কারবালার ঘটনা নিয়ে নানা বিভ্রান্তি এবং ইতিহাসের পরম্পরা-
লিখেছেন লিখেছেন আনোয়ার আলী ৩০ জুন, ২০১৬, ১০:১৩:০০ সকাল
(ইতিহাসের আলোকে একটি গবেষনাধর্মী লেখা)
কারবালার সেই মর্মদন্তু ঘটনা কমবেশী সবারই জানা। আর এই ঘটনা নিয়ে মুসলিম সমাজে রয়েছে নানামত, নানা প্রশ্ন, নানা বিভ্রান্তি, নানা অনৈক্য, নানা আকিদা। প্রশ্ন হলো কেন? এ ঘটনায় ইমাম হুসাইন ইতিহাসের চরমতম নৃশংসতার শিকার হয়ে শাহাদাত বরন করেছেন এতে কোন দ্বিমত তো থাকার কথা নয়।থাকার কথা নয় কোন বিভ্রান্তিও। আসুন এবার ইতিহাসের পরম্পরায় জানি কেন এমন হলো।
১। হযরত মুয়াবিয়া ও হয়রত আলীর দ্বন্দ্ব এবং সিফফিনের যুদ্ধ:
এরা দু’জনই উচ্চ পর্যায়ের সাহাবী। হযরত আলী হলেন আহলে বাইতের সামিল এবং বেহেস্তের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী।হযরত মুয়াবিয়াও ছিলেন ওহি লেখক এবং তিনিও বেহেস্তের সুসংবাদপ্রাপ্ত। রোমের প্রথম যুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছেন, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত সংক্রান্তে বুখারী শরীফের হাদীস রয়েছে। মুয়াবিয়ার নেতৃত্বেই সে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।
হযরত উসমান মজলুম অবস্থায় নিহত হওয়ার পর দেশব্যাপী তার এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। হযরত আলীও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি নিজেও উসমান হত্যার বিচার চাইছিলেন। কিন্তু লোকেরা তার কাছে বাইয়াত গ্রহন করায় এবং সেনাবাহিনীতে হত্যাকারীর সর্মথকেরা থেকে যাওয়ায় দেশের নাজুক পরিস্থিতিতে তিনি চাইছিলেন আগে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। কিন্তু সিরিয়ার প্রভাবশালী গর্ভনর মুয়াবিয়া চাইছিলেন আগে উসমান হত্যার বিচার হোক, তারপর আলীর খেলাফত তিনি মেনে নেবেন।
ইতিমধ্যে ঘটে যায় আরেক হৃদয়বিদারক ঘটনা। কিছু সাহাবীর পরামর্শে মা আয়শা আলীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঘর থেকে বের হন। আলী তাকে পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হলেও, কিছু কুচক্রিমহল মা আয়শার কাফেলায় আক্রমন করে বসে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, যা উষ্ট্রের যুদ্ধ নামে ইতিহাসে সমৃদ্ধ।উভয়পক্ষের প্রায় ১০,০০০ সাহাবী প্রাণ হারান এতে।উপায়ান্তর না দেখে মা আয়শা যে উষ্ট্রের উপর আরোহন করেছিলেন, সেই উষ্ট্রের পায়ে আঘাত হানার আদেশ দেন আলী। যুদ্ধ থেমে যায়। মা আয়শা তার ভুল বুঝতে পারেন এবং নিজগৃহে ফিরে যান। আলীর ইমামতিতে উভয়পক্ষের শহীদদের এক সাথে জানাজা পড়ানো হয় এবং দাফন কাফন সম্পন্ন হয়।
এ ঘটনার পরও উসমান হত্যার বিচারের দাবী নিয়ে কিছু লোক ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে প্রবৃত্ত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নাজুক থেকে নাজুক হতে থাকলে শক্ত অবস্থান নিতে বাধ্য হন আলী। তিনি সিরিয়ার গর্ভনর পদ থেকে মুয়াবিয়াকে বরখাস্ত করার আদেশ দেন এবং তার বিরুদ্ধে সৈন্যদল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।উমাইয়া বংশের মুয়াবিয়া এবং হাশেমী বংশের আলীর লোকজনের মধ্যে এমনিতেই বংশগত দ্বন্দ বিরাজমান ছিল। সিরিয়ায় মুয়াবিয়া ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী। তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল রয়ে গেলেন এবং আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ মোকাবিলা করতে পিছপা হলেন না। ফলতঃ সিফফিন নামক স্থানে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রচুর সাহাবীর প্রাণ যায়। শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। তবে এ যুদ্ধে মুয়াবিয়ার কুটনৈতিক বিজয় অর্জিত হয়। তিনি প্রাদেশিক গর্ভনর থেকে খিলাফতের হকদার বনে যান।
২। এই যুদ্ধের ফলাফল এবং এ থেকে শিক্ষনীয়:
সিফফিনের যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায়। ভ্রাতৃঘাতী এ যুদ্ধ দুজন প্রসিদ্ধ সাহাবীর পরস্পরের দ্বন্দের কারণেই সংঘটিত হয়েছে। অনেক আলেমই এ দন্দ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে নিষেধ করেন। কিন্তু চোখ বন্ধ করে রাখলেই তো আর প্রলয় বন্ধ হয় না। এ ঘটনা দ্বারা প্রমাণ হয়েছে, সাহাবীরা যা করেছেন, তার সবগুলোই নির্ভূল ছিল না। তাদের সব কাজ সুন্নত নয়। তারা সত্যের মাপকাঠিও নন। কতেক লোক সাহাবীর ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে তাদেরকে নবী-রসুলের স্তরে তুলে ফেলেন। আর সেটা যে একেবারেই ঠিক নয়, উষ্ট্রের যুদ্ধ এবং সিফফিনের যুদ্ধ তা চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
ইসলামের উষালগ্নে সংঘঠিত সিফফিনের যুদ্ধ, উষ্ট্রের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসের ছাপ ছাপ কলঙ্ক। আর এই কলঙ্ক, ঝড়ঝঞ্জা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া ছিল এক মহা অগ্নিপরীক্ষা এবং এক মহান জিহাদ , যা থেকে মুসলমানদের অনেক কিছুই শিখার আছে। ইজতেহাদী ভুল থেকে কি মহা প্রলয় ঘটে যায়, এসব ঘটনা তার সাক্ষী। ইতিহাসের দৃষ্টিতেও এরা কেউই ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুত ছিলেন না। বরং প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহি ছিলেন। এ কারনে তাদের বিরোধে অনেক সাহাবী নিরপেক্ষ ভুমিকায় ছিলেন। সাহাবীদের মধ্যে এমন মতানৈক্য কেন সংঘটিত হলো তার গ্যুঢ় রহস্য একমাত্র আল্লাহপাকই ভাল জানেন। এসব ঘটনা নিয়ে সাহাবী সম্পর্কে খারাপ ধারনা পোষন করা ইসলাম সর্মথন করে না। তবে এসব ঘটনা প্রমাণ করে একমাত্র নবী রসুল ব্যতীত আর কেউই ভুলের উর্ধে ছিলেন না। সাহাবী হলেও তারা ছিলেন মানুষ, আর মানুষের ইজতেহাদী ভুল হতেই পারে। ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া মুমীনের দায়িত্ব। ভুল আঁকড়ে থাকা নয়।
৩। আলীর শাহাদাত এবং এর পরবর্তী ঘটনা:
পরবর্তীতে খারেজীদের আক্রমনে আলী শাহাদাত বরন করেন। তার পুত্র হাসানের হাতে লোকজন বায়াত গ্রহন করতে থাকেন। কিন্তু মুয়ারিয়া হাসানকে না মানার কারনে আবারো যুদ্ধ আবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলে হাসান রক্তপাত এড়াতে সন্ধির প্রস্তাব দেন এবং মুয়াবিয়ার সমর্থনে ক্ষমতা ত্যাগ করতে রাজি হন। এভাবে মুসলমানদের দুটো দলের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এ সম্পর্কে মহানবী আগেই ভবিষ্যতবানী করেছিলেন এই বলে যে, আমার এই সন্তান (হাসান) এর মাধ্যমে মুসলমানদের দুটো দলের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। ঠিক তা-ই হয়েছে।
৪। দক্ষ হাতে মুয়াবিয়ার রাষ্ট্র পরিচালনা ও খারেজী প্রসঙ্গ:
রাষ্ট্রের সবকিছু সামলে নিয়ে মুয়াবিয়া একজন দক্ষ শাসকের পরিচয় দেন এবং ইসলামী বিধি বিধানের আওতায় থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তবে তার রাজত্বকালে তার কতেক গর্ভনর আলীর নিন্দা করতে কসুর করতেন না, যা ইসলামী রীতিকে ক্ষুন্ন করে। খারেজীরা আলী বা মুয়াবিয়া কাউকেই মুসলমান মনে করতেন না। মুয়াবিয়ার প্রতি আলীর নমনীয়তাকে তারা অনৈসলামিক আখ্যা দেয়। তারা উভয়কেই হত্যা করে ফিতনা নির্মুলের উদ্যোগ নেয় এবং আলীকে হত্যা করতে পারলেও মুয়াবিয়া বেঁচে যান। আলীর হত্যাকারী মুলজিমকে শাস্তি দেবার সময়ও সে আল্লাহর জিকিরে মশগুল ছিল। তার কপালে ছিল নামাজের চিহ্ন। সে তার নীতিতে অটল ছিল। সত্যটা আল্লাহপাকই ভাল জানেন। খারেজীরা ইসলামী দল ত্যাগ করায় তারা মুয়াবিয়া এবং আলী উভয়ের দুশমনে পরিণত হয়ে যায়। ইতিহাসে তাদের সম্পর্কে বিশদগারই বেশী পরিলক্ষিত হয়। তাদের নীতি আদর্শ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। ইসলামের বিধিবিধানে ইজমা-কিয়াসের ধার তারা ধারতো না এবং বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগাতো না মর্মে ইতিহাস পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়। তারা উগ্রপন্থী ছিল ঠিকই, তবে তাদেরকে কেউ অমুসলিম আখ্যা দেবার সাহস করেনি।
৫। ইয়াজীদের মনোনয়ন:
মুয়াবিয়া তার শেষ জীবনে এসে সাহাবী মুগীরা ইবনে শুবার পরামর্শে নিজপুত্র ইয়াজীদকে রাষ্ট্রের শাসক নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।তার এ সিদ্ধান্ত ছিল সরাসরি ইসলামী রীতির ব্যত্যয়। মহানবী থেকে শূরু করে খোলাফায়ে রাশেদীনের কেউই এধরনের কাজ করেননি। তাছাড়া নিজ পুত্রকে খলিফা ঘোষনা করাটা নীতি নৈতিকতার দিক থেকেও ছিল অত্যন্ত নীচু স্তরের। উপরন্তু ঐ সময়টা ছিল সাহাবী-তাবেইনের যুগ। যোগ্যতম সাহাবীরা ঐ সময়ে জীবিত ছিলেন। কিন্তু মুয়াবিয়া রাষ্ট্রের বৃহত্তর ঐক্য ও স্বার্থের চিন্তা থেকে নিজ পুত্রকেই খলিফা মনোনীত করে যান মর্মে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহপাকই ভাল জানেন। তার এ মনোনয়ন ইসলামের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। খেলাফত শেষ হয়ে শুরু হয় রাজতন্ত্রের যুগ। আর এর দ্বারা মহানবীর আরেকটি ভবিষ্যতবানী সত্য প্রমাণিত হয়। তাহলো- ইসলামের ইতিহাসে দেশ শাসনের বিষয়টা শুরু হয়েছে রহমত ও নবুয়তের ভিত্তিতে (মহানবীর আমলে)। এরপর রহমত ও খেলাফতের ভিত্তিতে (খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ৩০ বছর)। আর এর পরই তা পরিণত হয় জুলুমবাজ রাজতন্ত্রে। এর ইংগিত আছে হাদীস শরীফেও। (দেখুন আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৮, প্রথম প্রকাশ-২০০৭, ইসলামী ফাউন্ডেশন)
মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে সেই যে রাজতন্ত্রের সুচনা হয়েছিল, আজো মুসলিম সমাজ সেই যাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। রাজতান্ত্রিক মুসলিম দেশগুলোতে মুয়াবিয়াকে তাই বিশেষ সম্মানের সাথে মুল্যায়ন করা হয়। এই সাহাবীর কৃতকাজকে ইসলামী বলে চালানোর একটা বিশাল প্রয়াস তারা চালিয়ে আসছেন সেই মুয়াবিয়ার রাজত্বকাল থেকেই। এটা এখনো চলমান আছে। রাজদরবারের আলেমরা সাহাবীর মর্যাদা বলতে মুয়াবিয়ার মর্যাদাই বুঝে থাকেন।মুয়াবিয়াসহ তার সমর্থক সাহাবীদের সত্যের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করেন। অথচ তার ভুলের কারনে হাজার হাজার সাহাবীর শাহাদাত বরনকেও আমলে আনা হয় না। সাহাবীর মর্যাদা কেবল মুয়াবিয়া ও তাকে সমর্থনকারীদের ঘিরেই আবর্তিত।
৬। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাঃ
মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াজীদ যখন মুসলিম রাজ্যের রাজা হলেন, সেটা ইমাম হোসেনসহ অনেক সাহাবী মেনে নেননি সংগত কারনেই। খিলাফত ব্যবস্থার ব্যত্যয় ঘটায় হুসাইন তা মেনে নেননি। এদিকে কুফা থেকে একের পর এক চিঠি আসতে থাকে হুসাইনের কাছে যে, তারা ইয়াজীদকে মানেন না। তারা ইমাম হুসাইনকে চান। আর খিলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনই ছিল ইমাম হোসাইনের (রা.) সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থনও ছিল তার পক্ষে। উপরন্তু কুফাবাসীগন ইয়াজীদের অপশাসনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে বারংবার ইমাম হুসাইন-এর সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকলে তিনি তাতে সাড়া দেন। তিনি কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কুফার অবস্থা জানার জন্যে হুসাইন তার চাচাতো ভাই মুসলিম-বিন-আকিলকে সেখানে প্রেরণ করেন। মুসলিম কুফাবাসীর সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে ইমাম হুসাইনকে কুফায় আসতে অনুরোধ করে পত্র লিখেন। কিন্তু এরিমধ্যে ইয়াজীদের অধিনস্থ ইরাকের শাসনকর্তা কঠিন হৃদয়ের ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ মুসলিম-বিন-আকিলকে খুঁজে বের করে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন এবং তার সহায়তাকারীদেরও খুঁজে হত্যা করেন। এতে কুফাবাসীরা ভীত হয়ে পড়েন। তারা হুসাইনের সাহায্যে এগিয়ে আসতে আর সাহস পেলেন না। কুফাবাসীরা ইমাম হুসাইনকে খলিফা হিসাবে দেখতে চাইলেও হুসাইনের জন্য প্রাণ বিসর্জণ দিতে রাজি ছিলেন না। ইয়াজীদের নির্মমতার কথা জেনেও ইমাম হোসাইন- এর সঙ্গীরা যে জেনে শুনে বুঝেই ইমামের সাথে যোগ দিয়েছিলেন তা খুবই স্পষ্ট। হুসাইনকে ভালোবেসে, তাঁর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রেখেই তাঁরা হুসাইনের সাথে থেকে প্রাণপণে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। ইমাম হুসাইন এবং তাঁর সঙ্গীদের ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে, তরবারীর সেই আঘাতের যন্ত্রণার চেয়ে আরো বেশি কষ্টকর ছিল জনগণের অজ্ঞতা এবং মূর্খতার আঘাত। সেজন্যেই জনতার চিন্তার ভূবন থেকে অজ্ঞতার পর্দা অপসারণ করাটা ছিল তাদেঁর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ।
মুসলিম-বিন-আকিল প্রেরিত পত্র পেয়ে ইমাম হুসাইন স্ত্রী, পুত্র কন্যা, আত্মীয়-স্বজন এবং ২০০ অনুচর সহ কুফার পথে রওনা হন। কুফার ইয়াজীদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর হুসাইনকে ইয়াজীদের আনুগত্যের শপথ গ্রহনের নির্দেশ দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তারা ফোরাত নদীর তীর ঘিরে দর্ন্ডায়মান হলেন এবং হুসাইন শিবিরের পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিলেন।
তাসূয়ার দিনে কারবালার পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও হুসাইনের সঙ্গীরা অবিচল আস্থা ও ঈমানের সাথে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। চরম সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও তাঁরা হুসাইনের সাথে কৃত তাদেঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেননি। এই অনড় ঈমানের অধিকারী একজন ছিলেন হযরত আব্বাস। তিনি ছিলেন হযরত আলির ছেলে। তাঁর মা ছিলেন উম্মুল বানিন। হযরত আব্বাস ছিলেন অকুতোভয় এক যুবক। তাঁর ঈমান, বীরত্ব, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলির কথা ছিল প্রবাদতুল্য। দেখতেও তিনি ছিলেন খুব সুন্দর। কারবালার অসম যুদ্ধে তিনিই ছিলেন হুসাইনপক্ষের প্রধান সিপাহসালার। ইমাম হুসাইনের প্রতিরক্ষায়, নারী ও শিশুদের তাঁবুর প্রতিরক্ষায় এবং ইমাম হুসাইনের সন্তানদের জন্যে পানির ব্যবস্থা করতে প্রাণপণে লড়েছেন তিনি।
অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের ৪ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হুসাইনকে অবরুদ্ধ করে ফেলেন এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেন। মাত্র ২০০ মানুষের বিপক্ষে ৪০০০ সৈন্য। পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়ায় ইমাম হুসাইনের কচি সন্তানেরা প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে হযরত আব্বাস ফোরাতে যান পানি আনতে। নিজেও তিনি ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলেন। আঁজলা ভরে পানি তুলে খেতে যাবেন এমন সময় তাঁর মনে পড়ে যায় ইমাম হুসাইনের তৃষ্ণার্ত শিশু সন্তানের কথা। পানি ফেলে দিয়ে মশক ভর্তি করে তাঁবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই শত্রুপক্ষের তীরে তাঁর এক হাত কেটে যায়। মশকটাকে তিনি অপর হাতে নিয়ে ইমাম হুসাইনের তাঁবুর দিকে ছুটলেন। এবার অপর হাতটিও কাটা পড়ে। মশকটাকে এবার তিনি মুখে নিয়ে তাঁবুর দিকে যেতে চাইলেন। শত্রুর তীর এবার সরাসরি তার দেহে আঘাত হানে। এভাবে শহীদ হয়ে যান তিনি। এরপর অসম এই যুদ্ধে আলী আকবর শহীদ হয়ে যান। কারবালায় আরো যাঁরা শহিদ হন তাদেঁর মধ্যে রাসূলের প্রিয় সাহাবা হাবিব ইবনে মাজাহের, তাঁর প্রাচীন বন্ধু মুসলিম ইবনে আওসাজা, নওমুসলিম ওহাবসহ আরো অনেকেই।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দুরাবস্থায় পতিত হয়ে হুসাইন ওবায়দুল্লাহর নিকট তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটা গ্রহনের অনুরোধ জানান। তাহলো-হয় তাকে মদীনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক, কিম্বা তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক, বা ইয়াজীদের সাথে আলোচনার জন্যে দামেস্কে যেতে দেয়া হোক। কিন্তু ক্ষমতাদর্পী ওবায়দুল্লাহ এর কোনটাই মানলেন না। এদিকে পানির অভাবে হুসাইন শিবিরে হাহাকার পড়ে গেলো। ছোট শিশুরা মুর্ছা যেতে লাগলো। নিরুপায় হুসাইন শেষবারের মত অনুরোধ করলেও, পাষান্ডদের মন গলেনি। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর কারবালার প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধ শুরু হলো। হুসাইনের ভ্রাতুষ্পুত্র কাশিম সর্বপ্রথম শত্রুর আঘাতে শাহাদাত বরন করলেন। তৃষ্ণার্ত হুসাইন শিশুপুত্র আসগরকে কোলে নিয়ে ফোরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলেন কিন্তু ইয়াজীদ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর শিশুপুত্রের শরীরে বিদ্ধ হয়ে শিশুপুত্রটি শাহাদাত বরন করলে একাকী অবসন্ন হুসাইন তাবুর সামনে বসে পড়লেন। এমন সময় এক মহিলা তাকে এক পেয়ালা পানি এনে দিলেন। কিন্তু শত্রুর তীর তার মুখ বিদীর্ণ করে দিলো। সীমার নামীয় ইয়াজীদের এক সৈন্য তরবারীর আঘাতে হুসাইনের মস্তক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। এই ভয়ন্কর দৃশ্যে কঠিন হৃদয়ও বিগলিত হলো। হুসাইন পরিবারের জীবিত সদস্যদের বন্দী করে দামেস্কে ইয়াজীদের নিকট পাঠানো হয়। এদিকে হুসাইনের মৃত্যুর এমন ভয়াবহ দৃশ্য পুরো দেশের মানুষকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলল। ইয়াজিদ ভয় পেয়ে গেলেন। ক্ষমতা নিরাপদ রাখতে এবং জনরোষের ভয়ে কৌশলী ভুমিকায় তিনি বন্দিদের মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন।
ঐতিহাসিক আল-ফাখরী, ফন ক্রেমার এবং ইবনুত তিকতাকার মতে ইয়াজীদের রাজত্বকাল তিনটি দুষ্কর্মের জন্য বিখ্যাত। প্রথম বছরে তিনি মহানবীর আদরের দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইনকে হত্যা করেন, দ্বিতীয় বছরে মদীনাকে লুন্ঠন করেন এবং তৃতীয় বছরে তিনি কাবার উপর হামলা করেন।
৭। এই যুদ্ধে কথিত শীয়া, সুন্নী এবং মুমীনদের ভূমিকা:
কুফাবাসী শীয়ারা কাপুরুষত্বের পরিচয় বরাবরই দিয়েছেন। তারা আমানতের খিয়ানত করেছেন। ইমাম হুসাইনকে কথা দিয়েও তারা কথা রাখেননি। ইয়াজীদ বাহিনীর দৃঢ়তার সামনে কাপুরুষের চেয়েও নিকৃষ্ট আচরন করে হুসাইনকে একা রেখে তারা ঘরে ফিরে গেছেন। তাদের এই গাদ্দারী ইতিহাসের পাতাকে কলঙ্কিত করে রেখেছে। কথিত সুন্নীরা ব্যথিত হলেও, ইয়াজীদ-এর পিছনেই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। সিরিয়াবাসীরা ছিলেন এই শ্রেনীর লোক। আর সবচাইতে করুণ অবস্থায় ছিলেন কেবল মুমীনরা। তারা ইয়াজীদ বাহিনীর সামনে নিতান্তই অসহায় ছিলেন। তারা ইয়াজীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন, পরিনামে ইয়াজীদ বাহিনীর হাতে দলে দলে প্রাণ হারালেন, মা-বোনেরা হারালো তাদের ইজ্জত। এরা ছিলেন মক্কা ও মদীনার অধিবাসী।
৮। ইয়াজীদকে নির্দোষ প্রমাণের কেন এমন প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা?
ইমাম হুসাইন-এর শাহাদাতের পর পুরো মুসলিম বিশ্বের উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেন ইয়াজীদ। ইমাম হুসাইন-এর প্রতি সাধারন মানুষের আবেগ বুঝতে পারেন ধূর্ত ইয়াজীদ। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সব কিছুই কৌশলে ম্যানেজ করতে হয়। সেই পথেই এগুলেন তিনি। বললেন তিনি উপস্থিত থাকলে হুসাইনকে তিনি হত্যা করতেন না। তিনি হুসাইনকে দমাতে নির্দেশ দিয়েছেন, হত্যার নয়। ইয়াজীদ তার পক্ষে জনমত গঠনে নানা প্রচেষ্টায় লিপ্ত হলেন অত্যন্ত ধূর্তামীর সাথে। তার সাথী হলো কিছু দরবারী আলেম। সাহাবাদের নানাভাবে কোনঠাসা করা হলো। কারবালার যুদ্ধে ইয়াজীদ দায়ী হলে, ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগ বৈধতা পায়। মানুষ রাজতন্ত্রকে ঘৃনা করবে এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠবে। কাজেই সেটা যাতে হতে না পারে সে দায়িত্ব পালন করেছেন এইসব দরবারী আলেমরা। কিছু তথাকথিত শীয়া ইমাম এবং কিছু সুন্নি ইমাম দিয়ে নানা কল্পকাহিনী ফেঁদে কারবালার ইতিহাস পাল্টে দেয়ার অপচেষ্টা অতীতেও হয়েছে এবং এখনো ঠিক সমভাবেই হচ্ছে। ইমাম হুসাইন কেন ইয়াজীদের বিরুদ্ধে গেলেন, মদিনা থেকে কেন বের হলেন নানাভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে তার জন্য ইমাম হুসাইনকে ক্ষমতালোভী আখ্যায়িত করে প্রকারান্তে তাকেই দোষী সাব্যস্থ্য করার অপচেষ্টাও কম হয়নি। তারা বলেন কুফায় যাওয়ার কারণেই ইয়াজীদ বাহিনী ইমাম হুসাইনকে শহীদ করতে সক্ষম হয়েছিল। তারা বুঝাতে চান, অন্যায়ের বিরোধিতা করে হুসাইন ঠিক কাজ করেননি। ইয়াজীদের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে হুসাইনই অন্যায় কাজ করেছেন। তারা বলতে চান, মুসলিমরা ইয়াজীদের শাসনের উপর ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। হুসাইন এসে সেই ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেছেন (নাউজুবিল্লাহ)। আবার কিছু সুবিধাবাদী আলেম বলেছেন, ইয়াজীদকে ভালও বলা যাবে না, আবার খারাপও বলা যাবে না। গোঁজামিলটা খেয়াল করুন। নবীর দৌহিত্রের হত্যাকারী জালিম শাসককে নাকি খারাপ বলা যাবে না। এই না বলার অর্থ কিন্তু ইয়াজীদকে সমর্থণ করাই। অনেকে কারবালার যুদ্ধকে হক ও বাতিলের যুদ্ধ নয় বলে অভিমত দিতে কুন্ঠিত হলেন না। প্রকারান্তরে তারা বলতে চান, ইমাম হুসাইন হকের পক্ষে ছিলেন না (নাউজুবিল্লাহ)।
ইয়াজীদের সমর্থনে কিছু জাল হাদীসও যুগে যুগে মানুষকে গেলানোর অপচেষ্টা হয়েছে। তার একটা হলো, “যে ব্যক্তি আশুরার দিনে তার পরিবারবর্গের লোকদের জন্য সচ্ছলতার (ভাল খাবার) ব্যবস্থা করবে আল্লাহ সারা বছর তাকে সচ্ছল রাখবেন।”
এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেছেন; হাদীসটি সহীহ নয়। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইবনে কায়্যিম জাওযী রহ. এ হাদীস সম্পর্কে বলেছেনঃ
“তাবারানী হাদীসটি আনাস রা. সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ সূত্রে হাইছাম ইবনে শাদ্দাখ নামের ব্যক্তি অপরিচিত। এবং উকায়লী বর্ণনা করেছেন আবু হুরাইরা রা. থেকে। এবং তিনি বলেছেনঃ এ সূত্রে সুলাইমান বিন আবি আব্দুল্লাহ নামের ব্যক্তি অপরিচিত। হাদীসটি সংরক্ষিত নয় আর এ হাদীসের প্রত্যেকটি সূত্র একেবারে বাজে ও খুবই দূর্বল।(আল-মানারুল মুনীফ ফিসসহীহ ওয়াজ যয়ীফ : ইবনে কায়্যিম জাওযী -রহ.)
ইয়াজীদ আর রাজতন্ত্রকে বৈধতা দেবার কি প্রাণান্তর অপচেষ্টা হয়েছে, এসব ঘটনাই তার প্রমাণ। না জানি আরো কত জাল হাদীস তারা সৃষ্টি করে রেখেছেন।
অতীতের সেই ইয়াজীদের প্রেতাত্মারা এখনো মুসলিম বিশ্বের মজলুম মানুষের বুকে চেপে বসে আছেন। ইসলামী ছদ্মবেশ গায়ে মাখিয়ে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানাবার সেই পুরোনো কৌশলকে নানাভাবে বিস্তৃত করেছেন তারা। তাদের কারনেই মুসলমানের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস আজ ইহুদীদের বুটের তলায় পিষ্ট হয়ে লাঞ্চিত, দলিত, অপমাণিত। মুসলমানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় কেবলা মক্কা মদীনা শাসন করছেন তারাই, যারা মুসলিম জাহানের বড় গাদ্দার এবং পশ্চিমাদের পদলেহী সেবাদাস। বংশানুক্রমে এরা ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন আর এই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বংশানুক্রমে পশ্চিমাদের দাসত্ব করে আসছেন। অথচ মক্কা-মদীনার অবস্থান হওয়ার কারনে এই দেশটি মুসলিম বিশ্বের হৃদপিন্ড হিসাবে গোটা মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারতো।পারতো মুসলমানদের সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে। কিন্তু তারা নিজেরাই পশ্চিমা পুঁজারী, জাতীয়তাবাদ পুঁজারী। রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমাদের পদলেহণেই জীবন কাটছে তাদের। ইসলামে নিষিদ্ধ আরব জাতীয়তাবাদের পুঁজারী এই সব শাসকেরা ইসলামের বিকৃত ইতিহাস মুসলমানদের গেলানোর নানা প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন সঙ্গত কারনেই। তাদের দান খয়রাতের অর্থে পরিচালিত বিভিন্ন মুসলিম দেশের কিছু ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসাগুলোতে ইয়াজীদের পক্ষে বড়ই চাতুর্যে্যর সাথে শিক্ষা দেয়া হয়। ধুর্তামীতে পরিপূর্ণ এই সব লেখার শিরোনাম দেখে মনে হবে ইমাম হুসাইনের পক্ষে লেখা। কিন্তু অত্যন্ত সচেতনভাবে ও সুকৌশলে তাতে ইয়াজীদের পক্ষে প্রচারনা চালানো হয়। আজকাল অনেক বড় ইসলামী পন্ডিতও টিভি চ্যানেলের টাকা জোগাড়ে হেকমতের নামে একইভাবে রাজতন্ত্রের পূঁজারীতে লিপ্ত হয়ে পড়েছেন।
৯। সম্মানীত সাহাবীরা কেন হুসাইনকে কুফা যা্ওয়া রুখতে চেয়েছিলেন ?
ইমাম হুসাইন যখন কুফাবাসীর পত্র পেয়ে কুফায় যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন অনেক সম্মানীত সাহাবী তাকে কুফা যেতে নিষেধ করেছিলেন। তারা কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি আগে থেকেই অনুমান করেছিলেন বলেই হুসাইনকে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কোনভাবেই ইয়াজীদকে সমর্থণ করে নয়। কিন্তু তাদের এই নিষেধের বিষয়ে ইয়াজীদের সমর্থকেরা/রাজতন্ত্রপন্থীরা এটাকে ইয়াজীদের পক্ষে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন।
১০। ইয়াজীদ এই হত্যাকান্ডের সাথে কতটুকু জড়িত ছিলেন?
মাত্র ৩৭ বৎসর বয়সে ইয়াজীদের মৃত্যু ঘটে। ইবনে কাছির-এর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ার ৮ম খন্ডে তার একটা উক্তি দেখা যায়। তাহলো-মৃত্যু কালে তিনি প্রার্থনা করছেন এই বলে যে, ‘‘হে আল্লাহ তুমি আমায় পাকড়াও করো না এই জন্যে যে যা আমি চাইনি এবং প্রতিরোধও করিনি। তুমি আমার ও ওবায়দুল্রাহ বিন জিয়াদের মধ্যে ফয়ছালা করো।’’ তার এই প্রার্থনায় তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি ঐ ঘটনার প্রতিরোধ করেননি। অথচ ইচ্ছা করলেই প্রতিরোধ করতে পারতেন। এই হত্যাকান্ডে তিনি নিজের চাইতেও ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে বেশী দায়ী করেছেন।
কিন্তু সত্য তো এটাই যে, এই হত্যাকান্ড তার অমতে হয়নি। হত্যাকারীকে তিনি কোন সাজাও দেননি। প্রতিরোধও করেননি। ঘটনা ঘটতে দিয়েছেন এবং পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েও হত্যাকারীর পক্ষাবলম্বন করেছেন। কোন শাস্তি দেননি। রাস্ট্রপ্রধান হিসাবে এ হত্যাকান্ডের দায় তো তারই। এক্ষেত্রে তাকে নিরাপরাধ প্রমাণ করার মত কোন কিছুই ইতিহাস ঘেটে পাওয়া যায় না।
ইয়াজিদ ভাল মানুষ হলে ইমাম হুসাইন এ কথা বলতেন না যে, ইয়াজিদের মত অসত লোক যদি মুসলমানদের (স্বীকৃত) নেতা হয় তাহলে ইসলাম চির-বিদায় নেবে। ইয়াজিদ ভাল মানুষ হলে মক্কা ও মদিনার বিখ্যাত সাহাবিরা তাকে সমর্থন করতেন, কিন্তু তারা তা করেননি বলেই মক্কা ও মদিনায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় ইয়াজিদ।
সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে যোবাইর:
ইয়াজিদ এটা শুনেছিল যে সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে যোবাইর বলতেন: ইয়াজিদ এক প্রতারক, মাতাল ও সত্য পথ পরিত্যাগকারী এবং এমন এক ব্যক্তি যে গায়িকা নারীদের সঙ্গে থাকে। (বিদায়া ও নিহায়া, খণ্ড-৮ পৃ-২৭৯)|
এমনকি ইয়াজিদের দোসর ইবনে জিয়াদও মক্কায় হামলা চালানোর ব্যাপারে তার রাজা ইয়াজিদের হঠকারী নির্দেশে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিল: আল্লাহর শপথ! এক ফাসিকের জন্য আমি দু’টি বিষয় সমন্বিত করব না। আমি এরিমধ্যে নবীর কন্যার সন্তানকে হত্যা করেছি। আর এখন সে (ইয়াজিদ) আমাকে বায়তুল হারামে যুদ্ধ বাধাতে বলছে। ইবনে জিয়াদ যখন ইমাম হুসাইন-কে শহীদ করে তখন জিয়াদের মা মারজানা তীব্র তিরস্কার করে পুত্রকে বলেছিল: তোমার মৃত্যু হোক! তুমি কি করলে এবং কত বড় অপরাধ করেছ! (বিদায়া ও নিহায়া, খণ্ড-৮ পৃ-২৭৯)
ইয়াজিদ যে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি ছিল তা তার ছেলে মুয়াবিয়া(দ্বিতীয়)ও উল্লেখ করেছিল বলে ইতিহাসে বর্ণনা এসেছে। ইয়াজিদ ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবার এবং সঙ্গীদের হত্যা করায় মুসলমানদের মধ্যে ইয়াজিদ পরিবার কলঙ্কিত হয়েছে বলে উল্লেখ করে মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াজিদ এবং এ জন্য সে ইয়াজিদের মৃত্যুর পর কথিত খলিফা হতে রাজি হয়নি।
ইয়াজিদের অভিশপ্ত হওয়া সংক্রান্ত আরো এক অকাট্য যুক্তি:
ইবনে কাসিরের বিদায়া ও নিহায়ার অষ্টম খণ্ডের ২৭৪ পৃষ্ঠায় এ হাদিসটি উল্লেখিত হয়েছে ইমাম হাম্বলের মুসনাদ থেকে। এতে বলা হয়েছে: যে অবিচার ছড়িয়ে দেয় ও মদীনার লোকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তার ওপর আল্লাহর ও তাঁর ফেরেশতাদের এবং সব মানুষের অভিশাপ বর্ষিত হয়।
পবিত্র কুরআনেও (সুরা আহজাবে) বলা হয়েছে: যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বিরক্ত করে বা কষ্ট দেয় আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তথা পরকালে তাদের ওপর অভিশাপ দেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন অপমানজনক বা লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। (৩৩:৫৭)
১১। ইয়াজীদকে সমর্থনকারীদের সাথে মুসলমানের সম্পর্ক:
যারা নবীর দৌহিত্রের নৃশংস হত্যাহান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট জালিম ইয়াজীদকে সমর্থণ করেন, তাদের সাথে মুসলমানের একটাই সম্পর্ক, আর তা হলো তারা আহলে বাইতের দুশমন। নবীর দুশমন। মুসলমানরা একই সময় আলী ও তাঁর হত্যাকারীর অনুসারী এবং হুসাইন ও তাঁর হত্যাকারীর অনুসারী হতে পারেন না; মুসলমানরা হয় আলীর সাথে নতুবা তার হত্যাকারীর সাথে অথবা হুসাইনের সাথে বা ইয়াজীদের সাথে। অনেকেই বলেন ইয়াজীদ তার আমল নিয়ে চলে গেছেন তাকে খারাপ বলে কি লাভ? ফেরাউন, আবু লাহাব, আবু জেহেলও তো তাদের আমল নিয়ে চলে গেছেন। ইসলামকে এবং নবীকে ভালবাসলে ঐসব দুরাচারী অন্যায়কারীদের ঘৃণা করতেই হবে। ভালকে যেমন ভাল বলতে হবে ঠিক তেমনি খারাপকে খারাপ বলাও ঈমানের দাবী।
পবিত্র সহি বুখারী হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি, তিনি হাসান বিন আলীকে কাঁধে নিয়ে বলেছেনঃ হে আল্লাহ! আমি একে ভালবাসি। সুতরাং তুমিও তাঁকে ভালবাসো এবং যে তাঁকে ভালবাসে তুমি তাকেও ভালবাসো।
বুখারী শরীফের আরেকটি হাদীসে বলা হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, এরা দুজন (হাসান ও হুসাইন) আমার দুনিয়ার দুটি ফুল।
তিরমিজী শরীফের আরেকটি হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ হাসান ও হুসাইন জান্নাতবাসী যুবকদের সরদার হবেন।
নবীজীর এই কলিজার টুকরার প্রতি বিদ্বেষপোষনকারী এবং তার পরোক্ষ হত্যাকারী ইয়াজিদকে কোন মুমীন সমর্থণ করতে পারেন না। ইয়াজীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অটুট রাখতে ইয়াজীদের পরোক্ষ নিদের্শে তার পাপিষ্ঠ সেনারা ইমাম হুসাইনকে হত্যা করেছেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহ এমন জিনিস, ইয়াজীদ মুয়াবিয়ার (রাঃ) মত সাহাবার সন্তান হওয়া সত্বেও নবীজীর কলিজার টুকরা দৌহিত্রকে রুখে দিতে /হত্যা করতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। আর দরবারী আলেমদের কথা তো বলাই বাহুল্য। তারা যুগে যুগে তাদের রচিত তথাকথিত সঠিক ইতিহাস মানুষকে শেখাবার ও হজম করাবার নানা চেষ্টা করেছেন। ইমাম হুসাইনের গুনগান গেয়ে কৌশলে ইয়াজীদের পক্ষে বহু বইপুস্তক লিখেছেন। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে মুসলমানেরা বিভ্রান্ত হননি। যুগে যুগে তাদের শত সহস্র প্রচেষ্টা সত্বেও নবীর দৌহিত্রের হত্যাকারীকে কেউ মেনে নেননি।
১২। হুসাইনের হত্যাকারীদের চরম পরিণতি:
হুসাইনকে হত্যা করার পর ইয়াজীদ একটি দিনও শান্তিতে থাকতে পারেননি। চতুর্দিকে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠে। মরিয়া হয়ে তিনি মক্কা ও মদীনা আক্রমণ করেন। হাজার হাজার সাহাবীকে হত্যা করেন। নারীদের ধর্ষণ ও লাঞ্চিত করেন। এতো করেও ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠে। মাত্র ৩ বছরের মাথায় তার মৃত্যু ঘটে। মুসলমানের ঘৃনা এবং আল্লাহর লানত তাকে ঘেরাও করে। যে রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্যে এতো হত্যাকান্ড, সাহাবীদের হত্যা, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, জুলুম নির্যাতন, সে রাষ্ট্র ক্ষমতায় তিনি থাকতে পারলেন না। পারলেন না দুনিয়াতে বেঁচে থাকতেও। ইমাম য’হরী (রহঃ) বলেন, যারা হযরত হুসাইনের হত্যাকান্ডে অংশগ্রহন করেছিলেন, তাদের মধ্যে একজনও রেহাই পায়নি। দুনিয়াতেই তারা চরম পরিণতি প্রাপ্ত হয়েছে। আর আখেরাত তো রয়েছেই। আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকেও একইভাবে হত্যা করা হয়। আবদুল মালেক ইবনে উ’মায়ের লাইছি’র বর্ণনা, তিনি বলেন যে, আমি কুফার রাজপ্রাসাদে হুসাইনের মস্তক আবদুল্লা ইবনে যিয়াদের সামনে একটি থালায় রক্ষিত দেখেছি। আবার একই প্রাসাদে আবদুল্লা ইবনে যিয়াদের খন্ডিত মস্তক দেখেছি মুখতারের সামনে। হুসাইনকে হত্যার মাত্র ৫ বছরের মাথায় ৬৬ হিজরীতে মুখতার ক্ষমতা গ্রহন করে হুসাইনের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করেন এবং একে একে সবাইকে হত্যা করেন। তিনি একদিনেই ২৪৮ জনের কিসাস করেন। ছাবেত ইবনে যাওযী বর্ণনা করেছেন, এক বৃদ্ধ হুসাইনের হত্যায় অংশগ্রহন করেছিল। সে অন্ধ হয়ে যায় এবং ধুকে ধুকে তার মৃত্যু ঘটে। সিরাত গ্রন্থগুলোতে এর অনেক বর্ণনা রয়েছে। মোট কথা হত্যাকারীরা কেউই রেহাই পায়নি। সবারই করুণ মৃত্যু হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানের ক্ষোভ, ঘৃনা এবং বদদোয়া তাদেরকে ঘেরাও করে রাখবে।
১৩। হুসাইন-কে কেন ইমাম বলা হয়?
পুরো মুসলিম বিশ্ব এক কথায় তাকে ইমাম বা নেতা মেনে নিয়েছেন। ইয়াজীদ জনতার উপর চেপে বসেছিল। ইয়াজীদ মুসলিম বিশ্বের নির্বাচিত নেতা ছিল না। সেই সময় থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানেরা ইয়াজীদকে ইমাম বা নেতা হিসাবে মেনে নেননি নেবেনও না। হুসাইনকে ইমাম বলার অর্থ ইয়াজীদকে স্বীকার না করা। ইমাম বা নেতা হুসাইনই। সেকারনে তখন থেকেই যুগে যুগে হুসাইন-এর নাম নেয়ার আগে 'ইমাম' বলা হয়। ইমাম হাসানকেও বিষ প্রয়োগে অত্যন্ত কৌশলে হত্যা করা হয়েছিল। তিনিও মুসলিম জাতির ইমাম। ইয়াজীদের বংশধরদের যতই গা জ্বলুক, কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানেরা হাসান এবং হুসাইনকে ‘ইমাম’ হিসাবেই ঘোষনা দেবেন। আর অন্যদিকে নৃশংসতার প্রতীক ইয়াজীদের নামে আজ পর্যন্ত কোন মুসলমান সন্তানের নাম রাখা হয়নি, কেয়ামত পর্যন্ত হবেও না। যদিও মুসলিম নামধারী শীর্ষ দেশগুলোতে এজিদী শাসন এখনো বলবৎ রয়েছে।
১৪। মুয়াবিয়া- সম্পর্কে আমাদের ধারনা কিরুপ হওয়া উচিত ?
ইয়াজীদকে খলিফা হিসাবে মনোনয়ন দিয়ে হযরত মুয়াবিয়া একটা বড় রকমের ভুল করেছেন-এতে কোনই সন্দেহ নেই। ঐসময়টা ছিল সাহাবী, তাবেইনদের যুগ, খলিফা মনোনয়নের জন্যে অনেক যোগ্য লোক থাকা সত্বেও তিনি কি কারনে পুত্র ইয়াজীদকে মনোনীত করেছিলেন, সেটা আল্লাহই ভাল জানেন। তবে তার বর্তমানে কারবালার এই ঘটনা ঘটেনি। তিনি হযরত আলীর খেলাফতের বিরুদ্ধেও অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন। তিনি চাইছিলেন ওসমান হত্যার প্রতিশোধ আগে নিতে, কিন্তু আলী চাইছিলেন আগে খিলাফত ঠিক করতে। দু’জনই নিজ নিজ অবস্থান থেকে হয়তো সঠিক ছিলেন, যদিও পথ ছিল ভিন্ন। তাদের উভয়েরই ইজতেহাদী অনেক ভুল ছিল। সবার উপরে যে কথা, তাহলো, উভয়েই ছিলেন সম্মানিত সাহাবী। হযরত আলী ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী। সাহাবীদের সম্পর্কে কোন খারাপ ধারনা কোন মুসলমানের থাকতে পারে না। মুয়াবিয়ার ভুলে পরবর্তীতে ইসলামের চরম ক্ষতি হয়েছে।ইসলামের খিলাফত ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, তথাপি একজন সম্মানিত সাহাবী হিসাবে তিনি মুসলমানদের শ্রদ্ধার পাত্রই থাকবেন। কারবালার ঘটনার জন্যে তিনি দায়ী ছিলেন না। দায়ী ছিল তার দুরাচারী পুত্র ইয়াজীদ। নবীর দৌহিত্রকে এমন নৃশংশভাবে হত্যাকান্ডে যার সামান্যতম সম্পর্কও থাকবে, তেমনটা জানলে তিনি নিশ্চয়ই ইয়াজীদকে খলিফা হিসাবে মনোনয়ন দিতেন না। রোম অভিযানে সমুদ্র যাত্রায় নেতৃত্ব দেওয়ায় মুয়াবিয়ার ক্ষমা প্রাপ্তি সংক্রান্তে সহি হাদীস রয়েছে। কাজেই তিনিও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। তবে তাদের ভুলগুলোকেও যারা সুন্নত হিসাবে বিবেচনা করেন তারা কি কারনে করেন তা তো সহজেই অনুমেয়।
১৫। কারবালার ঘটনায় নানা ধরনের ফেরকা:
শীয়া: শীয়া নামধারী মতবাদের লোকজন মনে করেন ইয়াজীদের ক্ষমতা গ্রহন ছিল অনৈসলামিক, যদিও তা বিশিষ্ট সাহাবী মুয়াবিয়ার ইচ্ছাতেই হয়েছিল। মুয়াবিয়ার প্রতিষ্ঠিত রাজতান্ত্রিক পদ্ধতি অবৈধ এবং জুলুম। ইমাম হুসাইনকে ভালবাসা এবং তার হত্যাকারীদের ঘৃণা করা শীয়ারা তাদের ঈমানের অংশ মনে করেন। সাথে সাথে তারা সাহাবীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা পোষন করেন। তাদের ধারনা আলীই ছিলেন প্রথম খেলাফতের দাবীদার। আলীকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করার জন্যে তারা আবু বকর, উমর এবং উসমানকে দায়ী করেন।
সুন্নি: সুন্নিরা উপরোক্ত মতের বিপরীত ধারনা পোষন করেন। পার্থক্য এটাই যে, তারাও হাদীসের আলোকে ইমাম হুসাইনকে ভালবাসেন বলে দাবী করেন।
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত: এটা উল্লেখিত উভয় মতের মাঝামাঝি একটা মতবাদ। এরা ইয়াজীদকে ইসলামী শাসক মনে করেন বিশিষ্ট সাহাবী হযরত মুয়াবিয়া তাকে মনোনীত করার কারনে। ইয়াজীদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইনের রুখে দাড়ানোকে এরা শীয়াদের প্ররোচনা মর্মে বিবেচনা করেন। কুফাবাসীর প্ররোচনায় হুসাইনের কারবালা প্রান্তরে যাওয়ার কারনেই এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ড ঘটেছে বলে এরা মনে করেন। এরা কারবালার যুদ্ধকেও হক আর বাতিলের যুদ্ধ মনে করেন না। এরা ইয়াজীদকে নীম সমর্থন করেন আবার হুসাইনের জন্যেও করুণা প্রদর্শন করেন। তারা হুসাইনকে হত্যার জন্যে ইয়াজীদকে দায়ী করেন না। দায়ী করেন আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে এবং কুফাবাসীকে। এরা ইসলামী খেলাফতকেও ভালবাসেন আবার রাজতন্ত্রকেও মেনে নেন। এরা ইয়াজীদকে ভালও বাসেন না আবার তাকে মন্দও বলেন না। এরা সবসময়ই মাঝামাঝি একটা অবস্থান বজায় রাখেন। কারবালার ঘটনাকে ঘিরে মাতামাতি করাকে এরা সমর্থন করেন না। সাহাবীদের বিরোধ নিয়ে এরা কোন উচ্চবাচ্য করেন না। সাহাবীদের এরা সত্যের মাপকাঠি বিবেচনা করেন।
সালাফী মতবাদঃ এরা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ছায়াতলে থেকে রাজতন্ত্রের অনুকুলে সবকিছুকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন করেন। ইবনে তাইমিয়ার মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এই মতবাদ। রাজতন্ত্রকে ইসলামী বলে প্রচারণা চালানোই এদের প্রধান লক্ষ্য। এরা ইয়াজীদকে ‘রাহমাতুল্লাহ’ বলে সম্ভোধন করেন এবং ইয়াজীদের পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেন। ইয়াজিদ বিরোধী সকল কর্মকান্ডকে শীয়াদের কাজ বলে গন্য করেন। এরা কারবালার যুদ্ধকে নিছক একটা রাজনৈতিক বিরোধের জের মনে করেন। তবে শীয়ারা ১০ই মহররমে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক মিছিল বের করেন তাকে ‘ধর্মীয় কর্মকান্ড’ আখ্যা দিয়ে শিরক-বিদআতের জিগির তুলে তৃপ্তি লাভ করেন। সালাফী মতবাদকে রাজতন্ত্রের অনুকুলে লালিত পালিত একটা ‘সুবিধাবাদী ইসলামী’ মতবাদ আখ্যা দেন অনেকে। এরা সবসময়ই রাজ আনুকুল্য পেয়ে এসেছেন। রাজতন্ত্রের অনুকুলে না গেলে কোন ইসলামী ব্যাখ্যাই এরা মেনে নেন না। এই মতবাদে বিশ্বাসী অনেক আলেম ও মুফতি রয়েছেন, যারা সবকিছুকেই রাজতন্ত্রের অনুকুলে তাদের ইসলামী ব্যাখ্যা পেশ করেন এবং রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার প্রধান শক্তি ‘বিভাজন’-কে এরা যারপরনাই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। মুসলিম আকিদায় বিশ্বাসীদের মাঝে শীয়া, সুন্নী ইত্যাদি বিভাজন করে রাখতে এরা অগ্রনী ভূমিকা পালন করে আসছেন।
[এখানে আল-কোরআনের আয়াতগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য, তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো এবং দলাদলি করে বিভক্ত হয়ো না ৷ (আল-ইমরান/১০৩)
আর তাদের মতো হয়ো না যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল আর মতভেদ করেছিল তাদের কাছে সুস্পষ্ট নির্দেশাবলী আসার পরেও। আর এদেরই জন্য আছে কঠোর শাস্তি (৩: ১০৫)
নিঃসন্দেহ যারা তাদের ধর্মকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দল হয়ে গেছে, তাদের জন্য তোমার কোনো দায়দায়িত্ব নেই। নিঃসন্দেহ তাদের ব্যাপার আল্লাহ্র কাছে, তিনিই এরপরে তাদের জানাবেন যা তারা কী করেছিল। (৬: ১৫৯)
এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা তাদের ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত। (রুম/৩২)
''ধর্মকে কায়েম করো, আর এতে একে-অন্যে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’’ মুশরিকদের জন্য এ বড় কঠিন ব্যাপার যার প্রতি তুমি তাদের আহ্বান করছ! আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা করেন তাকে তাঁর কারণে নির্বাচিত করেন, আর তাঁর দিকে পরিচালিত করেন তাকে যে ফেরে। (৪২: ১৩)
অনেক মানুষ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে। (১২: ১০৬)
কাজেই বোঝা গেলো, ইসলামে ঐক্য ফরয আর বিভক্তি হারাম। যারা এই বিভক্তির কাজ যারা করেন তারা আল-কোরআনের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেন। আর এটা সুষ্পষ্ট কুফরী।]
১৬। হুসাইন কি যুদ্ধ করতে বেরিয়েছিলেন?
উত্তর হলো না। তার হাতে কুফাবাসীরা বাইয়াত করবে বলে অঙ্গীকার করেছিলেন এবং ইয়াজীদী শাসন ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থার ব্যত্যয় বিধায় তিনি কুফাবাসীর বাইয়াত গ্রহনের মনস্থ করেই বেরিয়েছিলেন। ঐ সময়ে মুসলিম উম্মাহ ইয়াজীদকে মেনে নেননি। ইয়াজীদের পিছনে জাতী ঐক্যবদ্ধ ছিল না। সিরিয়াবাসীকে বাদ দিলে পুরা জাতিই ছিল ইয়াজীদের বিরুদ্ধে। কাজেই হুসাইন ইসলামের স্বার্থেই পরিবার পরিজন নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধ করবেন এমন প্রস্তুতি নিয়ে বের হননি। তেমনটা হলে নিজ পরিবার-পরিজন ও নারী শিশুদের নিয়ে বের হতেন না। তবে জালিমরা তাকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছেন এবং তিনি মজলুম অবস্থায় শহীদ হয়েছেন।
১৭। কারবালার ইতিহাসকে বিকৃত করার উপাদান:
শীয়া নামধারী কিছু লোকজন আশূরার দিনে শোক পালনের নামে নানা বিদআত ও শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত হন। আর তাদের এই কার্যকলাপ দরবারী আলেমদের জন্যে হয় পোয়াবারো। কেননা এগুলোর বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা কারবালার পুরো ইতিহাসকেই ইয়াজীদের পক্ষে দাড় করিয়ে দেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করার নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত হন। আবার কিছু লোক কারবালার ইতিহাসকে ঘিরে নানা কল্পকাহিনী ফেঁদে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন।
১৮। ইয়াজীদ এবং হুসাইন উভয়ের পক্ষে থাকার রহস্যঃ
ইয়াজীদ প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে হুসাইনের হত্যার জন্যে দায়ী ছিলেন। তিনি হত্যাকারীদের কোন শাস্তি তো দেনইনি, তাদেরকে অপসারনও করেননি। এমন পাপিষ্ঠ লোকের পক্ষে যারা ওকালতি করেন, তারা আবার হুসাইনের জন্যেও মায়াকান্না করেন। একটিবার নিজের বিবেককে জিজ্ঞেস করুন, যারা ইয়াজীদকে ভালবাসেন, তারা মুখে যতই বলুন, তাদের অন্তরে হুসাইনের পক্ষে বিন্দুমাত্র ভালবাসা কি থাকতে পারে? মানুষ একইসাথে শিকার এবং শিকারীর পক্ষে থাকতে পারেন না। হুসাইনকে যেহেতু মহানবী জান্নাতের সর্দার আখ্যায়িত করেছেন, সে কারনে রাজতন্ত্রের তল্পীবাহকরা হুসাইনের বিরোধিতায় শক্তহাতে কলম ধরতে পারছেন না বলেই প্রতীয়মান।
১৯। কারবালার ঘটনায় মুসলমানদের অবস্থান:
[এর আগে জানতে হবে মুসলমান কারা?
আল্লাহপাক বলেন,
আর কে বেশী উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করে এবং আল্রাহর নির্দেশ মেনে চলে এবং বলে, আমি 'মুসলিম' [আল কোরআন, ৪১: ৩৩]
সুরা আল ইমরানে বলা হয়েছে, তাহলে বলে দিন (ওদেরকে) তোমরা সাক্ষী থাকো একথার যে আমরা সর্বান্তকরনে আল্লাহতে আত্মসমর্পনকারী 'মুসলিম' [৩: ৬৪]]
মুসলিমরা কারবালার ঘটনার জন্যে পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে ইয়াজীদকে দোষী সাব্যস্থ করেন। তবে ইয়াজীদকে কাফের নয়, ফাসিক মনে করেন। ইয়াজীদকে দোয়াও করেন না, অভিশাপও দেন না। কেননা অভিশাপ এবং গালাগাল দেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। তারা হুসাইনের এই কুরবানীকে রাজনৈতিক দন্দ মনে করেন না। বরং ইসলামের পক্ষে ইমাম হুসাইনের এই সিদ্ধান্তকে তারা মনেপ্রাণে সমর্থন করেন। তারা শিয়া-সুন্নি উভয়ের বাড়াবাড়িকে অপছন্দ করেন। হুসাইনের এই ত্যাগ থেকে শিক্ষা গ্রহন করে ইসলামী শাসনের পক্ষে উজ্জীবিত হওয়া উচিত বলে এরা মনে করেন।
২০। ইমাম হুসাইনের বিরুদ্ধে যত অপপ্রচার:
ক। রাজতন্ত্রপন্থীরা মনে করেন হুসাইন ক্ষমতার দাবিদার ছিলেন বিধায় তিনি কুফাবাসীর প্ররোচনায় যুদ্ধে যেতে উদ্ভুদ্ধ হয়েছিলেন। অনেক সাহাবী তাকে কুফায় যেতে নিষেধ করেছিলেন।
প্রকৃত সত্য: হুসাইন মোটেই ক্ষমতার লোভে বের হননি। ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থার দিক পরিবর্তন লক্ষ্য করেই তিনি জীবন দিতেও কুন্ঠিত ছিলেন না। [বিস্তারিত জানার জন্যে পড়ুন, মুহররমের শিক্ষা, সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী] আর বিশিষ্ট সাহাবীরা তাকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন, কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে আঁচ করতে পেরেই। অন্য কারনে নয়।
খ। হযরত উসমান এবং আলীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তারা সবাই হুসাইনের চেয়ে বেশী মর্যাদাশীল ছিলেন। কিন্তু মুসলমানেরা কেবল হুসাইনের মৃত্যুকেই শোকবহ মনে করে।
প্রকৃত সত্য: ইসলামের ইতিহাসে অনেক নবী রসুলসহ খলিফা হযরত উসমান, হযরত আলীসহ হুসাইনের চাইতেও বেশী মর্যাদাপূর্ণ আরো অনেক বড় বড় মহান ব্যক্তির হত্যাকান্ডের ঘটনা থাকলেও ৬১ হিজরীর কারবালার ঘটনা এতোটাই পৈচাশিক ও নির্মমতম ছিল যে এটা যুগে যুগে কঠিন হৃদয়কেও নাড়া দিয়েছে, এখনো দেয় এবং নিঃসন্দেহ তা কেয়ামত পর্যন্ত জালিমদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতে ও ইসলামী খেলাফতের পক্ষে মুমীনদের উদ্ভূদ্ধ করায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে। ১৪০০ বছর পেরিয়ে গেলেও মানুষ এখনো শোকার্ত হয়। সাম্প্রতিককালের আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া রাজন হত্যার কথাই ধরুন, প্রতিদিনই অনেক শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু রাজন হত্যায় যে নৃশংসতা হয়েছে, তা কঠিন হৃদয়কেও নাড়া দিয়েছে। হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে সরকারকে বাধ্য করেছে।
গ। হিজরত ও জিহাদ ও বিপদে ধৈর্য্য ধারনের তাদের (হাসান ও হুসাইন) ভাগ্যে জোটেনি, যা আহলে বাইতের অন্যান্যের নসীব হয়েছিল। [আশুরা ও কারবালা, আবু আহমাদ সাইফুদ্দীন বেলাল, পৃষ্ঠা-৪০]
প্রকৃত সত্য: হুসাইনের জীবনী এবং ইতিহাস পাঠ করলে এটা সুষ্পষ্ট যে, হিজরত, জিহাদ এবং বিপদে ধৈর্য্য ধরন সবকিছুই তার ভাগ্যে জুটেছে। হিজরত এবং জিহাদ করেই তো তিনি জীবন দিলেন। অপপ্রচারকারী রাজতন্ত্রের এজেন্টরা অতীতেও ছিল এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। ইতিপূর্বে কোন মুসলমান তো দুরের কথা, অমুসলিমরাও হুসাইনের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপবাদ দেয়নি। নব্য সালাফীরা অত্যন্ত কৌশলে ইদানীংকালে এ হীন কাজটি করে চলেছেন।
ঘ। হুসাইনকে যারা সমর্থন করেন, তার জন্যে শোক প্রকাশ করেন, তারা শিরক বিদআতে লিপ্ত।
প্রকৃত সত্য: কারবালার ঘটনাকে ঘিরে শিয়া নামধারী কতিপয় গোষ্টির কিছু শিরকী কর্মকান্ড বিদ্যমান আছে-একথা সত্য। কিন্তু সেসবকে উপাদান ধরে পুরো ইতিহাস পাল্টিয়ে দেয়ার ধুরন্ধর অপচেষ্টা রাজতন্ত্রের দরবারী আলেমরা হরহামেশাই করে যাচ্ছেন। রাজতন্ত্রীরা যতই চেষ্টা করুন, কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানেরা কারবালার নৃশংসতাকে ঘৃনা করেই যাবে। ঘৃনা হুসাইনের হত্যাকারীর প্রতি, ঘৃনা রাজতন্ত্রের প্রতি। মুসলমানের বুক পূর্ন থাকবে আহলে বাইতের প্রতি এবং তাদের আদর্শের প্রতি।
২১। ইয়াজীদের পক্ষে যত প্রচারনা-
ক। ইয়াজীদ কারবালার হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন না।
প্রকৃত সত্য: আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ার ৮ম খন্ডে তার একটা উক্তি দেখা যায়। তাহলো-মৃত্যু কালে তিনি প্রার্থনা করছেন এই বলে যে, ‘‘হে আল্লাহ তুমি আমায় পাকড়াও করো না এই জন্যে যে যা আমি চাইনি এবং প্রতিরোধও করিনি। তুমি আমার ও ওবায়দুল্রাহ বিন জিয়াদের মধ্যে ফয়ছালা করো।’’ তার এই প্রার্থনায় তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি ঐ ঘটনার প্রতিরোধ করেননি। অথচ ইচ্ছা করলেই প্রতিরোধ করতে পারতেন। এই হত্যাকান্ডে তিনি নিজের চাইতেও ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে বেশী দায়ী করেছেন।
কিন্তু সত্য তো এটাই যে, এই হত্যাকান্ড তার অমতে হয়নি। হত্যাকারীকে তিনি কোন সাজাও দেননি, অপসারনও করেননি। প্রতিরোধও করেননি। ঘটনা ঘটতে দিয়েছেন এবং পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েও হত্যাকারীর পক্ষাবলম্বন করেছেন। কোন শাস্তি দেননি। রাস্ট্রপ্রধান হিসাবে এ হত্যাকান্ডের দায় তারই। এক্ষেত্রে তাকে নিরাপরাধ প্রমাণ করার মত কোন কিছুই ইতিহাস ঘেটে পাওয়া যায় না।
খ। ইয়াজীদ হুসাইনের কর্তিত মস্তক দেখে ব্যাথিত হয়েছিলেন।
প্রকৃত সত্য: ইয়াজীদ হুসাইনের শাহাদাতের সংবাদ পেয়ে প্রথমে খুশীই হয়েছিলেন। তারপর তিনি লজ্জিত হন। [দেখুন আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪২৩]
গ। ইয়াজীদের ক্ষমা প্রাপ্তি সংক্রান্তে সহি হাদীস আছে।
প্রকৃত সত্য:
‘‘হাদীসে প্রমাণ রয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, রোম সাম্রাজ্যে প্রথম যে সেনাদলটি যুদ্ধ করবে, তাদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে ক্ষমা রয়েছে। আর এ সেনাদলটিকে রাসুল (সা) উম্মে হারাম (রা)এর ঘরে স্বপ্নে দেখেছিলেন। উম্মে হারাম (রা) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন আমাকে তাদের দলভূক্ত করেন। রাসুল (সা) বললেন, তুমি হবে প্রথম দলের যোদ্ধাদের অন্তর্ভূক্ত। উসমান ইবনে আফফানের (রা) এর আমলে ২৭ হিজরীতে সাইপ্রাস বিজয় হয়। আমীর মুয়াবিয়া (রা)-এর পরিচালিত সৈন্যদল যখন সাইপ্রাস যুদ্ধে রত ছিল তখন তাদের সাথে উম্মে হারাম (রা) যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। তারপর তিনি সাইপ্রাসে ইনতিকাল করেন। এরপর দ্বিতীয় সেনাবাহিনীর আমীর ছিলেন তার পুত্র ইয়াজীদ ইবনে মুয়াবিয়া। উম্মে হারাম (রা) ইয়াজীদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি। এটা ছিল নবুওয়াতের অন্যতম প্রধান দলীল।’’
(আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪১৯, প্রথম প্রকাশ-২০০৭, ইসলামী ফাউন্ডেশন)
খেয়াল করুন, রোম সাম্রাজ্যে প্রথম যে সেনাদলটি যুদ্ধ করবে, কেবল তাদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে ক্ষমা রয়েছে। ১ম সেনাদলে ছিলেন মুয়াবিয়া। ইয়াজীদ প্রথম সেনা দলের নন। ১ম সেনাদলটি যুদ্ধ করেছেন ২৭ হিজরীতে। ইয়াজীদ ছিলেন দ্বিতীয় সেনাদলের। রাজতন্ত্রের দরবারী আলেমেরা ইয়াজীদের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে এ হাদীসটিকে বরাবরই ব্যবহার করে আসছেন।
ঘ। ইয়াজীদ সম্পর্কে যত খারাপ কথা বলা হয়, তার সবই মিথ্যা, কেবল শিকার করা ছাড়া।
প্রকৃত সত্য: ইয়াজীদ কেবল হুসাইনের হত্যাকারীই নন। তিনি মক্কা ও মদীনা আক্রমনকারী। মদীনায় সাহাবী হত্যা ও নারীদের গণধর্ষনের অনুমতি দিয়ে তিনি মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে গেছেন মর্মে অনেক বিশিষ্ট আলেম অভিমত দিয়েছেন।
ঙ। সালাফী কতেক আলেম বলে থাকেন হুসাইন অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য ইয়াজিদের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তাই তাঁকে হত্যা করা সঠিক ছিল। তারা বুখারী শরীফের এই হাদীছ দিয়ে দলীল দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন যে,
"একজন শাসকের সাথে তোমরা ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় যদি তোমাদের জামআতে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য কেউ আগমন করলে তাকে হত্যা করো।" (বুখারী)
তারা বলেন, মুসলিমরা ইয়াজিদের শাসনের উপর ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। হুসাইন এসে সেই ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেছেন। সুতরাং তাঁকে হত্যা করা যুক্তিসংগত হয়েছে।
প্রকৃত সত্য: ইয়াজীদের শাসনের পক্ষে মুসলিম জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না এটা সিরাতগ্রন্থগুলো থেকেই সুষ্পষ্ট। হুসাইন যখন তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলের চিঠি পেলেন তখন খেলাফতের দাবী ছেড়ে দিয়ে ইয়াজিদের সৈনিকদের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন।
তাকে মুসলিম রাজ্যের কোন সীমান্তের দিকে যেতে দেয়া হোক।
অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক। কিন্তু ইয়াজীদ বাহিনী এর কোনটিই মানতে রাজি হননি। তারা পাল্টা হুসাইনকে আত্মসমর্পনের প্রস্তাব দিয়ে তাকে বন্দি করতে চাইলেন। তাদের এই প্রস্তাব মেনে নেয়া হুসাইনের জন্যে ওয়াজিব ছিল না। তিনি এহেন জালিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকেই বেছে নিলেন। কাজেই দরবারী আলেমদের অসত্য বক্তব্যে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন কারন নেই। বেহেস্তবাসী যুবকদের সর্দার এই মজলুম ব্যক্তিটির বিরুদ্ধে বুখারী শরীফের এই হাদীস বর্ণনা করে রাজতন্ত্রপন্থীরা মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছেন অত্যন্ত সুকৌশলে। পাঠকগণ একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, ইয়াজীদের সাথে মুসলমানেরা ঐক্যবদ্ধ থাকাবস্থায় হুসাইন বিদ্রোহ করেছেন, এটা একেবারেই মিথ্যা কথা। ইরাকের, মদীনার এবং মক্কার মুসলমানেরা ইয়াজীদকে ঐ সময় মেনে নেননি। সাহাবীরা তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না। কাজেই বুখারী শরীফের এই হাদীস হুসাইনের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্রও প্রযোজ্য নয়। তিনি স্ত্রী, পুত্র, নারী-শিশু পরিবার পরিজন নিয়ে যুদ্ধ করতেও বের হননি, এটা বলাই বাহুল্য। রাজতন্ত্রপন্থীরা সাধারণ লোকজনের মাঝে ধুঁয়াশা সৃষ্টির জন্যেই এটার আশ্রয় নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেন।
ঙ। ইয়াযীদ-এর নামের সাথে ‘রাহমাতুল্লাহি’ বলা উচিত।
প্রকৃত সত্য: রাজতন্ত্রের দরবারী আলেমরা এতোই বেপরোয়া যে, তারা হুসাইনের বিপরীত শক্তি ইয়াযীদ-এর নামের সাথে ‘রাহমাতুল্লাহি’ বলা শুরু করেছেন। অবশ্য অতীতে রাজতন্ত্রীদের এতোটা নির্দয় আচরন করতে দেখা যায়নি। আহলে বাইতের দুশমনেরা চিরকাল মুসলমানের দুশমনই থাকবেন। মক্কা-মদীনা আক্রমণকারী, প্রচুর সাহাবীর হত্যাকারী, মদীনায় লুন্ঠন ও ধর্ষনের নিদের্শদানকারী, কারবালার ঘটনার মুল রূপকার ইয়াযীদকে কি কারনে ‘রাহমাতুল্লাহি’ বলার দরকার পড়লো তা কি সহজেই অনুমেয় নয়?
পরিশিষ্ট: যারা ইয়াযীদের পক্ষাবলম্বন করে রাজতন্ত্রকে ইসলামে হালাল বলে গন্য করতে ব্যতিব্যস্ত, তারা কি আসলেই হুসাইনের প্রতি সহানুভূতিশীল? তাদের লেকচার বা নানা লেখায় তারা হুসাইনের ভক্ত সাজার ভান করেন। এমন একটা ভনিতা করেন যে, তাদের হৃদয় হুসাইনের জন্য পরিপূর্ণ। এটা আসলে শিয়াদের মতই মেকিতা। ইয়াযীদ আর হুসাইন তো কখনোই প্যারালাল নয়। হক আর বাতিল কি একই সরলরেখায় চলতে পারে? কোন মানুষ সরকারের পক্ষেও আছেন আবার বিরোধীদলের পক্ষেও আছেন-একথা কি বাস্তবসম্মত?
২২। আশুরা ও কারবালার ঘটনার মধ্যে মিল-অমিলঃ
মহররম ও আশুরা একটি ফজিলতপূর্ণ মাস ও দিন। এমাসে ও দিনে অনেক নবী-রসুলের ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। ‘আল্লাহ তাআলা আসমান, জমিন, লওহ কলম, সাগর, পর্বত এই দিনে সৃষ্টি করেছেন। আদমকে এ দিনেই ক্ষমা করা হয়েছে, ফেরাউনকে ফোরাতে ডুবানো হয়েছে, নুহ(আঃ)-কে উদ্ধার করা হয়েছে। এই আশুরার দিনেই হযরত ইব্রাহীম(আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। এছাড়াও আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে। মহানবীর আমল থেকেই এ ফজিলত মাসটি পালন হয়ে আসছে। শুকরিয়ার দিন হিসাবে মুসলমানেরা আশুরার রোজা রাখতো। মহানবী(সঃ) এমাসের অনেক ফজিলতের কথা বর্নণা করে গেছেন। কারবালার ঘটনাটি ঘটে মহানবীর ওফাতের অনেক পরে, ৬১ হিজরীতে। কিন্তু ঘটনা চক্রে আশুরার দিনেই কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে যায়, যা আর সবকিছুকে ছাপিয়ে মুসলমানদের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে, মুমীনদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। মুমীনদের কাছে এ মাসটি যেমন শুকরিয়া, নাজাত ও পরিত্রাণের মাস, অন্যদিকে এ মাসটি তাদের জন্য চরম শোক ও বেদনার মাসও। এদিন জালিমের হাতে আহলে বাইতের করুণ মৃত্যু হয়েছে কেবল তাই নয়, ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থার কবর রচিত হয়ে জালিম রাজতন্ত্রের যাঁতাকলে মানবতা নিষ্পেষিত হয়েছে।
[লেখাটি বই আকারে ছাপানোর আগে ব্লগে প্রকাশ করা হলো এই জন্যে যে, আপনাদের মন্তব্য থেকে এটি আরো সমৃদ্ধ ও নির্ভূল করতে পারবো-এই প্রত্যাশায়।]
সার্চ কিওয়ার্ড: এজিদ, এজীদ, ইয়াজিদ, ইয়াযিদ, কারবালা, মহররম, আশুরা, শিয়া, হোসেন, হোসাইন, মু’আবিয়া, মুয়াবীয়া।
বিষয়: বিবিধ
৫০০৭ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
Click this link
একটি বিষয় অনেকে ভুলেযান যে ইয়াজিদ সাহাবি ছিলেন না। তার জন্ম রাসুল সাঃ এর ওফাত এর পর। সুতারাং তার মর্যাদা কিছুতেই ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর সমতুল্য হতে পারেনা।
অসাধারণ বিশ্লেষণ - এই ধরেনের মান সম্পন্ন লেখা আরো বেশী বেশী প্রত্যাশা করি । যেটা অন্যায় তাকে অন্যায় বলে মেনে নিয়ে ফিতনা থেকে দূরে থাকা আর একতার রজ্জু দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরাই একজন প্রকৃত মুসলমানের স্বরূপ হওয়া উচিত।
মন্তব্য করতে লগইন করুন