর বাইরে আর কিছুই নয়। সাহাবীরা নবী-রসুল নন। তাদের লোভ, লালসা, দুনিয়াবী মায়া, দূর্বলতা কিম্বা ভুলভ্রান্তি থাকতেই পারে। সমস্যা হয় তখনই, যখন কেউ বিবাদমান উভয়পক্ষের সাহাবীদের সত্য প্রমাণে ব্রতী হয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আগুনে ঘি ঢেলে দেন আর তাদের কারো দুনিয়াবী লোভ-লালসাকে ইজতেহাদী ভুল আখ্যা দিয়ে সত্যকে আড়াল করার প্রয়াস শুরু করেন।
ইসলামের ইতিহাসের একমাত্র কলঙ্কিত টার্নিং পয়েন্টটির নাম হলো, সিফফিনের যুদ্ধ, যা হযরত আলী এবং হযরত মুয়াবিয়ার মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। আরেকটি যুদ্ধের নাম উষ্ট্রের যুদ্ধ, যা উম্মূল মুমেনীন হযরত আয়েশা এবং আলীর মধ্যে সংঘটিত হযেছিল। সেই আমলেই ১০ হাজার মুসলমান নিহত হন ঐ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে।
উষ্ট্র এবং সিফফিনের যুদ্ধের পটভূমি-
হযরত উসমান মজলুম অবস্থায় নিহত হওয়ার পর দেশব্যাপী তার এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। হযরত আলীও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি নিজেও উসমান হত্যার বিচার চাইছিলেন। হযরত উসমানের দূর্দিনে আলীই ছিলেন তার সাথী। তিনি নিজ দুই পুত্র হাসান ও হুসাইনকে উসমানের প্রহরায় রেখেছিলেন। আলী কথনোই উমমানের প্রতিপক্ষ ছিলেন না। উগ্রপন্থীরা উসমানকে হত্যা করে। কোরআন তিলওয়াত রত অবস্থায় খারিজিরা তাকে হত্যা করে। পরবর্তীতে লোকেরা আলীর কাছে বাইয়াত গ্রহন করায় এবং সেনাবাহিনীতে হত্যাকারীর সর্মথকেরা থেকে যাওয়ায় দেশের নাজুক পরিস্থিতিতে আলী ক্ষমতা গ্রহন করলেও তিনি চাইছিলেন আগে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তারপর উসমান হত্যার বিচার করতে। কিন্তু সিরিয়ার প্রভাবশালী গর্ভনর মুয়াবিয়া বায়না ধরলেন আগে উসমান হত্যার বিচার হোক, তারপর আলীর খেলাফত তিনি মেনে নেবেন। একমসয় আলীকে তিনি উমসান হত্যাকারী হিসাবেই গন্য করতে শুরু করেন।
ইতিমধ্যে ঘটে যায় আরেক হৃদয়বিদারক ঘটনা। কিছু সাহাবীর পরামর্শে মা আয়শা আলীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঘর থেকে বের হন। আলী তাকে পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হলেও, কিছু কুচক্রিমহল মা আয়শার কাফেলায় আক্রমন করে বসে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, যা উষ্ট্রের যুদ্ধ নামে ইতিহাসে সমৃদ্ধ। উভয়পক্ষের প্রায় ১০,০০০ সাহাবী প্রাণ হারান এতে। উপায়ান্তর না দেখে মা আয়শা যে উষ্ট্রের উপর আরোহন করেছিলেন, সেই উষ্ট্রের পায়ে আঘাত হানার আদেশ দেন আলী। যুদ্ধ থেমে যায়। মা আয়শা তার ভুল বুঝতে পারেন এবং নিজগৃহে ফিরে যান। আলীর ইমামতিতে উভয়পক্ষের শহীদদের এক সাথে জানাজা পড়ানো হয় এবং দাফন কাফন সম্পন্ন হয়।
এখানে প্রশ্ন এসে যায়, মা আয়শা কি ফিতনা সৃষ্টি করেছিলেন? আর ফিতনা খতম না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার হুকুম তো ইসলামে রয়েছে। তাহলে আলী কেন ফিতনা খতম করলেন না? সার্বিক বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখানে উভয়পক্ষের মধ্যে যথেষ্ট ভুল বোঝাবুঝি ছিল ঠিকই, কিন্তু কোনপক্ষেরই কোন লোভ বা দূরভিষন্ধি ছিল না। মা আয়শা উসমান হত্যার বিচারের দাবীতে আলীকে বাধ্য করার নিয়তেই বেরিয়েছিলেন। তিনি ফিতনা সৃষ্টির জন্যে বের হননি। পরে তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। আলীও তাকে সসম্মানে ঘরে ফিরে যেতে সহায়তা করেন।
এ ঘটনার পরও উসমান হত্যার বিচারের দাবী নিয়ে কিছু লোক ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে প্রবৃত্ত হয়ে পড়ে। হযরত মুয়াবিয়া ছিলেন তার অন্যতম। পরিস্থিতি নাজুক থেকে নাজুকতর হতে থাকলে উম্মার স্বার্থে শক্ত অবস্থান নিতে বাধ্য হন আলী। তিনি সিরিয়ার গর্ভনর পদ থেকে মুয়াবিয়াকে বরখাস্ত করার আদেশ দেন। মুয়াবিয়া তা অমান্য করলে আলী তার বিরুদ্ধে সৈন্যদল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। উমাইয়া বংশের মুয়াবিয়া এবং হাশেমী বংশের আলীর লোকজনের মধ্যে এমনিতেই বংশগত দ্বন্দ বিরাজমান ছিল। সিরিয়ায় মুয়াবিয়া ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী। তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল রয়ে গেলেন এবং আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ মোকাবিলা করতে পিছপা হলেন না। ফলতঃ সিফফিন নামক স্থানে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৭০ হাজার সাহাবীর প্রাণ যায়। শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। তবে এ যুদ্ধে মুয়াবিয়ার বিশাল কুটনৈতিক বিজয় অর্জিত হয়। তিনি প্রাদেশিক গর্ভনর থেকে পুরা মুসলিম জাহানের খিলাফতের হকদার বনে যান।
এখানে লক্ষনীয় বিষয় হলো, মুয়াবিয়া উসমান হত্যার বিচারের দাবী তুলে কোন অন্যায় করেননি। তবে ইসলামী জাহানের আমীরের নির্দেশ অমান্য করে এবং খিলাফতের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়ে নিশ্চয়ই অন্যায় করেছেন। যা ইসলামের দৃষ্টিতে একটা অমার্জনীয় অপরাধ হিসাবে গন্য। সিফফিনের যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায়। ভ্রাতৃঘাতী এ যুদ্ধ হযরত মুয়াবিয়ার কারণে সংঘটিত হয়েছে। এ ঘটনা দ্বারা প্রমাণ হয়েছে, সাহাবীরা যা করেছেন, তার সবগুলোই নির্ভূল ছিল না। তাদের সব কাজ সুন্নত নয়। তারা সত্যের মাপকাঠিও নন। কিছু দরবারী আলেম বিশেষ করে সালাফী মতাবলম্বরীরা সাহাবীর ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে তাদেরকে নবী-রসুলের স্তরে তুলে ফেলেন। উভয়ে সত্যের পখে ছিলেন মর্মে নানা গোঁজামিল দিয়ে বিতর্ক এবং ধাঁধাঁর সৃষ্টি করেন। তাদের এসব আজগুবী ও অবাস্তব ব্যাখ্যা বিশ্লেষনে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এখানে আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, হযরত আলী ছিলেন প্রথমস্তরের (উচ্চপর্যায়ের) এবং বেহেস্তের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী। যেসব সাহাবীর মর্যাদার কথা আল-কোরআনের সুরা তওবার ১০০ নং আয়াতে আল্লাহপাক নিজেই বর্ণনা করেছেন। সুন্নি মাজহাবের ফাতহুল কাদির গ্রন্থে এসেছে: “সত্য সে যুগে আলীর সঙ্গেই ছিল। কারণ, তাঁর (নেতৃত্বের প্রতি জনগণের) বায়আত (আনুগত্যের শপথ) বিশুদ্ধ ছিল ও তা গৃহীত হয়। তাই তিনি জামাল যুদ্ধে ন্যায়ের পথে ছিলেন ও মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে সিফফিনের যুদ্ধের সময়ও ন্যায়ের পথে ছিলেন। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া কোন বদরী, খন্দক বা বাইয়্যানাতের সাহাবী ছিলেন না। মক্কা বিজয়ের পর যখন দলে দলে লোকেরা ইসলাম গ্রহন করছিল, তিনি এবং তার পিতা আবু সুফিয়ান সেই সময় ইসলাম গ্রহন করেছিলেন। তিনি মহানবীর সঙ্গ দিয়েছেন এবং অহিও লিপিবদ্ধ করেছেন। তার এক ভগ্নি মহানবীর স্ত্রী ছিলেন। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া দুনিয়াবী লোভ লালসা দ্বারা পরীক্ষিত হয়েছিলেন-মর্মে ইবনে কাছির তার আল-বিদায়া-ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সমুদ্রপথে রোম বিজয়ে তিনি ১ম সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর মহানবী বলেছেন, সমুদ্র পথে যুদ্ধের ১ম সেনাদলের সকলেই ক্ষমাপ্রাপ্ত। অর্থাৎ তারা জান্নাতি। হযরত মুয়াবিয়ার শত ভুলভ্রান্তি সত্বেও তিনি একজন জান্নাতি সাহাবী। হযরত আলী, ফাতিমা, হাসান, হুসাইন-এরা সবাই জান্নাতি এবং এরা আহলে বাইতের অংশ। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়ার শাসন কাল থেকে মুসলিম জাহান ইসলামের খেলাফত ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। শিয়ারা আহলে বাইতের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত মহব্বতের নামে ইসলামের মুল থেকে বেরিয়ে ‘দলে দলে বিভক্ত’ হয়ে পড়ে। একইভাবে সুন্নিরাও শিয়াদের বিপরীত দলে অবস্থান নেয়। শিয়াদের হাদীসগ্রন্থে বিশিষ্ট সাহাবায়ে-কেরাম আবু হুরায়রা, মা আয়শা, মুয়াবিয়া, মুগিরা সহ তাদের সমর্থকদের কোন উল্লেখ নেই। অন্যদিকে সুন্নিদের সিহাহ সিত্তা আবু হুরায়রা, মা আয়শা, আবদুল্লাহ ইবনে উমার-এর রেওয়ায়েতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। সেখানে আলী, ফাতিমা, হাসান, হুসাইনের তেমন কোন রেওয়ায়েত নেয়া হয়নি বললেই চলে। এটা ইতিহাসের ট্রাজেডি।
এসব যুদ্ধের ফলাফল:
যুদ্ধের কুফল তো বলে শেষ করা যাবে না। ইসলামের শত্রুরা ইসলামকে আখ্যায়িত করছে অনৈক্য, যুদ্ধ, হানাহানি আর রক্তপাতের ধর্ম হিসাবে। অনেকেই বলেন, সাহাবীরাই যেখানে ক্ষমতার জন্যে কামড়াকামড়ি করেছেন, সাধারনের কথা তো বলাই বাহুল্য। ইসলামের উষালগ্নে এ যুদ্ধ পুরা ইসলাম ধর্মের মর্মবানীর উপরই একটা প্রচন্ড আঘাত হেনেছে। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যুগে যুগে মানুষেরা ভুল সংকেত পেয়ে আসছে।
তবে এ যুদ্ধের সুফলটাও একবার লক্ষ্য করুন না কেন। এই সব যুদ্ধের ফলে প্রমাণ হয়েছে, কেউই ভুলের উর্ধ্বে নন। মুসলমানেরা অতিভক্তির বিষবাষ্প থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। পেরেছে উগ্রপন্থা পরিহার করতে। ইসলামে গোঁড়ামীর কোন স্থান নেই। ভিন্ন মত ভিন্ন পথ ইসলামের কোন ক্ষতি করে না। ক্ষতি করে ইতিহাসের। ইতিহাসের পাতা ক্ষত বিক্ষত হয়, রক্তাক্ত আর কলঙ্কিত হয়। আমাদের বুঝতে হবে, মুসলমানদের ইতিহাস কিন্তু ইসলাম নয়। ইসলামের মুল ভিত্তি কোরআন-এবং হাদীস। ইতিহাস দিয়ে ইসলামকে বিচার করা যায় না। এইসব দ্বন্দ সংঘাতের ইতিহাস পড়লে কোন মুসলমানের মধ্যে গোঁড়ামী আর বাসা বাঁধতে পারে না। ভিন্ন মতের কারনে সাহাবীদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে, যুগে যুগে ভিন্ন মত থাকবেই। সঠিক পথ খুঁজে নেওয়ার একমাত্র আশ্রয়স্থল কোরআন-হাদীস।
বিষয়: বিবিধ
২৫৮০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন