কি ঘটেছিল সেদিন কারবালায়?
লিখেছেন লিখেছেন আনোয়ার আলী ০৩ নভেম্বর, ২০১৪, ০৮:৫৩:২০ রাত
মহররম মাস ও আশুরার (১০ই মুহররম) দিনটা মুসলিম জাহানের উপর চেপে বসা রাজা-বাদশাহ শেখ ও আমির শাসিত রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্যে একটা চরম বিব্রতকর দিন। রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারনে স্বৈরাচারী শাসক ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে ৬১ হিজরীতে এদিন মহানবীর দৌহিত্র বেহেস্তবাসী যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) শাহাদাত বরন করেছিলেন। তৎকালীণ স্বৈরশাসক ইয়াজিদের হুকুমে তার গর্ভনর ওবাইদুল্লাহ জিয়াদের নেতৃত্বে মহানবীর এই দৌহিত্রকে সেদিন ইতিহাসের নির্মমতম এবং পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে অনেক নবী রসুলসহ খলিফা হযরত উসমান, হযরত আলীসহ হুসাইনের চাইতেও বেশী মর্যাদাপূর্ণ আরো অনেক বড় বড় মহান ব্যক্তির হত্যাকান্ডের ঘটনা থাকলেও ৬১ হিজরীর কারবালার ঘটনা এতোটাই পৈচাশিক ও নির্মমতম ছিল যে এটা যুগে যুগে কঠিন হৃদয়কেও নাড়া দিয়েছে, এখনো দেয় এবং নিঃসন্দেহ তা কেয়ামত পর্যন্ত জালিমদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতে ও ইসলামী শক্তির পক্ষে মুমীনদের উদ্ভূদ্ধ করায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে।
হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কর্তৃক ইয়াজিদকে খলিফা মনোনয়ন ছিল ইসলামী শাসন ব্যবস্থা মুলে কুঠারাঘাত:
মহানবী(দঃ) ইন্তেকালের পূর্বে কাউকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাননি। তিনি জনগনের উপর তার উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ভার ছেড়ে দিয়ে যান। সেইমতে প্রথম চারজন উত্তরাধিকারী তথা খোলাফায়ে রাশেদীন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগন কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু উমাইয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুয়াবিয়া খিলাফত লাভের সাথে সাথে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। ৬৭৬ খ্রীষ্টাব্দে বসরার শাসনকর্তা হযরত মুগিরার প্ররোচনায় তিনি তার জ্যৈষ্ট পুত্র ইয়াজিদকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার মর্মমুলে চরম কুঠারাঘাত করেন। হযরত মুয়াবিয়া এবং হযরত মুগীরা উভয়েই সম্মানিত সাহাবী ছিলেন। যেহেতু তারা কোন নবী বা রসুল ছিলেন না, স্বাভাবিক কারনেই তারা ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন না। কিন্তু তাদের এই ভুল ইসলামের ইতিহাসকে ক্ষত বিক্ষত, রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত করে। ইসলামের শাসন পদ্ধতির মুলে চরম কুঠারাঘাত করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর পুত্র ইয়াজিদ ছিল নিষ্ঠুর, বিশ্বাসঘাতক, অধার্মিক ও মদ্যপায়ী। হযরত মুয়াবিয়ার সম্মানার্থে অনেকেই বলেন তিনি যখন তার পুত্রকে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন, তখন ইয়াজিদ নাকি এমন দুরাচারী ছিল না। মুয়াবিয়া মৃত্যুর পরই নাকি সে এমন হয়েছে। হতে পারে, আল্লাহই ভাল জানেন।
ঐতিহাসিক আল-ফাখরী, ফন ক্রেমার এবং ইবনুত তিকতাকার মতে ইয়াজিদের রাজত্বকাল তিনটি দুষ্কর্মের জন্য বিখ্যাত-প্রথম বছরে সে মহানবীর আদরের দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইনকে হত্যা করে, দ্বিতীয় বছরে মদীনাকে লুন্ঠন করে এবং তৃতীয় বছরে সে কাবার উপর হামলা করে।
এই পাপাচারী ইয়াজিদ-এর খলিফা হিসাবে মনোনয়ন অন্যরা মেনে নিলেও, ইসলামের ব্যত্যয় মহানবীর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন মেনে নিলেন না। হুসাইনের এই ন্যায্য দাবীকে আবদুল্লাহ-ইবনে যুবাইর, আবদুল্লাহ-ইবনে ওমর, আবদুর রহমান-ইবনে আবু বকর সমর্থন করেন। অবশ্য কিছুদিন পর শেষোক্ত দুজন ইয়াজিদের প্রলোভনে পড়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে নেন। ইয়াজিদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হুসাইন এবং আবদুল্লাহ-ইবনে যুবাইর মক্কায় চলে যান।
কারবালার ঘটনা:
ইয়াজিদ ইসলামী শাসন ব্যবস্থার ব্যত্যয় ঘটানোয় ইমাম হুসাইনের মত মুমীন ব্যক্তির পক্ষে সেটা মেনে নেয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। খিলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনই ছিল ইমাম হোসাইনের (রা.) সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থনও ছিল তার পক্ষে। উপরন্তু কুফাবাসীগন ইয়াজিদের অপশাসনের হাত থেকে বাচার জন্যে বারংবার ইমাম হুসাইন-এর সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকলে তিনি তাতে সাড়া দেন। তিনি কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কুফার অবস্থা জানার জন্যে হুসাইন তার চাচাতো ভাই মুসলিম-বিন-আকিলকে সেখানে প্রেরণ করেন। মুসলিম কুফাবাসীর সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে ইমাম হুসাইনকে কুফায় আসতে অনুরোধ করে পত্র লিখেন। কিন্তু এরিমধ্যে ইয়াজিদের অধিনস্থ ইরাকের শাসনকর্তা কঠিন হৃদয়ের ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ মুসলিমকে খুঁজে বের করে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং তাকে সহায়তাকারীদেরও খুঁজে হত্যা করে। এতে কুফাবাসীরা ভীত হয়ে পড়ে। তারা হুসাইনের সাহায্যে এগিয়ে আসতে আর সাহস পেলো না। কুফাবাসীরা ইমাম হুসাইনকে খলিফা হিসাবে দেখতে চাইলেও ইমাম হুসাইনের জন্য প্রাণ বিসর্জণ দিতে রাজি ছিল না। ইয়াজিদের নির্মমতার কথা জেনেও ইমাম হোসাইন (আ) এর সঙ্গীরা যে জেনে শুনে বুঝেই ইমামের সাথে যোগ দিয়েছিলেন তা খুবই স্পষ্ট। ইমামকে ভালোবেসে, তাঁর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রেখেই তাঁরা ইমামের সাথে থেকে প্রাণপণে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সঙ্গীদের ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে, তরবারীর সেই আঘাতের যন্ত্রণার চেয়ে আরো বেশি কষ্টকর ছিল জনগণের অজ্ঞতা এবং মূর্খতার আঘাত। সেজন্যেই জনতার চিন্তার ভূবন থেকে অজ্ঞতার পর্দা অপসারণ করাটাই ছিল তাদেঁর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ।
মুসলিম প্রেরিত পত্র পেয়ে ইমাম হুসাইন স্ত্রী, পুত্র কন্যা, আত্মীয়-স্বজন এবং ২০০ অনুচর সহ কুফার পথে রওনা হন। কুফার ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর হুসাইনকে ইয়াজিদের আনুগত্যের শপথ গ্রহনের নির্দেশ দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তারা ফোরাত নদীর তীর ঘিরে দর্ন্ডায়মান হলো এবং হুসাইন শিবিরের পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিলো।
তাসূয়ার দিনে কারবালার পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ইমামের সঙ্গীরা অবিচল আস্থা ও ইমানের সাথে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। চরম সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও তাঁরা ইমামের সাথে কৃত তাদেঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেননি। এই অনড় ইমানের অধিকারী একজন ছিলেন হযরত আব্বাস (আ)। তিনি ছিলেন হযরত আলি (আ) এর ছেলে। তাঁর মা ছিলেন উম্মুল বানিন। হযরত আব্বাস ছিলেন অকুতোভয় এক যুবক। তাঁর ইমান, বীরত্ব, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলির কথা ছিল প্রবাদতুল্য। দেখতেও তিনি ছিলেন খুব সুন্দর। কারবালার অসম যুদ্ধে তিনিই ছিলেন ইমামপক্ষের প্রধান সিপাহসালার। ইমামের প্রতিরক্ষায়, নারী ও শিশুদের তাঁবুর প্রতিরক্ষায় এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর সন্তানদের জন্যে পানির ব্যবস্থা করতে প্রাণপণে লড়েছেন তিনি।
অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবেন যিয়াদের ৪ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইনকে (রা.) অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। মাত্র ২০০ মানুষের বিপক্ষে ৪০০০ সৈন্য। পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়ায় ইমামের কচি সন্তানেরা প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে হযরত আব্বাস (আ) ফোরাতে যান পানি আনতে। নিজেও তিনি ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলেন। আঁজলা ভরে পানি তুলে খেতে যাবেন এমন সময় তাঁর মনে পড়ে যায় ইমাম হোসেন (আ.) এর তৃষ্ণার্ত শিশু সন্তানের কথা। পানি ফেলে দিয়ে মশক ভর্তি করে তাঁবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই শত্রুপক্ষের তীরে তাঁর এক হাত কেটে যায়। মশকটাকে তিনি অপর হাতে নিয়ে ইমামের তাঁবুর দিকে ছুটলেন। এবার অপর হাতটিও কাটা পড়ে। মশকটাকে এবার তিনি মুখে নিয়ে তাঁবুর দিকে যেতে চাইলেন। শত্রুর তীর এবার সরাসরি তার দেহে আঘাত হানে। এভাবে শহীদ হয়ে যান তিনি। এরপর অসম এই যুদ্ধে আলী আকবর শহীদ হয়ে যান। কারবালায় আরো যাঁরা শহিদ হন তাদেঁর মধ্যে রাসূলের প্রিয় সাহাবা হাবিব ইবনে মাজাহের, তাঁর প্রাচীন বন্ধু মুসলিম ইবনে আওসাজা, নওমুসলিম ওহাবসহ আরো অনেকেই।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দুরাবস্থায় পতিত হয়ে হুসাইন ওবায়দুল্লাহর নিকট তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটা গ্রহনের অনুরোধ জানান। তাহলো-হয় তাকে মদীনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক, কিম্বা তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক, বা ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্যে দামেস্কে যেতে দেয়া হোক। কিন্তু ক্ষমতাদর্পী ওবায়দুল্লাহ এর কোনটাই মানলো না। এদিকে পানির অভাবে হুসাইন শিবিরে হাহাকার পড়ে গেলো। ছোট শিশুরা মুর্ছা যেতে লাগলো। নিরুপায় হুসাইন শেষবারের মত অনুরোধ করলেও, পাষান্ডদের মন গলেনি। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর কারবালার প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধ শুরু হলো। হুসাইনের ভ্রাতুষ্পুত্র কাশিম সর্বপ্রথম শত্রুর আঘাতে শাহাদাত বরন করলেন। তৃষ্ণার্ত হুসাইন শিশুপুত্র আসগরকে কোলে নিয়ে ফোরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলেন কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর শিশুপুত্রের শরীরে বিদ্ধ হয়ে শিশুপুত্রটি শাহাদাত বরন করলে একাকী অবসন্ন হুসাইন তাবুর সামনে বসে পড়লেন। এমন সময় এক মহিলা তাকে এক পেয়ালা পানি এনে দিলো। কিন্তু শত্রুর তীর তার মুখ বিদীর্ণ করে দিলো। সীমার নামীয় ইয়াজিদের এক সৈন্য তরবারীর আঘাতে হুসাইনের মস্তক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো। এই ভয়ন্কর দৃশ্যে কঠিন হৃদয়ও বিগলিত হলো। হুসাইন পরিবারের জীবিত সদস্যদের বন্দী করে দামেস্কে ইয়াজিদের নিকট পাঠানো হয়। এদিকে হুসাইনের মৃত্যুর এমন ভয়াবহ দৃশ্য পুরো দেশের মানুষকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলল। ইয়াজিদ ভয় পেয়ে গেলো। ক্ষমতা নিরাপদ রাখতে এবং জনরোষের ভয়ে কৌশলী ভুমিকায় সে বন্দিদের মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দিলো।
শীয়া সুন্নি ফেরকার সৃষ্টি:
হুসাইনের এই রক্তপাতকে কিছু লোক কোনমতেই মেনে নিতে পারলো না। তারা বিদ্রোহী হলো। তারা ইয়াজিদ এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠলো। এরা ইতিহাসে শীয়া নামে পরিচিত হলো। ১০ই মহররমই এই শিয়াদের জন্ম। মুসলমানরা দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। একপক্ষ অসন্তুষ্ট হলেও ইয়াজিদের শাসন মেনে নিলো। তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নামে একটা নতুন মাযহাবের জন্ম দিলো। যারা এর কিছুই মানলো না তারা শীয়া-নামীয় আরেক নতুন মাযহাবের জন্ম দিলো। মাযহাবীয় এ বিভক্তি ধীরে ধীরে স্থায়ী রুপ নিলো, যা ইসলামী সমাজকে দুর্বল করে দিলো। কারবালার ঘটনা থেকেই মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছিল প্রকটভাবে। ফাতেমী খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা ওবায়দুল্লাহ আল মাহদী শীয়া মতের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। এটা যারা বলেন তার ইতিহাসের বিপরীত এবং সরাচর মিথ্যা বলেন। এছাড়া ওবায়দুল্লাহ আল মাহদী মা ফাতেমার বংশধর ছিলেন কিনা তা নিয়ে তার শাসনামলের এবং তৎপরবর্তী একশ বছর পর্যন্ত কোন বিতর্ক ছিল না। ১০১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিদ্বন্দ্বী আব্বাসীয়রা যে প্রচারপত্র প্রকাশ করে তাতে তাকে ইহুদীর সন্তান বলে গন্য করা হয়। তবে ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন, মাকরিজী, ইবনুল আসীর, আবদুল ফিদা এরা সকলেই বলেছেন তিনি ফাতেমার বংশধর ছিলেন। দরবারী আলেমরা এই বিতর্ককে ভালভাবে কাজে লাগিয়ে খুবই ফায়দা তুলেছেন। আসলে তিনি ইহুদীর সন্তান ছিলেন কি ফাতেমার বংশধর ছিলেন তা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। আসল কথা হলো তিনি শীয়া মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। কারবালার ঘটনা থেকেই শীয়া মতবাদের সুত্রপাত হয়েছিল।
শীয়া এবং সুন্নি-- উভয় মাযহাবের লোকজন নিজ নিজ আকীদা বিশ্বাসকে সহী শুদ্ধ মনে করেন। এই ধরনের মাযহাব ও বিভক্তি ইসলামে সম্পূর্ণই নিষিদ্ধ। মুসলমানেরা এখন পরিচয় দেন, সুন্নি মুসলমান বা শীয়া মুসলমান হিসাবে, যা আদৌ ইসলাম সম্মত নয়। বরং সরাসরি বিদআত হয়।
আল্লাহপাক বলেন,
আর কে বেশী উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করে এবং আল্রাহর নির্দেশ মেনে চলে এবং বলে, আমি 'মুসলিম' [আল কোরআন, ৪১: ৩৩]
সুরা আল ইমরানে বলা হয়েছে, তাহলে বলে দিন (ওদেরকে) তোমরা সাক্ষী থাকো একথার যে আমরা সর্বান্তকরনে আল্লাহতে আত্মসমর্পনকারী 'মুসলিম' [৩: ৬৪]
কাজেই এই বিভক্তি মোটেই কাম্য নয়। কোরআনে বিশ্বাস থাকলে মুসলিম ছাড়া অন্য কোন পরিচয় গ্রহনযোগ্য নয়। সঙ্গত কারনেই এ বিষয়টার অবতারনা করলাম। কোরআন এবং হাদীস যারা মানবে না তারা অমুসলিম হবেন, শীয়া বা সুন্নি হবেন কেন ? কিন্তু অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও, এই শীয়া সুন্নির বিভক্তিও সেই কারবালার ঘটনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।
কুফাবাসীর বেঈমানী ও ইমাম হোসাইনের ভাষণ:
ইমাম হোসাইন (আ কারবালার প্রান্তরে কুফাবাসীদের উদ্দেশে বিশেষ করে ইয়াজিদের দল-বলের উদ্দেশে কয়েকটি ভাষণ বা খুতবা দেন। ইমাম পাক তার একটি ভাষণে বলেন- হে কুফাবাসী! আপনারা জানেন, ইয়াজিদ ও তার লোকজন আল্লাহর রাস্তা ত্যাগ করে শয়তানের রাস্তা ধরেছে। তারা পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ ছড়াচ্ছে। তারা আল্লাহর সীমা লংঘন করে বায়তুল মালকে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করেছে। তারা হালাল-হারামের ধার ধারে না। বন্ধুগণ! আপনারা এটা ভালোভাবেই জানেন, অন্যের চেয়ে খিলাফতের ওপর আমার হকই সর্বাধিক। আপনারা আমার কাছে কুফায় আসার জন্য বারবার চিঠি পাঠিয়েছেন এবং আমার প্রতি আনুগত্য শপথ (বাইয়াত) গ্রহণ করবেন বলে দূত পাঠিয়ে আমাকে অনুরোধ করেছেন। জানিয়েছেন, আপনারা আমার সঙ্গ ত্যাগ করবেন না এবং আমার জীবনকে আপনাদের জীবনের চেয়েও মূল্যবান মনে করবেন।
হে কুফার বাসিন্দারা, আপনারা যদি আপনাদের ওয়াদার ওপর অটল থাকেন তবে হিদায়েত লাভ করবেন। আর যদি আপনারা তা মেনে না নেন এবং বাইয়াত ভঙ্গ করেন তাতেও আমি বিস্মিত হব না, কারণ আপনারা আমার পিতা মওলা আলীর সঙ্গে, আমার ভাই ইমাম হাসানের সঙ্গে এবং আমার চাচাতো ভাই হজরত মুসলিম বিন আকীলের সঙ্গে এর আগে এরকম ব্যবহার করেছেন। আপনারা তো আপনাদের আখিরাত নষ্ট করেছেন, সেই সঙ্গে অন্যকে ধোঁকা দিয়ে নিজেদেরই সর্বনাশ ডেকে এনেছেন। যারা ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে তারা আসলে নিজেদেরই ক্ষতি করে।
কারবালার মাঠে একে একে যখন সবাই শাহাদতবরণ করছে আর ইমাম হোসাইন সবার ছিন্ন লাশ মোবারক তুলে এনে তাঁবুতে রাখছেন। অবশেষে ইমাম পাক তাঁবু থেকে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে সর্বশেষ যে মর্মস্পর্শী ভাষণ দেনÑ হে লোক সকল! আপনারা তাড়াহুড়া ও গোলমাল করবেন না, শান্ত হন। আগে আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে আমার ওপর যে দায়িত্বভার দেয়া হয়েছে তা আমাকে পালন করতে দিন। এখানে আমি কেন এসেছি? কি জন্য এসেছি? তা আপনাদের জানা দরকার। আমার কথাগুলো যদি আপনাদের যুক্তিসঙ্গত মনে হয় তবে তা গ্রহণ করবেন এবং আপনারা যদি আমার প্রতি সুবিচার করতে পারেন তবে সেটাই হবে আপনাদের জন্য চরম সৌভাগ্যের কারণ। আর যদি আমার কথাগুলো মনঃপূত না হয় এবং আপনারা যদি ন্যায়বিচার করা থেকে বিরত থাকেন তাহলে আমার কিছু বলার থাকবে না। আপনারা তখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। হে কুফার বাসিন্দারা, আপনারা আমার বংশীয় মর্যাদা সম্পর্কে চিন্তা করুন।
ইমাম হুসাইনের এই ভাষণ দ্বারাই প্রমাণ হয় যে, কুফাবাসীরা চরম গাদ্দারী করেছে। তারা কথা দিয়ে কথা রাখেনি। তারা বাইয়াত নিতে রাজি ছিল। কিন্তু ইসলামী হুকুমতের জন্য জান-মাল দিতে রাজি ছিল না।তারা ইমাম হুসাইনের পক্ষে থাকতে রাজী ছিল, কিন্তু ইমাম হুসাইনের জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল না।
দরবারী আলেমদের মিথ্যাচার ও ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা
ইয়াজিদ ভাল করেই জানতো, সরাসরি ইমাম হুসাইনের বিরোধিতায় নামলে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই সে এমন নির্মম হত্যাকান্ড ঘটিয়েও কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। তার অধীনস্থ আলেমদের দিয়ে তার পক্ষে জনমত গঠনের অপচেষ্টা করেছিল।
ক্ষমতালোভী দুষ্চরিত্র ইয়াজিদ বেঁচে নেই। কিন্তু ইয়াজিদের প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র এখনো শীর্ষ মুসলিম দেশগুলো কব্জা করে রেখেছে। স্বৈরাচাররা মুসলমানদের বুকে চেপে বসে আছে। মুসলমানদের বোকা বানাবার জন্যে তাদেরও কিছু গৃহপালিত আলেম ইমাম পীর জাতীয় লোক আছেন। এরা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের নামে নানাভাবে চেষ্টা করছে কারবালার ইতিহাসকে ম্লান করে এর গুরুত্বকে খাটো করার। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কায়দা করে বলতে চায়, ইমাম হুসাইন ক্ষমতার লোভেই নাকি কুফায় গমন করেছিলেন। তার এই যাওয়াতে নাকি ইসলামের কোন কল্যাণ ছিল না। এটা নাকি হক আর বাতিলের যুদ্ধ ছিল না। (নাউজুবিল্লাহ)। আল্লাহর লানত এইসব দরবারীর উপর। তারা ইয়াজিদের নৃশংসতাকে এবং ফোরাত নদীর পানি সরবরাহ বন্ধকে সহি নয় মর্মে প্রতিপন্ন করতে তৎপর। কেউ কেউ কারবালার এ ঘটনাকে কেচ্ছা কাহিনী বলতেও দ্বিধা করেনি। ইনিয়ে বিনিয়ে তারা দলীল পেশ করে কেবল দরবারী আলেমদের। তারা বুঝাতে চান, কারবালার ঘটনা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। এ নিয়ে মাতামাতি করে লাভ নেই। ইয়াজিদ হুসাইনের হত্যাকারী নয়। ইমাম হুসাইন মুসলিম জাতির নির্বাচিত আমীর বা খলীফা ছিলেন না। তাকে হত্যা করা জায়েজ ছিল বলেও তারা কৌশলে মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। কোন কোন আলেম তো ইয়াজিদের প্রতি অতিরিক্ত লিখতে গিয়ে তাকে ‘রাহমতুল্লাহ’বলতেও কুন্ঠিত হননি। তবে এইসব দরবারী আলেমরা বড়ই ধূর্ত। তারা প্রথমেই হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর পক্ষে এমনভাবে বন্দনা করেন যে পড়ে মনে হবে তারা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর খুবই ভক্ত এবং পক্ষের লোক। প্রথমেই বোঝাতে চেষ্টা করেন ইমাম হুসাইনের মহব্বতে তাদের কলিজা ভরপুর। কিন্তু ধূর্তামীর আশ্রয়ে 'প্রকৃত ইতিহাস' শেখাবার নামে এবং বড়ই চাতুর্য্যপূর্ণভাবে তারা ইয়াজিদের সাফাই গায়। তারা হযরত ইমাম হুসাইনকে হত্যার জন্য হযরত ইমাম হুসাইনকেই দায়ী করেন। কেউ কেউ শীয়াদের দায়ী করেন। অথচ ঐসময় শীয়া মতবাদের সৃষ্টিই হয়নি। মোট কথা, যে কোনভাবেই যেন ইয়াজিদকে দায়ী করা না হয়। ইমাম হুসাইনের হত্যার দায় কুফাবাসীর উপরও চাপাতে চান। তারা বোঝাতে চান, ইমাম হুসাইন কুফাবাসীর ফাঁদে পড়ে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। অথচ কুফাবাসীদের প্ররোচনায় হুসাইন ইয়াজিদের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন-এমনটা কোন মুসলমান মনে করতে পারে না। বরং ইমাম হুসাইন ইসলামী খেলাফতের পক্ষে এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। এটা ঠিক কুফাবাসীরা কথা দিয়ে কথা রাখেনি। তারা ইমাম পরিবারের সাথে চরম গাদ্দারী করেছে।
দরবারী আলেমরা চরম ধূর্ততার আশ্রয়ে ইয়াজিদকে ভাল শাসক, ইসলামের খেদমতগার বলেও প্রতিপন্ন করতে চান। তাদের মতে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নাকি সহি নয়। তারা মানুষকে বোঝাতে চান, ইয়াজিদ হুসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দিলেও হুসাইনকে হত্যার নির্দেশ দেয়নি। পাঠক খেয়াল করুন ফাঁকিবাজিটা কোথায়। ইয়াজিদ যখন হুসাইনকে হত্যার ঘটনা শুনলো তখন ইয়াজিদ ব্যথিত হয়েছিল বা হত্যাকারীকে শাস্তি দিয়েছিল এমন কোন দলীল তো পাওয়া যায় না। দরবারীরা বলে বেড়ান যে, হুসাইনের ছিন্ন মস্তক ইয়াজিদের দরবারে এলে সেখানে নাকি কান্নার রোল পড়ে যায়। কিন্তু হত্যাকারীকে তো ক্ষমতা থেকে সরিয়েও দেয়নি এবং কোন শাস্তিও দেয়নি। গর্ভনর ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ তো তার স্বপদে বহাল তবিয়তেই ছিল। তাহলে কি বোঝা গেলো? দরবারীরা আরো বুঝাতে চান রাজতন্ত্র তেমন খারাপ কিছু নয়। যুগে যুগে এইসব দরবারীরা নানাভাবে মুসলমানদের সত্য ইতিহাস শেখাবার নামে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করেছে। কারবালার প্রকৃত ইতিহাসকে তারা শীয়াদের অপপ্রচার শীয়া মতবাদ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ যাতে এসব আমল না করে সে লক্ষ্যে তারা শীয়া শীয়া বলে জিগির তুলেছে। কেননা কারবালার ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা মুমীনের মনে দাগ কাটেই। মানুষ জালিম রাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। আর এই চেতনা ঠেকানোই দরবারী আলেমদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
ইয়াজিদকে নিদোর্ষ প্রমানের কেন এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ?
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের পর পুরো মুসলিম বিশ্বের উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে ইয়াজিদ। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর প্রতি সাধারন মানুষের আবেগ বুঝতে পারে ধূর্ত ইয়াজিদ। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সব কিছুই কৌশলে ম্যানেজ করতে হয়। সেই পথেই এগুলো ইয়াজিদ। ভাবখানা এমন যে ইমাম হুসাইনকে সে হত্যার স্পষ্ট নির্দেশ দেয়নি। তার পক্ষে জনমত গঠনে নানা প্রচেষ্টায় লিপ্ত হলো সে অত্যন্ত ধূর্তামীর সাথে। তার সাথী হলো কিছু দরবারী আলেম। সাহাবাদের নানাভাবে কোনঠাসা করা হলো। কারবালার যুদ্ধে ইয়াজিদ দায়ী হলে, ইমাম হুসাইনের যুদ্ধ বৈধতা পায়। মানুষ রাজতন্ত্রকে ঘৃনা করবে এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠবে। কাজেই সেটা যাতে হতে না পারে সে দায়িত্ব পালন করছেন এইসব দরবারী আলেমরা। কিছু তথাকথিত শীয়া ইমাম এবং কিছু সুন্নি ইমাম দিয়ে নানা কল্পকাহিনী ফেঁদে কারবালার ইতিহাস পাল্টে দেয়ার অপচেষ্টা অতীতেও হয়েছে এবং এখনো ঠিক সমভাবেই হচ্ছে। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) কেন ইয়াজিদের বিরুদ্ধে গেলেন, মদিনা থেকে কেন বের হলেন নানাভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে তার জন্য ইমাম হুসাইনকে ক্ষমতালোভী আখ্যায়িত করে প্রকারান্তে তাকেই দোষী সাব্যস্থ্য করার অপচেষ্টাও কম হয়নি। তারা বলেন কুফায় যাওয়ার কারণেই ইয়াজিদ ইমাম হুসাইনকে শহীদ করতে সক্ষম হয়েছিল। তারা বুঝাতে চান, অন্যায়ের বিরোধিতা করে হুসাইন ঠিক কাজ করেননি। ইয়াজিদের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে হুসাইনই অন্যায় কাজ করেছেন। তারা বলতে চান, মুসলিমরা ইয়াজিদের শাসনের উপর ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। হুসাইন এসে সেই ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেছেন (নাউজুবিল্লাহ)। আবার কিছু সুবিধাবাদী আলেম বলেছেন, ইয়াজিদকে ভালও বলা যাবে না, আবার খারাপও বলা যাবে না। গোঁজামিলটা খেয়াল করুন। নবীর দৌহিত্রের হত্যাকারী জালিম শাসককে নাকি ভাল খারাপ কোনটাই বলা যাবে না। এই না বলার অর্থ কিন্তু ইয়াজিদকে সমর্থণ করাই। অনেকে কারবালার যুদ্ধকে হক ও বাতিলের যুদ্ধ নয় বলে অভিমত দিতেও কুন্ঠিত হলেন না। প্রকারান্তরে তারা বলতে চান, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) হকের পক্ষে ছিলেন না (নাউজুবিল্লাহ)।
ইয়াজিদের সমর্থনে কিছু জাল হাদীসও যুগে যুগে মানুষকে গেলানোর অপচেষ্টা হয়েছে। তার একটা হলো من وسع على عياله يوم عاشوراء وسع الله عليه سائر السنة. قال الإمام أحمد : لا يصح هذا الحديث
“যে ব্যক্তি আশুরার দিনে তার পরিবারবর্গের লোকদের জন্য সচ্ছলতার (ভাল খাবার) ব্যবস্থা করবে আল্লাহ সারা বছর তাকে সচ্ছল রাখবেন।”
এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেছেন; হাদীসটি সহীহ নয়। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইবনে কায়্যিম জাওযী রহ. এ হাদীস সম্পর্কে বলেছেনঃ
رواه الطبراني عن أنس مرفوعا، وفي إسناده الهيصم بن شداخ وهو مجهول، ورواه العقيلي عن أبي هريرة وقال: سليمان بن أبي عبد الله مجهول، والحديث غير محفوظ، وكل طرقه واهية ضعيفة لا تثبت
“তাবারানী হাদীসটি আনাস রা. সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ সূত্রে হাইছাম ইবনে শাদ্দাখ নামের ব্যক্তি অপরিচিত। এবং উকায়লী বর্ণনা করেছেন আবু হুরাইরা রা. থেকে। এবং তিনি বলেছেনঃ এ সূত্রে সুলাইমান বিন আবি আব্দুল্লাহ নামের ব্যক্তি অপরিচিত। হাদীসটি সংরক্ষিত নয় আর এ হাদীসের প্রত্যেকটি সূত্র একেবারে বাজে ও খুবই দূর্বল।(আল-মানারুল মুনীফ ফিসসহীহ ওয়াজ যয়ীফ : ইবনে কায়্যিম জাওযী -রহ.)
ইয়াজিদ আর রাজতন্ত্রকে বৈধতা দেবার কি প্রাণান্তর অপচেষ্টা হয়েছে, এসব ঘটনাই তার প্রমাণ। না জানি আরো কত জাল হাদীস তারা সৃষ্টি করে রেখেছে।
অতীতের সেই ইয়াজিদের প্রেতাত্মারা এখনো মুসলিম বিশ্বের মজলুম মানুষের বুকে চেপে বসে আছে। ইসলামী ছদ্মবেশ গায়ে মাখিয়ে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানাবার সেই পুরোনো কৌশলকে নানাভাবে বিস্তৃত করেছে তারা। তাদের কারনেই মুসলমানের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস আজ ইহুদীদের বুটের তলায় পিষ্ট হয়ে লাঞ্চিত, দলিত, অপমাণিত। মুসলমানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় কেবলা মক্কা মদীনা শাসন করছে তারাই, যারা মুসলিম জাহানের বড় গাদ্দার এবং পশ্চিমাদের পদলেহী সেবাদাস। বংশানুক্রমে এরা ক্ষমতা আঁকড়ে আছে আর এই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বংশানুক্রমে পশ্চিমাদের দাসত্ব করে আসছে। অথচ মক্কা-মদীনার অবস্থান হওয়ার কারনে এই দেশটি মুসলিম বিশ্বের হৃদপিন্ড হিসাবে গোটা মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারতো।পারতো মুসলমানদের সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে। কিন্তু তারা নিজেরাই পশ্চিমা পুঁজারী, জাতীয়তাবাদ পুঁজারী। ইসলামে নিষিদ্ধ আরব জাতীয়তাবাদের পুঁজারী এই সব শাসকেরা ইসলামের বিকৃত ইতিহাস মুসলমানদের গেলানোর নানা প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে সঙ্গত কারনেই। তাদের দান খয়রাতের অর্থে পরিচালিত বিভিন্ন মুসলিম দেশের কিছু ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসাগুলোতে ইয়াজিদের পক্ষে বড়ই চাতুর্যে্যর সাথে শিক্ষা দেয়া হয়। ধুর্তামীতে পরিপূর্ণ এই সব লেখার শিরোনাম দেখে মনে হবে ইমাম হুসাইনের পক্ষে লেখা। কিন্তু অত্যন্ত সচেতনভাবে ও সুকৌশলে তাতে ইয়াজিদের পক্ষে প্রচারনা চালানো হয়।
সম্মানীত সাহাবীরা কেন ইমামকে কুফা যা্ওয়া রুখতে চেয়েছিলেন ?
ইমাম হুসাইন যখন কুফাবাসীর পত্র পেয়ে কুফায় যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন অনেক সম্মানীত সাহাবী তাকে যেতে নিষেধ করেছিলেন। তারা কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি আগে থেকেই অনুমান করেছিলেন বলেই হুসাইনকে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কোনভাবেই ইয়াজিদকে সমর্থণ করে নয়। কিন্তু তাদের এই নিষেধের বিষয়ে ইয়াজিদের সমর্থকেরা/রাজতন্ত্রপন্থীরা এটাকে ইয়াজিদের পক্ষে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে।
ইয়াজিদ এই হত্যাকান্ডের সাথে কতটুকু জড়িত ছিল?
মাত্র ৩৭ বৎসর বয়সে ইয়াজিদের মৃত্যু ঘটে। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ার ৮ম খন্ডে তার একটা উক্তি দেখা যায়। তাহলো-মৃত্যু কালে সে প্রার্থনা করছে এই বলে যে, ‘‘হে আল্লাহ তুমি আমায় পাকড়াও করো না এই জন্যে যে যা আমি চাইনি এবং প্রতিরোধও করিনি। তুমি আমার ও ওবায়দুল্রাহ বিন জিয়াদের মধ্যে ফয়ছালা করো।’’ তার এই প্রার্থনায় সে নিজেই স্বীকার করেছে সে ঐ ঘটনার প্রতিরোধ করেনি। অথচ ইচ্ছা করলেই প্রতিরোধ করতে পারতো। এই হত্যাকান্ডে সে নিজের চাইতেও ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে বেশী দায়ী করেছে।
কিন্তু সত্য তো এটাই যে, এই হত্যাকান্ড তার অমতে হয়নি। হত্যাকারীকে সে কোন সাজাও দেয়নি। প্রতিরোধও করেনি। ঘটনা ঘটতে দিয়েছে এবং পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েও হত্যাকারীর পক্ষাবলম্বন করেছে। কোন শাস্তি দেয়নি। রাস্ট্রপ্রধান হিসাবে এ হত্যাকান্ডের দায় তারই। এক্ষেত্রে তাকে নিরাপরাধ প্রমাণ করার মত কোন কিছুই ইতিহাস ঘেটে পাওয়া যায় না।
ইয়াজিদকে সমর্থনকারীদের সাথে মুসলমানের সম্পর্ক:
যারা নবীর দৌহিত্রের হত্যাকারী জালিম ইয়াজিদকে সমর্থণ করে, তাদের সাথে মুসলমানের একটাই সম্পর্ক, আর তা হলো তারা ইসলামের দুশমন। নবী পরিবারের দুশমন। মুসলমানরা একই সময় আলী ও তাঁর হত্যাকারীর অনুসারী এবং হুসাইন ও তাঁর হত্যাকারীর অনুসারী হতে পারে না; মুসলমানরা হয় আলীর সাথে নতুবা তার হত্যাকারীর সাথে অথবা হুসাইনের সাথে বা ইয়াযিদের সাথে। অনেকেই বলেন ইয়াজিদ তার আমল নিয়ে চলে গেছে তাকে খারাপ বলে কি লাভ? ফেরাউন, আবু লাহাব, আবু জেহেলও তো তাদের আমল নিয়ে চলে গেছে। ইসলামকে এবং নবীকে ভালবাসলে ঐসব দুরাচারী শয়তানদের ঘৃণা করতেই হবে। ভালকে যেমন ভাল বলতে হবে ঠিক তেমনি খারাপকে খারাপ বলাও ঈমানের দাবী।
পবিত্র সহি বুখারী হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি, তিনি হাসান বিন আলীকে কাঁধে নিয়ে বলেছেনঃ হে আল্লাহ! আমি একে ভালবাসি। সুতরাং তুমিও তাঁকে ভালবাসো এবং যে তাঁকে ভালবাসে তুমি তাকেও ভালবাসো।
বুখারী শরীফের আরেকটি হাদীসে বলা হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, এরা দুজন (হাসান ও হুসাইন) আমার দুনিয়ার দুটি ফুল।
তিরমিজী শরীফের আরেকটি হাদীসে বলা হয়েছে,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
হাসান ও হুসাইন জান্নাতবাসী যুবকদের সরদার হবেন।
নবীজীর এই কলিজার টুকরাকে হত্যাকারী ইয়াজিদকে কোন মুসলমান সমর্থণ করতে পারেন না। ইয়াজিদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অটুট রাখতে ইয়াজিদের নিদের্শে তার পাপিষ্ঠ সেনারা ইমাম হুসাইনকে হত্যা করেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহ এমন জিনিস, ইয়াজিদ মুয়াবিয়ার (রাঃ) মত সাহাবার সন্তান হওয়া সত্বেও নবীজীর কলিজার টুকরা দৌহিত্রকে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি। আর দরবারী আলেমদের কথা তো বলাই বাহুল্য। তারা যুগে যুগে তাদের রচিত তথাকথিত সঠিক ইতিহাস মানুষকে শেখাবার ও হজম করাবার নানা চেষ্টা করেছেন। ইমাম হুসাইনের গুনগান গেয়ে কৌশলে ইয়াজিদের পক্ষে বহু বইপুস্তক লিখেছেন। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে মুসলমানেরা বিভ্রান্ত হননি। যুগে যুগে তাদের শত সহস্র প্রচেষ্টা সত্বেও নবীর দৌহিত্রের হত্যাকারীকে কেউ মেনে নেননি।
হুসাইন (রাঃ)-কে কেন ইমাম বলা হয়?
পুরো মুসলিম বিশ্ব এক কথায় তাকে ইমাম বা নেতা মেনে নিয়েছেন। ইয়াজিদ জনতার উপর চেপে বসেছিল। ইয়াজিদ মুসলিম বিশ্বের নির্বাচিত নেতা ছিল না। সেই সময় থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানেরা ইয়াজিদকে ইমাম বা নেতা হিসাবে মেনে নেয়নি নেবেও না। হুসাইনকে ইমাম বলার অর্থ ইয়াজিদকে স্বীকার না করা। ইমাম বা নেতা হুসাইনই। সেকারনে তখন থেকেই যুগে যুগে হুসাইন-এর নাম নেয়ার আগে 'ইমাম' বলা হয়। ইমাম হাসানকেও বিষ প্রয়োগে অত্যন্ত কৌশলে হত্যা করা হয়েছিল। তিনিও মুসলিম জাতির ইমাম। ইয়াজিদের বংশধরদের যতই গা জ্বলুক, কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানেরা হাসান এবং হুসাইনকে ‘ইমাম’ হিসাবেই ঘোষনা দেবেন। আর অন্যদিকে নৃশংসতার প্রতীক ইয়াজিদের নামে আজ পর্যন্ত কোন মুসলমান সন্তানের নাম রাখা হয়নি, কেয়ামত পর্যন্ত হবেও না। যদিও মুসলিম নামধারী শীর্ষ দেশগুলোতে এজিদী শাসন এখনো বলবৎ রয়েছে।
মুসলিম বিশ্বে কারবালার ঘটনার প্রভাব-
কারবালার ঘটনা ইসলামী সমাজে এত অধিক গুরুত্ব পেয়েছে যে কারনে, তা হলো মুসলমান মাত্রই জালিমের রিরুদ্ধে, ইসলামী খিলাফতের পক্ষে। কারবালার এ ঘটনা মুসলমানদের জেগে উঠার প্রেরণা যোগায় বলে এ যুগের নব্য জালিম শাসকেরা বড়ই বিচলিত। এ কথা ঠিক যে, কারো মৃত্যুর জন্য মাতম করার রীতি ইসলাম সমর্থণ করে না। এটা বিদআত। অনেকেই না জেনে সেটা করেন। শিয়া নামধারী কিছূ লোকজন এই সব করেন বলেই ইয়াজিদের সমর্থকদের পোয়াবারো হয়। তারা উছিলা পেয়ে যায় কারবালার ঘটনাকে শিরক বিদআত বলার। কিন্তু সে কারনে কারবালার ইতিহাস মলিন হওয়ার নয়। ইসলামের ইতিহাসে অনেক দুঃখজনক হত্যাকান্ড ঘটেছে, কিন্তু কারবালার ঘটনা এতই নৃশংস যে মানুষের হৃদয়কে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়। তার শাহাদাত এমন এক অসাধারণ ও অদ্বিতীয় শাহাদাত এবং এমন এক হৃদয় বিদারক ঘটনা, আগের এবং পরের যুগে যার কোন নজীর নেই। এত দীর্ঘস্থায়ী ও এত ব্যাপক শোক, কান্না ও আহাজারি মুসলিম জাতি আর কোন শাহাদাতের জন্য করেনি। মুসলমানদের এই শোক, এই কান্না এই প্রতিবাদ মুসলিম বিশ্বের উপর চেপে বসা নব্য ইয়াজিদদের হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। তা নইলে ইয়াজিদের পক্ষে তারা ইতিহাস বিকৃতিতে এমন মরিয়া হয়ে মাঠে নামছে কেন? কেন মহানবীর কলিজার টুকরা ইমাম হুসাইন(রা)কে হকের পক্ষে ছিলেন না বলে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে মানুষকে তা হজম করাবার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে? কারবালার ঘটনাকে মানুষ কেন এতো গুরুত্ব দিচ্ছে তা নিয়ে মাথা খুটে মরছে। তারা ভাল করেই জানে, কারবালার ঘটনা মানুষকে জালিমের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার প্রেরণা দেয়। কারবালার ইতিহাস সমগ্র বিশ্ব মানবতার জন্যে ব্যাপক শিক্ষণীয় ইতিহাস। অত্যাচারী শাসন শোষনের বিরুদ্ধে ইমানী শক্তিতে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাবার ইতিহাস। সৎ কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করা আর অসৎ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখার জ্বলন্ত উদাহরণ সৃষ্টির ইতিহাস। এই ইতিহাসে আরো যেসব নেতিবাচক প্রসঙ্গ ছিল তার একটি ছিল ইমামের সাথে দেওয়া জনগণের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। যার ফলে ইমামের দূত মুসলিম একাকী নিঃসঙ্গ হয়ে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তারপরও ইমাম তাঁর গতিপথ পরিবর্তন করেন নি।
মুয়াবিয়া(রাঃ) সম্পর্কে আমাদের ধারনা কিরুপ হওয়া উচিত ?
দুরাচারী ইয়াজিদকে খলিফা হিসাবে মনোনয়ন দিয়ে হযরত মুয়াবিয়া একটা বড় রকমের ভুল করেছেন-এতে কোনই সন্দেহ নেই। ঐসময়টা ছিল সাহাবী, তাবেইনদের যুগ, খলিফা মনোনয়নের জন্যে অনেক যোগ্য লোক থাকা সত্বেও তিনি কি কারনে পুত্র ইয়াজিদকে মনোনীত করেছিলেন, সেটা আল্লাহই ভাল জানেন। তবে তার বর্তমানে কারবালার এই ঘটনা ঘটেনি। তিনি হযরত আলীর খেলাফতের বিরুদ্ধেও অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন। তিনি চাইছিলেন ওসমান হত্যার প্রতিশোধ আগে নিতে, কিন্তু আলী চাইছিলেন আগে খিলাফত ঠিক করতে। দু’জনই নিজ নিজ অবস্থান থেকে হয়তো সঠিক ছিলেন, যদিও পথ ছিল ভিন্ন। তাদের উভয়েরই ইজতেহাদী অনেক ভুল ছিল। সবার উপরে যে কথা, তাহলো, উভয়েই ছিলেন সম্মানিত সাহাবী। হযরত আলী ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী। সাহাবীদের সম্পর্কে কোন খারাপ ধারনা কোন মুসলমানের থাকতে পারে না। মুয়াবিয়ার ভুলে পরবর্তীতে ইসলামের চরম ক্ষতি হয়েছে।ইসলামের খিলাফত ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, তথাপি একজন সম্মানিত সাহাবী হিসাবে তিনি মুসলমানদের শ্রদ্ধার পাত্রই থাকবেন। কারবালার ঘটনার জন্যে তিনি দায়ী ছিলেন না। দায়ী ছিল তার দুরাচারী পুত্র ইয়াজিদ। নবীর দৌহিত্রকে এমন নৃশংশভাবে হত্যাকান্ডে যার সামান্যতম সম্পর্কও থাকবে, তেমনটা জানলে তিনি নিশ্চয়ই ইয়াজিদকে খলিফা হিসাবে মনোনয়ন দিতেন না।
কারবালার ঘটনায় তিন ধরনের ফেরকা:
শীয়া: শীয়া নামধারী কিছু মতবাদের লোকজন মনে করে ইমাম হুসাইন হকে পক্ষে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেছেন। এয়াজিদের ক্ষমতা গ্রহন ছিল অনৈসলামিক। মুয়াবিয়ার প্রতিষ্ঠিত রাজতান্ত্রিক পদ্ধতি অবৈধ এবং জুলুম। ইমাম হুসাইনকে ভালবাসা এবং তার হত্যাকারীদের ঘৃণা করা তাদের ঈমানের অংশ মনে করে।
সুন্নি: সুন্নিরা উপরোক্ত মতের বিপরীত ধারনা পোষন করেন। পার্থক্য এটাই যে, তারাও ইমাম হুসাইনকে ভালবাসে বলে দাবী করে।
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত: এটা উল্লেখিত উভয় মতের মাঝামাঝি একটা সুবিধাবাদী মতবাদ। এরা ইয়াজিদকে ইসলামী শাসক মনে করে মুয়াবিয়া(রাঃ) তাকে মনোনীত করার কারনে। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইনের রুখে দাড়ানোকে এরা সহি মনে করেন না। হুসাইনের কারবালা প্রান্তরে যাওয়া এরা সমর্থন করেন না। কারবালার যুদ্ধকেও হক আর বাতিলের যুদ্ধ মনে করেন না। এরা ইয়াজিদকেও সমর্থন করেন আবার হুসাইনের জন্যেও মায়াকান্না করেন। তাদের এই মতবাদ পুরোপুরি রাজতন্ত্রের অনুকুলে।
কারবালার ইতিহাসকে বিকৃত করার উপাদান:
শীয়া নামধারী কিছু লোকজন আশূরার দিনে শোক পালনের নামে নানা বিদআতে লিপ্ত হয়। আর তাদের এই কার্যকলাপ দরবারী আলেমদের জন্যে হয় পোয়াবারো। কেননা এগুলোর বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা কারবালার পুরো ইতিহাসকেই ইয়াজিদের পক্ষে দাড় করিয়ে দেয়। মানুষকে বিভ্রান্ত করার নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।
আশুরার দিন যা বর্জনীয়
১। সুন্নি নামধারী কিছু লোক এদিন নানা জাতের খানাপিনা করেন, মহরম-এর বাদ্য বাজান, এদিনটাকে খুশীর আমেজে পালন করেন। আবার শীয়া নামধারী কিছু কুলাঙ্গার এদিন নানা জাতের মাতম করেন, বুকে পিঠে ছুরি মারেন, তাজিয়া মিছিল করেন। এসব কাজ অবশ্যই বর্জনীয়। এসব কখনোই ইসলাম অনুমোদন করেনি। কাজেই এগুলো বিদআত। এদের কিছু কিছু কর্মকান্ড শির্কের পর্যায়ভূক্ত। মুসলমানদেরকে অবশ্যই এসব বর্জণ করতে হবে। এইসব শির্ক বিদআত-রাজতন্ত্রপন্থীদের প্রচারনার জন্যে একটা মোক্ষম অস্ত্র হিসাবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই শির্ক বিদআতের বিরোধীতার নামে তারা কারবালার ইতিহাস বিকৃতি ঘটাতে সচেষ্ট হয়।
২। মুসলমানদের দূর্ভাগ্য, হারামাইন আল শরীফাইন এখনো ইসলামী ছদ্মবেশের রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারদের দখলে। ইয়াজিদের প্রেতাত্মারা এখনো মুসলমানদের উপর ছড়ি ঘুরাচ্ছে। নানাভাবে ইহুদীনাছারাদের সহযোগিতা করে আসছে। তাদের অর্থে লালিত ইয়াজিদের গুনগান গাওয়া ধূর্ত দরবারী আলেমরা মুসলমানের মাঝে নানা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। আমাদের দেশের যেসব মাদ্রাসা মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর দান খয়রাতে চলে, তারাই ইসলামের নামে রাজতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি করে। এদের প্রত্যাখ্যান করুন, যারা কারবালার ঘটনাকে খাটো করে ও এদিনটিকে গুরুত্বহীণ দেখানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এদের এড়িয়ে চলুন। প্রকৃত ইতিহাস শেখাবার নামে এরা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। ইয়াজিদের পক্ষে, রাজতন্ত্রের পক্ষে জনমত গঠনই এদের লক্ষ্য। নবী পরিবারের এইসব দুষমনদের জন্য আল্লাহর দরবারে হেদায়েত প্রার্থনা করুন।
যা করনীয়
১। মহররমের ৯ ও ১০ তারিখে অথবা ১০ ও ১১ তারিখে রোজা রাখুন। কেননা কারবালার এই মর্মান্তিক ঘটনা ছাড়াও এদিনটি ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: রামাযানের পর সর্বোত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মুহাররামের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হল রাতের নামায।” (মুসলিম)৬) ইব্ন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই আশুরার দিনের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে এত গুরুত্বসহকারে অন্য কোন দিন রোযা পালন করতে দেখিনি। (অর্থাৎ রামাযান মাস ছাড়া) (বুখারী)।
২। কারবালার এ বিয়োগান্ত ঘটনা স্মরন করে ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও তার পরিবারবর্গের জন্যে দোয়া করুন। আল্লাহপাক বলেছেন, ‘যাঁরা আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় শহীদ হন তাঁদেরকে কখনও মৃত মনে করো না। বরং তাঁরা নিজেদের রব তায়ালার নিকট জীবিত ও রিযিকপ্রাপ্ত।’ (সূরা আলে ইমরান-১৬৯)
৩। কারবালার ঘটনার চেতনায় উদ্ভূদ্ধ হয়ে রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, পীরবাদ, জালিম শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে মনেপ্রাণে ঘৃণা প্রকাশ করুন, ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠায় নিজ করনীয় ঠিক করুন এবং তা পালনের দৃঢ় শপথ নিন। কবি’র এ অমর বাণীটা স্মরণ রাখুন, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কি বাদ।
বিষয়: বিবিধ
২১৪১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন