ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশঃ দায় কার?
লিখেছেন লিখেছেন আবরারুল হক ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৮:০৯:৩৩ রাত
সোনার বাংলাদেশ আজ রক্তের হোলিখেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। পত্রিকা বলি আর টিভি বলি, আহত-নিহতের সংবাদ ছাড়া আর কোন সংবাদ খুঁজে পাওয়াটাই এখন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এই লেখা যখন লিখছি তখনও হয়ত দেশের আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সরকারবিরোধীদের সংঘর্ষ চলছে।
কিন্তু কেন এই সংঘাত? কেন এই রক্তের হোলিখেলা? কেন আজ সবুজ বাংলাদেশ রক্তে রঞ্জিত?
এর কারণ বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের তুলে আনা “যুদ্ধাপরাধ ইস্যু”। তত্ত্বাবধায়কের ইস্যু আলোচনায় আছে অথর্ব নির্বাচন কমিশনের পাগলের মত কিছু আচরণের কারণে। নাহলে ঐ ইস্যুকে বিএনপি নেতাদের মুখ ছাড়া অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিশ্বের বুকে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সদ্যজাত বাংলাদেশের দায়িত্ব কাঁধে নেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি জানতেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই দেশের এমন অনেক নাগরিক ছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি এবং তারা বাংলাদেশ নামক একটি দেশের পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি দেখলেন যে এই সংখ্যাটা খুব কম নয়, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় নতুন দেশের পক্ষে ছিলেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব রাজাকার, আলবদর, আল শামস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করেছে তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দ্য বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২ বা দালাল আইন আদেশ শিরোনামে আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই আইনের আওতায় দুই হাজার ৮৮৪টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় সাজা দেওয়া হয় ৭৫২ জনকে। এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিল। পরবর্তীতে দালাল আইনের অধীনে ৩৭ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিভিন্ন আদালতে তাদের বিচার আরম্ভ হয়। এর পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে কর্মরতদের কেউ দালালি এবং যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না তা যাচাই করার জন্য ১৯৭২ সালের ১৩ জুন একটি আদেশ জারি করে যা তখন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক ৩৭ হাজারের অধিক ব্যক্তির ভেতর থেকে প্রায় ২৬ হাজার ছাড়া পায়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ৫ নং ধারায় বলা হয়, ‘যারা বর্ণিত আদেশের নিচের বর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব ক’টি অভিযোগ থাকবে। ধারাগুলো হলো: ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো অথবা চালানোর চেষ্টা), ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র), ১২৮ ক (রাষ্ট্রদ্রোহিতা), ৩০২ (হত্যা), ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা), ৩৬৩ (অপহরণ),৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ) ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ),৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা), ৩৭৬ (ধর্ষণ), ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি), ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তিকালে আঘাত), ৩৯৫ (ডাকাতি), ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি),৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি), ৪৩৫ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন),৪৩৬ (বাড়িঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার), ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে কোন জলযানের ক্ষতিসাধন) অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান। এসব অপরাধী কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নন।’ পরবর্তিতে আরেকটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন কর্মকর্তা ছাড়া বাকিদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেন। সদ্যজাত দেশের অগ্রগতির দিকে নজর রেখে জাতিকে এক রাখার মহান ইচ্ছায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা ছিল তাদের ক্ষমা করে দেন। পরবর্তিতে ১৯৫ জন পাকিস্তানিকেও তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়, যাদের কেউই বেসামরিক ব্যক্তি ছিলেন না।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান যে নতুন দেশ গঠনের পক্ষে ছিলনা, তা তারাও স্বীকার করেন। এই ক্ষেত্রে একটা বিষয় ভাবা যেতে পারে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীনতা একটা কথা আসে মাঝে মধ্যে। যদি সত্যিই যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে ঐখানে বসবাসকারী নাগরিকদের কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? স্বাভাবিকভাবেই তার দায়িত্ব হবে এই দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। এরপর যদি তারা স্বাধীন হয়েই যায়, তাহলে এই দেশপ্রেমিকদেরও তারা ঠিকই যুদ্ধাপরাধী বলে খ্যাত হবে। কিন্তু তারা তাদের সঠিক কর্তব্যই পালন করেছিল। জামায়াতের ক্ষেত্রেও বিষয়টা অনেকটা তাই।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬-২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকাকালিন সময়ে জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে সরকার চালালেও ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ইস্যুটিকে পুনরুজ্জিবীত করে, যার মূল টার্গেটে পরিণত হয় জামায়াতে ইসলামী, যদিও আওয়ামী লীগ নামক দলটির যুদ্ধাপরাধীদেরকেও মানুষ ভালমতই চেনে। কিন্তু তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার করার সময় ফরিদপুরের এক যুদ্ধপরাধীকে মন্ত্রীসভায় রেখে দেয়ায় এই বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এছাড়া আওয়ামী লীগ জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের ইস্যু দাড় করানোর কারণে জামায়াত-শিবিরের লোকজনও আওয়ামী লীগের যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে লেগে যায়, যা পরবর্তিতে অনেক কিছুই বের করে।
গত ১১ই ডিসেম্বর রাতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর পুর্বে ৯ই ডিসেম্বর কার্যকরের কথা থাকলেও তা পিছিয়ে যায়। কিন্তু ঐ দিনই সারা দেশে বিক্ষোভার আগুন জ্বলে উঠে। এরপর সরকারের একেবারে গোয়ার্তুমির ফলে দেশের সর্বত্র সহিংসতা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিন ১০ জনের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে দেশব্যাপী। এরই মধ্যে বিজয় দিবসেও পুলিশের গুলিতে নিহত হয় শুধু সাতক্ষীরাতেই ৭ জন। সর্বশেষ বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর (বর্তমানে আইন শৃংখলা ভঙ্গকারী বাহিনী) সাথে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা আওয়ামী লীগের ১০০ কর্মী (এদের ক্যাডার বলা হারাম) (http://www.srilankaguardian.org/2012/04/bengal-tigers-in-r-cage.html) নিয়ে চলছে সিলেক্টেড কিলিং (http://www.aljazeera.com/indepth/features/2013/12/bangladesh-could-be-set-prolonged-unrest-2013121413637178691.html)। তারা দিন দুপুরে মিছিল থেকে মানুষ হত্যা ছাড়াও রাতে ঘরে ঘরে গিয়ে হত্যা করছে বিরোধী মতের নেতাদের, যার শিকার লক্ষীপুরের জামায়াত নেতা ডাঃ ফয়েজ। এইভাবে প্রতিদিন দলীয় কর্মীদের খুন করায় বিএনপি জামায়াতের কর্মীরাও অতি স্বাভাবিক ভাবেই আওয়ামী লীগের নেতাদের সুযোগ পেলে ভালমত মেহমানদারী করে দিচ্ছে এবং কিছু জায়গায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাও ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর জাতীয় স্বার্থে নিভিয়ে ফেলা যুদ্ধাপরাধের ইস্যু আবার জাগ্রত করে জাতীর মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি পারেননি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে অবিতর্কিত রাখতে। চরম প্রশ্নের সম্মুখীন ট্রাইব্যুনালে বিচারের পর সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলা গেলে সেখানেও সৃষ্টি হয় বিতর্কের। নতুন আইন সংশোধনের কারণে সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগও প্রশ্নের উর্ধে থেকে বিচার কার্য শেষ করতে পারেনি।
জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির পর বিশ্বব্যাপী তার গায়েবানা জানাজায় অভূতপূর্ব সাড়া তার খ্যাতিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সরকারের অদ্ভুত দেশবিরোধী আচরণ দেশকে করে তুলে রক্তাক্ত। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বিচারে পাখির মত গুলি করে মানুষ হত্যা দেশের রাজনৈতিক ও সামগ্রিক অবস্থাকে আরো নাজুক করে তুলছে। দিনের বেলা বুলডোজার দিয়ে মানুষের ঘর ভেঙ্গে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে।
সর্বশেষ ঘটনা কতদূর যায়, বলা কঠিন, তবে পরিণতি যে কারো জন্যই সুখকর হবে না, তা বলে রাখা যায়। কারণ মশা তার হাতেই মরে যার রক্ত সে খায়, এবং এটাই স্বাভাবিক।
বিষয়: বিবিধ
১০৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন