সম্ভাবনার বাংলাদেশঃ সমস্যা, সমাধান ও সম্ভাবনা (১)

লিখেছেন লিখেছেন আবরারুল হক ১৮ জানুয়ারি, ২০১৪, ১০:১১:০৫ রাত

প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রায় সমসাময়িককালে স্বাধীন হওয়া অনেক দেশ আজ পৃথিবীর বুকে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাদের স্ব স্ব স্বকীয়তা নিয়ে। উন্নত বিশ্বের মর্যাদা পেয়েছে তাদের মাঝে অনেকেই। কিন্তু আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ আজও ‘উন্নয়নশীল’ মুখোশধারী দরিদ্র দেশ। শুধু অর্থনীতি নয়, প্রায় সর্বক্ষেত্রেই আমাদের অবস্থান নিচের সারিতে। আমাদের এই দুরবস্থার কারণ ও সমাধান অনুসন্ধান করবো আমরা সবাই। তার জন্যই এই ‘সম্ভাবনার বাংলাদেশঃ সমস্যা, সমাধান ও সম্ভাবনা’ সিরিজ। সকলের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে ইনশাআল্লাহ্‌ আমরা একটা ইতিবাচক উপসংহারে পৌছার চেষ্টা করবো।

বাংলাদেশের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেই সব সমস্যার ‘সমাধান প্রয়োজন’ এই কথা সবাই বলে। কিন্তু কি হতে পারে সেই সমাধান? খুব কমই এই ব্যাপারে কথা বলে সবাই। আমরা প্রথমে চেষ্টা করব সমস্যাসমূহ এবং সমস্যাসমূহের স্বরূপ জানার। তারপর এই সমস্যার কারণ কি, তা খোঁজার চেষ্টা করব। তারপর আমরা খুঁজব সেই উপায়, যা আমাদের এই সমস্যা সমূহের সমাধান করতে পারবে। সামনে রাখব আমাদের সম্ভাবনার যত দিক।

এই সুদীর্ঘ পথচলায় আপনাদের সকলের মূল্যবান পরামর্শ আশা করবো সবসময়ই।

আজ আপনাদের সামনে কেবল তুলে ধরব আমাদের সমস্যা সমূহ, যা আমার দৃষ্টি গোচর হয়েছে। সমস্যাসমুহ প্রকটতা অনুযায়ী ক্রমিক হিসেবে সাজানো হয় নি। একের পর এক লিখেই যাব শুধু।

দারিদ্র্য

অধিক অকার্যকর জনসংখ্যা

শিক্ষার অভাব

কৃষিতে কম গুরুত্ব প্রদান

দুর্নীতি

বেকারত্ব

মেধা পাচার

বিদেশী পণ্যের প্রতি নির্ভরশীলতা

রাজনৈতিক অস্থিরতা

নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজন, দল ও এলাকার প্রাধান্য দান

দেশপ্রেমের অভাব

রাজনৈতিক দলসমূহের ‘দেশ নয় দল বড়’ নীতি

অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা

প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতা

লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা

অদক্ষ অযোগ্য লোককে দায়িত্ব প্রদানঅব্যবস্থাপনা

সম্পদের অন্যায় বন্টন

অপরিকল্পিত নগরায়ন

কার্যকর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব

জবাবদিহিতার অভাব

নৈতিকতার অভাব

বিদেশী শক্তির প্রভাব

বিনিয়োগে সমস্যা

সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব

পাচার রুট হিসেবে ব্যবহার

বাংলাদেশের সমস্যাসমূহের মধ্যে দারিদ্র্য নিয়ে আলোচনা করবো আজ। আগে জানা যাক, দারিদ্র্য কি?

* দারিদ্রের সার্বজনীন কোন সংজ্ঞা নেই। তাই কে দরিদ্র আর কে দরিদ্র নয় সে ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে যার কোন সম্পদ নাই, উপার্জনের কোন ব্যবস্থা নাই সে ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে ও সর্বসম্মতিক্রমে দরিদ্র।

* বিশ্বখ্যাত অনলাইন বিশ্বকোষ Wikipedia- এ বলা হয়েছে, `Poverty is the shortage of common things such as food, clothing, shelter and safe drinking water, all of which determine the quality of life.'

* বাংলা পিডিয়ার মতে, `দারিদ্র্য এমন অর্থনৈতিক অবস্থা যখন একজন মানুষ জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান অর্জনে এবং স্বল্প আয়ের কারণে জীবনধারণের অপরিহার্য দ্রব্যাদি ক্রয় করতে অক্ষম হয়। দারিদ্র্যের দৃশ্যমান প্রতীক হচ্ছে অপুষ্টি, ভগ্নস্বাস্থ্য, জীর্ণশীর্ণ বাসস্থান, নিরক্ষরতা এবং বেকারত্ব অথবা আধা বেকারত্বে নিপতিত রুগ্ন-দুর্বল মানুষ।'

* ইসলামী পরিভাষায় দারিদ্র্যের স্তর দুইটি। যথা: ফকির (সেই অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি, যে নিজেকে সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করে চলেছে, কারো নিকটই কিছু প্রার্থনা করে না) ও মিসকিন (লাঞ্ছনাগ্রস্ত অভাবী ব্যক্তি, যে চেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়)।

* বাংলাদেশ সরকারের আই-পিআরএসপি (Interim Poverty Reduction Strategy Paper) অনুযায়ী দারিদ্র্য দুই রকম। যথা: আয় দারিদ্র্য এবং মানব দারিদ্র্য (আই-পিআরএসপি, সার সংক্ষেপ, জানুয়ারি ২০০৪, পৃ-৫)

* বিশ্ব ব্যাংক দারিদ্র্য সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে দারিদ্র্যের দু`টি সীমারেখা টেনেছে। উচ্চতর দারিদ্র্যসীমা নির্ধারিত হয়েছে যেখানে জনপ্রতি বার্ষিক জিডিপি ৩৭০ মার্কিন ডলার এবং নিম্নতর দারিদ্র্যের সীমা হচ্ছে ২৭৫ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত মান অনুযায়ী প্রতিদিন জীবন ধারনের জন্য ২১২২ ক্যালরি খাদ্য ও ৫৮ গ্রাম প্রোটিন ক্রয়ে অক্ষম জনগোষ্ঠীকে ধরা হয় দারিদ্র্যসীমার নিচে। আর ১৮০৫ ক্যালরি খাদ্যও কোনভাবে জুটাতে পারে না যে জনগোষ্ঠী তাদের অবস্থান চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে।

বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিয়ে কিছু তথ্য-

- বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় ১০৪৪ ডলার, যা দক্ষিণ এশিয়ায় ৪র্থ। ২০১২ সালে এই পরিমাণ ছিল ৯২৩ ডলার (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)। তবে বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে ২০১২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৭৫২ মার্কিন ডলার দেখানো হয়েছে।

- জাতিসংঘের এক সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মাত্র ১ শতাংশ লোক পৃথিবীর শতকরা ৪০ ভাগ সম্পদের অধিকারী। আর প্রাপ্তবয়স্ক ১০ শতাংশ বিত্তবান ভোগ করছে পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ সম্পদ। এই যে ভয়াবহ বৈষম্য- এর পেছনে যে দেশগুলো প্রধান ভূমিকা রাখছে, বাংলাদেশ তার একটি।

- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১০ সালের খানা জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। এর মধ্যে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ অতিদরিদ্র বা হতদরিদ্র।

- বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সালে বাংলাদেশের ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে ছিল। তখন হতদরিদ্রের হার ছিল ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এই হিসাবে ২০০০ থেকে এক দশকে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ পয়েন্ট হারে দারিদ্র্য কমেছে। এর মধ্যে ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কমেছে গড়ে ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আর ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কমেছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

- ইউনিসেফ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, দেশে ৩ কোটিরও বেশি শিশু দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, ২০১১ সালের মধ্যে শহরে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা হবে সাড়ে ৯ লাখ এবং পথে বসবাসকারী ও ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত অনাথ শিশুর সংখ্যা হবে ১০ লাখ।

- দেশে মোট সাড়ে ছয় কোটি শিশু রয়েছে। এদের অর্ধেকেই নিরঙ্কুশ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বাস করে। এর এক-চতুর্থাংশ আবার স্থায়ী দারিদ্র্যের শিকার। এছাড়া শতকরা ৪১ ভাগ আবাসন, ৬৪ ভাগ পয়ঃনিষ্কাশন, ৫৭ ভাগ পুষ্টি, ১৬ ভাগ স্বাস্থ্য ও ৭১ ভাগ তথ্যপ্রাপ্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এছাড়া পাঁচ বছরের নিচে যেসব শিশু মারা যায় তার শতকরা ৭ ভাগ ডায়রিয়ায় এবং ১২ ভাগ নিউমোনিয়ায় মারা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা এসব শিশু তাদের জীবনের পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশের ক্ষেত্রে নানা অন্তরায়ের সম্মুখীন হয়।

- গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণে’র সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৯১-৯২ সালে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩৭.৯ শতাংশ থেকে কমে ২০১২ সালে ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বার্ষিক কমার হার ১.৭৯ শতাংশ।

- বেসরকারি হিসাবে দেশে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা ৬২ শতাংশ। ঘরবাড়ি নেই ১২ শতাংশ আর শহরমুখী হচ্ছে বছরে ৬ শতাংশ।

- দেশের ৬টি বিভাগের মধ্যে বরিশাল বিভাগে দারিদ্রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিভাগভিত্তিক দারিদ্র্যের হার- ১.বরিশাল ৩৯.৪ ভাগ,

২.চট্টগ্রাম ২৬.২,

৩. ঢাকা ৩০.৫,

৪. খুলনা ৩২.১,

৫. রাজশাহী ৩৫.৭,

৬. রংপুর ৩২.৩ এবং

৭. সিলেটে ২৮.১ ভাগ জনগোষ্ঠী দরিদ্র।

- আরেকটা তথ্য মাথায় রাখতে পারেন। "ক্ষু্ধার দায়ে সন্তান বিক্রি" এই সংবাদ কিন্তু আমাদের দেশে খুব দূর্লভ কিছু না।

আরো অনেক তথ্য আছে। আপাতত আর না। পরবর্তী পর্বে এই দারিদ্র্যের কারণ নিয়ে কিছু পর্যালোচনার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ।

কারো কাছে আরো তথ্য থাকলে দিতে পারেন। আর পরামর্শ ও সংশোধন তো অবশ্য কাম্য।

বিষয়: বিবিধ

২২২৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

164116
১৮ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:২৭
শিশির ভেজা ভোর লিখেছেন : চমৎকার হয়েছে চালিয়ে যান
১৮ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:৩৭
118378
আবরারুল হক লিখেছেন : ধন্যবাদ। চলবে ইনশাআল্লাহ
164117
১৮ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:২৮
বড়মামা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ।
১৮ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:৩৭
118380
আবরারুল হক লিখেছেন : Happy
আপনাকেও মামা

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File